আমাদের পৃথিবীতে অদ্ভুত ক্ষমতাসম্পন্ন প্রাণীর কোনো অভাব নেই। একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির প্রাণী কেমন পরিবেশে বসবাস করে, তার উপর ভিত্তি করে এদের নানারকম শারীরিক পরিবর্তন ঘটতে থাকে। মূলত একটি পরিবেশে প্রাণীদের নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়। এসব প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার জন্যই এদের মাঝে এসব শারীরিক পরিবর্তন ঘটে। আর এভাবেই সৃষ্টির আদিকাল থেকে প্রাণীজগতে বিবর্তন ঘটে আসছে। একটি সহজ উদাহরণ দিয়ে ব্যাখা করা যাক।
আমরা মানুষেরা দীর্ঘ সময় ধরে মরুভূমিতে যাতায়াত করার সময় নানা সমস্যার সম্মুখীন হই। এগুলোর মধ্যে প্রধান সমস্যা হলো পানির অভাব। এছাড়াও রয়েছে খাদ্যের অভাব আর প্রচন্ড উত্তাপ। এখন মরুভূমির সবথেকে জনপ্রিয় প্রাণী হলো উট। উটের দেহে কিন্তু এই সবরকম প্রতিকূলতা মোকাবেলা করার বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে।
পানির অভাব যাতে না হয়, সেজন্য উটের গলার নিচে অতিরিক্ত পানি সংগ্রহ করে রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। মরুভূমিতে খাদ্যের অভাব অনেক। উটের পিঠের কুজ এই খাদ্যাভাব মেটাতে অনেক সাহায্য করে। এই কুজগুলো মূলত দেহের অতিরিক্ত চর্বি থেকে তৈরি হয়। কাজেই দেহ যখন খাদ্যের অভাব পূরণ করতে পারে না, তখন এই কুজের চর্বি বিপাকের মাধ্যমে দেহের খাদ্যের প্রয়োজন মেটানো হয়। এরা আবার চোখ বন্ধ করার মতো নিজেদের নাকও একইভাবে বন্ধ করতে পারে। এতে মরুভূমির বালুঝরে এদের কোনো অসুবিধাই হয় না। এছাড়াও উটের লোমশ শরীর এদের ত্বককে প্রচন্ড উত্তাপ থেকে রক্ষা করে।
উপরে উট মরুভূমিতে কীভাবে বেঁচে থাকে তার একটা উদাহরণ দেওয়া হলো। একই রকম আরো অনেক প্রাণী রয়েছে, যাদের বেঁচে থাকার জন্য অদ্ভুত সব শারীরিক কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়। এমনই একটি অদ্ভুতুড়ে ক্ষমতা হলো নিজ দেহ থেকে আলো তৈরি করতে পারার ক্ষমতা।
প্রাণীদের নিজ দেহ থেকে আলো উৎপন্ন করতে পারার এই ক্ষমতাকে বায়োলুমিনিসেন্স বলে। যেসকল প্রাণীদের এই ক্ষমতা রয়েছে তাদেরকে বলা হয় বায়োলুমিনিসেন্ট প্রাণী। মানুষকে আলো উৎপন্ন করার জন্য আগুন কিংবা বিজ্ঞানের দেওয়া বৈদ্যুতিক বাতির উপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু বায়োলুমিনিসেন্ট প্রাণীরা দেহে বিশেষ এক রাসায়নিক পরিবর্তনের মাধ্যমে এই আলো তৈরি করতে পারে। লুসিফারেজ নামক এক এনজাইমের কারণে দেহে এই রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে।
পৃথিবীতে শতকরা প্রায় ৭৬ ভাগ সামুদ্রিক প্রাণীই বায়োলুমিনিসেন্ট। এরা শরীর থেকে প্রধানত দুই উপায়ে উজ্জ্বল আলো তৈরি করতে পারে। এগুলো হলো: দেহের অভ্যন্তরীণ রাসায়নিক পরিবর্তন এবং শরীরে বসবাসকারী ব্যাকটেরিয়ার কারণে। সমুদ্র ছাড়াও স্থলেও এমন অনেক প্রাণী রয়েছে। জোনাকি পোকা এদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়। এরা ছাড়াও বিশেষ কিছু প্রজাতির গুবরে পোকার বায়োলুমিনিসেন্স রয়েছে। আজকের এই লেখাটিতে আমরা এমনই কিছু বায়োলুমিনিসেন্ট প্রাণী ও এদের এই ক্ষমতার প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করবো।
জোনাকি
জোনাকি মানুষের কাছে সর্বাধিক পরিচিত বায়োলুমিনিসেন্ট প্রাণী। শহরের ইট-পাথরের জগতে জোনাকির দেখা মেলা ভার। তবে গ্রামে এবং যেসব এলাকায় বাগান, বন-জঙ্গল রয়েছে, সেখানে প্রায়ই এদের দেখা পাওয়া যায়। বিশেষ করে যখন লোডশেডিং এর কারণে পুরো এলাকা অন্ধকারে ছেয়ে যায়। ছোটবেলায় জোনাকির এই আলো নিয়ে আমরা সবাই কমবেশি মাতামাতি করেছি। কিন্তু কখনো কী এদের এই আশ্চর্য ক্ষমতা সম্পর্কে আমাদের জানতে ইচ্ছা হয়েছে?
পৃথিবীতে প্রায় ২,০০০ প্রজাতির জোনাকি রয়েছে। তবে এদের মাঝে খুব কম সংখ্যক প্রজাতিই আলো তৈরি করতে পারে। এদের আলো তৈরির পেছনে মূল উদ্দেশ্য হলো শিকার করা ও বিপরীত লিঙ্গকে বংশবিস্তারের জন্য আকৃষ্ট করা। আলো তৈরির জন্য এদের দেহে কিছু বিশেষ রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে। এগুলো হলো ক্যালসিয়াম, অ্যাডিনোসিন ট্রাইফসফেট, লুসিফেরিন ও লুসিফারেজ এনজাইম। দেহের যে অঙ্গে এগুলো মিলে বিক্রিয়া ঘটে, সেটি সাধারণত বেশ পাতলা ও স্বচ্ছ হয়। রাসায়নিক পদার্থগুলো অক্সিজেনের সংস্পর্শে আসলেই বিক্রিয়া ঘটে এবং সবুজ ও হলুদ বর্ণের আলো উৎপন্ন হয়।
প্রজনন ঋতুর সময় বনজঙ্গল জোনাকি পোকায় ছেয়ে যায়। এরা তখন টিপ টিপ আলো তৈরির মাধ্যমে নৃত্যে মগ্ন থাকে। তবে কিছু বিশেষ প্রজাতির স্ত্রী জোনাকি রয়েছে যাদের আলো তৈরির উদ্দেশ্য ভিন্ন। এরা অন্য প্রজাতির পুরুষ জোনাকিদের আলো তৈরির মাধ্যমে মাটির কাছাকাছি নিয়ে আসে। অতঃপর এরা এই পুরুষ জোনাকিদের ভক্ষণে লিপ্ত হয়।
অ্যাংলারফিশ
সমুদ্রের তলদেশে বসবাসকারী এক অদ্ভুত মাছ হলো অ্যাংলারফিশ। শরীরের তুলনায় অনেক বড় এদের চোয়াল। সেই চোয়াল করাতের মতো ধারালো দাঁত দিয়ে বেষ্টিত। তবে এই মাছটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় অঙ্গ হলো এর মাথার অগ্রভাগে অ্যান্টেনার মতো এক প্রবৃদ্ধি। এই অ্যান্টেনার শেষ অংশে স্মার্টফোনের ফ্ল্যাশ লাইটের মতো আলো জ্বলে। ফাইটোপ্ল্যাংকটন নামক একপ্রকার ব্যাকটেরিয়ার সাহায্যে অ্যাংলারফিশ এই আলো তৈরি করে।
সমুদ্রের তলদেশে প্রায় ২,০০০ মিটার গভীরে এই মাছগুলো বিচরণ করে থাকে। এদের আলো তৈরির পেছনে মূল উদ্দেশ্য হলো শিকার করা। সমুদ্রের তলদেশের অন্ধকার পরিবেশে আলো জ্বালিয়ে এরা শিকারকে আকৃষ্ট করে। এই কারণেই তাদের আলো তৈরির অঙ্গটিকে ‘লিউর’ (ইংরেজি শব্দ lure থেকে নেওয়া) নাম দেওয়া হয়েছে। এই লিউর নাড়িয়ে অ্যাংলারফিশ শিকারকে ধীরে ধীরে নিজের মুখের কাছে নিয়ে আসে। তারপর কিছু বোঝার আগেই শিকার এই মাছের পেটে সাবার হয়ে যায়।
স্ত্রী অ্যাংলারফিশ পুরুষদের তুলনায় আকারে অনেক বড় হয়। এরা প্রজনন মৌসুমে ১০০-১,০০০টি ডিম দেয়। এই অদ্ভুত প্রকৃতির মাছের বয়স সীমা ১০-১৫ বছর। মাছগুলো প্রশান্ত মহাসাগর, আটলান্টিক মহাসাগর ও ভারত মহাসাগরে দেখতে পাওয়া যায়।
স্কুইড
সমুদ্রে যত অদ্ভুত প্রকৃতির প্রাণী বাস করে তাদের মাঝে স্কুইড একটি জনপ্রিয় নাম। বহু প্রজাতির স্কুইডের আলো তৈরির ক্ষমতা রয়েছে। তবে এরা শিকার ধরার জন্য এই আলো তৈরি করে না। বরং এই আলো তারা তৈরি করে শিকার থেকে বাঁচার জন্য। স্কুইডের দেহে আলো তৈরির মূল উৎস হলো কিছু বিশেষ ব্যাকটেরিয়া। এই ব্যাকটেরিয়া ও স্কুইড হলো মিথোজীবী, অর্থাৎ এরা একে অপরকে সাহায্যের মাধ্যমে একত্রে বেঁচে থাকে। স্কুইড এই ব্যাকটেরিয়াগুলোকে খাদ্য হিসেবে অ্যামিনো এসিড ও শর্করার জোগান দেয়। বদৌলতে ব্যাকটেরিয়াগুলো নিজেদের বায়োলুমিনিসেন্স ক্ষমতা দিয়ে স্কুইডদের শত্রু থেকে রক্ষা করে। কিছু প্রজাতির স্কুইড শিকারি প্রাণীর হাত থেকে বাঁচার জন্য উজ্জ্বল তরল মিউকাস দেহ থেকে নিঃসৃত করে। এভাবে এরা শিকারিকে দ্বিধায় ফেলে পালিয়ে যায়। আবার কিছু স্কুইড রয়েছে যেগুলো নিজেদের স্বচ্ছ শরীরকে উজ্জ্বল করার মাধ্যমে ছদ্মবেশ ধারণ করতে পারে। এই ধরনের একটি স্কুইড হলো ববটেইল স্কুইড।
ববটেইল স্কুইড ব্যাকটেরিয়ার সাহায্যে নিজের দেহ প্রজ্বলিত করে। এদের শরীর অনেক স্বচ্ছ হওয়ায় এরা পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সাথে সহজে মিশে যেতে পারে। এ কারণে শিকারি প্রাণীগুলো সহজে এদের ধরতে পারে না।
ল্যান্টার্ন ফিশ
ল্যান্টার্ন ফিশ অ্যাংলারফিশের ন্যায় গভীর সমুদ্রের মাছ। এদের মাথায় ফটোফোর নামক এক বিশেষ অঙ্গ থাকে যেখান থেকে আলো সৃষ্টি হয়। এই আলো সৃষ্টির প্রক্রিয়া অনেকটা জোনাকির মতোই। লেন্স আকৃতির ফটোফোর ব্যবহার করে এরা ইচ্ছামতো আলোর উজ্জ্বলতা পরিবর্তন করতে পারে। এভাবে এগুলো যেমন সমগোত্রীয় অন্যান্য মাছের সাথে যোগাযোগ করে, তেমনই শিকার ও প্রজননের উদ্দেশ্যে এই আলো কাজে লাগায়।
ক্রিস্টাল জেলি
সামুদ্রিক প্রাণীদের মাঝে অত্যন্ত সুন্দর একটি প্রাণী হলো জেলিফিশ। জেলিফিশদের মাঝে আবার অন্যতম সৌন্দর্যের অধিকারী হলো একটি বিশেষ প্রজাতি। এদের নাম ক্রিস্টাল জেলি। একেবারে পানির মতো স্বচ্ছ দেহ বিশিষ্ট এই জেলিফিশগুলো আলো তৈরি করতে পারে। এদের কর্ষিকা থেকে সবুজাভ নীল বর্ণের আলো নির্গত হয়। তবে এদের আলো তৈরির পেছনে তেমন কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য নেই। এরা এদের আঠালো কর্ষিকা দিয়ে শিকার আকড়ে ধরে এবং নিজেদের দেহের প্রায় অর্ধেক আকৃতির শিকার ভক্ষণ করতে পারে। ২০০৮ সালে একদল বিজ্ঞানী ক্রিস্টাল জেলির দেহ থেকে এক উপকারী প্রোটিন আবিষ্কার করেন। একই বছর এই আবিষ্কারের জন্য তারা নোবেল পুরষ্কার পান।
ক্লাস্টারউইংক শামুক
এতক্ষণ আমরা যতগুলো বায়োলুমিনিসেন্ট প্রাণী সম্পর্কে জেনেছি, তাদের বেশিরভাগই আলো তৈরি করে আকৃষ্ট করার জন্য। ক্লাস্টারউইংক শামুক ঠিক এর উল্টো। এদের কিছু স্পর্শ করলে বা কোনো বিপদে পড়লে এরা খোলসে ঢুকে পড়ে। আর এই খোলস থেকে এরা টিপ টিপ করে আলো জ্বালায়। শামুকের এই আলোর উৎস হলো বায়োলুমিনিসেন্ট ব্যাকটেরিয়া।
মুন জেলিফিস
মুন জেলিফিস হলো আরেক প্রজাতির জেলিফিস যেগুলো রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে আলো তৈরি করে। এদের দেহে লুসিফেরিন নামক পদার্থ থাকে, যা পানির অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে লুসিফেরেজ এনজাইম তৈরি করে। এদের দেহের শতকরা ৯৫ ভাগই পানি।
মুন জেলিফিস মূলত প্ল্যাংকটন, মাছের ডিম ও ছোট ছোট চিংড়ি খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। এদের বয়সসীমা ছয় মাস এবং পূর্ণবয়স্ক হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই এরা মৃত্যুবরণ করে।
মটিক্সিয়া
মটিক্সিয়া না বলে কেন্নো বললে সবার চিনতে একটু সুবিধা হবে। তবে এখানে বাসা-বাড়িতে সচরাচর দেখতে পাওয়া কেন্নোর কথা বলা হচ্ছে না। কেন্নোদের মাঝে এক বিশেষ প্রজাতি হলো মটিক্সিয়া সিকুওয়ি (Motyxia sequoiae)। এই প্রজাতির কেন্নো দেহ থেকে নীলাভ-সবুজ বর্ণের আলো তৈরি করতে পারে। এদের যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে সচরাচর দেখতে পাওয়া যায়। ৩-৪ সেন্টিমিটার লম্বা এই প্রাণীর দেহ মোট ২০টি খন্ডে বিভক্ত। তাছাড়া এদের শরীর বিষাক্ত সায়ানাইড তৈরি করতে পারে। স্ত্রী কেন্নো পুরুষ কেন্নো থেকে আকারে অপেক্ষাকৃত বড় হয়।
জ্বলজ্বল করতে থাকা এই কেন্নো যেকোনো নিশাচর প্রাণীর জন্য সাক্ষাৎ যম। এদের দেহ থেকে নির্গত বিষ একটি সুস্থ প্রাণীকে মেরে ফেলতে পারে। তবে গর্তে বসবাসকারী এই কেন্নোর দৃষ্টিশক্তি থাকে না।
শেষ কথা
প্রাণীজগৎ বৈচিত্র্যময়। এখানে একেক রকম প্রাণীর একেক রকম আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে। মানুষের বুদ্ধিমত্তা সমগ্র প্রাণীকুল থেকে মানুষকে আলাদা করে। তেমনি এই প্রাণীগুলোর কিছু অদ্ভুত ক্ষমতার জন্যও এদের নাম আলাদাভাবে নিতে হয়। এই বৈচিত্র্য নিয়ে মানুষ নিরন্তর গবেষণা করছে। জানা-অজানা এমন আরো কত অদ্ভুত প্রাণী আমাদের পৃথিবীতে রয়েছে তার কোনো ঠিক নেই।
বিচিত্র প্রাণীজগত সম্পর্কে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলো: