নিউ ইয়র্কে এক জাপানি লেখকের বই তুমুল ঝড় তুলেছে। বইয়ের দোকানে সেই বইয়ের স্তুপের পাশে কাঁচের জানালায় লেখকের প্রমাণ সাইজের ছবি ঝোলানো আছে। রাস্তা দিয়ে আসা যাওয়ার পথে অনেকেই দেখতে দেখতে চেহারা মাথায় গেঁথে রেখেছেন। মোটা দাগে বলতে গেলে, ইংরেজি বইয়ের সবচেয়ে বড় বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আমেরিকার বাজারে বেস্ট সেলারের জাহাজে উঠতে পারলে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে আরেকটি বড় বাজার ইংল্যান্ড পাড়ি দেওয়া সময়ের ব্যাপার। এই সাফল্যের জাহাজ খুব বেশি জাপানি লেখক পাড়ি দিতে পারেননি। অন্তত সমসাময়িক কালে একজনই পাড়ি দিয়েছেন।
নিউ ইয়র্কের সুন্দর ঝকঝকে সকালে সেই জাপানি লেখক হাঁটতে বেড়িয়েছেন, হটাৎ এক আমেরিকান মহিলা তাকে দেখে চমকে উঠলেন, বড় সাইজের পোস্টারে নির্ঘাত এই ব্যক্তিকেই দেখেছেন তিনি। নাম মনে না করতে পারলেও তিনি বললেন, আপনি সেই বিখ্যাত জাপানি লেখক না? স্বভাবসুলভ বিনয়ে তিনি বললেন, “না, আমি শুধুই একজন লেখক। তবুও আপনার সাথে দেখা করে আমি আনন্দিত।”
জাপানি লেখক হারুকি মুরাকামিকে নিয়েই কথা হচ্ছে। অনেক পত্রিকা আর ম্যাগাজিনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বারবার স্বীকার করে এসেছেন তিনি আসলেই খুব সাধারণ একজন লেখক, তার উপন্যাস যে বিশ্বজুড়ে লক্ষ কোটি কপি বিক্রি হবে সেই ব্যাপারে তার কোনো ধারণাই ছিল না। বরং লেখালেখি শুরু করার পর তার উপন্যাস নিয়ে খোদ জাপানেই কম সমালোচনা হয়নি।
তাকে জাপানে দীর্ঘদিন জাপানের সাহিত্যিক পরিমণ্ডলে ব্রাত্য হিসেবেই দেখা হয়েছে, কেউ বলেছেন তার উপন্যাসে অস্বাভাবিকভাবে পশ্চিমা উপাদান বেশি। পশ্চিমা সাহিত্য, সংগীত, কবিতার প্রভাব মুরাকামি অকপটে স্বীকার করেছেন। তার মতে জাপানি সাহিত্যের চেয়ে পশ্চিমা ইংরেজি সাহিত্য তাকে বেশি অনুপ্রেরণা দিয়েছে। রেমন্ড কারভার, জন আরভিং, জে ডি সালিংগার, স্কট ফিটজেরাল্ডের মতো বিখ্যাত আমেরিকান লেখকের গল্প উপন্যাস জাপানি ভাষায় অনুবাদ করেছেন মুরাকামি। স্কট ফিটজেরাল্ডের ‘দ্য গ্রেট গেটসবি’ উপন্যাসকে মুরাকামি তার লেখালেখির প্রধান অনুপ্রেরণা আখ্যা দিয়েছেন।
মুরাকামি লেখালেখির শুরুটা করেছিলেন ১৯৭৮ সাল থেকে, খ্যাতি পেতে দীর্ঘসময় লেগেছে। মুরাকামির ভাষ্য অনুসারে আত্রা খ্যাতির সাথে বৈশ্বিক রাজনৈতিক দ্বন্দের একটা সংযোগ আছে। ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মুরাকামি বলেন, ১৯৯০ সালে তার উপন্যাস রাশিয়ায় ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে উঠে, সেই সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজনৈতিক দোলাচলে ভাসছে সমগ্র পূর্ব ইউরোপ।
অসহায়ত্ব আর রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে মানুষ তার উপন্যাসে নোঙ্গর করেছে। একই কথা জার্মানির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, বার্লিন ওয়ালের পতনের রাজনৈতিক ঘোলাটে সময়ে জার্মানিতে জনপ্রিয় হয়ে উঠেন মুরাকামি। ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থান আর ব্রেক্সিটের সময় আটলান্টিকের দুই পাড়ে আবার হিড়িক পড়ে বইয়ের দোকানে মুরাকামির খোঁজে। কারণ তখন বাজারে আসে মুরাকামির ‘killing Commendatore’।
জাপানে তার উপন্যাস নিয়ে সমালোচনা হয়েছে এক দৃষ্টিকোণ থেকে সারা বিশ্বে আরেক কোণ থেকে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের সমালোচনাতে গুরুত্ব পেয়েছে তার চরিত্রের অদ্ভুত একাকীত্ব, উপন্যাসে যৌনতার উপস্থাপন, সমাজের ব্যাপারে চরিত্রের দৃষ্টিভঙ্গি। তবে বাদ যায়নি জাদু বাস্তবতা, অদ্ভুত চরিত্র আর ঘটনার উপস্থাপনা নিয়েও।
তবে খুব সম্প্রতি হারুকি মুরাকামিকে নিয়ে লেখা বই ‘Who We’re Reading When We’re Reading Murakami’ নামক বইয়ে ডেভিড কারাশিমা তুলে এনেছেন নতুন কিছু দিক। হারুকি মুরাকামির সাফল্যের পেছনে আমেরিকান প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আর অনুবাদকের যে ভূমিকা সেই দিকটিতে সবচেয়ে বেশি আলোকপাত হয়েছে। কারণ তার মতে আমেরিকা এবং বিশ্বজুড়ে ইংরেজি ভাষাভাষী পাঠকদের মাঝে হারুকি মুরাকামির যে সাফল্য, বেস্টসেলার বইয়ের তালিকায় জায়গা করে নেওয়ার ব্যাপারটির পেছনে অনুবাদকের হাত মোটেও কম নয়। জাপানি ভাষায় প্রকাশিত উপন্যাসের শব্দ, চিত্রপট, সময় বদলে দেওয়ার ব্যাপারটি নিয়ে গভীরভাবে খুঁজে দেখেছেন ডেভিড কারাশিমা।
আমেরিকার বাজারে হারুকি মুরাকামির উপন্যাসের প্রথম অনুবাদক ছিলেন আলফ্রেড বার্নবাম এবং সম্পাদক ছিলেন এলমার লুক। মুরাকামির তৃতীয় উপন্যাস যার জাপানি নামের সরাসরি অনুবাদ করলে দাঁড়ায় “An Adventure Surrounding Sheep”, এই উপন্যাসটি মূলত জাপানের সত্তরের দশকের পটভূমিতে রচিত। জাদুবাস্তবতার মিশেলে অনেকটা অনুসন্ধানী গোছের চমৎকার একটি উপন্যাস।
জাপানে ১৯৮২ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসের পটভূমি ছিল জাপানের সত্তরের দশকের শেষভাগকে কেন্দ্র করে। তবে ১৯৮৯ সালে আমেরিকান পাঠকদের কথা চিন্তা করে বার্নবাম আর লুক কিছু অদল বদলের আনার চিন্তা করেন। আমেরিকা এবং আন্তর্জাতিক পাঠকরা সাম্প্রতিক কোনোকিছুকে আরো বেশি গ্রহণ করবে এই কথা মাথায় রেখে ১৯৭০ সালের সাথে সম্পর্কিত দিন তারিখের বিষয়াদিতে পরিবর্তন আনা হয়।
‘A Wild Sheep Chase’ অনূদিত বইয়ের এই নামটিও নেওয়া হয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের একটি বক্তৃতার অংশকে সামান্য পরিবর্তিত করে। আমেরিকান পাঠক যারা রোনাল্ড রিগ্যানের ভাষণটি শুনেছেন তাদের কাছে বইয়ের নামটিও বেশ পরিচিত মনে হয়েছে। অবশ্য বার্নবামের মতে ‘An Adventure Surrounding Sheep’ এর তুলনায় অবশ্য তার দেওয়া নামটি মোটেই খারাপ হয়নি। পাঠকরাও এই নামটি সাদরে গ্রহণ করে। বইয়ের কয়েকটি চ্যাপ্টারের নামকরণেও একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, উপন্যাসের একটি অধ্যায়ের নাম দেওয়া হয় ‘One for the Kipper’, এটিও জনপ্রিয় একটি সিনেমার সংলাপ ‘Make it one for the Gipper’ থেকে নেওয়া।
বার্নবাম আর লুকের এই অনুবাদ ব্যাপকভাবে আমেরিকান বাজারে সাড়া ফেলে। ১৯৮৯ সালে মুরাকামির আমেরিকান বাজারে এই অভুতপূর্ব সাফল্যের পেছনে কেউ কেউ বড় করে দেখেছেন আমেরিকা-জাপানের অর্থনৈতিক টানাপোড়েনকেও। আশির দশকে জাপানের অর্থনীতির স্বর্ণযুগ। আমেরিকান অনেক প্রতিষ্ঠানকে জাপানী বিনিয়োগকারীরা কিনে নিচ্ছে, জাপানের এই মনোভাবকে অনেক বিশ্লেষক আগ্রাসী বলেও আখ্যা দিচ্ছিলেন। সুতরাং আমেরিকার মানুষের মনে জাপান নিয়ে প্রভূত কৌতুহল। সেখান থেকে জাপানি লেখক যিনি আবার তার সমাজে ব্রাত্য, তার লেখা আমেরিকার বাজারে ব্যাপক সাফল্য পায়।
আমেরিকায় মুরাকামির বইয়ের অসাধারণ সফলতার ফলে এই বই নজর কাড়ে বিশ্ববাসীর কাছে, অনুবাদ শুরু হয় অন্য অনেক দেশেই। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা ইংরেজি অনুবাদকে প্রামাণ্য ধরেই কাজ শুরু করেন। এবং এভাবেই অনেক দেশে এই উপন্যাসে জাপানি মূল থেকে অনেক বদলে যায়।
হারুকি মুরাকামির দ্বিতীয় উপন্যাস যেটি আমেরিকার বাজারে জায়গা করে নেয়, ‘Hard-Boiled Wonderland and the End of the World’, এই বইয়ের অনুবাদক হিসেবে ছিলেন আলফ্রেড বার্নবাম এবং সম্পাদক ছিলেন এলমার লুক। আমেরিকান পাঠকরা যাতে আগ্রহ না হারিয়ে ফেলে এই জন্য প্রায় ১০০ পৃষ্ঠা কাটছাট করেন তারা। গল্পের মূল চরিত্রের যৌনতার ব্যাপারে কিছু সংলাপ বদলে দেওয়া হয়, কিছু বাদ দেওয়া হয়। এই উপন্যাস সেই অর্থে তেমন সফলতা পায়নি আমেরিকার বাজারে।
আমেরিকান বাজারে এরপর মুরাকামির উপন্যাসের প্রকাশক এবং অনুবাদক বদলেছে, তবে প্রতিটা উপন্যাসে কাটছাঁট হয়েছে। ‘The Wind-Up Bird Chronicle” এর অনুবাদক জে রুবিনের কাছে মুরাকামির মূল লেখাটি বেশ ‘বিক্ষিপ্ত’ মনে হয়েছে। তাই অনুবাদের সময় তিনি দুইটা আলাদা ভার্সন তৈরি করেন, একটিতে মুরাকামির মূল লেখার অবিকৃত অনুবাদ আরেকটিতে প্রায় ২৫,০০০ শব্দ কাটছাঁট করে গোছানো অনুবাদ। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান দ্বিতীয়টিকেই গ্রহণ করেছে প্রকাশের জন্য এবং এই উপন্যাসটিও ব্যাপকভাবে সফল।
জে রুবিন, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জাপানিজ স্টাডিজের অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। হারুকি মুরাকামির লেখার ধরন নিয়ে গবেষণাও করেছেন। মুরাকামির বেস্টসেলার উপন্যাস 1Q84 এর সহ অনুবাদক হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি। জাপানি ভাষায় তিনটি আলাদা বই আকারে প্রকাশ হলেও ইংরেজিতে তা কাটছাঁট হয়ে একটি বই আকারে প্রকাশ করা হয়। জে রুবিনের মতে, হারুকি মুরাকামির লেখার মাঝে মানুষের সাথে সংযোগ গড়ে তোলার এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে, তার কাছে আছে প্রতিটি পাঠককে নাড়া দেওয়ার শক্তি। সেই শক্তি অক্ষুণ্ণ রেখেই রুবিন অনুবাদের চেষ্টা করেছেন। তবে পাঠকের স্বাচ্ছন্দ্যের কথা চিন্তা করেই কাটছাঁট করেছেন।
ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারেও মুরাকামি স্বীকার করে নিয়েছেন অনুবাদে তার লেখা খানিকটা পরিবর্তন হচ্ছে। অনেকটা মজা করেই বলেছেন, “আমার লেখা বিশাল কলেবরের জাপানি বই ইংরেজি অনুবাদে আসতে আসতে বছর দুয়েক লেগে যায়, তাই ইংরেজি অনুবাদ যখন পড়তে বসি, তখন প্রায় সবই ভুলে যাই আসল গল্প। প্রথম পাঠকের মতো আমিও উত্তেজনা নিয়েই প্রতিটি পাতা উল্টাই।”
অনুবাদে বদলে যাওয়া আর অনুবাদকের গণ্ডি, অনুবাদে কতটুকু বদলে গেলে তাকে আমরা আসলেই বদলে যাওয়া বলছি নিয়েও আলাপ কম হয়নি। বিখ্যাত অনুবাদক এবং গবেষক লরেন্স ভেনুতি তার বই ‘The Translators Invisibility’ তে এই সমস্যাগুলোকে বিশ্লেষণ করেছেন। মুরাকামি সহ বিভিন্ন ভাষার লেখকের ক্ষেত্রে ইউরোপ-আমেরিকান অনুবাদক-প্রকাশকেরা পাঠকের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য অনুবাদে ভাষাগত এবং সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোকে জলাঞ্জলি দিচ্ছেন। দেখা যাচ্ছে স্থানীয় কোনো প্রথা অনুষ্ঠানেকে তারা ইউরোপ আমেরিকার জনপ্রিয় কিছুর সাথে মিলিয়ে বা সাদৃশ্য দেখিয়ে উপস্থাপন করছেন। এতে অবশ্য পাঠকের কাছে ঘটনাটি পরিচিত মনে হচ্ছে, পাঠকের স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বই বিক্রি বাড়ছে। এই ঘটনাটি জনপ্রিয় বিদেশি লেখকদের ক্ষেত্রে বেশি ঘটছে, সচেতন পাঠক বা সমালোচক ছাড়া কেউই তলিয়ে দেখছেন না মূল উপন্যাসে কী আছে, কী পরিবর্তন হয়েছে। এই পুরো প্রক্রিয়াটিকে লরেন্স ভেনুতি চিহ্নিত করেছেন “Domesticated Translation” হিসেবে।
তবে ভেনুতি তার বইয়ে মূল ভাষা, সংস্কৃতি অক্ষত রেখে যে অনুবাদ অর্থাৎ “Foreignizing Translation”, সেটিকে প্রাধান্য দেওয়ার পক্ষে আলোচনা করেছেন। এতে পাঠক মূল ভাষার স্বাদ গন্ধ অনেক বেশি উপভোগ করতে পারবেন। তবে বলাই বাহুল্য, প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান খুব শীঘ্রই সেদিকে হাঁটছে না।
অনুবাদে হারিয়ে যাওয়া অনেক লেখককেই দুনিয়াজুড়ে চোখে পড়বে, নিজের ভাষায় সফল হলেও ইংরেজির বৈশ্বিক পাঠকদের ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন অনেক লেখক। কিন্তু হারুকি মুরাকামি সেখান থেকে আলাদা নিজের দেশের পাঠকরাই শুরুতে তাকে ধরতে ব্যর্থ হয়, অনুবাদেই যেন তিনি উজ্জ্বল তারকা, তবে দিন যত গড়িয়েছে জাপানের নতুন প্রজন্মের কাছে নিজেকে তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছেন মুরাকামি, এখন মুরাকামির বই মানে খোদ জাপানেই প্রি-অর্ডারের হিড়িক পড়ে যায়। তাই বিশ্বজুড়ে তো বটেই এমনকি নিজের দেশ জাপানেও হারুকি মুরাকামিকে পাদপ্রদীপের আলোয় আসার পথটি করে দিয়েছেন অনুবাদকেরা। ইউরোপ আমেরিকায় অনূদিত হয়ে ব্যাপক খ্যাতি না পেলে হারুকি মুরাকামি কি আজও ব্রাত্য হয়ে থেকে যেতেন জাপানের সাহিত্যিক পরিমণ্ডলে?