বাংলায় ‘সাক্ষী গোপাল’ একটি বহুল প্রচলিত বাগধারা। এটা দিয়ে এমন কাউকে বোঝানো হয়, যিনি ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে নিষ্ক্রিয় দর্শকের ন্যায় সবকিছু অবলোকন করেন, কিন্তু মুখে কিছু বলেন না। আবার, যার উপস্থিতিই সাক্ষ্যদানের সমান, তাকেও সাক্ষী গোপাল বলা হয় কখনো কখনো। ‘সাক্ষী গোপাল’ কথাটি প্রচলিত হওয়ার পেছনে চমৎকার একটি মিথ চালু আছে। সরাসরি সেই আলাপেই যাওয়া যাক।
সে অনেককাল আগের কথা। সে যুগে আর্যভারতে চারটি আশ্রম বা জীবন যাপনের চতুর্বিধ অবস্থা প্রচলিত ছিল। ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস। ব্রহ্মচর্যে গুরুর নিকট শিক্ষিত-দীক্ষিত হতে হতো, গার্হস্থ্যে ছিল গৃহজীবন বা সংসারজীবন। বানপ্রস্থ ঈশ্বরের দিকে অভিগমনের প্রথম ধাপ। এতে ব্যক্তিকে সংসারধর্ম ত্যাগ করে অরণ্যে গিয়ে ঈশ্বরচিন্তায় নিমগ্ন হতে হতো। আর সন্ন্যাসে সম্পূর্ণরূপে ঈশ্বরের নিকট নিজেকে সঁপে দিতে হতো। ভিক্ষাবৃত্তি ছিল এসময়কার অবলম্বন।
দক্ষিণ ভারতের বিদ্যানগর নামক এক স্থানে একজন কুলীন ব্রাহ্মণ চতুরাশ্রমের তৃতীয়টিতে উপনীত হলে তিনি সংসারের সব দায়িত্ব বড় ছেলের হাতে দিয়ে তীর্থদর্শনে বেরিয়ে পড়লেন। গয়া, কাশী, প্রয়াগ দর্শন করে তিনি মথুরায় এসে উপনীত হন। তিনি বৃন্দাবনের বারো বন, গোবর্ধন পর্বত ইত্যাদি দেখে পরমানন্দ লাভ করলেন। তীর্থযাত্রার একপর্যায়ে তার সাথে একজন যুবক ব্রাহ্মণের সাক্ষাত হয়। যুবক বিপ্রটি (বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ) নিবিষ্টমনে তার সেবা করেন। যুবকের বিনম্রতায় ব্রাহ্মণ অত্যন্ত মোহিত হন। যুবাবিপ্রটি তাকে সাথে নিয়ে সব তীর্থ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখান।
বৃদ্ধ ব্রাহ্মণটি একসময় মনে মনে ভাবতে থাকেন, “আহা! এমন সুন্দর মনের ছেলেটির সাথে যদি আমার মেয়েটির বিয়ে দিতে পারতাম!” বৃন্দাবন দর্শনের একপর্যায়ে তার দুজন গোপাল মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়ান। বৃদ্ধ তখন তার মনের কথাটি যুবককে বললে যুবক বলেন, “ব্রাহ্মণদেব, আমি আপনার পদসেবায় নিজেকে নিযুক্ত করেছি কোনোকিছু পাওয়ার লোভে নয়। আপনি আশীর্বাদ করুন, আমায় এতেই আমার সুখ।” যুবকের নির্লোভ মনোভাবে ব্রাহ্মণ অত্যন্ত খুশি হলেন। তিনি বললেন, “বাবা, আমি তোমার আচার-ব্যবহারে যা বুঝলাম তোমার মতো ছেলে আরেকটি মেলা ভার। আমার কন্যার সৌভাগ্য এমন বর পাওয়া।”
যুবক তখন বলেন,
“ধনে-মানে-গৌরবে আমি আপনার সমকক্ষ নই। আমি আপনার মতো মহাকুলীন নই। আমার ট্যাঁকে কানাকড়ি নেই। আপনি রাজি হলেও আপনার পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, কন্যা এরা রাজি হবে না। তাই, এ কথা এখানেই শেষ হোক।”
বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ তখন বললেন,
“আমার কন্যাকে আমি মানুষ করেছি। সে আমার মতকে কোনোদিনও অমান্য করবে না। পিতার আদেশ তার শিরোধার্য। আর, আত্মীয়-স্বজন, পরিবার এরা কোনোদিনও আমার উপকারে আসেনি। তাই, এদের কথা ছাড়ো। তুমি রাজি হলেই হবে।”
যুবকটি তখন হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন। তখনকার দিনে একটি প্রথা ছিল– কোনো ব্যাপারে কেউ কোনোপ্রকার সংকল্পে আবদ্ধ হতে চাইলে মন্দিরে গিয়ে দেবতাকে সাক্ষী করে প্রতিজ্ঞা করা হতো। বৃদ্ধ বিপ্র তখনই গোপালের মন্দিরে গোপালকে সাক্ষী রেখে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন যে তার কন্যার সাথে যুবাবিপ্রের বিয়ে দেবেন। যুবকটি গোপালের মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিজ্ঞা করলেন,
“হে প্রভু, আমি এই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের কন্যাকে বিয়ে করব। যদি এ ব্রাহ্মণ যেকোনোভাবে তার প্রতিজ্ঞা থেকে বিচ্যুত হন, তখন তোমায় এসে এর প্রতিজ্ঞার ব্যাপারে সাক্ষ্যপ্রদান করতে হবে।”
তীর্থযাত্রা শেষ করে তারা তাদের দেশে ফিরে গেলেন। ব্রাহ্মণ বিদ্যানগরে ফিরে এসে চিন্তায় পড়ে গেলেন। ভাবাবেশে দেওয়া প্রতিজ্ঞা পূরণ করতে গেলে পরিবার-সমাজ তাকে ত্যাগ করবে, না করলে নিজে প্রতিজ্ঞাভঙ্গের দায়ে নরকগামী হবেন। দুশ্চিন্তায় তিনি ব্যাকুল হয়ে পড়লেন। একপর্যায়ে বৃদ্ধ তার স্ত্রী, পুত্র, কন্যাকে ডেকে সব কথা খুলে বললেন। বৃদ্ধের ছেলে তার কথা শুনে গর্জে উঠল। স্ত্রী কাঁদা শুরু করল। আত্মীয়-স্বজনরা এসে বলে গেল,
“ধন নেই তাতে কী? সমান সমান কূল এবং সুপাত্র হলেই হলো। কিন্তু সে তো আমাদের চেয়ে নিচু জাতের ব্রাহ্মণ। তার সাথে তুমি কন্যার বিবাহ দিলে আমরা তোমার সাথে সবরকম সম্পর্ক ছেদ করব।”
বৃদ্ধ পড়লেন ধর্মসংকটে। আবেগে করা প্রতিজ্ঞার জন্য আপনজন পর হয়ে গেল। বৃদ্ধ ঠাকুরঘরে ঢুকে নিজেকে বন্দী করে ফেললেন। যে গোপালের সামনে তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, সেই গোপালের মূর্তির সামনে বৃদ্ধ কান্না জুড়ে দিলেন। ঈশ্বরের নিকট এ ধর্মসংকট থেকে উদ্ধার করতে অনেক কাকুতি-মিনতি জানালেন। এর কয়েক সপ্তাহ পড়েই যুবক ব্রাহ্মণটি এসে হাজির। তিনি পুরোদমে বিয়ের প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিলেন। বৃদ্ধকে দেখে প্রণাম করে বললেন,
“ব্রাহ্মণদেব, বিলম্বের জন্য ক্ষমা চাচ্ছি। আমি পুরো তৈরি হয়েই এসেছি। এখন শুভদিন দেখে আপনি আপনার প্রতিজ্ঞা পূরণ করুন।”
কিন্তু তখন বৃদ্ধ আর রাজি হলেন না। বৃদ্ধের অসম্মতি দেখে যুবক আশ্চর্য হয়ে বললেন,
“ঈশ্বরের মূর্তির সামনে করা প্রতিজ্ঞা একজন ব্রাহ্মণ হয়ে কীভাবে ভঙ্গ করতে পারেন আপনি!”
যুবকের চিৎকার শুনে বৃদ্ধের বড় ছেলে একটি লাঠি নিয়ে তেড়ে এলো। যুবকও ছাড়বার পাত্র নন। তিনি দৌড়ে গ্রামের সবাইকে জড়ো করল। সালিশ বসল।
যুবক পঞ্চায়েতবর্গকে বললেন,
“শুনুন আপনারা। আপনারাই এ অন্যায়ের বিচার করুন। দীর্ঘদিন আমি এই ব্রাহ্মণের পদসেবা করেছি। আমার একাগ্রতায় মুগ্ধ হয়ে তিনি বৃন্দাবনে গোপালের মূর্তির সামনে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে আমার সাথে এর কন্যাকে বিয়ে দেবেন। এখন আমি এসেছি। কিন্তু তিনি কন্যাদান করতে রাজি হচ্ছেন না।”
সব শুনে তারা যুবকের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করল। এমন সময় বৃদ্ধের বড় ছেলে সবাইকে লক্ষ্য করে বলল,
“এই যুবক মিথ্যা কথা বলছে। আসলে সে একজন জোচ্চোর। আমার বাবা বরাবরই খোলা মনের মানুষ। তিনি ট্যাঁকে প্রচুর অর্থকড়ি গুঁজে তীর্থযাত্রায় বেরিয়েছিলেন। এই যুবক তার সেবা করেছে ঠিকই, কিন্তু টাকাকড়ি সব ঝেড়ে দিয়েছে। তাতেও এর মন ভরেনি। আমার বাবাকে ধুতরোর বীজ খাইয়ে ভারসাম্যহীন করে এমন কথা আদায় করিয়েছে। এখন এসেছে তার বাকি পরিকল্পনা পূরণ করতে।”
গ্রামবাসীদের কেউ কেউ তখন যুবকটিকে সন্দেহের চোখে দেখল। বৃদ্ধের বড় ছেলে যুবকটিকে বলল,
“প্রতিজ্ঞা যখন ঈশ্বরের সামনে করেছ, তখন আর কী করা। সাক্ষী তো একমাত্র গোপাল স্বয়ং। যদি গোপাল এসে সাক্ষী দিতেন, তখন বোঝা যেত- তুমি সত্য কথা বলছ।”
যুবক কোনো প্রমাণ পেশ করতে না পেরে পঞ্চায়েতকে বললেন,
“ঠিক আছে। আমি কায়মনে ঈশ্বরের সেবা করেছি। আমার মান তিনিই রক্ষা করবেন। ঈশ্বর এসে সাক্ষ্য দিলে যখন আপনারা বিশ্বাস করবেন, তখন আমি গোপালকেই নিয়ে আসব।”
এই কথা বলে যুবক তখনই বৃন্দাবনের দিকে হাঁটা ধরলে বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ ও তার পরিবার হাফ ছেড়ে বাঁচল। বড় ছেলে তার বাবাকে বলল,
“কারোর ডাকে কোনোদিনও পাথরের মূর্তি কথা বলবে না। আর বললেও বৃন্দাবন থেকে এতদূর হেঁটে আসবে না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, বাবা। আপদ গেছে।”
তবুও ব্রাহ্মণ মনে শান্তি পেলেন না।
যুবক দীর্ঘ পদযাত্রার পরে গোপালের মন্দিরে এসে পৌঁছালেন। মন্দিরে পৌঁছে গোপালের পায়ে লুটিয়ে পড়ে কান্নাকাটি জুড়ে দিলেন। হঠাৎ, তার মনে হলো, পাথরের মূর্তি থেকে কেউ কথা বলছেন। মুখ তুলে তিনিও কথার উত্তর দিলেন। মূর্তি বললেন,
“আমি জানি, তুমি কী চাও। তোমার মনের বাসনা পূর্ণ হবে। তুমি বিদ্যানগরে ফিরে গিয়ে ওদের সবাইকে জড়ো করো আবার। আমি তোমার পক্ষে সাক্ষী দেব।”
যুবক বললেন,
“প্রভু, তুমি চার হাতওয়ালা বিষ্ণুর রূপে দেখা দিলেও ওরা বিশ্বাস করবে না। গোপালের মূর্তির সামনে যখন প্রতিজ্ঞা হয়েছে, তখন গোপালের মূর্তিকেই সাক্ষ্য দিতে হবে।”
মূর্তি বললেন,
“সে কী কথা! গোপালশূন্য হয়ে গেলে এ মন্দিরের কী হবে?”
যুবক আবার লুটিয়ে পড়ে বললেন,
“সে তুমি ভালো জানো। আমার মান তোমার হাতে, প্রভু। তুমি না গেলে ওরা সবাই আমাকে মিথ্যাবাদী ভাববে।”
মূর্তি তখন বললেন,
“তা-ই হবে। তবে একটি কথা। তুমি সামনে সামনে যাবে, আমি তোমার পেছন পেছন চলব। প্রতিদিন এক সের চালের ভাত রেঁধে আমায় খাওয়াতে হবে। আর, কখনো পেছন ফিরে তাকাতে পারবে না। পেছনে তাকালে আমি সেখানেই দাঁড়িয়ে যাব। আর এগোব না।”
গোপালের মূর্তির কথায় যুবক খুব খুশি হলেন। সবগুলো শর্ত মেনে নিলেন তিনি। শেষে বললেন, “প্রভু, পেছনে যখন তাকাতে পারব না, তাহলে কীভাবে বুঝব, তুমি আমার পেছন পেছন আসছ?” তখন গোপাল বললেন, “আমি আমার পায়ে নুপুর পরে নিলাম। এই নুপুরের শব্দে তুমি বুঝতে পারবে, আমি তোমার সাথেই চলছি।” যুবক আনন্দিত হয়ে চলা শুরু করলেন। মূর্তিরূপী গোপালও তার পিছু নিলেন। যুবকটি প্রতিদিন সবচেয়ে ভালো চালের ভাত রেঁধে গোপালের মূর্তিকে খেতে দিলেন। একবারও পেছনে তাকালেন না।
হাঁটতে হাঁটতে তারা বিদ্যানগরের সন্নিকটে চলে এলেন। এমন সময় গোপালের মূর্তি তার পায়ের নুপুর চেপে ধরলেন। নুপুরের আওয়াজ না পাওয়ায় যুবক ব্যাকুল হয়ে পেছনে চাইতেই দেখলেন, গোপালের কৃষ্ণমূর্তি সেখানেই দাঁড়িয়ে গেছেন এবং তার দিকে তাকিয়ে হাসছেন। মূর্তিটি বললেন, “আমি এখানেই রইলাম। তুমি গিয়ে ওদের সবাইকে ডেকে আনো।” যুবক দৌড়ে গ্রামের সবাইকে ডেকে আনলেন। খবরটি খুব দ্রুত রটে গেল। সবাই সাক্ষীদাতা গোপালকে দেখতে এলো। গোপাল চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকেই সাক্ষ্য দিলেন যে যুবক বিপ্র সত্য কথা বলছে।
বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ ও তার পরিবার তাদের ভুল বুঝতে পারল। যুবকের সাথে তিনি তার কন্যার বিয়ে দিলেন। এর কিছুদিনের মধ্যে সেখানকার রাজা সাক্ষীগোপালের মূর্তির চারদিকে একটি মন্দির বানিয়ে দিলেন। পরবর্তী সময়ে উড়িষ্যার রাজা তামিলনাড়ু জয় করলে তিনি সাক্ষীগোপালের মূর্তিকে উড়িষ্যায় এনে প্রতিষ্ঠিত করেন। বর্তমানে সাক্ষী গোপাল মন্দিরটি উড়িষ্যার কটকনগরে অবস্থিত। আর এভাবেই, ‘সাক্ষী গোপাল’ কথাটির প্রচলন হয়েছিল।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই গল্পগুলোর প্রেক্ষাপট, ঘটনাক্রম, চরিত্র, প্রতিবেশ প্রভৃতি বিষয়ে অল্পবিস্তর মতভেদ থাকতে পারে। তবে, গল্প বর্ণনার ক্ষেত্রে সর্বাধিক প্রচলিত কাহিনীটিই অনুসরণ করা হয়েছে। কোনো ধর্ম, বর্ণ এবং মতবাদকে কোনোরূপ কটূক্তি, কটাক্ষ বা অপমানের অভিপ্রায়ে এ লেখাটি রচিত হয়নি।