মহামুনি সক্রেটিস বললেন, সদগুনই জ্ঞান আর জীবন একটা শিল্প। এই বিশ্বাস সংক্রমিত হলো তার শিষ্য প্লেটোর শিরায়, উপশিরায়। সে প্রজ্ঞায় তার বিখ্যাত বই ‘রিপাবলিক’-এ একটি আদর্শ রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করলেন। তিনি যা করলেন, তাতে কোনো ঐতিহাসিক তাৎপর্য নেই। পুরোটাই তার মস্তিষ্ক প্রসূত।
প্লেটোর রাষ্ট্রভাবনা ছিল ঢলে পড়া এথেন্সকে শান্তিপূর্ণ দেখতে ‘কেমন হওয়া উচিত?’, এ ভাবনাকে সামনে এনে ‘কেমন হয়?’ ভাবনাকে প্রশমিত করেছেন প্লেটো। যদিও আমাদের আলাপের বিষয় এত গভীর নয়, ভাববাদীও নয়। নিছক কিছু কেচ্ছাকে কাছ থেকে বুঝতে চেষ্টা করা, যা প্লেটো শুরু করেছেন আড়াই হাজার বছর আগে, শেষ করেননি। সেখান থেকে সাহিত্যের একটি নতুন ধারা জন্ম নেয়, থমাস মুর থেকে এ বাংলায় এসে রোকেয়াকেও একই ভাবনা নেড়েছে প্রবল বেগে, সে একই চিন্তা, আদর্শ রাষ্ট্র, স্বপ্নের রাজ্য, ইহলোকের বেহেশত, যা সেদিনের ‘ইউটোপিয়া’, আজকেরও।
এখানের আলাপের বিষয় ‘ইউটোপিয়া’; যার শুদ্ধ বাংলা কেউ কেউ ‘স্বপ্নালোক’ করেছেন। থমাস মুর নামে এক দার্শনিক প্রথম একটি বইয়ের নাম দেন ‘ইউটোপিয়া’। গ্রিক দুটো শব্দ ‘ou’ মানে ‘না’, ‘Topos’ মানে ‘জায়গা’ নিয়ে বানালেন নতুন শব্দ- ‘Utopia’; অর্থাৎ ‘no where’ বা ‘কোনো জায়গা না’। এই হিউম্যানিস্ট দার্শনিক কল্পনাপ্রসূত এ উপন্যাসে দেখিয়েছেন, ইউটোপিয়া একটি ‘ভালো জায়গা’।
থমাস মুর রসিক লোক ছিলেন বটে। যে জায়গা ভালো, সে জায়গা তো কোথাও থাকতে পারে না একথা তো আজ সবাই জানি। ১৫১৬ সালেও তিনি জানতেন, তাই লিখলেন ‘কোনো জায়গা না’ আর ‘ভালো জায়গা’ পরস্পর সমার্থক। থমাস মুর নতুন আবিষ্কৃত দ্বীপদেশের কল্পনা করেছেন। এ দেশের সমাজটি হতে হবে আইন, সুশাসন ও পারস্পরিক সুসম্পর্কের প্রতীক। খেয়াল করলে দেখা যায়, UTOPIAN এবং UROPIAN শব্দাবলীর মধ্যে শুধু T এবং R এর ব্যবধান। মূলত ‘ইউটোপিয়া’ রূপক, ইউরোপিয়ান তৎকালীন সমাজব্যবস্থার বিপরীতে ‘ইউটোপিয়ান’ সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে উপস্থাপন করতে থমাস ব্যর্থ হননি।
প্লেটোকে আঁকড়ে ধরেননি, অথচ রাষ্ট্র নিয়ে ভাববেন- এমন তো হয় না। একথা খোদ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক অ্যারিস্টটল যতটা অস্বীকার করেন না, ততটা প্রথম ইউটোপিয়ান সাহিত্যের সূচনা করা থমাস মোরও। ইউটোপিয়ার মূল জনক প্লেটোকেই বলা দরকার, কেননা প্লেটো রিপাবলিকে ইউটোপিয়ার কথাই বলেছেন। তবে তিনি কোনো কল্পিত রাষ্ট্রের খোশগপ্পো বলেননি, এই যা। সেখানে সুযোগ পেয়ে থমাস মুর এঁটে বসলেন কেচ্ছা। এমন একটি রাষ্ট্রের কথা বললেন, যা স্বপ্নের মতো, অনাচার নেই, শোষণ, জুলুম , লুটতরাজ নেই। পুঁজিবাদ, ধনী গরীবের বৈষম্য যেখানে নিপাত গেছে, সুবিচার প্রতিষ্ঠিত। শ্রম ও সম্পদের সুষম বণ্টন এবং এমন মানবজনম কে না চায়? রবি ঠাকুরের ‘বীরপুরুষ’ কবিতার চারটে লাইন আওড়ে দিলে যেন এখানে ঠিক ঠাক এঁটে যাবে,
রোজ কত কী ঘটে যাহা তাহা
এমন কেন সত্যি হয় না, আহা।
ঠিক যেন এক গল্প হতো তবে,
শুনত যারা অবাক হতো সবে।
একটি ইউটোপিয়ার প্রকৃতি স্বভাবসুলভ বৈপরীত্যবাদী। প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত দর্শন ধর্ম, রাজনীতি বা অর্থনীতিতেই সমজাতীয় নয় এবং এদের ভিন্ন যা দর্শন রয়েছে, তা দ্বন্দ্ব বাঁধায় হরহামেশা; যা একে অন্যের মতকে, ভিন্ন চিন্তাকে থোড়াই কেয়ার করে। যদিও একই সাথে সবাই সন্তুষ্ট হতে পারে না, সম্ভবও হয়নি।
সমাজতান্ত্রিক, পুঁজিবাদী, রাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক, নৈরাজ্যবাদী, বাস্তুবাদী, নারীবাদী, পিতৃতান্ত্রিক, সাম্যবাদী, শ্রেণিবদ্ধ, বর্ণবাদী, বামপন্থী, ডানপন্থী, সংস্কারবাদী, মুক্ত প্রেম, পারমাণবিক, বর্ধিত পরিবার, সমকামী এবং আরও অনেক ইউটোপিয়ান ধারণা রয়েছে। প্রত্যেকে নিজের কল্প স্বর্গবাদ নিয়ে অনেক যুক্তি দেন, মানব অবস্থার উন্নতির জন্য যা নাকি অপরিহার্য এবং প্রতিটি আদর্শবাদী নিজেদের ইশতেহারে নিজেদের ঠিক দাবি করেন, বাকি প্রত্যেককে ভুল এবং অস্তিত্বহীন দাবি করেন না বৈকি। যদি ভুলভাবে ব্যবহার করা হয়, তবে এটি বিপজ্জনক হয়ে ওঠে, যা আবার ভিন্ন একটি ধারা। এর নাম ডিস্টোপিয়া। আজও তাই সুরাহা হয় না, সবার সহাবস্থানে একটি আদর্শ রাষ্ট্র সম্ভব কি না!
আদর্শ রাষ্ট্র, এ বলে যদিও পরম কিছু নেই, একথা প্রমাণিত সত্য। ‘তবে’, ‘কিন্তু’, ‘হেতু’, ‘অধিকন্তু’, ‘যদি’, ‘নতুবা’র মতো সমুচ্চয়ী অব্যয় মাথাচাড়া দিয়ে বলে, ‘আপেক্ষিক’ নয় কি? হ্যাঁ, তা কিছুটা। একেকজনের আদর্শ রাষ্ট্র একেক রকম। একজন কমিউনিস্ট বিশ্বাসীর কাছে, কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা পেলেই আদর্শ রাষ্ট্র হয়েছে; “এবার বাড়ি যাই, আর কিছু চাই না” ভাবনা তো নিছক ছেলেমানুষী- একথা আজ মাও সে তুং আর চীনের সুবিশাল প্রাচীরটাও জানে। শান্তির জন্য আমরা আদর্শ রাষ্ট্র চাইছি, তার জন্যেও যে অশান্তি হচ্ছে, একথা বাপুজি টের পেয়ে খাওয়া-দাওয়া তো কম ছাড়েননি। সুভাষ বোসও জেদী ছেলে, ঝামেলা ঠিক পেকে গেল! হিন্দুর জন্য আলাদা হিন্দুস্তান হলো, মুসলমানের জন্য পাকিস্তান; আদর্শ রাষ্ট্রের মুখখানা দেখা গেল না। যাক সে আলাপ ভিন্ন, তবুও প্রাসঙ্গিক ।
ইউটোপিয়ার সূচনা যেখানে হয়, আমরা সেখানে ফিরি। থমাস মুরের চোখ দিয়ে দেখলে, সামনে ভেসে ওঠে দূরবর্তী কোনো দিগন্তের ভ্রমণকাহিনীর বিস্তারিত আলাপ। তিনি তখন নেদারল্যান্ডে, রাজা অষ্টম হেনরির রাষ্ট্রদূত হিসেবে ইংরেজ বাণিজ্য বিষয়ে বিশেষ আলোচনায়। এরপরে অ্যান্টওয়ার্পে ভ্রমণ করেন, যেখানে তিনি থাকা শুরু করেন এবং পিটার গিলস নামে সে শহরের এক সৎ, শিক্ষিত নাগরিকের সাথে বন্ধুত্ব করেন ।
দেখা মেলে রাফেল হাইথলডে নামক এক বৃদ্ধেরও। একদিন মুর, গিলস এবং হায়থলডে মুরের বাড়িতে চলে গেলেন এবং তার বাগানে তিনজন মিলে বিস্তারিত এক আলাপে মাতলেন। হাইথলডে আমেরিগো ভেসপুচির সাথে এমন একটি দেশ ভ্রমণ করেন, যা তার কাছে আদর্শ মনে হয়। সে রাষ্ট্রের নাম দেন তিনি ইউটোপিয়া। যদিও পরে আমরা জানতে পারি, মোর আর গিলস বাস্তব চরিত্র হলেও এই হাইথলডে একটি মনগড়া অস্তিত্ব।
৫৪টি শহরের এ রাষ্ট্রে জ্ঞানী লোকেরা শাসক, যেখানে শ্রমের বণ্টন সুষম, কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পদ কারও নেই। ভোগ-বিলাসের সুযোগ নেই, আরাম-আয়েশের জীবনকে প্রশ্রয় দেয়া হয় না। অপরাধীরা এখন ক্রীতদাসের জীবন পালন করে। রাষ্ট্রীয় সম্পদ আছে, যা সবাই ব্যবহার করতে পারে। তাতে বিশেষ কোনো অধিকার কারও নেই বা দেওয়া হয়নি বলা যেতে পারে। কোনোকিছুর মালিক না হয়েও সম্পদশালী হওয়া যায়; মনের শান্তি, আনন্দ এবং দুশ্চিন্তামুক্ত জীবনের চেয়ে মূল্যবান সম্পদ আর কী আছে? যুদ্ধের বদৌলতে যে ‘গৌরব’ আসে, এর চেয়ে লজ্জার আর কিছুই নেই। যুদ্ধ নয়, শান্তির সোপান এনে দেয় ইউটোপিয়া।
ইউটোপিয়ার বাতাস বঙ্গদেশে আসেনি, এমন নয়। ইজিচেয়ারে আরাম করতে করতে সুলতানা দেখল, এক ইউরোপীয় নারী তাকে সামনে বাগানের সম্মিলনে যেতে ডাকছে। এ নারীকে সুলতানা চেনে না, তবে দেখতে অনেকটা তার পরিচিত সিস্টার সারার মতো ঠেকছে। ‘সারা’ বলে সম্বোধন করলেও সে কিছু মনে করছে না, বরং স্বতস্ফূর্ত আলাপ চালিয়ে নিচ্ছে। সুলতানা তখনো টের পায়নি, এই জায়গাটা তার পরিচিত স্বদেশ ভারতবর্ষ নয়, এ জায়গার নাম লেডিল্যান্ড। নারীস্থান, অনন্য এক পরিস্থান, যেখানে নারীরা রাজপথ দাপিয়ে বেড়ায় আর পুরুষেরা থাকে ঘরবন্দী।
এটি একটি নারীবাদী ইউটোপিয়ান দেশ, যেকোনো ইউটোপিয়ান রাষ্ট্র বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনের উপর ব্যাপক নির্ভরশীল। বিদ্যুৎ ও সৌরশক্তি নির্ভর একটা রাষ্ট্রের মডেল নারীস্থান। আরবান ফার্মিং, গোটা দেশ একটা বৃহৎ বাগান হবে- একথা সগৌরবে স্বীকার করে নারীস্থান। যেখানে বিজ্ঞানভিত্তিক কাজ হয়, সেখানে জ্ঞানী মানুষ থাকবে এবং আদর্শ রাষ্ট্রের জন্য জ্ঞানী মানুষ প্রয়োজন।
পেশীশক্তি যেকোনো সমাজের চালিকাশক্তি হয় না, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এই দেশ। সুলতানা অবাক হয়, যে দেশে পুরুষেরা রাজ করে না, সে দেশ কী করে উন্নত হচ্ছে? সারা যুক্তিবাদী মানুষ। জ্ঞান ও প্রাচুর্যে লেডিল্যান্ডের নারীরা সুলতানার চেয়ে এগিয়ে, তা আঁচ করতে ভুল হয় না। হাতির আকৃতিগত শ্রেষ্ঠত্ব তার বুদ্ধিমত্তা প্রকাশ করে না- এমন সব স্বভাবসুলভ আলাপ আমরা শুনি।
সুলতানার পুরো ভ্রমণটাই একটা স্বপ্ন, কল্পনা বা ভ্রম। যা ভেঙে গেলে সুলতানা আবিষ্কার করে, সে যেখানে আছে, তা মোটেও নারীস্থান নয়। সেই আরামকেদারায় এখনো বসা সে, যে দেশ পুরুষদের রেষানলে পুড়ছে, নারীরা মোটেও আরামে নেই সেখানে। যেখানে পুরুষেরা নৈতিক জীবনে হীন, দুই-দশ বিঘা জমির জন্য যুদ্ধ করে, কোহিনুর ধুয়ে আবে হায়াত পান করার স্বপ্ন দেখে, ভীষণ গৌরবের জীবন ভাবছে- কিন্তু মোটেও তা নয়। এই কেচ্ছা আমাদের শোনান বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। নারীবাদের এমন ইউটোপিয়া আজও বাংলার প্রতিটি পুরুষতান্ত্রিক লোকের জন্য একটা উত্তম কষাঘাত, খালি চোখে টের পাওয়া যায়।
আইনস্টাইন বলেন, কল্পনার কাছে আমাদের কিছু ঋণ আছে। কল্পনা জ্ঞানের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। প্লেটো থেকে মুর, এই বাংলায় রোকেয়া- সবাই কল্পনায় একটাই বাসনা পোষণ করেছেন। মানুষের মুক্তি, স্বাধীনতা, উৎপাদন ও শ্রম ও শাসনের বণ্টন, এমন ইউটোপিয়া কি কোনোদিন হবে, নাকি কল্পনাতেই অন্ত্যমিল?