হুমায়ূন আহমেদ আমাদের সবার প্রিয় সাহিত্যিক। গান, উপন্যাস, ছোটগল্প, চলচ্চিত্র যেখানেই তিনি হাত দিয়েছেন, সেখানেই সোনা ফলেছে। হুমায়ূন আহমেদের পরিণত জীবনের মতো তার ছেলেবেলাও ছিলো অন্য দশটা ছেলেদের চেয়ে আলাদা। বাবা পুলিশে চাকরি করার কারণে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় থাকা হয়েছে তার।
১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নানাবাড়িতে হুমায়ূন আহমেদের জন্ম হয়। ঘরে ছেলে সন্তান জন্ম হওয়াতে হুমায়ূন আহমদের নানা খুব খুশি হন। তখন হুমায়ূনের বাবা ফয়জুর রহমান পুলিশের ওসি হিসেবে সিলেটে ছিলেন। তিনি অবশ্য কন্যা সন্তান প্রত্যাশা করেছিলেন। অনাগত কন্যার জন্য জামা-কাপড়, এমনকি পায়ের রুপার মলও কিনে রেখেছিলেন। ছেলে সন্তান হওয়ার খবর শোনার পর তিনি মনে মনে একটু অখুশিই হন। পরে হুমায়ূনকে সেই মেয়েদের ফ্রকই পড়তে হয়! তার মা আয়েশা ফয়েজ স্বামীকে খুশি করার জন্য হুমায়ুনের মাথায় বেণীও করে দিতেন!
এভাবেই বাবা-মায়ের আদরে দিন কাটতে থাকে শিশু হুমায়ূনের। কিন্তু সুখ বেশিদিন সয়নি তার। একসময় তার মা টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হন। এতে ওনার স্মৃতি নষ্ট হয় এবং ঐ সময় তিনি হুমায়ূনকে চিনতে পারতেন না। হুমায়ূনকে ময়মনসিংহের মোহনগঞ্জে তার নানীর কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। নানীর বুকের দুধ খেয়ে শিশু হুমায়ূন বড় হতে থাকেন। তার বয়স যখন দুই বছর, তখন তার মা আবার স্বাভাবিক হতে শুরু করেন। এরপর হুমায়ূন সিলেটে এসে আবার বাবা-মা’র সাথে থাকতে লাগলেন। কিন্তু এবারও সুখ তার বেশিদিন সইলো না। তার মা আবারও টাইফয়েডে আক্রান্ত হন। নিয়ম অনুযায়ী দ্বিতীয়বার টাইফয়েডে আক্রান্ত হলে আর রক্ষা নেই। ডাক্তার হুমায়ূনের বাবাকে তার মায়ের আসন্ন মৃত্যুর জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে বললেন । এ সময় ফয়জুর রহমান হুমায়ূনের নাম রাখলেন কাজল। বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালীতে অপুর স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছিলো। আর অপুর ছেলের নাম ছিলো কাজল। এ থেকে বোঝা যায়, হুমায়ূনের বাবা মানসিক প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এবারও আয়েশা ফয়েজ মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসলেন।
হুমায়ূন আহমেদের বাবা ছিলেন একজন আবেগী মানুষ। অদ্ভুত অদ্ভুত কাজ করতেন তিনি, যা হুমায়ূন আহমেদকে হয়তো পরিণত জীবনে প্রভাবিত করেছে। যা বেতন পেতেন, তার বেশিরভাগই বই কিনে খরচ করে ফেলতেন। তার সংগ্রহে ছিলো প্রায় চার হাজার বই; কিনেছিলেন বেহালা, এমনকি ঘোড়াও। তার এমন বেহিসাবি বিলাসিতার ফলে চরম অর্থকষ্টে পড়তে হয় পরিবারকে। তার আবার হাত দেখার এবং ফটোগ্রাফির নেশাও ছিলো। এক খামখেয়ালী ভবঘুরে ধরনের মেজাজ ছিলো ফয়জুর রহমানের। এমনকি তিনি নাকি একসময় প্রেতচর্চাও করতেন! তিনি নিজের মৃত্যু সম্বন্ধেও ভবিষ্যৎবানী করেছিলেন। তিনি ধারণা করেছিলেন, তার মৃত্যু হবে অপঘাতে, কাকতালীয়ভাবে, যা পরবর্তীতে সত্য হয়।
হুমায়ূন আহমেদের মা ছিলেন অসম্ভব শক্ত মনের একজন মানুষ। হুমায়ূনের বাবা মারা যাওয়ার পর তিনি এত বড় সংসার একলাই চালিয়েছেন। হুমায়ূন আহমেদ যে তার পরবর্তী জীবনে রহস্যপ্রিয় ছিলেন এবং বিভিন্ন অদ্ভুত কর্মকাণ্ড করতেন, এর পেছনে হয়তো তার বাবা বা পরিবারের অন্যান্য সদস্যের ভূমিকা ছিলো। হুমায়ূনের দাদা মৃত্যুকালে দোয়া করেছিলেন এভাবে,
“হে পরম করুণাময়, আমার পুত্রকন্যা এবং তাদের পুত্রকন্যাদের তুমি কখনও অর্থবিত্ত দিও না। তাদের জীবনে যেন অর্থকষ্ট লেগেই থাকে। কারণ টাকাপয়সা মানুষকে ছোট করে। আমি আমার সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে ‘ছোট মানুষ’ চাই না। বড় মানুষ চাই।’
এই প্রার্থনা থেকেই বোঝা যায়, হুমায়ূনের দাদাও সাধারণ কোনো মানুষ ছিলেন না। হুমায়ূনের জীবন সামনের দিকে এগোতে থাকে। তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষায় পাঁচটি লেটার সহ বোর্ডে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন। শৈশবে খুবই দুরন্ত ছিলেন তিনি। তার এই দুরন্তপনাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নানা উপায় অবলম্বন করা হতো। ছোটবেলায় কোনো দুষ্টুমির সাজা হিসেবে তার মেজো চাচা তাকে একহাতে ধরে কুয়ার মধ্যে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। আর তিনি চিৎকার করতে থাকেন, আমি আর করবো না, আমি আর করবো না! এই শাস্তি হুমায়ূনের উপর অনেকদিন চলে। অবশেষে এই ঘটনা তার বাবার নজরে আসে। আর এই নির্মম শাস্তির সমাপ্তি ঘটে। হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন, পরিণত বয়সেও তিনি এই গহীন কুয়ার দুঃস্বপ্ন দেখতেন।
এখানে বলে রাখা দরকার, হুমায়ূনের মেজো চাচা তাকে খুব ভালোবাসতেন। এমনকি তার অক্ষরজ্ঞানও লাভ হয়েছিলো তার মাধ্যমে। হুমায়ূন মাকড়শাকে খুব ভয় পেতেন। এই ভয়কে কাজে লাগিয়ে তাকে ঘুম পাড়ানো হতো। হুমায়ূন পরবর্তীতে বলেছিলেন, তার জীবন থেকে এই কয়েকটা ঘটনা বাদ দিলে বাকি পুরোটাই ছিলো আনন্দের। বাবা-মায়েরা অনেক সময় সন্তানদের এরকম মানসিক ভয়ভীতি দেখিয়ে কিছু করিয়ে থাকেন, কিন্তু তারা বুঝতে পারেন না, নিজেদের অজান্তেই তারা তাদের কী ক্ষতি করে চলেছেন।
আমরা দস্যি ছেলে বলতে যা বুঝি, হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন ঠিক তেমন। ক্লাসে মারামারি করতেন, এমনকি মেরে রক্ত পর্যন্ত বের করে ফেলেছিলেন কয়েকজনের। ক্লাস টুতে থাকতে এক সহপাঠিনীকে তিনি বিয়ের প্রস্তাব দেন। আর মেয়েটি রেগেমেগে হুমায়ূনকে খামচি দিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করেন।
হুমায়ূনের শৈশবে দাদাবাড়ি আর নানাবাড়ি ভ্রমণ ছিলো আনন্দের সময়। হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন, তার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় সময়গুলো কেটেছে নানাবাড়িতে। ঘুড়ি উড়ানো, লাটিম খেলা, রাত-বিরাতে মাছ ধরা দেখা এসব করতে করতেই নানা বাড়িতে তার দিন কেটে যেত। হুমায়ূনের দাদাবাড়ি ছিলো খুবই রক্ষণশীল। দাদাবাড়ির মহিলাদের কখনও বাইরের মানুষ দেখেনি। এমনকি ঘরের ভেতরেও পর্দা চালু ছিলো। হুমায়ূন আহমেদ তার আত্মজীবনীতে বলেছেন, উনার দাদার বাবা এবং দাদার ইচ্ছামৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগে হুমায়ূনের দাদা তার ছোট ছেলেকে ডেকে বলেন, আমি তাহলে যাই। তারপর তিনি জীবনমায়া ত্যাগ করেন। হুমায়ূন আহমেদের বাবা গানবাজনা পছন্দ করতেন। গ্রামে গেলে তিনি গানের আসর বসাতেন। কিন্তু তা হুমায়ূনের দাদার বাড়িতে নয়, বাইরে কোথাও অন্য কারও বাসায়।
হুমায়ূনের পুরো ছেলেবেলা কেটেছে ঘোরাঘুরি করে। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে একদিন এক বাড়িতে ঢুকে পড়লেন তিনি। বাড়িটি যেন স্বপ্নপুরীর মতো! গাছগাছালিতে ভরা সেই বাড়িতে তার দেখা হলো শুক্লাদির সাথে। শুক্লাদি তখন ষোল সতেরো বছরের কিশোরী। শুক্লাদি হুমায়ূনকে একটা মিষ্টি দিলেন সেদিন। একদিন শুক্লাদি হুমায়ূনকে একটি বই পড়তে দেন। বইয়ের নাম ‘ক্ষীরের পুতুল’, লেখক অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এটাই হুমায়ূনের পড়া প্রথম সাহিত্য। এরপর যেন পাল্টে যান তিনি। দস্যি ছেলেটা দুপুরে ঘোরাঘুরির বদলে বুঁদ হয়ে থাকে সে বইয়ের পাতায়! বই চুরি করা শুরু হলো বাবার আলমারি থেকে। একদিন ধরা পড়লেন। যে বই পড়ছিলেন, তার নাম ‘প্রেমের গল্প’। হুমায়ূনের বাবা তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে লাইব্রেরির সদস্য করে দিলেন। তিনি লাইব্রেরি থেকে প্রতিদিন দুটি করে বই নিয়ে পড়তে থাকলেন। হুমায়ূনের প্রতিদিনের বই নেয়াতে লাইব্রেরিয়ানও অতিষ্ঠ হয়ে সাধারণ জ্ঞানের বই ধরিয়ে দিলো তাকে। কিন্তু হুমায়ূন সবসময় ছুটেছেন আনন্দের পেছনে। শিক্ষা বিষয়টা তিনি ওভাবে নেননি। বাসায় বইটি এনে ভালো না লাগায়, তিনি সেটিকে ছিঁড়ে কুটি কুটি করলেন!
বাবার চাকরির জন্য অনেক জায়গাতেই যাওয়া হয়েছে হুমায়ূনের। এর মধ্যে অনেক জায়গা ছিলো দুর্গম। যেখানে কোনো স্কুল ছিলো না। হুমায়ূনের আনন্দ শুরু হতো সেখানে। হুমায়ূন একবার ঘুমাচ্ছিলেন। হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখেন, মশারির ভেতরে এক আলোর ফুল। তিনি ভয়ে চিৎকার করে উঠলেন, “এটা কী! এটা কী!” তার বাবা তাকে বললেন, ঘরের ভেন্টিলেটর দিয়ে আলো মশারির উপরে পড়ে আলোর ফুল হয়ে গেছে। হুমায়ূন সে ফুল ধরতে চাইলেন পারলেন না। তার কথায়, তিনি সারা জীবন এ সুন্দরকে ধরার চেষ্টা করেছেন। তার আজীবনের এই তৃষ্ণাই হয়তো তাকে এত সৃষ্টিশীল করে তুলেছিলো। সেই হাহাকার নিয়ে তাই তিনি বলেছিলেন,
“সৌন্দর্যকে ধরতে না পারার বেদনায় কাটলো আমার শৈশব, কৈশোর ও যৌবন। আমি জানি সম্ভব না, তবুও চেষ্টা করে যাচ্ছি যদি একবার জোছনার ফুল ধরতে পারি- মাত্র একবার। এই পৃথিবীর কাছে আমার এর চেয়ে বেশি কিছু চাইবার নেই।”
ফিচার ইমেজ- jazzyjaber.deviantart.com