প্রাণীজগতে অধিকাংশ প্রাণীর শরীরেই প্রাকৃতিকভাবেই কিছু না কিছু প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা আছে। সাপকে আক্রমণ করতে গেলে সাপ পাল্টা ছোবল দেয়। অক্টোপাসকে আক্রমণ করতে গেলে সে পাল্টা কালি ছুঁড়ে সাময়িকভাবে অন্ধ করে দেয়। টিকটিকিকে আক্রমণ করতে গেলে সে নিজের লেজ খসিয়ে শত্রুর দৃষ্টি লেজের দিকে ফিরিয়ে সেই সুযোগে পালিয়ে যায়।
পিপীলিকার অবশ্য এরকম কোনো বিশেষ ক্ষমতা নেই। তারা ফরমিক এসিড যুক্ত হুল ফোটাতে পারে, শক্ত চোয়াল দিয়ে শত্রুকে কামড়ে ধরতে পারে, তাদের শক্ত খোলসযুক্ত মাথাগুলো একত্রিত করে মাটির নিচের বাসার প্রবেশ পথ বন্ধ করে রাখতে পারে, কিন্তু এর বেশি তেমন কিছু করতে পারে না।
পিপীলিকার মধ্যে অবশ্য সৈনিক পিপীলিকার কথা ভিন্ন। এদের চোয়ালের গঠন ভিন্ন, এদের স্বভাবও অনেকটা আক্রমণাত্মক। এরা মাটির নিচের বাসার পরিবর্তে অধিকাংশ সময় মাটির উপরে অস্থায়ী বাসা তৈরি করে সেখানে বসবাস করে এবং এর আশেপাশে শত্রুর সন্ধান করে। নিজেদের বসতির উপর, বিশেষ করে রানী পিপীলিকার উপর কোনো আক্রমণের সম্ভাবনা দেখলেই এরা শত্রুর উপর আক্রমণ করে বসে এবং অধিকাংশ সময়ই খুব সহজেই শত্রুকে ঘায়েল করতে পারে। আর যদি শত্রু আক্রমণ করেই বসে, তবে অনুগত সৈন্যের মতো এরা নিজের জীবন বাজি রেখে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করে এবং রানীকে রক্ষা করতে গিয়ে প্রায়ই মৃত্যুবরণ করে।
তবে পিপীলিকার মধ্যে একটি বিশেষ প্রজাতি আছে, যারা নিজ সম্প্রদায়কে শত্রুর হাত থেকে রক্ষার জন্য শুধু শত্রুর সাথে যুদ্ধ করেই জীবন দেয় না, এরা শত্রুর মুখোমুখি হওয়া মাত্র এর উপর সরাসরি আত্মঘাতী হামলা করে বসে। এই জাতীয় পিপীলিকা শত্রুর দ্বারা হুমকির সম্মুখীন হলে তাকে আক্ষরিক অর্থেই জাপটে ধরে এবং পেটের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে রাসায়নিক পদার্থের নিঃসরণ ঘটিয়ে নিজেও নিহত হয়, শত্রুকেও হত্যা করে।
প্রচলিতভাবে কামিকাজি পিপীলিকা, মালয়েশিয়ান পিপীলিকা, মালয়েশিয়ান বিস্ফোরক পিপীলিকা প্রভৃতি নামে পরিচিত হলেও এদের বৈজ্ঞানিক নাম Camponotus saundersi। কামিকাজি শব্দটি জাপানী, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যেসব জাপানী বৈমানিক শত্রুজাহাজ ধ্বংসের উদ্দেশ্যে বিস্ফোরক ভর্তি প্লেন নিয়ে জাহাজের উপর ক্র্যাশ করে আত্মাহুতি দিত, তাদেরকে কামিকাজি বলা হতো। সেখান থেকেই এই পিপীলিকাকে অনেকে কামিকাজি নামে সম্বোধন করে থাকেন।
এদের বসবাস প্রধানত মালয়েশিয়া এবং ব্রুনেইয়ের বনাঞ্চলে। সেজন্য এরা মালয়েশিয়ান পিপীলিকা নামেও পরিচিত। মালয়েশিয়াতেও এদের অবস্থান সব স্থানে না, শুধুমাত্র পূর্বাঞ্চলীয় রেইনফরেস্টেই এদেরকে দেখা যায়। এদের বর্ণ কালো এবং কমলা রঙের। এরা অত্যন্ত বিরল প্রজাতির প্রাণী এবং এদের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন। বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এরা সৈনিক শ্রেণীর না, কর্মী শ্রেণীর। কিন্তু তা সত্ত্বেও নিজেদের বসতিকে রক্ষার জন্য এরা আত্মঘাতী হামলার মতো চরম ত্যাগ স্বীকার করে।
প্রায় সব পিপীলিকার চোয়ালের ভেতরেই এক ধরনের গ্রন্থি থাকে, যা সাধারণত হজমের জন্য সহায়ক এনজাইম সংরক্ষণে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও প্রায় সব পিপীলিকাই সামান্য পরিমাণে রাসায়নিক পদার্থ নির্গমন করতে পারে, যা পারস্পরিক যোগাযোগের কাজে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু মালয়েশিয়ান পিপীলিকার ক্ষেত্রে এই চোয়ালের গ্রন্থির আকার অস্বাভাবিক রকমের বড় হয়ে থাকে। মাথার পর থেকে শুরু হয়ে পাকস্থলী পর্যন্ত পুরো গ্রন্থিটাই হলুদ বর্ণের ঘন আঠালো রাসায়নিক পদার্থ সঞ্চয়ের কাজে ব্যবহৃত হয়।
শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলে এরা প্রথমে শত্রুকে দুই পা দিয়ে আঁকড়ে ধরে এরপর নিজের শরীরকে শত্রুর মাথার সাথে জোরে চেপে ধরে এবং পাকস্থলীর পেশির অস্বাভাবিক রকমের সংকোচন ঘটিয়ে পেটের খোলসে ফাটল ধরিয়ে পেট চিরে ফেলে। এর ফলে গ্রন্থির ভেতরে সঞ্চিত রাসায়নিক পদার্থগুলো চারদিকে বিস্ফোরণের মতো ছড়িয়ে পড়ে। রাসায়নিক তরলের বিক্রিয়ায় শত্রুর চোখ অন্ধ হয়ে যায় এবং তরলটি ঘন ও আঠালো হওয়ায় মুখ বন্ধ হয়ে যায়। পিপীলিকার মৃতদেহটি শত্রুর শরীরের সাথে আঠার মতো আটকে যায়। ফলে শত্রু ধীরে ধীরে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুবরণ করে। এছাড়াও এই রাসায়নিক পদার্থের বিশেষ গন্ধের মাধ্যমে আশেপাশে থাকা স্বজাতীয় পিপীলিকারা সাবধান হয়ে যেতে পারে যে, কাছেই কোনো বিপজ্জনক শত্রু আছে।
মালয়েশিয়ান পিপীলিকাদের এ ধরনের আত্মঘাতী হামলা সবচেয়ে বেশি কাজে লাগে এলাকা দখলের যুদ্ধে। খাবারের সন্ধানে উপযুক্ত পরিবেশে বাসা তৈরি করার পর প্রায়ই ভিন্ন প্রজাতির পিপীলিকা, বিশেষ করে উইভার অ্যান্ট এদের উপর আক্রমণ করে এদেরকে উচ্ছেদ করে এলাকা দখল করার জন্য। তখন নিজেদের এলাকার স্বাধীনতা রক্ষার জন্য এই বীর যোদ্ধারা নিজেদেরকে উৎসর্গ করে। এছাড়াও উইভার অ্যান্ট এবং কিছু কিছু প্রজাতির মাকড়শা এদেরকে শিকার হিসেবে ধরার জন্যও আক্রমণ করে। তখনও এরা আত্মঘাতী হামলার মাধ্যমে শত্রুকে ধ্বংস করে।
মালয়েশিয়ান পিপীলিকার এই আত্মঘাতী বৈশিষ্ট্য প্রথম আবিষ্কার করেন জার্মান জীববিজ্ঞানী উলরিখ মাশউইটজ, ১৯৭৪ সালে। তিনি সর্বপ্রথম লক্ষ্য করেন যে, এদেরকে তার চিমটা বা সাঁড়াশি দিয়ে ধরতে গেলেই এরা বিস্ফোরিত হয়ে যাচ্ছে। ফলে তিনি এদের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। সাবধানে কিছু পিপীলিকাকে তিনি ইউরোপে তার গবেষণাগারে নিয়ে যান এবং সেখানেও তিনি একই ফলাফল দেখতে পান। অন্য কোনো পিপীলিকা এদের কাছাকাছি আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে আসামাত্রই এরা বিস্ফোরণে আত্মাহুতি দিচ্ছে।
সম্প্রতি মালয়েশিয়ান পিপীলিকার এই আচরণগত বৈশিষ্ট্য এবং আত্মহননের প্রক্রিয়ার উপর বেলজিয়ামের ক্যাথলিক ইউনিভর্সিটি অফ লুভেনের গবেষক জোহান বিলেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ উটাহের অবসরপ্রাপ্ত বাস্তুবিদ ডায়ানা ডেভিডসন একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। তারা ব্যাখ্যা করেন, এই পিপীলিকাগুলো শুধু তাদের বসতিকে রক্ষা করে না। তারা তাদের বসতির আশেপাশের বিস্তৃত এলাকাকে সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করে, যেন তাদের খাদ্যের সরবরাহ বাধাপ্রাপ্ত না হয়। সেজন্যই ল্যাবরেটরিতে থাকা অবস্থায়ও এরা একইরকম আচরণ করে।
তারা বলেন, প্রাণীদের মধ্যে এ ধরনের আত্মহননের উদাহরণ খুবই বিরল। কিছু মৌমাছি এবং উঁই পোকার মধ্যে এ ধরনের প্রবণতা দেখা যায়, কিন্তু সেটা সরাসরি রানীকে রক্ষা করার সময়। কিন্তু এলাকার স্বাধীনতা রক্ষার জন্য শত্রুর উপর আত্মঘাতী হামলার প্রবণতা প্রাণীজগতে আর নেই। তাদের মতে, যদিও অনেক প্রাণীই স্বজাতীয়দেরকে অথবা পরিবারকে রক্ষা করার জন্য মৃত্যু পর্যন্ত যুদ্ধ করে, কিন্তু এই পিপীলিকার ক্ষেত্রে নিজেদেরকে উড়িয়ে দেওয়ার যে উদাহরণ দেখা যায়, তাতে মনে হয়, এটি তাদের ইচ্ছাকৃত আত্মত্যাগ।
যদিও একটি শত্রুর আক্রমণ ঠেকাতে গিয়ে একটি পিপীলিকার মৃত্যুবরণকে অনেক বেশি ত্যাগ স্বীকার করা মনে হতে পারে, কিন্তু বাস্তবে মানুষের সমাজের মতোই এ ধরনের আত্মঘাতী আক্রমণ এরা শত্রুদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করে। এই পদ্ধতিতে এরা নিজের আকারের চেয়েও অনেক বড় আকৃতির এবং শক্তিশালী শত্রুকে পরাজিত করতে পারে। এছাড়া একবার আত্মঘাতী হামলা দেখার পর সহজে এদের উপর আর কেউ আক্রমণ করার সাহস পায় না। সৌভাগ্যবশত, পিপীলিকার সমাজে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধ নামে কোনো মার্কিন প্রকল্প নেই, ফলে অল্প কয়েকটা আত্মঘাতী হামলা ছাড়া বাকি সম্প্রদায় শান্তিতেই দিন কাটাতে পারে!