পুরাণগুলো রচিত হয়েছিল আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগে। সেই যুগে সাহিত্যের মুখ্যধারা বলতে যা ছিল, তা এই পুরাণই। তাই, তখনকার সভ্যতা-সংস্কৃতির ব্যাপারে জানতে হলে পুরাণে মুখ গুঁজতেই হবে। পুরাণ রচয়িতাগণ ঠিক যে পুরাণ রচনা করেছিলেন, আজকের পুরাণগুলো একদম সে অবস্থায় নেই। যুগান্তরে সেগুলো পরিবর্তিত, পরিমার্জিত, পরিবর্ধিত হয়ে আজকের রূপ পরিগ্রহ করেছে।
অনুবাদের খাতিরেও পুরাণের বিভিন্ন সংস্করণ ভূ তথা ভারতের একেক অঞ্চলে একেক ভাষায় প্রচারিত হয়েছে। সেজন্যে একই প্রসঙ্গে একাধিক পৌরাণিক ঘটনা বা প্রেক্ষাপট বা চরিত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। যারা প্রকৃত রসবোদ্ধা, তারা এ বিষয়গুলো মেনে নিয়েই পুরাণ থেকে রসাহরণ করেন।
বাঙালি ছেলে-মেয়েদের মেঘনাদের সাথে পরিচয় হয় সমাস পড়ার কালে। ‘মেঘনাদ’ মধ্যপদলোপী বহুব্রীহি সমাসের উদাহরণ। ভাঙলে হয়, মেঘের ন্যায় নাদ যার। জন্মের পরে শিশু মেঘনাদের চিৎকার ছিল মেঘের গর্জনের ন্যায়। তাই, নবাগতের নাম রাখা হলো মেঘনাদ। তামিল পুরাণে অবশ্য একে মেঘনাদ না বলে ‘মেঘনাথ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মেঘের নাথ। অর্থাৎ, মেঘের রাজা, যিনি মেঘের রাজ্যের একাধিপতি। মেঘনাদ মেঘের আড়াল থেকে যুদ্ধ করতেন। তাকে পুরাণে অতি উচ্চস্তরীয় একজন যোদ্ধা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
তিনি ‘অতিমহারথী’ শ্রেণীয় বীরের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। মহারথী বলা হয় তাদের, যারা একসাথে দশসহস্র সৈন্যের মোকাবিলা করতে পারেন। মেঘনাদ একসাথে বারোজন মহারথীর সাথে যুদ্ধ করতে সক্ষম ছিলেন বলে তাকে ‘অতিমহারথী’ বলা হতো। পূর্বের একটি পর্বে মেঘনাদের জন্মকালে গ্রহদের অবস্থানের ব্যাপারে রাবণের গৃহীত পদক্ষেপ নিয়ে বলা হয়েছে। এখানে তাহলে তার জীবনের অন্য ঘটনাগুলো উল্লেখ করা যাক।
মেঘনাদের অন্যান্য নামের মধ্যে একটি নাম ‘কানীন’। ‘কানীন’ অর্থ, কুমারী মায়ের গর্ভজাত সন্তান। সমুদ্রমন্থনে মধুরা (কোথাও আছে সুলক্ষণা) নামীয় এক সুন্দরী নারীর উদ্ভব হয়েছিল। কেউ বলেন, তিনি অপ্সরা ছিলেন। কারো বা রয়েছে ভিন্নমত। তাকে শিবপত্নী পার্বতী সখী হিসেবে গ্রহণ করে কৈলাসে নিয়ে যান। পার্বতীর সখী হয়ে কৈলাসে বেশ আমোদেই দিন কাটছিল তার। একদিন স্নানশেষে পার্বতী তাকে শুকনো বস্ত্র আনতে অন্দরে পাঠালে শিব তার সাথে রমণে লিপ্ত হন।
উত্তর রামায়ণ অনুসারে– মধুরা বস্ত্র আনতে নয়, শিবকে পুজো করতে অন্দরে প্রবেশ করেছিলেন। মধুরা শিবকে বাধা দিতে ভয় পান, আবার সখীপতির সাথে এহেন রতিক্রিয়ায় মিলিত হতেও কুণ্ঠাবোধ করেন। শিব একটি বর দিয়ে তাকে এ অবস্থা থেকে মুক্তি দান করেন। শিব বর দেন যে, বিয়ের পরেই তার গর্ভসঞ্চার হবে এবং একটি বীর্যবান পুত্রের জন্ম দেবেন তিনি। মধুরা মহাদেবকে প্রণাম করে বস্ত্র নিয়ে পার্বতীর কাছে গেলে পার্বতী সব জানতে পেরে তাকে অভিশাপ দেন। দেবীর অভিশাপে মধুরা ব্যাঙে পরিণত হন।
বারো বছর পরে তার ব্যাঙদশার অবসান হয় এবং অসুররাজ ময় ও তার পত্নী হেমা তাকে পুত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন। মধুরার নতুন নাম হয় মন্দোদরী। পরে, রাবণের সাথে তার বিয়ে হয়। রাবণ-মন্দোদরী দম্পতির প্রথম পুত্র মেঘনাদ।
মেঘনাদ পুরাণে বর্ণিত একমাত্র যোদ্ধা যার অস্ত্রভাণ্ডারে একইসাথে ব্রহ্মাস্ত্র, বৈষ্ণবাস্ত্র ও পাশুপতাস্ত্র ছিল। যুদ্ধকলা, সৈন্যসমাবেশ, রণনীতি প্রণয়ণ, সাহস ও শৌর্যে মেঘনাদ প্রকৃতই রাবণের উত্তরাধিকারী ছিলেন। মেঘনাদকে যুদ্ধশিক্ষা দিয়েছিলেন অসুরগুরু শুক্রাচার্য। পিতার ন্যায় যুদ্ধংদেহী মনোভাবের দরুণ ত্রিলোকের বিভিন্ন রাজ্য আক্রমণ করে সেগুলো রাক্ষস রাজ্যভুক্ত করতেন তিনি। একবার নাগলোক আক্রমণ করে শেষনাগকে পরাজিত করে তার কন্যা সুলোচনাকে বিয়ে করে লঙ্কায় নিয়ে আসেন মেঘনাদ। মেঘনাদের এ আচরণে শেষনাগ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে অভিশাপ দেন।
পরবর্তীকালে শেষনাগই রামের ভাই লক্ষ্মণ হয়ে জন্মে মেঘনাদের বিনাশ করেছিলেন। মেঘনাদ দেবী মহামায়ার আরাধনা করে দেবীর আশীর্বাদে মায়াবিদ্যা লাভ করেন। পুরাণ এবং রামায়ণে মেঘনাদকে একজন মায়াবী যোদ্ধা হিসেবেই উপস্থাপন করা হয়েছে। মায়া সৃষ্টি করে শত্রুর মনোবল ভেঙে দিয়ে তার দুর্বলতম স্থানে আঘাত করে তাকে ধরাশায়ী করার প্রবণতা দেখা যায় মেঘনাদের মধ্যে। রাবণ স্বর্গ আক্রমণ করলে তার জেষ্ঠ্যপুত্র তার সঙ্গী হন। যুদ্ধের শুরুতে দেবতারা অসুরদের পাত্তা না দিলেও কয়েক দণ্ডের ভেতর পুরো স্বর্গলোক অসুরদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। অসুরদের থামাতে ইন্দ্র বজ্রাস্ত্র প্রয়োগ করেন। এতে অনেক অসুরসেনা প্রাণ হারায়।
ইন্দ্রের পুত্র জয়ন্ত রথ নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করলে মেঘনাদের সাথে তার দ্বন্দ্ব হয়। যুদ্ধে মেঘনাদের অস্ত্রের প্রকোপে জয়ন্ত আহত ও অচেতন হয়ে পড়েন। কেউ কেউ বলেন, সে যুদ্ধে জয়ন্ত প্রাণ হারিয়েছিল। জয়ন্তকে ইন্দ্রের শ্বশুর পুলোমা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তুলে রথে চড়িয়ে অন্দরমহলে নিয়ে যান। অমৃত পান করেও দেবরাজের পুত্র একজন অসুরের অস্ত্রে অচেতন হয়ে পড়েছেন বা প্রাণ হারিয়েছেন– এমন সংবাদ চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে দেবসেনারা আত্মবিশ্বাস হারিয়ে পালানো শুরু করে। পুত্রশোকে ইন্দ্র রাবণের রথের ওপর বজ্র প্রয়োগ করলে অসুররাজ রথ থেকে ভূমিতে পড়ে যান।
মেঘনাদ পিতার আত্মাভিমান রক্ষা করতে ইন্দ্রকে আক্রমণ করেন। দু’জনের ভীষণ লড়াই হয়। ইন্দ্র পরাজিত হন। তাকে মায়াশিকল দিয়ে বেঁধে রাবণের সম্মুখে হাজির করা হয়। মেঘনাদ ইন্দ্রকে লঙ্কায় নিয়ে যান। লঙ্কাবাসী দেবরাজের এ দশা দেখে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে। এক বছর ইন্দ্রকে লঙ্কায় বেঁধে রাখা হয়। রামায়ণ বলে, অহল্যাকে ধর্ষণের শাস্তিস্বরূপ ইন্দ্রের ঐ দশা হয়েছিল। এক বছর পরে দেবতাদের অনুরোধে ব্রহ্মদেব লঙ্কায় অবতরণ করেন।
তিনি মেঘনাদ ও রাবণকে আশীর্বাদ করেন। লঙ্কাবাসীর সামনে ব্রহ্মদেব মেঘনাদের নতুন নামকরণ করেন, ‘ইন্দ্রজিৎ’। ব্রহ্মদেবের অনুরোধে ইন্দ্রজিৎ ইন্দ্রকে মুক্ত করেন। ব্রহ্মদেব মেঘনাদের মহানুভবতায় সন্তুষ্ট হয়ে তাকে বর দেন। ইন্দ্রজিৎ অমরত্বের বর চাইলে ব্রহ্মা হেসে তার কাঁধে হাত রেখে বলেন, “তুমি আমাকে তোমার খুব ব্যক্তিগত একটি স্থানে নিয়ে যাও”। ইন্দ্রজিৎ তাকে নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে নিয়ে যান। ব্রহ্মা নিকুম্ভিলার অগ্নিকে আশীর্বাদ করে বলেন,
“যেকোনো যুদ্ধের পূর্বে এই যজ্ঞাগারে তুমি দেবী প্রত্যঙ্গিরার (নিকুম্ভিলার প্রতিষ্ঠিত দেবী তথা লঙ্কার পূজিত দেবীগণের একজন) পূজো করলে এ অগ্নির ভেতর থেকে একটি দিব্যরথ বেরোবে। সেটিতে চড়ে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হলে তুমি হবে অজেয়।”
ব্রহ্মার বরে মেঘনাদ অজেয় হলেন ঠিকই, কিন্তু একদম অমর হলেন না। মেঘনাদের বরে আরেকটি বিষয় ছিল। সেখানে মেঘনাদের হত্যাকারীর গুণগুলো উল্লেখ করা হয়। চৌদ্দ বছর নিদ্রা, স্ত্রীসঙ্গ থেকে বিরত কোনো শৌর্যশালী মানবই মেঘনাদকে হত্যা করতে পারবে। একমাত্র লক্ষ্মণের ভেতর সেই গুণগুলো বিরাজমান ছিল।
মেঘনাদের জয়ের ঝুলি পিতা রাবণের মতোই ভারি। সীতার খোঁজ আনতে হনুমান লঙ্কায় প্রবেশ করেন। খুঁজতে খুঁজতে একসময় অশোকবনে সীতার সাথে তার সাক্ষাৎ হয়। হনুমানের আগ্রাসনে অশোকবনের রাক্ষসীরা ভয় পেয়ে রাবণকে খবর দেয়। হনুমানকে ধরাশায়ী করতে রাবণ প্রথমবার তার পুত্র অক্ষয়কুমারকে প্রেরণ করেন। অক্ষয় হনুমানের হাতে নিহত হলে মেঘনাদ ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে আসেন। হনুমানের সাথে যুদ্ধে এঁটে উঠতে না পেরে মেঘনাদ হনুমানের উপর ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করেন। দেবতাদের বরে হনুমান ব্রহ্মাস্ত্রের প্রকোপ থেকে রক্ষা পেলেও অচেতন হয়ে পড়েন। তাকে বেঁধে রাবণের সম্মুখে হাজির করা হয়।
রাম-রাবণের যুদ্ধে মোট তিনদিন মেঘনাদ যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। রামের হাতে পিতৃব্য কুম্ভকর্ণের মৃত্যুর পর রাবণ মেঘনাদকে প্রেরণ করেন। প্রথমদিনের যুদ্ধে মেঘনাদের প্রকোপে অনেক বানরসেনা নিহত হয়। এদিন তিনি রাম-লক্ষ্মণকে নাগপাশে আবদ্ধ করেন। মেঘনাদের অস্ত্রের প্রভাবে রামশিবির নাগেরা ছেয়ে ফেলে। তখন গরুড় এসে রাম-লক্ষ্মণকে উদ্ধার করেন। গরুড়ের সাথে নাগদের দ্বন্দ্ব বহু আগের। সে গল্প অন্যদিন হবে।
দ্বিতীয় দিনের যুদ্ধে মেঘনাদের শক্তিশেলের আঘাতে লক্ষ্মণের অচেতন হয়ে পড়া, হনুমান কর্তৃক বৈদ্য ও জড়িবুটি নিয়ে আসা এসব আগের একটি পর্বেই বলা হয়েছে। তৃতীয়দিনের যুদ্ধে লক্ষ্মণকে জীবিত দেখে মেঘনাদ আশ্চর্যান্বিত হন। এদিনও ভয়ানক যুদ্ধ হয়। যুদ্ধক্ষেত্রে মেঘনাদ মায়াসীতা তৈরী করে বানরদের সামনে তাকে হত্যা করলে বানর শিবিরে হাহাকার সৃষ্টি হয়। সুযোগমতো মেঘনাদ নিকুম্ভিলায় ঢুকে যজ্ঞ শুরু করলে বিভীষণ পথ দেখিয়ে এবং পরামর্শ দিয়ে লক্ষ্মণকে ও বানরদের নিকুম্ভিলাতে নিয়ে আসে।
মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’টির বদৌলতে বাংলাভাষীদের কাছে মেঘনাদ খুবই পরিচিত নাম। মাইকেল মেঘনাদকে জাতীয় বীরে পরিণত করেছেন। মাইকেলের ‘মেঘনাদবধ’ মূল রামায়ণের সাথে সর্বাংশে এক নয়। মাইকেল নিকুম্ভিলাতে নিরস্ত্র অবস্থায় লক্ষ্মণের হাতে মেঘনাদের পতন দেখালেও রামায়ণ গাইছে খানিকটা ভিন্ন সুর। রামায়ণানুসারে, নিকুম্ভিলার বাইরে সশস্ত্র সংগ্রামে লক্ষ্মণের হাতে মেঘনাদ প্রাণ হারিয়েছিলেন। লক্ষ্মণ ইন্দ্রপ্রদত্ত অঞ্জলিকাস্ত্র প্রয়োগ করে মেঘনাদকে বধ করেন। একই অস্ত্রের দ্বারা মহাভারতে অর্জুন কর্ণকে বধ করেছিলেন।
মেঘনাদের হত্যার খবর শুনে রাবণ ক্রোধে ও ক্ষোভে ফেটে পড়েন। পুত্রের সৎকার সম্পন্ন করে যুদ্ধক্ষেত্রে রাক্ষসদের পক্ষে তিনি স্বয়ং নেতৃত্ব দেন। রাবণ আরেকবার লক্ষ্মণকে শক্তি অস্ত্রের দ্বারা ঘায়েল করেন। সেবার রাম পরলোকে গিয়ে পিতা দশরথের কাছ থেকে তার প্রতিকার নিয়ে এসে লক্ষ্মণকে বাঁচিয়েছিলেন।
মধুসূদন দত্তের মেঘনাদ এবং বাল্মিকীর মেঘনাদ পুরোপুরি এক নয়। মেঘনাদ নায়ক না খলনায়ক- সেটি যুগান্তরে প্রজন্মের একেকজন ভাবুকের দ্বারা একেকভাবে নির্ধারিত হবে। ভক্তিযুগে খলনায়ক থাকলেও আধুনিক যুগে মেঘনাদ নায়ক হিসেবে বিধৃত হয়েছেন। মেঘনাদের অবস্থান নিয়ে তর্ক থাকলেও তার পরাক্রম নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সবাই একবাক্যে স্বীকার করেন, মেঘনাদ ছিলেন শৌর্যে-বীর্যে প্রকৃত রাবণি।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: এ গল্পগুলোর প্রেক্ষাপট, ঘটনাক্রম, চরিত্র, প্রতিবেশ প্রভৃতি বিষয়ে অল্পবিস্তর মতভেদ থাকতে পারে। তবে, গল্প বর্ণনার ক্ষেত্রে সর্বাধিক প্রচলিত কাহিনীটিই অনুসরণ করা হয়েছে। কোনো ধর্ম, বর্ণ এবং মতবাদকে কোনোরূপ কটূক্তি বা কটাক্ষ বা অপমান করার অভিপ্রায়ে এ লেখাটি রচিত হয়নি।