প্রাচীন মিশরের অন্যতম পরিচিত একটি প্রতীক হলো ‘আই অফ হোরাস’ বা হোরাসের চোখ। ‘ওয়াডজেট’ নামেও পরিচিত এটি। মিশরীয় বহু প্রাচীন শিলালিপি, চিত্রকর্ম, পুঁথি কিংবা পিরামিডের দেয়ালে এই প্রতীক লক্ষ্য করা যায়। মিশরীয়দের বিশ্বাস, এই প্রতীক খারাপ কোনো কিছু থেকে সুরক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুনর্জীবন লাভে সাহায্য করে। এর শক্তিশালী সুরক্ষা ক্ষমতার কারণে প্রাচীন মিশরবাসীদের মধ্যে কবচ আকারে এটি বিপুল পরিমাণে ব্যবহৃত হতো। শুধু প্রাচীন মিশরেই নয়, বর্তমানে এখনো পর্যন্ত এটি সুরক্ষার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কিন্তু একটি চোখের প্রতীক কিভাবে সুরক্ষা দেবে? কিভাবেই বা এই রহস্যময় প্রতীকের উৎপত্তি হলো? চলুন আজকে জেনে নেয়া যাক এসব প্রশ্নের উত্তর।
হোরাসের চোখের উৎপত্তি খুঁজতে আমাদেরকে জানতে হবে মিশরীয় দেবতা ওসাইরিস ও সেটের গল্প। প্রাচীন মিশরীয় পুরাণ অনুসারে, ওসাইরিস ছিলেন মিশরের রাজা এবং আইসিস তার রানী। তাদের পিতা হলেন পৃথিবীর দেবতা গেব ও মাতা আকাশের দেবী নাট। ওসাইরিসের ভাইয়ের নাম ছিল সেট। মিশরের রাজসিংহাসনের প্রতি তার ছিল তীব্র লোভ। ফলে কিভাবে ওসাইরিসকে হত্যা করে রাজসিংহাসন দখল করা যায় তা নিয়েই সবসময় মগ্ন থাকতো সেট। অবশেষে নানা চিন্তাভাবনার পর তিনি চমৎকার একটি বুদ্ধি বের করেন।
ইথিওপিয়ার রানীর সহায়তায় ওসাইরিসের দেহের মাপে চমৎকার একটি সিন্দুক নির্মাণ করেন তিনি। এরপর সেট এক বিশাল ভোজের আয়োজন করে ওসাইরিসকে সেই ভোজে নিমন্ত্রণ করেন। সেটের ৭২ জন বন্ধু ও সহযোগীকেও নিমন্ত্রণ করা হয় এই ভোজে। ভোজের সুস্বাদু খাবার আর মদ পানে যখন সবাই মগ্ন তখন সেট সেই কক্ষে সিন্দুকটি নিয়ে আসেন।
সিন্দুকের কারুকার্য দেখে মুদ্ধ হন উপস্থিত সবাই। এবার সেট ঘোষণা দেন, এই সিন্দুকটির মধ্যে শোয়ার পর যার দেহের সাথে এটি মাপসই হবে তাকেই এটি উপহার দেয়া হবে। যেহেতু ওসাইরিসের মাপেই সিন্দুকটি তৈরি করা হয়েছিল সেহেতু ওসাইরিস সিন্দুকের মধ্যে ঢুকলেই সেটি তার শরীরের মাপের সাথে সঠিক ভাবে মিলে যায়। ফলে পুরষ্কার হিসেবে সেটি ওসাইরিসকে দিয়ে দেয় সেট। তবে যখনই ওসাইরিস সেই সিন্দুকে প্রবেশ করেন তখনই সিন্দুকের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয় এবং ওসাইরিস সহ সেই সিন্দুকটি নিক্ষেপ করা হয় নদীতে। ফলে মৃত্যু হয় ওসাইরিসের।
এই ঘটনার পর ওসাইরিসের স্ত্রী আইসিস তার স্বামীর মৃতদেহ খুঁজে বের করেন। এরপর তিনি জাদুবিদ্যার মাধ্যমে সাময়িকভাবে তার স্বামীর জীবন ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন এবং তার সাথে মিলিত হন। ফলে গর্ভবতী হন আইসিস এবং জন্ম হয় তাদের পুত্র হোরাসের।
নির্দিষ্ট সময় পর ওসাইরিস অধোলোকের দেবতা হয়ে সেখানে চলে যান এবং আইসিস একাই তাদের পুত্রকে লালনপালন করতে থাকেন। হোরাস বড় হওয়ার পর তার পিতার হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ খুঁজতে থাকে। একসময় তার চাচা সেটের সাথে হোরাসের কয়েক দফা যুদ্ধ হয় এবং শেষমেশ হোরাস সেটকে পরাজিত করেন। তবে দীর্ঘ এই যুদ্ধে হোরাস তার একটি চোখ হারান।
কিভাবে হোরাস তার চোখ হারান সেটি নিয়ে দুটি গল্প প্রচলিত রয়েছে। একটির মতে, হোরাসের চাচা সেট তার একটি চোখ উপড়ে নেন এবং এটিকে ছয় টুকরা করে ফেলে দেন। আরেকটি গল্প অনুসারে, মৃত পিতাকে পুনর্জীবন দানের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ হিসেবে হোরাস নিজেই তার চোখটি উপড়ে ফেলেন। তবে যেভাবেই হোক না কেন, পরবর্তীতে হোরাসের হারিয়ে ফেলা সেই চোখ আবার জাদুর মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। আর এই কাজ করেছিলেন হোরাসের সঙ্গিনী হাথোর নয়তো জ্ঞানের দেবতা থোট।
যেহেতু জাদুবিদ্যার মাধ্যমে হোরাসের সেই চোখটি ফিরিয়ে আনা হয়েছিল তাই প্রাচীন মিশরবাসী বিশ্বাস করতেন এই চোখটির নানা রকম আরোগ্য ক্ষমতা রয়েছে। আর এই বিশ্বাস থেকেই হোরাসের চোখের প্রতীকটি হয়ে উঠে এত জনপ্রিয়। সেসময় স্বর্ণ, নীলকান্তমণি, মূল্যবান পাথর সহ নানা ধরনের বস্তুতে এই প্রতীক অঙ্কন করে কবচ তৈরি করা হতো এবং তা অলংকার হিসেবে ব্যবহৃত হতো। মৃতদেহ সাজতেও এই অলংকারের ব্যবহার ছিল লক্ষ্যণীয়।
তবে হোরাসের চোখ যে শুধুই এক জাদুকরী প্রতীক ছিল তা কিন্ত নয়। এই প্রতীকের পেছনে রয়েছে প্রাচীন মিশরের বিখ্যাত সব গণিতজ্ঞের অবদান। লোককাহিনী অনুসারে, হোরাসের চোখ উপড়ে ফেলার পর তা ছয় ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। আর প্রতীক হিসেবেও তাই হোরাসের চোখের এই প্রতীকটির রয়েছে ৬টি ভাগ। এই ভাগের প্রত্যেকটি অংশ পরিমাপের জন্য এদের রয়েছে নির্দিষ্ট পরিমাণ ভগ্নাংশ মান।
- চোখের ডান অংশের মান – ১/২
- চোখের তারার মান – ১/৪
- চোখের ভ্রুর মান – ১/৮
- চোখের বাম পাশের মান – ১/১৬
- প্রতীকের বাকানো লেজের মতো অংশের মান – ১/৩২
- এবং চোখ থেকে পড়া অশ্রু বিন্দুর মান – ১/৬৪
এই সবগুলো অংশের মান যোগ করলে হয় ৬৩/৬৪, যা অসম্পূর্ণ। এই হারানো একটা অংশ দেবতা থোটের ক্ষমতাকে নির্দেশ করে। আরেকটি মতানুসারে, এই বাদ পড়া অংশটি দ্বারা জগতের কোনো কিছুই যে নিখুঁত নয় তা বোঝানো হয়।
এ তো গেলো প্রতিটি অংশের গাণিতিক পরিমাণ। এবার চলুন দেখা যাক এই প্রতীকের প্রতিটি অংশ কী অর্থ প্রকাশ করে।
হোরাসের চোখের এই প্রতীকের ৬টি অংশের প্রত্যেকটি ভিন্ন ভিন্ন ইন্দ্রিয়ের সাথে সম্পর্কিত। এই প্রতীকে, চোখের ডান পাশের অংশটি কোনো কিছুর গন্ধ নেয়ার অনুভূতির সাথে সম্পর্কিত। যেহেতু এই অংশটি নাকের সবচেয়ে কাছে অবস্থিত সেহেতু এটি নাককেই নির্দেশ করে। প্রতীকের দ্বিতীয় অংশটি হলো চোখের মনি। বোঝাই যাচ্ছে, এ অংশটি দৃষ্টির সাথে সম্পর্কিত। পরের অংশ চোখের ভ্রু চিন্তা-ভাবনাকে নির্দেশ করে। কারণ কোনো কিছু চিন্তা করার সময় এ অংশটির পরিবর্তনই আমরা লক্ষ করি। প্রতীকে চোখের বাম পাশের অংশটি শ্রবণ ক্ষমতাকে নির্দেশ করে। কারণ প্রতীকে এ অংশটি কানের দিকে ইঙ্গিত করছে এবং এটির আকারও বাদ্যযন্ত্রের মতো।
প্রতীকের প্যাঁচানো লেজের মতো অংশটি কিন্তু দেখতে অনেকটা গম কিংবা শস্যদানা থেকে বের হওয়া অঙ্কুরের মতো। ফলে এটি খাদ্য ও আহারকে নির্দেশ করে। সেই সাথে স্বাদ লাভের ইন্দ্রিয়ের প্রতীক এটি। সর্বশেষ অংশ চোখের পানির স্পর্শানুভূতিকে নির্দেশ করে। আবার এটি দিয়ে একটি গাছের ডালকে মাটিতে রোপন করা হচ্ছে এটাও বোঝানো হয়। সুতরাং, প্রতীকের ৬টি অংশ যথাক্রমে গন্ধ, দৃষ্টি, চিন্তা, শ্রবণ, স্বাদ ও স্পর্শ এই ৬টি অনুভূতি বোঝায়। প্রতীকের চোখকে ধরা হয় এ সমস্ত অনুভূতির ইনপুট পয়েন্ট হিসেবে। এসব অনুভূতির সাথেই কিন্তু আমাদের দেহের কার্যকলাপ সম্পর্কিত। আর এর ফলেই প্রাচীন মিশরে এই প্রতীক স্বাস্থ্য ও সুরক্ষার জন্য বহুল ভাবে ব্যবহৃত হতো।
প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা বহুকাল আগেই শেষ হয়ে গেলেও বর্তমান যুগে হোরাসের চোখের ব্যবহার কিন্তু আজও লক্ষ্য করা যায়। এখনো পৃথিবীর বহু দেশে এই প্রতীক নানা আকার ও মাধ্যমে ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলোতে জেলেরা প্রায়ই তাদের নৌকা ও জাহাজের গায়ে হোরাসের চোখের প্রতীক এঁকে থাকেন। সামুদ্রিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার আশায় এটি করা হয়।
এছাড়া বর্তমানে বহু মানুষ অলংকার হিসেবেও এই প্রতীকযুক্ত গহনা পরে থাকেন। সৌন্দর্যের পাশাপাশি অন্যের কুনজর থেকে রক্ষা পাওয়ার আশায় এটি পরেন তারা। এছাড়াও, বিভিন্ন দেশে তরুণ ও যুবকের মধ্যে এই প্রতীক যুক্ত টিশার্ট বহুল প্রচলিত। বিভিন্ন গোপন সংগঠন ও কন্সপিরেসি থিওরিস্টদের মধ্যেও হোরাসের চোখের এই প্রতীক অনেক জনপ্রিয়। তাদের কাছে এই চোখ শুধু সুরক্ষাই নয় বরং ক্ষমতা, জ্ঞান ও মোহের প্রতীক।