প্রাণীজগতে বৈচিত্র্যময় বন্ধুত্বের চিত্র আমরা অনেকেই দেখেছি। কখনো হাতির সাথে কুকুর, বিড়ালের সাথে শেয়াল, এমনকি জিরাফের সাথে অস্ট্রিচের বন্ধুত্বের নজিরও শোনা গেছে। কিন্তু এ সব কিছুকে হার মানিয়েছিল তিন বন্ধুর গল্প। তারা জাতে যেমন ভিন্ন, তেমনি জন্মসূত্রে তাদের ভৌগলিক আদি-নিবাসও ভিন্ন। আর তাই, ‘লিও-বালু-শের খান’ এর গল্পটা একটু আলাদাই বটে।
২০০১ সালের কথা! আমেরিকার জর্জিয়া স্টেটের প্রাণকেন্দ্র আটলান্টার এক বাড়িতে মাদকবিরোধী অভিযান চালাতে প্রস্তুত স্থানীয় পুলিশ বাহিনী। আকস্মিকভাবে হামলা চালিয়ে বাড়ি থেকে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হলো। পুরো বাড়ি তল্লাশি চালিয়ে বিপুল পরিমাণ মাদকের পাশাপাশি বেজমেন্ট থেকে উদ্ধার করা হলো তিন বিশেষ অতিথিকে।
আমেরিকান কালো ভাল্লুক বালু!
আফ্রিকান সিংহ লিও!
বঙ্গদেশের বাঘ শের খান!
বেজমেন্টে ছোট ছোট খাঁচায় বন্দী সেই বাঘ, ভাল্লুক আর সিংহের বয়স তখন সবে কয়েক মাস। নোংরা স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে থেকে থেকে ততদিনে তিনজনেরই নাজেহাল অবস্থা। অপুষ্টিতে শুকিয়ে হাড্ডিসার দেহগুলোর ওজন ছিল স্বাভাবিকের চেয়েও অনেক কম।
শের খানের দেহের হাড় ও চামড়ার বিভিন্ন অংশের ভেতরে ও বাইরে বিভিন্ন জীবাণুর সংক্রমণ দেখা গেল। লিওর নাকের ওপর দেখা গেল বিচ্ছিরিভাবে ছড়ে যাওয়া রক্তাক্ত এক জখম। সবচেয়ে বাজে অবস্থায় ছিল বালু। বেচারা ছোট্ট ভাল্লুকটাকে তো রীতিমতো সার্জারিই করাতে হয়েছিল।
তিনজনের এই দুরবস্থা দেখে তখনই বনে ছেড়ে না দিয়ে যথাযথ চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তুলতে নিকটস্থ অভয়ারণ্যে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন উদ্ধারকর্মীরা। আর তাই আটলান্টার সেই ড্রাগ ডিলারের বাড়ি থেকে উদ্ধার করে তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় নোয়াহ্’স আর্ক স্যাংচুয়ারিতে। পূর্ণ চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে সেখানেই খাওয়া-ঘুম-খেলায় আনন্দে বেড়ে উঠতে থাকে তিন বন্ধু।
উল্লেখ্য, এই ভাল্লুক ও বাঘের নামকরণ করা হয়েছে বিখ্যাত গল্প ‘দ্য জাঙ্গল বুক’ এর দুই চরিত্র বালু ও শের খানের নামানুসারে। প্রকৃতির অদ্ভুত মেলবন্ধনে গড়া এ বন্ধুত্বে ‘লিও-বালু-শের খান’ এর একসাথে পথচলার স্থায়িত্ব ছিল পনেরোটি বছর।
দীর্ঘ এ সময়ে শুধু একসাথে খাওয়া-ঘুম-খেলাই নয়, একে অন্যের দেখাশোনাও করতো তারা। শৈশবে ভিন্ন প্রজাতির প্রাণীদের মধ্যে বন্ধুত্বটা খুব একটা অস্বাভাবিক না। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে এই বন্ধুত্ব তারা ধরে রাখতে পেরেছিল প্রাপ্তবয়স্ক হবার পরেও!
নোয়াহ্’স আর্ক স্যাংচুয়ারির কিউরেটর অ্যালিসন হেজকথ এক সাক্ষাৎকারে হাফিংটন পোস্টকে জানিয়েছিলেন,
সাধারণত একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় লৈঙ্গিক পরিপক্বতা আসার আগপর্যন্ত প্রাণীদের মধ্যে ভিন্ন প্রজাতির কোনো প্রাণীর সাথে বন্ধুত্ব দেখা যায়। কিন্তু, অবাক করা বিষয় হলো, বড় হবার পরেও তারা তিনজন সবসময় একটি পরিবার হয়েই ছিল।
উদ্ধার করে আনার পর তাদের চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তুলতে যথেষ্ট সময় লেগে গিয়েছিল। নতুন এই পরিবেশে মানিয়ে নিতেও তাদের বেশ সময় লেগে গিয়েছিল।
প্রথম যখন তাদেরকে এই স্যাংচুয়ারিতে আনা হলো, বালু-শের খান-লিও তখন মারাত্মকভাবে আহত। ভয়ে আতঙ্কে গায়ে গায়ে লেগে একে অন্যের সঙ্গী হয়ে ছিল তারা।
অন্ধকার নোংরা বেজমেন্টের বদ্ধ কুঠুরি থেকে জর্জিয়া ডিপার্টমেন্ট অফ ন্যাচারাল রিসোর্সের হাত ধরে ২৫০ একরের সুবিশাল স্বর্গে ঠাঁই সুখেই কেটেছিল তিন বন্ধুর দিনগুলো।
বয়স বাড়ার একপর্যায়ে স্যাংচুয়ারি কর্তৃপক্ষ তাদেরকে আলাদা আলাদা জায়গায় থাকার ব্যবস্থা করে দেয়ার চেষ্টা করলেও, শেষ পর্যন্ত বন্ধুত্বের টান তাদেরকে আলাদা হতে দেয়নি।
এমনকি তাদের জন্য তিন একরের আবাসস্থল বরাদ্দ করা হলেও, একে অন্যকে তারা কখনোই চোখের আড়াল করতে চাইত না বলে ১০০ ফুটের ভেতরেই থাকতো। তা থেকে এটাই প্রমাণ হয় যে, ওরা কেবল সহাবস্থানই করতো না, একে অন্যের উপস্থিতি উপভোগও করতো।
স্বভাবের দিক থেকে বালু সবচেয়ে রাগী। বাকিদেরকেও বেশ শাসনে রাখত। লিওর মধ্যে একটু ছন্নছাড়া ভাব থাকলেও চারপাশে কী হচ্ছে এ ব্যাপারে সে সবসময়ই সতর্ক থাকত। আর তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে আমুদে প্রাণীটি ছিল শের খান। অত্যুৎসাহী শের খান সবসময়ই খেলায় মেতে থাকতে পছন্দ করত।
অবশ্য মধুর বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছিল স্যাংচুয়ারি কর্তৃপক্ষকে। কারণ এই তিনজনকে তো আলাদা করাই যাবে না। আবার তিনজন ভিন্ন ভিন্ন তিন প্রজাতির হওয়ায়, তাদের যথাযথ পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করাও ছিল বেশ চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার। খেলা-ঘুমের পাশাপাশি খাওয়ার বেলায়ও পরিবারের মতো একসাথেই খেতে অভ্যস্ত ছিল তিন বন্ধু।
২০১৬ সালের গ্রীষ্মের শেষ দিকে একদিন হঠাৎ করেই লিওর আচরণে একটু অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করেন একজন কেয়ারটেকার। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে দেখা যায়, তার লিভারের ৮০ শতাংশেরও বেশি অংশ টিউমারে আক্রান্ত হয়ে গেছে। এ অবস্থায় অপারেশন করে তাকে সুস্থ করে তোলাও আর সম্ভব না। তাই বেশ কয়েক সপ্তাহ খুব অসুস্থ থাকার পর বাধ্য হয়েই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবার পথ করে দেয় স্যাংচুয়ারি কর্তৃপক্ষ।
২০১৬ সালের আগস্টে, পনেরো বছর বয়সে শের খান আর বালুকে ছেড়ে বন্ধুত্বের মায়া কাটিয়ে বিদায় নেয় লিও। তাদের আবাসস্থলের পাশেই এক স্মৃতিস্তম্ভের নিচে ঠাঁই হলো তার।
মানুষের মতো অন্যান্য অনেক প্রাণীর মাঝেই আপনজন হারানোর বিষণ্ণতা দেখা যায়। আর দশটা সাধারণ প্রাণীর থেকে ভিন্ন এ পরিবারের অবশিষ্ট দুই সদস্যের প্রতি এ ঘটনার পর একটু বাড়তি মনোযোগই দিয়েছিল নোয়াহ্’স আর্ক স্যাংচুয়ারি কর্তৃপক্ষ।
দুই বছর বাদে, ২০১৮ সালে শের খানও অসুস্থ হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত ১৮ ডিসেম্বর, সতেরো বছর বয়সে বিদায় নিয়ে, সবার আগে পথ দেখানো লিওর পাশেই চিরনিদ্রায় শায়িত হলো সে।
জঙ্গলে বিরল প্রজাতির বেঙ্গল টাইগার সাধারণত একা থাকতে পছন্দ করলেও শের খান সারাদিনই তার দুই ভাই বালু আর লিওর সাথে খেলায় মেতে থাকত। শেষ দিনগুলোতেও তার একা থাকতে হয়নি। দেহের অনেকটুকু অচল হয়ে গেলেও, অধিকাংশ সময় শের খানের কাছে কাছেই থাকত বালু।
দুই ভাইকে হারিয়ে একা একাই বেঁচে আছে আমেরিকান কালো ভাল্লুক বালু। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নোয়াহ্’স আর্ক স্যাংচুয়ারির অফিসিয়াল পেজ থেকে নিয়মিত বিভিন্ন আপডেট প্রকাশ করা হয়। বালুর একাকিত্বের সঙ্গী হতে অন্য কোনো প্রাণীকে আনা যেতে পারে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে এক বার্তায় কর্তৃপক্ষ জানায়,
অনেকেই জানতে চেয়েছেন, বালুর সঙ্গী হিসেবে কোনো প্রাণীকে আনা যেতে পারে কি না। উত্তরটা- ‘না’। বালু প্রাপ্তবয়স্ক, বড় আকারের কর্তৃত্বপূর্ণ স্বভাবের একটি প্রাণী, যে তার জীবনের অধিকাংশ সময়টাই এখানে নিজ আবাসস্থলে কাটিয়েছে। সাধারণত কালো ভাল্লুকেরা নিজ পরিসরে একাকী থাকতে পছন্দ করে। তাছাড়া বালু অন্য কোনো বড় প্রাণী বা ভাল্লুকের উপস্থিতি পছন্দ করে না। বরং এমন কোনো প্রাণীকে আনা হলে, আক্রমণ করার প্রবণতাও দেখা গেছে তার মাঝে। এমতাবস্থায় বালুর সংস্পর্শে অন্য কোনো প্রাণীকে আনা হলে মারাত্মকভাবে আহত হবার ঘটনা থেকে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। আর আমাদের আদরের বালুর সাথে এমন কোনো ঘটনা আমাদের একেবারেই কাম্য নয়।
প্রকৃতির নির্মম ইচ্ছায় একাকীই দিন কাটছে তার। হয়তো এভাবেই একদিন একাকিত্বের অবসান ঘটিয়ে দুই ভাইয়ের ডাকে সাড়া দিয়ে বিদায় নেবে পরিবারের সবচেয়ে রাগী সদস্যটিও।
কথায় আছে, ভালো বন্ধু হয় আকাশের তারার মতো, খানিক সময়ের জন্য চোখের আড়াল হলেও নেয় না বিদায়, ঠিকই হয়ে রয় যাত্রাসঙ্গী। আর ভালো বন্ধু হবার পথে জাত-ধর্ম-বর্ণের অমিল বাধা হতে পারে না কখনোই। জীবনের যন্ত্রণাদায়ক প্রথম কয়েকমাসের পর, প্রায় দুই দশকের এ পথচলায় বন্ধুত্বের অমর বার্তাকেই তুলে ধরেছে লিও, শের খান ও বালু।