Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

প্রাকৃতিক ইন্টারনেট: যে ইন্টারনেট ব্যবহার করে উদ্ভিদেরা

সাধারণত ইন্টারনেট বলতে বোঝায় কম্পিউটারের সাথে কম্পিউটারের আন্তঃযোগাযোগ। বর্তমানে ইন্টারনেটে ১৯০টিরও অধিক দেশের লক্ষ লক্ষ কম্পিউটার একে অপরের সাথে সংযুক্ত রয়েছে। ইন্টারনেট আবিষ্কার ও তা ব্যবহারের ইতিহাস খুব বেশি পুরনো নয়। ইন্টারনেট ১৯৬৯ সালে উদ্ভাবিত হয়। বর্তমানে এর সাথে আমরা সবাই কম-বেশি পরিচিত। তথ্য আদান-প্রদান, দূর-দূরান্তের সাথে যোগাযোগ স্থাপন ছাড়াও নানাবিধ কাজ দ্রুততার সাথে সম্পাদন করতে ইন্টারনেটের জুড়ি মেলা ভার।

ইন্টারনেট শুধু যে মানুষই ব্যবহার করছে তা নয়, প্রকৃতিতেও ইন্টারনেট ব্যবহারের কথা জানা যায়। অবাক হয়েছেন? এরপর আরো অবাক হবেন, যখন জানবেন এই প্রাকৃতিক ইন্টারনেট ব্যবস্থা উদ্ভিদেরা লক্ষ লক্ষ বছর ধরে ব্যবহার করে আসছে।

মানুষের ইন্টারনেট ব্যবস্থায় সংযোগ; Source: digitalunite.com

ইন্টারনেট সিস্টেমে কম্পিউটারের সাথে কম্পিউটারের সংযোগ স্থাপন করার জন্য সাধারণত কপার তার, অপটিক্যাল ফাইবার এবং বেতার তরঙ্গ ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও অনেকগুলো কম্পিউটার স্যাটেলাইটের সাথে যুক্ত থাকে। তাহলে প্রাকৃতিক ইন্টারনেট সিস্টেমে গাছপালার মাঝে সংযোগ স্থাপন করে কে?

ছত্রাক? হ্যাঁ, এই ছত্রাককেই বলা হয় পৃথিবীর প্রাকৃতিক ইন্টারনেট। যেখানে ছত্রাকের মূল শরীর অনেকাংশে স্যাটেলাইটের মত কাজ করে। আর ছত্রাকের মাইসিলিয়াগুলো তামার তার বা অপটিক্যাল ফাইবারের ন্যায় কাজ করে। মাইসিলিয়াম (বহুবচন- মাইসিলিয়া) হচ্ছে ছত্রাকের শাখাযুক্ত নলাকার সুতার ন্যায় গঠন, যেগুলো আণুবীক্ষণিক থেকে খালি চোখেও দেখা যায়।

Image Source: missioncommunitymarket.org

সাধারণত উদ্ভিদ ও ছত্রাকের পারস্পরিক নির্ভরতার মাধ্যমে উভয়ের উপকার লাভের প্রক্রিয়াকে বলা হয় মাইকরাইজাল মিথোজীবিতা। এই নির্ভরতার জন্য ছত্রাক, গাছের মূলে আশ্রয় নেয়। অতঃপর তা গাছকে পানি ও পুষ্টি উপাদান গ্রহণে সক্ষম করে তোলে। অপরদিকে গাছ ছত্রাককে শর্করা জাতীয় খাদ্য প্রদান করে। এভাবে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া না থাকলেও ছত্রাক শর্করা জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করে বেঁচে থাকে। উদ্ভিদ ও ছত্রাকের এই মিথোজীবিতা উনিশ শতকে জার্মান জীববিজ্ঞানী আলবার্ট বার্নাড ফ্রাঙ্ক আবিষ্কার করেন।

ছত্রাকের সাথে উদ্ভিদের মাইকোরাইজাল মিথোজীবিতা; Image Source: wonkonthewildlife.com

উদ্ভিদজগৎ সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ ভাস্কুলার স্থলজ উদ্ভিদ (যাদের জাইলেম ও ফ্লোয়েম টিস্যু রয়েছে; যেমন- ফার্ন, হর্সটেইল, লাইকোপড ইত্যাদি) মাইকোরাইজাল মিথোজীবিতার উপর নির্ভর করে বেঁচে আছে। ফ্রাঙ্কের মিথোজীবিতার পদ্ধতি হতে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত মানুষের ধারণা ছিল যে, ছত্রাকের মাধ্যমে একক উদ্ভিদ প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান পায়।

ছত্রাক যদি হয় স্যাটেলাইট, উদ্ভিদ যদি হয় কম্পিউটার আর তথ্য আদান-প্রদানের জন্য মাইসিলিয়া যদি হয় তামার তার, তবে এখনও উদ্ভিদের ইন্টারনেট ব্যবস্থায় পুরোপুরি সংযোগ স্থাপিত হয়নি। কারণ মানুষের আবিষ্কৃত ইন্টারনেট ব্যবস্থায় যেমন একাধিক কম্পিউটার সংযুক্ত থাকে, তেমন মাইসিলিয়ামের মাধ্যমে একাধিক উদ্ভিদ একে অপরের সাথে সংযুক্ত থাকে। দেখা যাক, প্রাকৃতিক ইন্টারনেট ব্যবস্থায় একাধিক গাছের সংযোগ আছে কিনা।

ছত্রাক থেকে বের হওয়া মাইসিলিয়া স্থলভাগের প্রায় সব স্থানেই বিস্তৃত হয়ে আছে। এছাড়া জলেও ভাসমান অবস্থায় ছত্রাকে সুতার ন্যায় বস্তু তথা মাইসিলিয়াম কোষ পাওয়া যায়। মাইসিলিয়াম সাধারণত এক মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। এগুলো মাটির নিচে প্রায় এক ঘন ইঞ্চি পর্যন্ত প্রবেশ করতে পারে। অর্থাৎ প্রাকৃতিক ইন্টারনেট ব্যবস্থার সংযোগ ক্যাবল বা তার আমাদের পায়ের নিচেই বিস্তৃত হয়ে আছে।

এভাবে বিশাল পরিসরে বিস্তৃতি লাভ করে ছত্রাক; Image Source: ww2.kqed.org

ছত্রাক মাদুরের মত বিস্তৃতি লাভ করতে পারে। প্রতি আউন্স মাটিতে হাজার হাজার প্রজাতির ছত্রাক রয়েছে। ধারণা করা হয়, বিশ্বে ৬০ লক্ষ প্রজাতির ছত্রাক রয়েছে, যার মধ্যে মাত্র ৫০-৭৫ হাজার প্রজাতিকে তালিকাভূক্ত করা হয়েছে। ছত্রাকের কিছু কিছু প্রজাতি আছে যারা একত্রিত হয়ে ২০,০০০ একরেরও অধিক এলাকা ঢেকে ফেলতে পারে। কিছু কিছু ছত্রাক যেমন- হোয়াইট বাটন ছত্রাক (Agaricus bisporus) একাই ওরিগন’স ব্লু পর্বতের ২,৩৮৪ একর এলাকা ছেয়ে ফেলেছিল। নীল তিমিকে বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ প্রাণী বলা হলেও পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জীব আবিষ্কৃত হয় ১৯৯৮ সালে। জীবটি হচ্ছে Armillaria ostoyae নামক ছত্রাক, যা লম্বায় প্রায় ১১০ ফুট। অপরদিকে তিমি মাছ ৯৮ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে।

শুধু ছত্রাকই যদি এই বিশাল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে যেতে পারে তবে তা থেকে বের হয়ে আসা মাইসিলিয়ামের বিস্তৃতি কিন্তু কম হওয়ার কথা নয়। মাইসিলিয়াম একত্রে পেঁচিয়ে ০.২ ইঞ্চি ব্যাসের ৩০ ফুট লম্বা সুতার সমান হতে পারে। তাছাড়াও এগুলো প্রতিদিন ১/৪ ইঞ্চি থেকে ২ ইঞ্চি পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়।

মাইসিলিয়া মাটির নিচে বিস্তার লাভ করে। এ সময় এরা বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে। এই সংযোগের মাধ্যমে একই প্রজাতির অথবা ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদের মাঝে তথ্য আদান-প্রদান ঘটে। তথ্য প্রদানের মাধ্যমে ক্ষতিকর কোনো জীবাণু বা কীট থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য সংকেতও প্রদান করে।

মাইসিলিয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পরিবেশের হঠাৎ পরিবর্তনে সাড়া দেয়। এছাড়াও মাইসিলিয়ামের মাধ্যমে উদ্ভিদ বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ পাঠিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত উদ্ভিদকে মেরে ফেলতে পারে। এভাবে উদ্ভিদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। অনেকটা সাইবার ক্রাইমের মতো, তাই নয় কি? এই সমস্ত বিষয়টিকে উদ্ভিদের ক্ষেত্রে ‘wood wide web’ বলে আখ্যায়িত করা হয়।

wood wide web এ দুটি উদ্ভিদের মাইসিলিয়ার সংযোগ ও সংকেত; Source: woodwideweb.no

অবশেষে জানা গেল, ছত্রাকের মাইসিলিয়াম মানুষের ব্যবহৃত ইন্টারনেটের তামার তারের ন্যায় কাজ করে। তাহলে সত্যিকারার্থেই বলা যায়, উদ্ভিদেরও নিজস্ব ইন্টারনেট ব্যবস্থা রয়েছে।

প্রাকৃতিক ইন্টারনেট ব্যবস্থা সম্পর্কে ১৯৭০ সালে প্রথম ধারণা দিয়েছিলেন পল স্ট্যামেটস। ২০০৮ সালে তিনি একটি ভিডিও বার্তায় উদ্ভিদ ও ছত্রাকের দ্বারা গঠিত প্রাকৃতিক ইন্টারনেট ব্যবস্থা নিয়ে তার ধারণার কথা ব্যক্ত করেছিলেন। তবে ১৯৯৭ সালে ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা সুজান সিমার্ড ছত্রাকের ইন্টারনেট ব্যবস্থাকে সর্বপ্রথম প্রমাণ করতে সক্ষম হন। তিনি দেখান, Douglas fir এবং Paper birch উদ্ভিদ ছত্রাকের মাইসিলিয়ার মাধ্যমে একে অপরের মধ্যে কার্বন স্থানান্তর করে। এছাড়াও উদ্ভিদ একই উপায়ে নাইট্রোজেন ও ফসফরাস স্থানান্তর করে।

উদ্ভিদের ইন্টারনেট ব্যবস্থায় বৃহৎ উদ্ভিদ থেকে ছোট উদ্ভিদ সাহায্য পায়। এই সহায়তা ছাড়া অনেক চারাগাছ বাঁচতে পারতো না। তাছাড়াও ১৯৯৭ সালের গবেষণায় সিামার্ড প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে, ছায়াযুক্ত স্থানে জন্মানো চারাগাছ খাদ্যের অভাবে থাকাকালীন দাতা উদ্ভিদ থেকে প্রচুর পরিমাণ কার্বন গ্রহণ করে। তাই তিনি উদ্ভিদের একক অস্তিত্বের ধারণা থেকে বেরিয়ে আসেন এবং বেঁচে থাকার জন্য সবাই একে অপরের উপর নির্ভরশীল- এ কথাও ব্যক্ত করেন। ২০১১ সালে তার এক ডকুমেন্টারীতে বলেন- “These plants are not really individuals in the sense that Darwin thought they were individuals competing for survival of the fittest.”। সহজভাবে বলা যায়, উদ্ভিদজগতের নিজস্ব ইন্টারনেট ব্যবস্থা থাকায় প্রতিযোগীতার মাধ্যমে শুধু যোগ্যতমরাই টিকে থাকবে- এই কথাটি গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলছে।

ফিচার ইমেজ- touchonelife.org

Related Articles