মার্ভেল কমিকে হাতুড়ি হাতে মারমুখী থরের ঝাঁপিয়ে পড়ার দৃশ্য বেশ পরিচিত। সত্যিকার ভাইকিং উপকথায় থরের উপস্থাপন আরো দাপুটে এবং বৈচিত্র্যময়। শক্তি, পৌরুষ, ঝড় এবং বজ্রের অধিপতি হিসাবে নর্স দেবতাদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিধর। নারী এবং যৌনতার সাথে সম্পর্কের দরুন উর্বরতার সাথেও সম্পৃক্ত করা হয়। লাল চুল এবং দাঁড়ি নিয়ে থর অঙ্কিত হয়েছেন পুরোদস্তুর নায়কোচিত ঢঙে। ওদিন কিংবা লোকি যেখানে গোপন এবং ছলনাময়; থর সেই বিপত্তির সামনে সরাসরি হাতুড়ি মিওলনির হাতে দণ্ডায়মান। এজন্যই দেবলোকের শান্তি যখনই ইয়োতুন (উচ্চারণ ‘জতুন’ এর- কাছাকাছি) বা দানবদের দ্বারা বাধাগ্রস্ত হয়; অন্য দেবতারা তাকিয়ে থাকেন থরের দিকে। ভাবটা যেন, “এবার থর, একটা কিছু করো”।
গোড়া থেকেই থর দারুণভাবে জনপ্রিয়। ঠিক প্রথম খ্রিস্টাব্দ থেকেই নর্স পুরাণে তার উপস্থিতির নজির মেলে। পরবর্তী সময়ে গোটা ভাইকিং জমানা পার হয়েও জার্মানিক ভাষাগোষ্ঠীর সংস্কৃতির লোককথায় দাপটের সাথে টিকে আছেন থর।
বজ্রদেবতা থর
প্রাচীন নর্স শব্দ থর আর প্রাচীন স্যাক্সনে থানার; যার অর্থ থান্ডার বা বজ্র। এটিই নির্দেশ করে প্রাকৃতিক ঘটনাবলিতে থরের নিয়ন্ত্রণের বিষয়। রোমান ক্যালেন্ডার গ্রহণ করার সময় জার্মানিক সংস্কৃতিতে দিয়েস আয়োভিস বা জুপিটারের দিন পরিবর্তন করা হয় ‘থর’স ডে’ নামের দ্বারা। আধুনিক ইংরেজিতে তা ‘থার্সডে’ হিসাবে টিকে আছে।
থরের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র হাতুড়ি মিওলনির। সেই হাতুড়ির আঘাতে পাহাড় ধসে পড়ে। আগুন জ্বলে ওঠে আকাশে। বজ্র টানা আর শত্রুকে আঘাত করা ছাড়াও বিশেষ ক্ষেত্রে পুনরুত্থিত করতে পারে মৃতকেও। থরের চোখ জ্বলজ্বল করে আগুনের মতো। ইয়ার্নগ্রেইপর নামে লোহার দস্তানা দেখা যায় হাতে। কোমরে থাকে বিশেষ বেল্ট মেগিনগিয়র্দ। যখনই থর তার বেল্ট শক্ত করে বাঁধবেন; শক্তি হয়ে উঠবে দ্বিগুণ। অন্য দেবতাদের মতো তিনি রংধনু সেতু ব্যবহার করলে ধসে পড়বে। তাই দেবতাদের সভায় যোগ দিতে থর প্রতিদিন হেঁটে পার হয়ে আসেন চারটি নদী।
টানগ্রিসনির এবং টাননিয়স্তির নামে দুই ছাগলে টানা রথে চলাফেরা করেন থর। প্রসঙ্গত বলা যায়, থর প্রায়ই ছাগল জবাই করে খান। কেবল দুটি ছাগল মৃত্যুর পর পুনরুত্থিত করেছেন রথ টানার জন্য। শক্তির কারণে যেকোনো যুদ্ধের সুযোগ হাতছাড়া করতে নারাজ থর। দেবতা স্বভাব হলেও ক্রোধমুক্ত না তিনি; মাঝে মাঝে এমন সব ধ্বংসাত্মক কাণ্ড করে ফেলেন, যা পরে ঠিক করতে পারেন না। দয়া-মায়া বিষয়টা খুব কমই আছে। দীর্ঘযাত্রা আর রোমাঞ্চকর অভিযান খুব প্রিয়। অনেক বিবরণীতেই থরের নামের সাথে আতলি (ভয়ানক), বিয়র্ন (ভাল্লুক), এইরিয়ন (একাই একশো), হারদুগাদর (দুঃসাহসী আত্মা) এবং ভিংথর (বজ্রের গর্জন) ইত্যাদি তকমা ব্যবহার করা হয়েছে। ওদিনের মতো দুই সংস্কৃতির সেতুবন্ধন না হয়ে থর ছিলেন যথার্থভাবেই প্রকৃতির অস্থির দিকটার ব্যক্তিরূপ।
পরিবার ও জন্মসূত্র
এসির দেবতাদের প্রধান ওদিনের পুত্র থর। মায়ের নাম ইয়োর্দ (আর্থ)। মা ইয়োতুন বা দানবপক্ষীয় হবার কারণে থরের রক্তে দেব আর দানব মিলিত হয়েছে। ওদিনের বিখ্যাত পুত্র বালদর, ভালি এবং ভিদার তার সৎভাই। ভাইদের মধ্যে আরো আছেন টিয়র, হেইমদ্যাল, ব্র্যাগি এবং হোদর।
পরিণত বয়সে থর বিয়ে করেন সিফকে। সিফ মূলত বিশ্বাস, পরিবার আর উর্বরতার দেবী। সিফের গর্ভে জন্ম নেওয়া থরের কন্যার নাম থুদর; যে পরে ভ্যালকারিতে পরিণত হয়। ভ্যালকারি শব্দটি ভ্যালকারিয়র থেকে আসা। এর দ্বারা নর্স পুরাণে বিশেষ শ্রেণির নারীদের বোঝায়, যুদ্ধক্ষেত্রে মানুষের বাঁচামরার সিদ্ধান্ত নেয়। বিয়ের বাইরে থরের প্রেমিকা দানবকন্যা ইয়ার্নসাক্সা। তার গর্ভে ম্যাগনি নামে এক ছেলে জন্ম নেয়। আরো ঢের প্রেমিকা আছে থরের, যাদের সাথে প্রেম দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তাদের একজনের গর্ভে জন্ম নেয় সন্তান মোদি (সাহস)। অবশ্য বালকের মাকে চিহ্নিত করা হয়নি নর্স পুরাণে।
পুরাণ
নর্স উপকথায় দেবতাদের শৈশব কিংবা পূর্বজীবন নিয়ে তেমন কিছু জানা যায় না। থরও তার ব্যতিক্রম নন। উপকথায় তিনি পুরোদস্তুর ক্ষমতাধর দেবতা হিসাবেই যাত্রা শুরু করেছেন। জার্মান জাতির দেবতার আসীনে কীভাবে থরের উদয় ঘটল; তা স্পষ্ট নয়।
থরের অস্তিত্ব প্রথম পাওয়া রোমান উৎস ধরে। থরকে সেখানে রোমান দেবতা জুপিটারের সাথে তুলনা করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, জুপিটারের কাল্ট আবার গড়ে উঠেছে গ্রিক দেবতা জিউসকে অনুসরণ করে। বিষয়টা অন্য অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়। রোমানরা প্রায়শ মিশর, মেসোপটেমিয়া কিংবা জার্মান দেবতাদেরকে নিজেদের দেবতাদের সাথে সাদৃশ্য দেখিয়ে বর্ণনা করত। কেল্টিক পুরাণে তারানিস এবং বৈদিক পুরাণে ইন্দ্রের মতো ইউরোপ, ভূমধ্যসাগরীয়, এবং দক্ষিণ এশীয় উপকথায় থরের সাদৃশ্যপূর্ণ বজ্রদেবতার সন্ধান পাওয়া যায়। যা-ই হোক, খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দেই ইন্দো-ইউরোপীয় উপাস্য হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন থর এবং তার সমবৈশিষ্ট্যের আর্কিটাইপ।
থরের মিওলনির
স্নোরি স্টারলাসন তার এডা গদ্যে বর্ণনা করেছেন থরের হাতুড়ি মিওলনিরের জন্ম আখ্যান। কূটকৌশল আর অনর্থের দেবতা লোকি একবার থরের স্ত্রী সিফের সোনালি চুল কেটে দেয়। ক্রোধে জ্বলে ওঠা থর লোকিকে ধরে ফেলেন উচিত শিক্ষা দেবার জন্য। হুমকি দেন হাড় ভেঙে দেবার। ভয়ে সংশোধনের প্রতিজ্ঞা করে লোকি, চলে যায় বামন রাজ্য সোয়ারতালফেইমে। নির্মাণের জন্য বামুনরা বিখ্যাত। সেখানে শ্রেষ্ঠ নির্মাতাকে খুঁজে বের করে সিফের জন্য নতুন চুল তৈরি করে দেবার কথা ভাবে লোকি।
বামনভূমিতে লোকি ইভালদির পুত্রদের খুঁজে পায়। তাদের থেকে সিফের জন্য নতুন চুলের পাশাপাশি তৈরি করে নেয় আরো দুটি মহাবস্তু। প্রথমটা স্কিদব্লাদনির নামের জাহাজ, যা কখনো ভাঙবে না এবং দ্বিতীয়টা ভয়ানক বর্শা গুঙনির। লোকি কিন্তু তখনও ফিরল না। বরং এ সুযোগে আরো কিছু হাতিয়ে নেবার ফন্দি আঁটল সে। ব্রোকর এবং সিন্দ্রি নামে দুই বামন সহোদরের কাছে গেল লোকি। তাদের ফুঁসলালো এই বলে যে, “ইভালদির ছেলেদের মতো দারুণ কিছু আর কেউ তৈরি করতে পারবে না”।
অনেকটা বাজি ধরেই এই দুই ভাই তিনটি মহাবস্তু নির্মাণ করে দেখালে। এক সোনালি চুলের শূকর; যা অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে, যেকোনো মাধ্যমে দৌড়াতে পারে এবং গতি ঘোড়ার চেয়ে দ্রুত। একটি স্বর্ণের আংটি দ্রাউপনিরম, যা প্রতি নবমতম রাতে আটটি আংটি বের করে দেয়। আর সর্বশেষ, হাতুড়ি মিওলনির। লোকি আসগার্দে ফিরে আসার পর সিফের কাছে নতুন চুল এবং থরের হাতে মিওলনির তুলে দেয়। অন্যান্য নির্মাণ তুলে দেওয়া হয় ওদিন এবং ফ্রেয়ার হাতে।
থরের নারীরূপ
চমৎকার বহু আখ্যান বর্ণিত হয়েছে থরকে নিয়ে। এডা কাব্যে মিওলনির চুরির গল্পটা একটু ব্যতিক্রম। এক সকালে থর ঘুম থেকে উঠে দেখলেন, তার হাতুড়ি মিওলনির নেই। ঘটনাটা ভয়াবহ। বলতে গেলে আসগার্দের জাতীয় সমস্যা। কারণ, মিওলনির আসগার্দকে বহুবার রক্ষা করেছে এবং করবে। দেবতাদের সাহায্য প্রত্যাশা করেন থর। দেবতারাও একমত হ্যামার খুঁজে বের করতে। দায়িত্ব পড়ল লোকির উপর। লোকি ফ্রেয়ার কাছ থেকে বাজপাখির পালক নিল। এই পালকে নিজের আকৃতি পরিবর্তন করে ফেলা যায়। বাজপাখি হয়ে অনেক খোঁজাখুঁজির পর লোকি টের পেল, মিওলনির দানবরাজা থ্রিমের কাছে।
লোকি আগের আকৃতিতে প্রকাশিত হলো থ্রিমের সামনে গিয়ে। দানবও স্বীকার করল হাতুড়ি চুরির কথা। কিন্তু ফেরত দেবার বিনিময়ে ফ্রেয়াকে বিয়ে করার শর্ত জুড়ে দিল সে। দেবতাদের জন্য এ প্রস্তাব ছিল অগ্রহণযোগ্য। হতাশ লোকি আসগার্দে ফিরে এসে সবাইকে জানাল বিষয়টা। নিরুপায় দেবতারা কেবল ঠোঁট কামড়াচ্ছেন আর মাথা চুলকাচ্ছেন। হঠাৎ বুদ্ধি নিয়ে এল হেইমদ্যাল,“দেবতারা মিলে থরকে কনে সাজিয়ে দেবে। লোকি থাকবে কনের সেবিকা হিসাবে। একবার যদি হাতে মিওলনির চলে আসে, দানবদের উচিত শিক্ষা দিয়ে ফিরে আসবে।” বিষয়টা থর অপমান হিসাবে নিলেন। অন্যান্য দেবতারাও সায় দিলেন না, নারী সেজে কাজ উদ্ধারের কারণে ভবিষ্যতে উপহাস হতে পারে। কিন্তু লোকি পছন্দ করল বুদ্ধিটা। রাজি করাল সবাইকে।
বুদ্ধিমতো থরকে সাজানো হলো ফ্রেয়ার সমস্ত গয়না আর পোশাক দিয়ে। কনের মতো আবৃত করা হলো মুখ। সব প্রস্তুত হলে থর আর লোকি গিয়ে নামলেন দানবরাজ্যে। এবার জমল নাটক। বিশ্বাস করে থ্রিম অতিথিদের ভেতরে নিয়ে খেতে দিলেন। ফ্রেয়ারূপী থর সে সময়েও নিজের পেটকে সামাল দিতে পারলেন না। একটা ষাঁড়, আটটা স্যালমন মাছ আর তিন বোতল মদ সাবাড় করে দিলেন। সবকিছু দেখে থ্রিম তো অবাক। কোনো নারীকে সে এভাবে খেতে দেখেনি।
বিষয়টা আঁচ করতে পেরে লোকি বোঝালো, “আপনার বিরহে কাতর ফ্রেয়া গত এক সপ্তাহ ধরে কিছু খায়নি। এজন্য এমন করে খাচ্ছে।” থ্রিম আশ্বস্ত হলেন জবাবে। উঁকি দিয়ে দেখতে গেলেন কনের চোখ। তার তখন আগুনের মতো জ্বলজ্বল করছে। থ্রিম বিব্রত হলে লোকি আবার বোঝাল, “রাজাকে দেখতে না পেরে গত এক সপ্তাহ ঘুমায়নি ফ্রেয়া। তাই অমন চোখ লাল।”
যথারীতি বিয়ের আয়োজন শুরু হলো। শর্ত মোতাবেক থ্রিম মিওলনিরকে আনিয়ে কনের কোলের উপর রাখলেন। এবার হাসতে হাসতে মিওলনির হাতে নিয়ে ঘোমটা তুলে দাঁড়ালেন থর। এক এক করে সবাইকে মেরে গোটা অনুষ্ঠান লণ্ডভণ্ড করলেন। তারপর বীরদর্পে ফিরলেন লোকিকে নিয়ে।
দানববধে থর
মিওলনির উদ্ধারের ঘটনা থেকেই বোঝা যায়, থর দানবদের ঘৃণা করতেন। দানব রুংনিরের সাথে টানাপোড়েনে সেই ঘৃণার প্রকাশ ঘটে আরো তীব্রভাবে। ওদিন একবার দানবরাজ্য ইয়োতুনহেইমে যান। রুংনির প্রথমে ওদিনকে চিনতে পারেনি। ফলে ওদিনের ঘোড়া নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করে। জবাবে ওদিন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় যে, তার ঘোড়া ইয়োতুনহেইমের যেকোনো ঘোড়াকে দৌড়ে হারাতে সক্ষম। রুংনিরও গ্রহণ করে। দৌড় শুরু হলো ইয়োতুনহেইম থেকে আসগার্দের ফটক অব্দি।
ইতোমধ্যে রুংনির আসগার্দে উপস্থিত হলেন। পানাহাররত দেবতারা তাকে ভেতরে আহবান করে খেতে দিলেন। মদ্যপান করে বেপরোয়া হয়ে গেলো রুংনির। তর্জন গর্জন শুরু করলো বেদম- “ভালহালা উল্টে দেব, আসগার্দ গুঁড়িয়ে দেব, দেবতাদের হত্যা করব, ফ্রেয়া এবং সিফকে উঠিয়ে নিয়ে বিয়ে করব”। তাকে শান্ত করার চেষ্টায় ক্লান্ত হয়ে গেলেন এসির দেবতারা। অবশেষে ডাকলেন থরকে। তিনি তখন পূর্বদেশে দানব শিকার করে অবসর সময় কাটাচ্ছেন। ফিরে এসে রুংনিরকে মারতে উদ্ধত হতেই ধিক্কার শুনলেন, “কেবল কাপুরুষই নিরস্ত্রের গায়ে হাত তোলে”। কথাটা মিথ্যে না। তাই থর তাকে দানবরাজ্যে যাবার সুযোগ দিলেন। সেখানে গিয়ে রুংনির সজ্জিত হলো নানা রকম সমরাস্ত্রে। এবার যুদ্ধ শুরু হলো। রুংনির তার ধারালো পাথর ছুঁড়ে দিল, থর ছুঁড়লেন মিওলনির। মধ্যপথেই পাথর ভেঙে মিওলনির সোজা গিয়ে আঘাত করল দানবের মাথায়। থেঁতলে গেল মাথা।
থর নিজেও আঘাত পেয়ে ফিরেছিলেন। পাথর ঢুকে গিয়েছিল মাথায়। দেবতাদের নার্স গ্রোয়া এসে তার মাথায় ঢুকে থাকা পাথর বের করে আনলে। উৎসাহ দেবার জন্য থর গল্প বলতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু থরের গল্প গ্রোয়াকে আরো দুঃখিত করে; এতটাই যে, রুংনিরের পাথর পুরোটা আর বের করা সম্ভব হলো না। পুরাণমতে, র্যাগনারক অব্দি থর তার মাথায় সেই পাথরের ভাঙা টুকরো নিয়ে ঘুরবেন। যা-ই হোক, আসগার্দে প্রাসাদ নির্মাণ নিয়ে আরো একবার সংঘর্ষ বাঁধে দানব আর দেবতাদের মধ্যে। সেবারেও থর ছুটে এসে থেঁতলে দেন প্রতিপক্ষকে।
ইয়োরমুঙ্গানদর আখ্যান
অনেক কিছুকেই ঘৃণা করেন থর। কিন্তু কোনোটাই বোধ হয় ইয়োরমুঙ্গানদরকে অতিক্রম করবে না। ইয়োরমুঙ্গানদর হলো মিদগার্দ বা মানুষের পৃথিবীতে বসবাস করা এক সাপের নাম। আরো স্পষ্টভাবে বললে, লোকি এবং তার দানবী স্ত্রী আঙ্গরবদার তিন দানবসন্তানের একজন ইয়োরমুঙ্গানদর। বাকি দুজন নেকড়ে ফেনরির এবং পাতালের হেল। ইয়োরমুঙ্গানদরের জন্মের পর ওদিন তাকে মিদগার্দকে ঘিরে থাকা সমুদ্রে নিক্ষেপ করলেন। দানবটা সেখানেই বড় হতে হতে পৃথিবীকে পেঁচিয়ে ফেলে। বৃত্তাকারে নিজের লেজকে মুখে পুরে রাখে। বেনজিন চক্র কিংবা ইউরোবরাসের কথা মনে করা যেতে পারে।
থর বেশ কয়েকবার মুখোমুখি হয়েছেন ইয়োরমুঙ্গানদরের। দানব হিমিরের কাছে এমন একটা কড়াই ছিল, যাতে সকল দেবতাদের জন্য মদ প্রস্তুত করা যায়। থরের কানে সে খবর গেলে তিনি অনুসন্ধানে বের হন। হিমিরকে খুঁজে পেতে খুব একটা কষ্ট হলো না। যা-ই হোক, হিমির থরকে নিয়ে সমুদ্রে গেল মাছ ধরতে। সে কয়েকটা তিমি ধরতে পারলেও থরের কাছে কোনো মাছ ধরা দিল না, বরং আটক হলো ইয়োরমুঙ্গানদর। থর সাপটাকে নৌকার পাটাতনে আছড়ে ফেলে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করলেন। তাতে আহত হলেও মরল না সাপটা, পালিয়ে গেল। এ গল্পের সমাপ্তিতে হিমির থরকে আঘাত করতে আসে। থর টের পেয়ে পাল্টা আঘাত করে হিমিরকে হত্যা করেন।
ইয়োরমুঙ্গানদর ফের ফিরে গেছে সমুদ্রে। যেদিন সে নিজের লেজকে মুখ থেকে বের করে ভূমিতে উঠে আসবে; সে মুহূর্ত থেকেই র্যাগনারকের শুরু। সেদিন তার সাথে যোগ দেবে ভাই ফেনরির। ফেনরির পৃথিবীতে আগুন জ্বালাবে আর ইয়োরমুঙ্গানদর বাতাসে মিশিয়ে দেবে বিষ। অবশেষে মুখোমুখি হবে থর আর ইয়োরমুঙ্গানদর। তাকে হত্যা করার পরে থর নিজেও তার বিষের দরুন মৃত্যুমুখে পতিত হবেন সেদিন। এটাই র্যাগনার্কে দেবতা থরের নিয়তি।
শেষের আগে
ভাইকিং যুগের অনেক আগে থেকে পতনের অনেক পর অব্দি থর জার্মান ভাষাগোষ্ঠীর কাছে জনপ্রিয় চরিত্র হিসাবে হাজির ছিলেন। গ্রিম ভ্রাতৃদ্বয়ের সংগ্রহে জার্মান লোককথায় তার প্রমাণ পাওয়া যায়। ঊনিশ শতকের দিকে জাতীয়তাবাদের হাওয়া লাগলে নতুন করে উজ্জীবিত হয় থরের আত্মা। উত্তর ও উত্তর পশ্চিম ইউরোপের সংস্কৃতিতে কবি, সাহিত্যিক, চিত্রকরেরা তাকে নিয়ে যান অন্য মাত্রায়।
বিশ ও একুশ শতকে মার্ভেল কমিক বুক এবং মার্ভেল সিনেমাটিক ইউনিভার্সের আবির্ভাবে থর আন্তর্জাতিকতা পেয়েছেন। অবশ্য পুরাণের থরকে কমিক বুকে নেবার সময় নির্মাতারা নিজেদের স্বাধীনতাকে ব্যবহার করে কিছুটা পরিবর্তন করেছেন। যেমন, পুরাণের থর লাল চুল ও লাল দাঁড়ি বিশিষ্ট হলেও মার্ভেলের থর সোনালি চুল ও দাঁড়িওয়ালা। সিনেমাতে থরের রূপে দেখা যায় ক্রিস হ্যামস্ওয়ার্থকে। তবে সবকিছু ছাড়িয়ে একজন নর্স দেবতা পুনরায় যে জেগে উঠেছেন; সেটাই বড় কথা।