বাইবেলের কাহিনীগুলোর অন্যতম টাওয়ার অব বাবেল। জেনেসিসের একাদশ অধ্যায়ের ১-৯ ছত্রে বর্ণিত হয়েছে এই টাওয়ারের গল্প, যার সূচনা মহাপ্লাবনের পরে। বলা হয়, এর অবস্থান ছিল ইউফ্রেটিসের পূর্ব তীরে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, টাওয়ার বলতে আসলে বোঝানো হয়েছে একধরনের ধাপ পিরামিডকে, যা জিগুরাট (ziggurat) নামে পরিচিত। ব্যাবিলোনিয়াতে এমন জিগুরাট প্রাচীনকালে বহু তৈরি হয়েছিল।
নতুন মানবসভ্যতা
বাইবেলের বর্ণনানুযায়ী, মহাপ্লাবন সংঘটিত হয় ২,৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ে। নতুন করে সভ্যতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে মেসোপটেমিয়ায় চলে আসে বেঁচে থাকা মানুষেরা। এখানে নিমরড (Nimrod) নামে এক ব্যক্তি, বাইবেলে যাকে বলা হয়েছে নোয়াহর (ইসলামে নবী হযরত নূহ আ.) সরাসরি বংশধর, একদল লোক নিয়ে বসতি স্থাপন করেন শিনারে (জেনেসিস ১০:৯-১০)। এরা ছিল নির্মাণকাজে দক্ষ। তারা সিদ্ধান্ত নিল এমন এক উঁচু টাওয়ার তারা তৈরি করবে যার মাথা গিয়ে ঠেকবে স্বর্গে।
জেনেসিসে এভাবে বলা হয়েছে, যখন সব মানুষ কথা বলতো একই ভাষায়, তখন তারা শিনারে এসে বাসা বাধলো। এরপর তারা একে অপরকে বললো, ‘আসো, ভালো করে কিছু ইট তৈরি করে পুড়িয়ে মজবুত করা যাক।’ যখন সব প্রস্তুত হয়ে গেলো তখন তার বললো, ‘এবার তৈরি করা যাক এক শহর, এর মাঝে থাকবে এক টাওয়ার যার উচ্চতা হবে স্বর্গ পর্যন্ত’। ফলে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়বে আমাদের নাম! (জেনেসিস ১১:১-৯)।
প্রথম শতকের রোমান-ইহুদি ইতিহাসবিদ জোসেফাসের মতে, বাবেলের টাওয়ার তৈরি করার মূল হোতা ছিলেন নিমরড, যাতে দ্বিতীয়বার প্লাবন এলেও তার নাগাল না পায়। আবার প্লাবনের তোড়ে পৃথিবী ডুবিয়ে দেয়ায় তিনি ঈশ্বরের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিলেন, ফলে স্বর্গে উঠে তার সঙ্গে বোঝাপড়ার ইচ্ছেও ছিল তার মনে।
ঈশ্বরের শাস্তি
চমকপ্রদ এই টাওয়ার দেখতে এলেন ঈশ্বর স্বয়ং। তিনি মানুষের অন্তরে চোখ বোলালেন, দেখতে পেলেন এই কীর্তিতে সফল হলে তারা ধর্মের পথ থেকে আরো দূরে সরে যাবে। ঈশ্বরের সন্তুষ্টি পেতে তো এ কাজ করছে না তারা, করছে নিজেদের খ্যাতি আর অহমিকার জন্য। ফলে তিনি ঠিক করলেন এদের ব্যর্থ করে দিতে হবে। মানবজাতি তখন কথা বলতো অভিন্ন ভাষায়। সুতরাং ঈশ্বর তাদের মুখের ভাষা পরিবর্তন করে দিলেন, একেকজন একেক ভাষায় কথা বলতে লাগলো। ফলে কেউ কাউকে বুঝতে পারল না, ভেস্তে গেল টাওয়ারের কাজ।
জেনেসিসে বলা হয়েছে, এবং ঈশ্বর বললেন, এখন মানুষ সবাই একত্রে, এবং একই ভাষা তাদের মুখে। কাজেই যা তারা করছে, তাতে সফল হবে খুব সহজেই। কাজেই তাদের মুখের দিয়ে দেয়া হবে বিভিন্ন ভাষা, ফলে তারা বুঝবে না একে অপরের কথা। এরপর মানবজাতি ছড়িয়ে পড়বে নানা দিকে, যারা থেকে যাবে সেখানে তারা গড়ে তুলবে নতুন শহর, বাবেল, কারণ ঈশ্বর সেখানেই তাদের বিশৃঙ্খল করে দিয়েছেন। (জেনেসিস ১১:৬-৯)।
বলা হয়, হিব্রু বালাল (bālal) থেকে উৎপত্তি হয়েছে বাবেলে’র, যার মানে বিশৃঙ্খল করে দেয়া। যেহেতু এখানেই মানুষকে বিশৃঙ্খল করে দেয়া হয়েছিল তাদের মুখে বিভিন্ন ভাষা জুড়ে দেয়ার মাধ্যমে, তাই নাকি শহরের এই নাম। সুমেরিয়ান বাবেল অর্থ অবশ্য ভিন্ন, ঈশ্বরের দরজা (gate of God)। আক্কাদিয়ানরা এক বলতো বাবিলি (Babili)। আমরা অবশ্য বাবেলকে জানি এর গ্রীক নামে, ব্যাবিলন। জেনেসিস অনুযায়ী, নিমরড যে রাজ্য গড়ে তুলেছিল তার কেন্দ্র ছিলো এই ব্যাবিলন। কেউ কেউ বলেন, টাওয়ার অব বাবেল বলতে আসলে শহরের নাম,ব্যাবিলন বোঝানো হয়েছে।
ঐতিহাসিক ব্যাবিলন
মেসোপটেমিয়ার ইউফ্রেটিস নদীর তীরে ব্যবিলন বহু প্রাচীন এক শহর। খ্রিষ্টের জন্মের প্রায় তিন হাজার বছর আগে আক্কাদিয়ান সাম্রাজ্যের রাজধানী আক্কাদের অদূরেই ছিল এর অবস্থান। আক্কাদিয়ানদের পতনের পর ১৯০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে অ্যামোরাইট নামে এক জাতি সেখানে রাজ্য বানিয়ে ব্যাবিলনকে তাদের প্রধান শহর করে। তাদের সময় থেকেই শুরু হয় এই শহরের সমৃদ্ধির গল্প।
ব্যাবিলনের শাসকেরা নানা সময় দেবতার উদ্দেশ্যে জিগুরাট তৈরি করেন। সুমেরিয়ান এক রাজাও ব্যাবিলনে জিগুরাট বানানোর কাজ হাতে নিয়েছিলেন, কিন্তু শেষ করতে পারেননি। শতাব্দীর পর শতাব্দী অর্ধনির্মিত থেকে যাওয়া সেই জিগুরাট থেকেই বাবেলের গল্পের জন্ম হতে পারে বলে কেউ কেউ মত দেন। পরবর্তীতে সত্যি সত্যি নেবুশ্যাডনেজার অবশ্য এক টাওয়ার নির্মাণ করেছিলেন এখানে, তবে তার উচ্চতা ছিল সাকুল্যে ৩২৫ ফুট।
অন্যান্য মিথোলজিতে টাওয়ার অব বাবেলের গল্প
সুমেরিয়ান মিথে এন্মের্কার (Enmerkar ) আর আরাত্তার রাজা নিয়ে প্রচলিত গল্পের সাথে বাবেলের কিছুটা মিল পাওয়া যায়। সুমেরিয়দের মতে, এই ঘটনা ২,১০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের, মহাপ্লাবনের শ’খানেক বছর পর। ভেঙে যাওয়া প্রস্তরফলক থেকে পুরো গল্প পাওয়া যায়নি, তবে উল্লেখ পাওয়া গেছে একটি টাওয়ারের। বর্ণিত আছে, বহু বহু বছর আগে, সমস্ত মানবজাতি ছিল একত্রে, দেবতা এনলিলের উপাসনা করতো একই ভাষায়। কিন্তু প্রাচুর্যের দেবতা এনকি তাদের ঠোঁটে দিয়ে দিলেন নানা বুলি, ফলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো তারা।
ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে সুপ্রাচীন এক আসিরিয়ান লেখনী, গবেষকদের মতে প্রায় তিন হাজার বছরের পুরনো। সেখানে ব্যবিলনের ব্যাপারে কী উল্লেখিত আছে দেখা যাক।
দেবতাদের দেবতা ব্যবিলনের ওপর ক্রুদ্ধ হলেন, কারণ তাদের হৃদয়ে ছিল অনর্থের চিন্তা। তার অভিশাপে ধসে পড়লো পবিত্র ঢিপি (mound)। শহরের দেয়াল, যা তারা গড়েছিল দিবালোকে, রাতের অন্ধকারে পরিণত হলো ধ্বংসস্তূপে। ক্রোধান্বিত দেবতার আদেশে তারা কথা বলতে লাগলো নানা ভাষায়, ফলে সৃষ্টি হলো বিশৃঙ্খলা।
মেসোপোটেমিয়া থেকে বেরিয়ে যদি আমেরিকার দিকে দেখি তাহলে আজটেক মিথোলজিতেও অনুরূপ উপাখ্যান পাওয়া যায়। জেলহুয়া (Xelhua) নামে এক দৈত্য প্লাবনের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে বিশাল এক পিরামিড বানাতে লাগলো। তার ইচ্ছে মেঘের দেশে উঠে যাওয়ার, যাতে আর কখনো বন্যা তাকে ছুঁতে না পারে। দেবতারা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। নির্মাণশ্রমিকদের মধ্যে তারা উদ্ভব ঘটালেন নানা ভাষার। কেউ যখন কারো কথা বুঝতে পারছিল না, তখন ভণ্ডুল হয়ে গেল জেলহুয়ার পরিকল্পনা।
ভারতীয় এক মিথোলজিতে বলা আছে বিশাল এক গাছের কথা, যা কিনা ছুঁতে চেয়েছিল স্বর্গের দরজা। তার উদ্দেশ্য খারাপ নয়, সমগ্র মানবজাতিকে নিজের ছায়াতলে আনা, যাতে তারা চিরদিন থাকে একসাথে। কিন্তু সেটা তো দেবতাদের উদ্দেশ্য নয়। ফলে ব্রহ্মা কেটে ফেললেন সেই গাছ, এবং তার কর্তিত শাখা-প্রশাখা থেকে জন্ম নেয় নানা ভাষা।
পলিনেশিয়ান গল্পে আছে রাটা ও তার তিন ছেলের কথা। ভয়াবহ এক বন্যা থেকে বেঁচে তারা ঠিক করলো বিশাল এক টাওয়ার বানাবে, যাতে সৃষ্টির দেবতা ভাতেয়ার (Vatea) সাথে দেখা করা যায়। কিন্তু ভাতেয়া সেই টাওয়ার শেষ হবার আগেই মাটিতে মিশিয়ে দিলেন। তার নির্দেশে শ্রমিকেরা, যারা এতদিন একই ভাষা ব্যবহার করছিল, হঠাৎ করেই বলতে লাগলো নানা বুলি। চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলায় আর সম্ভব হলো না টাওয়ারের নির্মাণ।
মিথোলজিতে মহাপ্লাবনের কাহিনীর মতো টাওয়ার অব বাবেলের গল্প নানা রূপে খুঁজে পাওয়া যায়। গবেষকদের ধারণা, কোনো একটি অভিন্ন ঘটনা থেকে এই সমস্ত উপকথার উৎপত্তির সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। কিন্তু তা কবে, কোথায় ঘটেছিল বা তার প্রকৃত স্বরূপ কী ছিল সেটা এখনও বিতর্কের বিষয়।