যা নেই ভারতে, তা নেই মহাভারতে

মহাভারত আকারে ও মাহাত্ম্যে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মহাকাব্য। চারটি জাত মহাকাব্যের একটিও বটে। মূলগ্রন্থ সংস্কৃতে রচিত হলেও বিভিন্ন ভাষার অনুবাদগুলোও মূল পাণ্ডুলিপি থেকে কম জনপ্রিয়তা পায়নি। ‘মহাভারত’ অর্থ ভরত বংশের মহান কাহিনী।

হিন্দু পুরাণের এক জনপ্রিয় রাজার নাম ভরত। তিনি ছিলেন রাজা দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার পুত্র এবং একজন ক্ষত্রিয় চন্দ্রবংশীয় রাজা। আর সেই ভরত রাজার বংশের কাহিনীগুলোই স্থান পেয়েছে মহাভারতে। কত বছর আগে এই গ্রন্থ রচিত হয়েছিল, সঠিকভাবে কেউ বলতে পারে না। প্রাচীন পণ্ডিতদের মতে, মোটামুটি পাঁচ হাজার বছর আগে রচিত হয়েছিল এটি। তবে আধুনিক বিশেষজ্ঞরা বলেন অন্য কথা। তাদের মতানুসারে- খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে খ্রিস্টিয় দ্বিতীয় শতকের মধ্যে মহাভারত রচিত হয়েছিল। 

যেভাবে রচিত হলো

মহাভারত রচনার ঘটনাটি বড় মজার। ব্যাসদেব, পুরো নাম ‘কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস’ ভরত বংশের কাহিনী নিয়ে একটি বিশালাকার গ্রন্থ রচনার জন্য হিমালয়ে বসে তপস্যা করছিলেন। তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করে তিনি ছোটেন ব্রহ্মলোকে, ভগবান ব্রহ্মের কাছ থেকে একজন শ্রুতিলেখক নিযুক্ত করার জন্য।

ভগবান ব্রহ্ম তাকে গণেশের কাছে পাঠান। গণেশ বই লিখতে রাজি হন কিন্তু সাথে সাথে একটি শর্ত জুড়ে দেন যে, শ্লোক বলার সময় থামা যাবে না। ব্যাসদেব তার শর্ত মেনে নিয়ে নিজেও একটি শর্ত দেন, শ্লোক লেখার সময় প্রত্যেকটি শ্লোক বুঝে বুঝে লিখতে হবে। গণেশ ব্যাসদেবের শর্ত মেনে নিয়ে তার আশ্রমের দিকে যাওয়া শুরু করেন নিজের বাহন মূষিকের পিঠে চড়ে। ব্যাসদেব শ্লোক বলার মাঝে কিছু দুর্বোধ্য শ্লোক ঢুকিয়ে দিতেন। এগুলো বুঝতে গণেশ একটু সময় নিলে তিনি পরের শ্লোকগুলো ভেবে নিতেন। এই শ্লোকগুলোই পরে ‘উদ্ভট শ্লোক’ নামে প্রসিদ্ধ হয়।

ব্যাসদেব গণেশকে আবৃত্তি করে মহাভারত শোনাচ্ছেন; Image Source : pinterest
ব্যাসদেব গণেশকে আবৃত্তি করে মহাভারত শোনাচ্ছেন; Image Source : pinterest

এভাবে মহাভারত লিখতে সময় লেগে যায় তিন বছর। আর এরই মাঝে গণেশ নিজের দুটো দাঁতের একটি হারান। তারপর তার নাম হয় একদন্ত। শুরুতে এই গ্রন্থের নাম ছিল ‘জয়’ এবং এর শ্লোকসংখ্যা ছিল ৮,৮০০। পরে ব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন এতে আরো শ্লোকের সংযোগ ঘটিয়ে ২৪,০০০ শ্লোকের একটি গ্রন্থ রচিত করেন। সেটির নাম ছিল ‘ভারত’। তারপর ‘ভারত’-কে অপর এক শিষ্য উগ্রশ্রবা অধ্যয়ন করে ১০০,০০০ শ্লোকবিশিষ্ট একটি গ্রন্থে পরিণত করেন। বর্তমানে প্রচলিত মহাভারতের শ্লোকসংখ্যা এক লক্ষ।

মহাভারতে অবশ্য এ বিষয়ে একটু ভিন্ন কথা বলা আছে। সেখানে আছে, ব্যাসদেব ষাট লক্ষ শ্লোকযুক্ত একটি ধর্মের জয়সূচক গ্রন্থ রচনা করেছেন- যার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনেরো লক্ষ শ্লোক পিতৃলোকে, চৌদ্দ লক্ষ শ্লোক যক্ষলোকে এবং বাকি এক লক্ষ শ্লোক প্রচলিত আছে মর্ত্যলোকে। মহাভারতে এভাবে আছে–

ত্রিংশচ্ছতসহস্রঞ্চ দেবলোকে প্রতিষ্ঠিতম্॥
পিত্রে পঞ্চদশ প্রোক্তং রক্ষোযক্ষে চতুর্দ্দশ।
একং শতসহস্রন্তু মানুষেষু প্রতিষ্ঠিতম্॥

ঐতিহাসিক গ্রন্থ মহাভারত

কেউ যদি বলে, মহাভারত শুধু একটি ধর্মগ্রন্থ- তবে বুঝতে হবে তিনি মহাভারত পড়েননি। মহাভারত শুধু একটি ধর্মগ্রন্থ নয়। এটি সে যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক গ্রন্থ। আজ থেকে চার-পাঁচ হাজার আগের ভারত দেখা যায় এই গ্রন্থে। সে যুগের সমাজবিধি ও আচার-অনুষ্ঠানের ব্যাপারে বলা হয়েছে এখানে। একটি প্রথা ছিল এমন, ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয় ছাড়া কেউ অস্ত্রশিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে না। বর্ণপ্রথার বিষয়ও জানা যায় এখান থেকে।

ভারতভূখণ্ডের বিভিন্ন রাজ্যের রাজবংশ, প্রথা, খাদ্যাভ্যাস, বাহন এবং উৎসবের কথা আলোচনা করা হয়েছে। ভারতকে আখ্যায়িত হয়েছে আর্যাবর্ত নামে। ভারতের বাইরের যুদ্ধপ্রিয় জাতিদের অসুর নামে পরিচিত করানো হয়েছে। স্বয়ম্বর অনুষ্ঠানের কথাও মহাভারতে উল্লেখ আছে।

তৎকালীন সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন যাগযজ্ঞের আনুষ্ঠানিকতার বিষয়ও আছে মহাভারতে। অশ্বমেধ যজ্ঞ, পুত্রেষ্টি যজ্ঞ, সর্পনিধন যজ্ঞ -এমন অনেক যজ্ঞের কথা আছে। হস্তিনাপুর, মগধ, পাঞ্চাল, চেদি, মদ্র, অঙ্গ, গান্ধার, পুণ্ড্র, বিরাট, দ্বারকাসহ তৎকালীন ভারতের সব রাজ্যের বিষয়েই বর্ণিত হয়েছে মহাভারতে, যেন পুরো আর্যাবর্তের একটি মানচিত্র আছে এখানে।

তৎকালীন ভারতের মানচিত্র (মহাভারত অনুসারে) ; Image Source : Vedicfeed
তৎকালীন ভারতের মানচিত্র (মহাভারত অনুসারে) ; Image Source : Vedicfeed

এছাড়াও কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের কাহিনী, এ যুদ্ধে ভারতভূখণ্ডের প্রতিটি রাজার সম্পৃক্ত হওয়ার ঘটনাসহ যুদ্ধপরবর্তী প্রতিটি ঘটনাই প্রমাণ দেয়, মহাভারত একটি ঐতিহাসিক গ্রন্থ।

দার্শনিক গ্রন্থ মহাভারত

মহাভারত একটি দার্শনিক গ্রন্থও বটে। ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ- এই চার পুরুষার্থ সংক্রান্ত আলোচনা করা হয়েছে মহাভারতে। মহাভারতে মোট ১৮টি অধ্যায় তথা ‘পর্ব’ ও ১০০টি ‘উপপর্ব’ রয়েছে। শ্রীমদভাগবত গীতা ভীষ্মপর্বের অন্তর্গত। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যে উপদেশাবলি প্রদান করেছেন, সেগুলোই মূলত গীতাতত্ত্বসার।

অর্জুনকে উপদেশরত অবস্থায় শ্রীকৃষ্ণ ; Image Source : alamy stock photo
অর্জুনকে উপদেশরত অবস্থায় শ্রীকৃষ্ণ ; Image Source : alamy stock photo

গীতার দর্শন আজও সারা পৃথিবীতে সমাদৃত। গীতায় আত্মার সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে-

অচ্ছেদ্যোহমদাহোহয়মক্লেদ্যোহশোষ্য
নিত্যঃ সর্বগতঃ স্থানুচলহং সনাতনঃ।।
(শ্রী গীতা অধ্যায়: ২, শ্লোক: ২৪)

অর্থাৎ, এই আত্মা অচ্ছেদ্য, অদাহ্য, অক্লেদ্য, অশোষ্য। তিনি চিরস্থায়ী, সর্বব্যাপী, অপরিবর্তনীয় ও সনাতন।

আজও আত্মার এই সংজ্ঞাই সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়। গীতায় মানুষের স্বত্তঃ, রজঃ, তমঃ গুণের প্রসঙ্গ এসেছে। জন্মান্তরের পুরোটাই মূলত গীতা থেকে গ্রহণ করেছে হিন্দুরা। দেহ ও আত্মার সংযোগ, যোগব্যায়াম ব্যবহার করে মনকে কেন্দ্রীভূত করা এগুলো শিখেছে মানুষ গীতা থেকে। ব্রহ্মজ্ঞান বা সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়েও গীতায় অনেক সুন্দর ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।

যুদ্ধকৌশল শেখায় মহাভারত

মহাভারত নাম শুনলেই অনেকের কানে বাজে রথ চলার শব্দ, তলোয়ারবাজির টুংটাং।

কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধরত কুরু-পান্ডব; Image Source : Vedicfeed
কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধরত কৌরব-পাণ্ডব; Image Source : Vedicfeed

তবে মহাভারতে শুধু যুদ্ধের কাহিনী বর্ণিত হয়নি, যুদ্ধকৌশলও বর্ণিত হয়েছে। বিভিন্ন ব্যূহ রচনার কৌশল, অস্ত্রচালনার কৌশল, সংযমের কৌশল শেখানো হয়েছে এখানে। সারাদিন যুদ্ধের পর যখন পাণ্ডব ও কৌরবদের রথী-মহারথীরা স্ব স্ব তাঁবুতে মিলিত হয়ে যুদ্ধকলা নিয়ে আলোচনা করতেন, সে আলোচনা থেকে অনেক কিছু শেখা যায়। অভিমন্যুকে মারার জন্য চক্রব্যূহ নির্মাণ করা হয়, যাতে ঢোকা সহজ হলেও বেরোনো কঠিন।

চক্রব্যূহ; Image Source : indiafacts
চক্রব্যূহ; Image Source : indiafacts

বিরাট রাজাকে আক্রমণের জন্য বজ্রব্যূহ নির্মাণ করা হয়। বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন অস্ত্রের ব্যবহার লক্ষ করার মতো। পরশুরাম ও ভীষ্মের যুদ্ধে ভীষ্ম ব্রহ্মাস্ত্র ব্যবহার করেন। অর্জুন জয়দ্রথকে বধ করেন পশুপাতাস্ত্র দিয়ে। এরকম আরো আছে নাগাস্ত্র, বাসববাণ ইত্যাদি। একটি বিষয় খুব খেয়াল করার মতো, মহাভারতের সব যুদ্ধতেই লোহার ব্যবহার আছে। অর্থাৎ, ব্রোঞ্জ যুগের সমাপ্তির পর শুরু হওয়া লৌহযুগ ছিল মহাভারতের সময়কাল।

মহাভারতের ব্যাপকতা

মহাভারতের ব্যাপকতা বা দার্শনিকতা শুধু কিছু পৌরাণিক কাহিনী বা আখ্যানের সমষ্টি নয়। এটি সেযুগের প্রচলিত বৈদিক ও ধার্মিক দর্শনের সারাংশ। একে পঞ্চমবেদ বলেও আখ্যায়িত করা হয়। এ ব্যাপারে একটি কাহিনী প্রচলিত আছে, একদা দেবতারা একটি তুলাযন্ত্রের এক পাল্লায় চারটি বেদ ও উপনিষদ রাখেন, আর অন্যপাল্লায় রাখেন মহাভারত। মহাভারতের পাল্লাটি ভারে ও মাহাত্ম্যে বেশি ভারি হয়। এ নিয়েও একটি শ্লোক আছে,

মহত্ত্বাদ্ ভারতবত্ত্বাচ্চ মহাভারতমুচ্যতে।।

অর্থাৎ –

জগতের তাবত বস্তুর চেয়ে মাহাত্ম্যপূর্ণ এই মহাভারত।

মহাভারতের ব্যাপারে বাংলায় একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে,

যা নেই ভারতে, তা নেই মহাভারতে।

এর মানে হল- মহাভারতে যা আছে, তা ভারতবর্ষের অন্য কোথাও থাকতে পারে। কিন্তু, মহাভারতে যা নেই, তা ভারতের কোথাও নেই।

Related Articles

Exit mobile version