ভয়ংকর আগুনে পুড়ছে আমাজন রেইনফরেস্ট, যে রেইনফরেস্টের কাছে পৃথিবী নানাভাবে ঋণী। আমাজনকে পৃথিবীর ফুসফুস বলা হয়। এর কারণ পৃথিবীর মোট অক্সিজেনের শতকরা ২০ ভাগই আমরা পাই এই বিশাল বন থেকে। তাছাড়া বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদের সমাবেশে প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থানের এক অসাধারণ নজির সৃষ্টি করেছে আমাজনের এই বিস্তৃত বনাঞ্চল। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এই রেইনফরেস্ট বৈশ্বিক উষ্ণতার বিরুদ্ধেও সমানে লড়াই করে যাচ্ছে।
দক্ষিণ আমেরিকার নয়টি দেশের সীমানা জুড়ে রয়েছে আমাজন রেইনফরেস্ট। তবে এই বনের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ ব্রাজিলের মধ্যে পড়ে। ব্রাজিলের এই অংশটিই দিনের পর দিন আগুনে ভস্ম হয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে পুরো পৃথিবীতেই এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে শুরু করবে।
দাবানল বা ওয়াইল্ড-ফায়ার যেকোনো শুষ্ক আবহাওয়ার বনাঞ্চলে ঘটে যাওয়া এক নিয়মিত ঘটনা। তবে সম্প্রতি আমাজনে এই দাবানলের পরিমাণ এতটাই বেড়েছে যে তা পরিবেশবিদদের থেকে শুরু করে বিজ্ঞানী, গবেষক এবং আমাদের মতো সাধারণ জনগণেরও টনক নড়িয়ে দিয়েছে। মূলত আমাজনের ব্রাজিল সংলগ্ন অঞ্চলের বনভূমিতে এই বছর রেকর্ড সংখ্যক এলাকা আগুনের লেলিহান শিখায় ভস্ম হয়েছে এবং হচ্ছে। ব্রাজিলের মহাকাশ গবেষণা সংস্থার (আইএনপিই) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ বছর ব্রাজিলে এখন পর্যন্ত ৭২,৮৪৩টি জায়গায় আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। আর তার প্রায় অর্ধেকই ঘটেছে আমাজন বনে। গত বছরের তুলনায় এই দাবানলের মাত্রা শতকরা ৮০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, এত বড় অঞ্চল জুড়ে আগুন লাগার পেছনে মুখ্য কারণ কী? ব্রাজিল সরকারের ভাষ্যমতে, শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে প্রাকৃতিক ভাবেই এমন দাবানলের উৎপত্তি ঘটেছে। তবে পরিবেশবিদরা বলছেন ভিন্ন কথা। তারা দাবি করছেন, মানবসৃষ্ট কারণেই এমন বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে।
প্রাকৃতিক কারণে নয়, মানুষই আমাজন ধ্বংসের জন্য দায়ী
আমাজনে আগুন লাগার ঘটনা এবারই প্রথম নয়। এর আগেও এরকম অনেকবার হয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি এই আগুন লাগার মাত্রা এতটাই বেড়েছে যে এর পেছনে কারণ খতিয়ে দেখা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। পরিবেশ বিষয়ক সংস্থাগুলোর মতে, গবাদি পশুর খামার এই আগুন সৃষ্টির পেছনে মূল কারণ। খামারের মালিকেরা পশুপালনের জন্য বনের একাংশ পুড়িয়ে সেখানে খামার তৈরি করে। আমাজন ওয়াচ নামক এক অলাভজনক সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালক ক্রিশ্চিয়ান পয়রিয়ের বলেন,
সৃষ্ট আগুনের বেশিরভাগই মানুষের দ্বারা জ্বালানো হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমেও আমাজন একটি আর্দ্র রেইনফরেস্ট। তাই এখানে এত সহজে আগুন লাগার প্রশ্নই আসে না।
ব্রাজিলের মহাকাশ সংস্থা আইএনপিইর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, শতকরা নিরানব্বই ভাগ আগুন মানুষের কারণেই সৃষ্টি হয়েছে, হোক তা ইচ্ছাকৃত বা দুর্ঘটনাবশত। এই ক্রমাগত অরণ্য বিনাশের জন্য ছোটখাট কৃষিকাজ থেকে শুরু করে বড় বড় কৃষি-সংক্রান্ত ব্যবসাই মূলত দায়ী। আগেও বন ধ্বংস করে এভাবে চাষাবাদ করার নজির রয়েছে। তবে অনিয়ন্ত্রিতভাবে আগুন লাগানো ও সরকারের অসচেতনতার কারণে এই আগুনের মাত্রা এখন বলতে গেলে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
প্রকৃতপক্ষে আমাজনের পরিবেশ চাষাবাদের জন্য বেশ অনুকূল। তাই এখানে খামার গড়ে ওঠা নতুন কোনো ঘটনা নয়। তবে একটি বিষয়ের দিকে বিশেষভাবে আলোকপাত করা প্রয়োজন। পুরো বিশ্বে মাংসের চাহিদা অনেক বেড়ে গিয়েছে। বিশেষ করে গরুর মাংস এখন সারা বিশ্বে একটি অপরিহার্য খাদ্য উপাদান। তাই এই বিফ বা গরুর মাংসের জন্য গবাদিপশুর চাষাবাদও অনেক বেড়েছে। ব্রাজিলের আমাজন সংলগ্ন এলাকা এই পশুর খামারের জন্য পৃথিবীব্যাপী বিখ্যাত। এখান থেকে প্রচুর মাংস পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় চালান দেওয়া হয়। তাই খামার বাড়ানোর জন্য ও অর্থনৈতিক লাভের আশায় অনেকেই এই ব্যবসার সাথে নিজেদের জড়াচ্ছেন। আর এর ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে আমাজনের বনভূমিকে।
আঙ্গুল তোলা হয়েছে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট বলসোনারোর উপর
বেশ কিছু পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা আমাজনের এই দুর্দশার জন্য সরাসরি ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জেয়ার বলোসোনারোকে দায়ী করছে। আমাজনে অনিয়ন্ত্রিতভাবে খামার সৃষ্টি ও গাছ কাটার পেছনে নাকি বলোসোনারোর পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে। এমনটিই অনেকে দাবী করছেন। পরিবেশগত বিষয়ে তার কতগুলো বিতর্কিত নীতির কারণে আমাজনের ভবিষ্যৎ এখন অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ। বিশাল এই রেইনফরেস্ট নিয়ে তার ব্যবসায়িক মনোভাবকে পরিবেশবিদরা তিরস্কার করেছেন। তাছাড়া রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে এই বিষয়ের সমাধান করাও এখন মুশকিল হয়ে গেছে।
প্রেসিডেন্টের সাথে বাকবিতণ্ডায় জড়ানোর কারণে ইতোমধ্যেই আইএনপিইর পরিচালককে তার পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে বলসোনারো নিজের বিরুদ্ধে করা সকল অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। আমাজনের অরণ্য-বিনাশ নিয়ে আইএনপিইর করা জরিপকে তিনি মিথ্যা বলে দাবী করেছেন। ব্রাজিলের একটি সংবাদ সংস্থা ‘এজেন্সিয়া ব্রাজিলের’ মতে, মহাকাশ সংস্থা আইএনপিইর আমাজন নিয়ে দেওয়া সতর্কতামূলক বার্তাকে প্রেসিডেন্ট বলসোনারো দেশে বাণিজ্যের জন্য ক্ষতিকর হিসেবে দাবি করেছেন।
প্রেসিডেন্ট বলসানারোর এই মনোভাব খামার মালিক, কাঠুরে ও আগুন লাগানো অন্যান্য পেশার মানুষদের মাঝে আরো বেশি সাহসের সঞ্চার করেছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না। অপরদিকে নিজের বিরুদ্ধে আসা সকল খবরের জন্য বলসোনারো নানা বেসরকারি সংস্থাকে দায়ী করেছেন। এমনকি তিনি বেশ কয়েকটি সংস্থার তহবিলেও হস্তক্ষেপ করেছেন। তার মতে,
অপরাধের অস্তিত্ব রয়েছে, আর আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে, এই ধরনের অপরাধ যাতে বেড়ে না যায়। আমরা বেসরকারি সংস্থাগুলোর সকল অর্থ সরিয়ে নিয়েছি। ফান্ডিংয়ের অভাবে চিমটির ব্যথা তারা ঠিকই অনুভব করছে। তাহলে হতে পারে, এসব সংগঠনই এই অপরাধমূলক কাজগুলো করে যাচ্ছে এবং জনগণের মাঝে আমার সম্পর্কে ও ব্রাজিল সরকার সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করছে। আমরা এখন মূলত এই যুদ্ধটারই মুখোমুখি হয়েছি।
গ্রিনপিস নামক একটি বেসরকারি পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা বলসোনারো ও তার সরকারকে জলবায়ুর ভারসাম্যের পথে এক বিরাট হুমকি হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। তাছাড়া অর্থনৈতিক সুবিধার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেওয়ায় আন্তর্জাতিকভাবেও তাকে নানা চাপের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
আগুনের ক্ষয়ক্ষতি আসলে কতটুকু ভয়াবহ ?
আমাজনের বিস্তীর্ণ বনভূমিতে আগুনের মাত্রা এতটাই বেশি যে ব্রাজিল থেকে এই আগুন ক্রমশ প্রতিবেশী দেশগুলোর বনে ছড়িয়ে পড়ছে। পার্শ্ববর্তী বলিভিয়া, প্যারাগুয়ে এবং পেরুর আকাশে কালো ছাইয়ের ঘনঘটা লক্ষ্য করা গেছে। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যে এই আগুনের মাত্রা কতটা ভয়ানক! আর এই আগুনের জন্য সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে আমাজনের পশুপাখিদের। নানা বিরল প্রজাতি মিলিয়ে জীবজগতের প্রায় দশ ভাগের এক ভাগ প্রাণীর সন্ধান পাওয়া যায় আমাজনে। আর এই পশুপাখি নিয়মিত দাবানলের সাথে তেমনটা পরিচিত না। তাই দ্রুতগামী ও বড় আকারের প্রাণীগুলো বিপদ থেকে বেড়িয়ে আসতে পারলেও, অপেক্ষাকৃত ছোট আকৃতির প্রাণীগুলোকে তাৎক্ষনিক আগুনের কাছে নতি স্বীকার করতে হয়। এভাবে মানুষের বর্বরতার ফল ভোগ করছে নিরীহ পশুপাখি।
এখন কথা বলা যাক আমাজনের এই আগুনের সুদূরপ্রসারী প্রভাব সম্পর্কে। বিশেষত এই রেইনফরেস্ট জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবেলায় এক প্রতিরক্ষার ঢাল হিসেবে কাজ করছিল। কিন্তু আগুন যে ক্ষতি করেছে তা এমনিতেই প্রতিকার করা অসম্ভব। আর এভাবে চলতে থাকলে বায়ুতে কার্বনের পরিমাণ বাড়তে থাকবে। আর জলবায়ু পরিবর্তনের মূল নিয়ামক হলো এই কার্বন। আমাজনে প্রতি মিনিটে একটি ফুটবল মাঠের সমান জায়গা আগুনে ভস্ম হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং বায়ুতে কার্বন বৃদ্ধির পরিমাণ অনুমান করা খুব কঠিন কিছু নয়।
শেষ কথা
নিজের বুদ্ধিমত্তা ও বিজ্ঞানের সহায়তায় মানুষ পৃথিবীকে নিজের হাতে মুঠোয় এনেছে। কিন্তু স্বার্থপরতা ও উদাসীনতার কারণে ঠিকই এই প্রকৃতি আমাদের হাত থেকে ফসকে যেতে চলেছে। নিজের সুবিধার জন্য আমরা যেভাবে ইচ্ছামতো প্রকৃতির উপর চড়াও হচ্ছি, একদিন প্রকৃতিও আমাদেরকে ঠিকই এর প্রতিদান দিয়ে দিবে। বৈশ্বিক উষ্ণতা, জলবায়ুর পরিবর্তন এসব কোনো বানোয়াট হুমকি নয়। এগুলোর অস্তিত্ব সত্যি সত্যি রয়েছে। তাই আমাদের নিজেদের স্বার্থের জন্য প্রকৃতির উপর এই বর্বরতা পরিহার করা উচি। নাহলে এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল পুরো মানবজাতির অস্তিত্বকেই করবে প্রশ্নবিদ্ধ।