আমাদের চারপাশে কত হাজার রকম আওয়াজের বিচরণ। এর মধ্যে কিছু আওয়াজ মাধুর্যকর, তো কিছু অনাকাঙ্খিত বা বিরক্তিকর। আছে এমন অনেক নগণ্য আওয়াজ যা সাধারণ মানুষ ধর্তব্যেই নেয় না, যেমন- কারো হাই তোলার আওয়াজ, খাবার চিবিয়ে খাওয়ার আওয়াজ, ঢেঁকুর তোলা, নাক ডাকা বা হাঁচি দেয়ার আওয়াজ, ধাতব জিনিস মেঝেতে পড়ার আওয়াজ, ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দ বা বাচ্চাদের কান্নার আওয়াজ। এমন সব তুচ্ছ আওয়াজে যদি আপনার তীব্র বিতৃষ্ণা থাকে বা নির্দিষ্ট এসব আওয়াজ শুনলেই আপনার বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, তাহলে আপনার এই সমস্যাটিকে বলে মিসোফোনিয়া (Misophonia)।
মিসোফোনিয়ার সাথে হাইপারঅ্যাকিউসিসকে (Hyperacusis) গুলিয়ে ফেলবেন না। যেকোনো উচ্চ মাত্রার আওয়াজে সবারই সমস্যা হয়। তীব্র মাত্রার কোনো আওয়াজে শরীরের বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রদর্শনকে হাইপারঅ্যাকিউসিস বলে; যেমন- গাড়ির হাইড্রোলিক হর্ণ, উচ্চস্বরের মাইক বা সাউন্ড বক্সের আওয়াজে সৃষ্ট সমস্যা। অন্যদিকে মিসোফোনিয়া হলো সুনির্দিষ্ট এক বা একাধিক আওয়াজের প্রতি থাকে বিতৃষ্ণা, এখানে আওয়াজ তীব্র না-ও হতে পারে।
মিসোফোনিয়া একপ্রকার স্নায়বিক সমস্যা, যার কারণে শ্রবণ উদ্দীপক বস্তুসমূহ মস্তিষ্কের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে গোলমাল পাকিয়ে বসে। ঠিক কী কারণে মিসোফোনিয়া হয়, তা এখনও একটি রহস্য। তবে এটি যে শুধু কর্ণকুহর বিষয়ক সমস্যা নয়, তাতে বিশেষজ্ঞরা একমত। এই সমস্যা আংশিক শারীরিক ও আংশিক মানসিক। কেননা, নির্দিষ্ট কিছু আওয়াজ এক বিশেষ প্রক্রিয়ায় মানুষের মস্তিষ্ককে আক্রান্ত করে এবং তাৎক্ষণিক শারীরিক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। অপ্রিয় সেই আওয়াজটির সম্মুখীন হলে মানুষ নিজের উপর প্রায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বসে। সুতরাং শরীর ও মন উভয়েই এই সমস্যার ধারক।
মিসোফোনিয়া, সিলেকটিভ সাউন্ড সেনসিটিভিটি সিনড্রোম (Selective Sound Sensitivity Syndrome) নামেও পরিচিত। সাধারণত ৯ থেকে ১৩ বছর বয়স পর্যন্ত ব্যক্তিবিশেষের মধ্যে এই সমস্যা গড়ে উঠতে পারে। মূলত বাল্যকালে শুরু হলেও এর লক্ষণ যেকোনো বয়সেই ধরা পড়তে পারে। যখন অতি সাধারণ আওয়াজ যা অন্যান্য মানুষ লক্ষ্যই করে না, অথচ আপনার উত্তেজনা ও নিয়ন্ত্রণহীনতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তখনই বুঝে নিতে হবে আপনি এই সমস্যায় ভুগছেন। একটি মাত্র আওয়াজের প্রতি অস্বস্তি থেকে মিসোফোনিয়া শুরু হতে পারে এবং পরবর্তীতে আরও অনেক ধরনের আওয়াজ এই তালিকায় যোগ হতে পারে। যদিও এই সমস্যায় মানুষ অনেক আগে থেকে ভুগে আসছে, তারপরেও মেডিক্যাল কন্ডিশন হিসেবে মিসোফোনিয়ার স্বীকৃতি এই নব্বইয়ের দশক থেকে।
মিসোফোনিয়া নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়েছে, হয়ে চলেছে। ব্রিটিশ ভিত্তিক একটি গবেষক দল ২০ জন প্রাপ্তবয়স্ক মিসোফোনিয়ায় আক্রান্ত মানুষের উপর এবং ২২ জন স্বাভাবিক মানুষের উপর একই সময়ে আলাদা আলাদাভাবে পরীক্ষা করেন। বিভিন্ন আওয়াজের প্রতি তাদের প্রত্যেকের অস্বস্তিকে তুলনামূলক রেটিং করা হয়। এর মধ্যে ছিল সাধারণ সংঘটক আওয়াজ বা কমন ট্রিগার সাউন্ড (খাওয়ার ও শ্বাস নেবার আওয়াজ), সার্বজনীন বিরক্তিকর আওয়াজ (বাচ্চার কান্না ও মানুষের চিৎকার) এবং নিরপেক্ষ আওয়াজ (বৃষ্টি পড়ার আওয়াজ)। ট্রিগার সাউন্ডগুলোকে মিসোফোনিয়া আক্রান্ত মানুষরা অতিমাত্রায় বিরক্তিকর বলে চিহ্নিত করে, অপরদিকে স্বাভাবিক মানুষরা এতে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। বাকি আওয়াজগুলোর ক্ষেত্রে দু’টি দলের অস্বস্তিই সমান মাত্রার দেখা যায়। এ থেকে বোঝা যায়, মিসোফোনিক মানুষরা কতিপয় ট্রিগার সাউন্ড দ্বারা সাধারণ মানুষদের তুলনায় অনেক বেশি আলোড়িত হন। অন্যান্য আওয়াজের ক্ষেত্রে সাধারণের সাথে তাদের কোনো পার্থক্য নেই।
গবেষণায় এই দল আরও খুঁজে পায় যে, মস্তিষ্কের একটি বিশেষ অংশ মিসোফোনিয়ার উৎপত্তিস্থল। এই অংশটি হলো অ্যান্টেরিয়র ইনস্যুলার কর্টেক্স (Anterior Insular Cortex) বা AIC। এই অংশটি একইসাথে রাগ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে এবং হৃৎপিন্ড ও ফুসফুস থেকে আসা ইনপুটগুলোর সাথে অন্যান্য বহিরাগত ইনপুটকে একীভূত করতে সাহায্য করে। fMRI Scan ব্যবহার করে মস্তিষ্কের কার্যকলাপ লক্ষ্য করে দেখা যায়, মিসোফোনিক মানুষদের ক্ষেত্রে ট্রিগার সাউন্ড ব্যবহার করলে মস্তিষ্কের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে এই AIC বেশি উত্তেজিত হয়। পাশাপাশি যে অংশগুলোতে দীর্ঘকালীন স্মৃতি সঞ্চিত থাকে এবং যেসব অংশ ভয় ও অন্যান্য অনুভূতির উৎপত্তিস্থল হিসেবে কাজ করে, সেগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে। এ থেকেই বোঝা যায় মিসোফোনিকদের নির্দিষ্ট আওয়াজে তীব্র অস্বস্তি বা আতঙ্কের মতো অনুভূতিপ্রবণ প্রতিক্রিয়া দেখানোর কারণ।
এছাড়াও গবেষকরা সমগ্র মস্তিষ্কের MRI করে দেখেন মিসোফোনিক ব্যক্তিদের স্নায়ুকোষে মায়েলিনের (Myelin) পরিমাণ বেশি থাকে। মায়েলিন এক ধরনের চর্বি জাতীয় পদার্থ, যা মস্তিষ্কের স্নায়ু কোষগুলোকে জড়িয়ে রাখে এবং ইনস্যুলেটর হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ এটি কোষগুলোকে তড়িৎ অন্তরক করে রাখে, ঠিক যেভাবে বৈদ্যুতিক তার অন্তরীত করা হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, মস্তিষ্ক অসংখ্য স্নায়ুকোষ দ্বারা গঠিত এবং এসব কোষের মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন অনুভূতি এবং প্রতিক্রিয়া তড়িৎ সংকেত হিসেবে প্রেরিত হয়। অতিরিক্ত মায়েলিন মিসোফোনিয়ার অন্যতম কারণ নাকি এর ফলাফল, তা এখনও জানা যায়নি।
ট্রিগার সাউন্ডের কিছু উদাহরণের মধ্যে আছে হাই তোলা, হেঁচকি, নাক টানার আওয়াজ, নাক ডাকার আওয়াজ, প্লাস্টিকের বোতল মোচড়ানোর আওয়াজ, কলমের ক্লিক, ধাতব বাসনের শব্দ, প্লেটে কাঁটা চামচের ঘষা, কাগজে কলম ঘষার আওয়াজ, ফোনের ম্যাসেঞ্জারের শব্দ, কী-বোর্ড বা মাউস টেপার আওয়াজ ইত্যাদি।
ট্রিগার সাউন্ডের সম্মুখীন হলে মিসোফোনিক ব্যক্তিদের মধ্যে বেশ কিছু লক্ষণ ফুটে ওঠে; যেমন- তাদের হার্টবিট রেট বেড়ে যায় ও প্রচুর ঘাম হয়। অনেক সময় তীব্র উত্তেজনায় এরা অন্যদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তেও পারে! এই বিষয়টির পেছনে কাজ করে কোনো অতীত স্মৃতি, মানসিক অস্বস্তি বা কোনো ভয়। স্বাভাবিকভাবেই এদের সামাজিক জীবন ব্যাহত হয়। কোনো সামাজিক জমায়েতে স্বস্তিদায়ক অবস্থান খুঁজে পেতে এদের সমস্যা হয় এবং এরা অনিরাপত্তায় ভোগে। কর্মস্থলে নিজের পারিপার্শ্বিকতার উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারা এদের জন্য মুশকিল হয়ে পড়ে। সহকর্মীর খাবার খাওয়ার শব্দে কারও প্যানিক অ্যাটাক হওয়াটাও সম্ভব। এসবের কারণে মিসোফোনিক ব্যক্তিদের মধ্যে ভর করে দুশ্চিন্তা ও বিষণ্ণতা। এরা হয়ে পড়ে নিঃসঙ্গ। সমস্যাগুলো কাউকে বললে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিদ্রূপের শিকার হতে হয় ও সমস্যা বাড়ে বলে আক্রান্ত ব্যক্তি আরও বেশি কোণঠাসা হয়ে পড়ে।
মিসোফোনিয়ার প্রতিকার হিসেবে ডাক্তাররা বিভিন্ন ধরণের থেরাপির ব্যবস্থা করে থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে কানে এক প্রকার হিয়ারিং এইড লাগানো হয় যা ট্রিগার সাউন্ডগুলোকে বিভ্রান্ত করে। এছাড়া কাউন্সেলিং ও অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টের ব্যবহারও করা হয়ে থাকে। যেকোনো সমস্যা চেপে রাখলে তা শুধু বাড়বেই। বিশ্বস্ত কেউ বা প্রফেশনাল কারো সাথে সমস্যার বিষয়ে কথা বলা দরকার। অনলাইনে অনেক সোশ্যাল মিডিয়া গ্রুপ পাওয়া যায় যেখানে অভিজ্ঞতা ও সমস্যার সাথে এঁটে ওঠার কৌশল নিয়ে পারষ্পারিক কথাবার্তা চালানো যায়। এছাড়া নিয়মিত শারীরিক কসরৎ ও পরিমিত ঘুমের দ্বারা দুশ্চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়াস চালাতে হবে।
মিসোফোনিয়া এমন একটি সমস্যা যেখানে শরীর ও মন উভয়েই জড়িত। তাই উভয়ের অনুশীলনের মাধ্যমেই এর সমাধান করতে হবে। এটা হয়তো কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। যেকোনো পরিস্থিতিতে আত্মবিশ্বাস ধরে রাখাটাই সবচেয়ে জরুরি।