কমোডো ড্রাগন: সত্যিকারের ড্রাগনের খোঁজে

সূত্রের সন্ধানে

ইন্দোনেশিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে কয়েকটি দ্বীপ আছে। জনমানবহীন রুক্ষ আর উষর। আগ্নেয়পাহাড়ের উত্থিত বিষবাষ্প তাদেরকে আরো ভয়ানক করে তুলেছে। স্থানীয় লোকজন মনের ভুলেও সেগুলোর ছায়া মাড়ান না! আগ্নেয়গিরির ভয়ে নয়, বিশ্রী কুদর্শন দ্বীপে নাকি বসবাস করে ভয়ঙ্কর এক জীব। তার সম্মুখে পড়লে আর রক্ষে নেই।

বিগত শতকের শুরুর দিকের ঘটনা, বিমান আবিষ্কৃত হয়েছে। মানুষ আকাশে ভেসে বেড়াতে শিখে গেছে। এক উৎসাহী বৈমানিক তার বিমানটিকে সেদিক দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে সেটি বিধ্বস্ত হয়ে সেই দ্বীপগুলোর একটিতে ভেঙে পড়ে। বন্য দ্বীপটি ভূগোলের বইতে কমোডো নামেই পরিচিত। তুখোড় বৈমানিক কোনোভাবে নিজেকে রক্ষা করে বিমান থেকে বেরিয়ে এলো। ঘন জঙ্গলে গাছপালা একটি আরেকটির গায়ে গায়ে লেগে এক আধো-আলো-ছায়াময় পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে। বিশ্রী সব পোকামাকড় গায়ে এসে উড়ে পড়ছে। মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে দাঁতালো শুকরের চিৎকার। সেগুলোকে কোনোভাবে বুদ্ধি খাটিয়ে এড়িয়ে চলতে লাগলো সে। একসময় বন থেকে সে বেরিয়ে এলো সমুদ্রের উপকূলে।

কিন্তু সৈকতের দিকে তাকাতেই তার হৃদপিণ্ড স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। অতিকায় বীভৎস কী যেন এগিয়ে আসছে তার দিকে! ফোঁসফোঁস করে শব্দ হচ্ছে কিম্ভূতকিমাকার সেই প্রাণীর মুখ থেকে। সেই সাথে মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে আগুনের হলকা। এটা কি রুপকথার সেই ড্রাগন?

যেন এক বিভীষিকা; Source: nationalgeographic.com

অভুক্ত পাইলট নিজেকে আর সামলাতে পারলো না। ওখানেই জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লো সে। খানিক পরে পাইলট জ্ঞান ফিরে পেয়ে নিজের দিকে ভয়ে ভয়ে তাকালো। নিজের অক্ষত হাত-পা বারবার পরীক্ষা করে দেখে নিশ্চিত হলো, ভয়ংকর প্রাণীটি তার ক্ষতি করেনি। তবু সেই দ্বীপে একমুহুর্ত থাকতে নারাজ সে।

ইন্দোনেশিয়ায় জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে প্রায় চৌদ্দ হাজার দ্বীপ। প্রাণ হাতে নিয়ে পালিয়ে এলো সে দ্বীপ থেকে এবং কোনোভাবে সভ্য মানুষদের লোকালয়ে পৌঁছে গেলো।

ড্রাগনের খোঁজে

নিজের পরিচিত পৃথিবীতে ফিরে সবাইকে নিজের ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা জানাল সে। সবাইতো ব্যাপারটাকে গাঁজাখুরি গল্প হিসেবে উড়িয়ে দিলো। আর দিবেই না বা কেন? এমন এক প্রাণী যার মুখ থেকে কিনা আগুনের ফুলকি বের হয় তার অস্তিত্ত্ব কে বিশ্বাস করবে?

তবু মানুষ স্বভাবতই গল্পপ্রিয়। স্থানীয় উপকথার সাথে ফিরে আসা বৈমানিকের কাহিনী এক করে কেউ কেউ বিশ্বাস করতে শুরু করল, তাহলে সত্যিই হয়তো উপকথার কোনো প্রাগৈতিহাসিক জন্তু বেঁচে আছে ইন্দোনেশিয়ার আদিম অরণ্যে। এদের একজন ডাচ লেফটেন্যান্ট ভ্যান স্টেইন, তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ব্যাপারটির সত্য-মিথ্যা যাচাই করবেন। লোকজন নিয়ে রওনা দিলেন তিনি। তারপর অদ্ভুত জীবগুলোর একটিকে মেরে তার চামড়া ছাড়িয়ে নিয়ে পাঠিয়ে দেন জাভায়।

পরবর্তীতে ১৯২৬ সালে ডব্লিউ ডগলাস কমোডো দ্বীপে অভিযান চালান। এই অদ্ভুত প্রাণীগুলোকে দেখে বিজ্ঞানীদের আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। এক বছর পরে আমেরিকার একদল অভিযাত্রী কমোডো দ্বীপে যায়। তারা বিশদ বিবরণ প্রকাশ করে এর উপর। সেই সাথে একটি রহস্যভেদ করলেন। বিমানচ্যুত পাইলট যে অগ্নিঝলক দেখেছিলো তা আর কিছু নয়, বরং ওগুলোর জিভ। কমলা রঙের জিভগুলি যখন বাতাসে লকলক করে, মনে হয় যেন মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে আগুনের ঝলক। প্রাণীগুলোকে একেকজন একেক নামে ডাকত, এই সময় এগুলোকে জায়গার নাম অনুসারে আর চেহারা সুরতের কারণে নাম পেলো কমোডোর ড্রাগন।

বিজ্ঞানীরা নমুনাগুলোকে বিশ্লেষণ করে মত দিলেন, পঞ্চাশ কোটি বছর আগে অস্ট্রেলিয়া থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া লিজার্ড মনিটরের বংশধর এরা। প্রাণীবিজ্ঞানীরা এবার নড়েচড়ে বসলেন। জোরেশোরে গবেষণা শুরু হলো। দেখা গেলো, শুধু কমোডো দ্বীপেই নয়, আশেপাশের চারটি দ্বীপেও বসবাস রয়েছে এদের।

এবার রাশিয়ার বিজ্ঞানীরা বিষয়টি নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করলো। তাদের সাহায্যে ইন্দোনেশিয়ার বিজ্ঞানীরা একটি যৌথ অভিযান চালালো। বিশাল জাহাজে করে রওনা হওয়ার পর উপকূলে নামতেই তাদের চোখে পড়লো, আট থেকে দশ ফুট লম্বা দুইটি প্রকান্ড জানোয়ার শক্তিশালী পায়ে ভর করে লেজ ঘষতে ঘষতে এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। বাদামী রঙয়ের চামড়ায় কালো কালো ছোপ। অঙ্গভঙ্গী আর চলাচল প্রচন্ড শক্তিমত্তার পরিচয় দিচ্ছে। বিজ্ঞানীরা তাদের সাথে কয়েকটি মৃত হরিণ এনেছিল। তার কয়েকটি ছুঁড়ে দিল ওদের দিকে। মুহুর্তেই সেগুলোকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ফেলল তারা। তারপর আগ্রাসী ক্ষুধার পরিচয় দিয়ে সাবাড় করে দিলো তাদের। সেগুলোকে ধরার জন্য ফাঁদ পাতলো বিজ্ঞানীরা কিন্তু পরের দিন গিয়ে দেখলো সেই ফাঁদের দফা রফা করে দিয়েছে ভয়ংকর প্রাণীগুলো। প্রাণীগুলোকে চোখেচোখে রাখতে শুরু করলো বিজ্ঞানীদের টিম।

কয়েকটি ক্ষুধার্ত ড্রাগন খাবারের সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো। ঘটনাচক্রে একটি বুনোশুয়োর সামনে পড়ে গেল তাদের। মুহুর্তেই প্রচণ্ড লেজের আঘাতে লুটিয়ে পড়লো হতভাগ্য বুনোশুয়োর।

ভয়ংকর এরা শিকারকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ফেলে মুহুর্তে; Source: dailymail.com

কোনোভাবেই জীবিত ধরা যাচ্ছিলো না সেগুলোকে। শেষমেশ তাদের সর্বগ্রাসী ক্ষুধাকে কাজে লাগালো তারা। মোটা লোহার শিকের বাক্স বানিয়ে তাকে লতাপাতার আড়ালে লুকিয়ে রেখে তার ভেতরে রেখে দিলো একটি মৃত পশু। ভেতরে যাওয়ার জন্য রইল একটিমাত্র সরু পথ। খাবারের সন্ধান পেতেই হিসহিস শব্দ তুলে তার ভেতরে ঢুকে গেলো কমোডোর ড্রাগন। অমনি বন্ধ হয়ে গেলো খাঁচা। তাদের এনে রাখা হলো জাকার্তার চিড়িয়াখানায়। কয়েকটি ঠাঁই পেলো ল্যাবরেটরিতে। সেগুলোকে কাটাছেঁড়া করে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হলেন, এদের আদি নিবাস অস্ট্রেলিয়াতেই। পঞ্চাশ কোটি বছর আগে হারিয়ে যাওয়া জায়ান্ট লিজার্ডের বংশধর এরা।

উৎপত্তি

বিজ্ঞানীদের ধারণা, কমোডো ড্রাগন ৪০ মিলিয়ন বছর আগে বিবর্তনের ধারায় উৎপন্ন হয়েছিলো এশিয়াতে। তারপর তারা পাড়ি জমিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ায়, যেখানে নিজেদের রুপ দিয়েছিল সরীসৃপ জগতের অন্যতম বৃহদাকার এই প্রাণীতে।

আজ থেকে পনেরো মিলিয়ন বছর পূর্বে অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যকার ভূ-তাত্ত্বিক সংঘর্ষের সময় কমোডো ড্রাগনদের একটি বড় অংশ চলে আসে ইন্দোনেশিয়ার কয়েকটি দ্বীপে। পরবর্তীতে বরফ যুগ শেষ হওয়ার পর সমুদ্রের পানি বেড়ে যায় নাটকীয় ভাবে। ফলে কমোডো ড্রাগনেরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে বাইরের জগত থেকে।

দৈহিক গড়ন  

বাদামী রংয়ের উপর কালচে ছোপ মেশানো কমোডো ড্রাগনেরা অতিকায় দেখতে। আট থেকে দশ ফুট লম্বায় আর ওজন আশি থেকে নব্বই কেজি। কখনো তা একশ পঞ্চাশ কেজি ছাড়িয়ে গেছে এমন রেকর্ডও রয়েছে। তারা লম্বা, কমলা, চেরা জিভ দিয়ে গন্ধ শোঁকার কাজটা সেরে নেয়।

এক ইঞ্চি লম্বা দাঁতগুলো শিকারকে টুকরো টুকরো করার জন্য যথেষ্ট। তবু এটি তাদের প্রধান অস্ত্র নয়। প্রকৃতি তাদের দিয়েছে আরো মারাত্মক এবং অব্যর্থ একটি উপায়। তাদের লালায় মিশে থাকে ভয়ংকর ব্যাকটেরিয়া, যারা শিকারের ক্ষততে মিশে তাকে অকেজো করে তুলতে সাহায্য করে। এদের খাবারের তালিকা থেকে বাদ যায় না কিছুই।

মরা মাছ বা প্রাণী তো খায়ই, সেই সাথে শিকারের জন্য এরা অলক্ষ্যে অপেক্ষা করে। যখন কোনো শিকার কাছাকাছি অপেক্ষা করে, তীব্রগতিতে আঘাত হানে এরা। এদের শক্তিশালী লেজের আঘাতে শুয়োর বা হরিণ কুপোকাত হওয়া স্বাভাবিক ঘটনা। বিভিন্ন প্রাণীর ডিম, সাপ, এমনকি স্বজাতিকে দিয়ে আহার সারতেও এরা দু’বার ভাবে না। এদের শক্তিশালী ঘ্রাণশক্তির মাধ্যমে কয়েক কিলোমিটার দূর থেকেই খাবারের সন্ধান করতে পারে।

বিজয়ী লাভ করবে একটি পরিপূর্ণ সঙ্গমের সুযোগ; Source: dailymail.com

সাধারণত মে- আগস্টে এরা মিলিত হয় এবং সেপ্টেম্বরে ডিম পাড়ে। মেয়ে ড্রাগন সাধারণত ত্রিশটি ডিম পাড়ে এবং কয়েক মাস পাহারা দেয়। বাচ্চা ড্রাগনের জীবনের প্রথম কয়েক বছর কাটে গাছে গাছে, লুকিয়ে লুকিয়ে। কেননা অন্য সকল শিকার তাদের জন্য ওঁত পেতে বসে থাকে। এদের মধ্যে রয়েছে তাদের স্বজাতিরাও। বাচ্চারা সাধারণত সবুজাভ হলদে কালোয় মেশানো থাকে। চারপাশের পরিবেশ থেকে দুর্বল শিশু ড্রাগনেরা নিজেকে রক্ষা করে চলে সে, যতক্ষণ না নিজেই হয়ে উঠছে ভয়ানক এক শিকারী, কমোডো দ্বীপের ত্রাস; কমোডো ড্রাগন।

ফিচার ইমেজ- metro.co.uk

Related Articles

Exit mobile version