Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

পাখিদের প্রবাস জীবন

বিদেশ ভ্রমণের প্রতি মানুষের ঝোঁক টের পাওয়া যায় সভ্যতার শুরু থেকে। হাওয়া বদলের নামে, জীবিকার টানে অথবা শিক্ষার বায়নায় জ্ঞানের গরিমার খাদ পুরো করতে মানুষ স্বদেশ ছেড়েছে বারবার। প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যে, উত্তর থেকে দক্ষিণে ছুটেছে, ছুটেই চলেছে। স্থলে, জলে বা আকাশপথে নিজের মাটি থেকে অন্য মাটিতে যাতায়াত হয়েছে ক্রমে ক্রমে। মানুষ যেমন পাখির উড়তে থাকা দেখে বারবার গান গেয়েছে,

এমন যদি হতো
আমি পাখির মতো
উড়ে উড়ে বেড়াই সারাক্ষণ

তেমনই বানিয়েছে উড়োজাহাজের মডেল। আচ্ছা, মানুষ এই ‘বিলেত ভ্রমণ’-এর কায়দা কি কোনোভাবে পাখিদের থেকে শিখেছে? শিখতেই পারে!

মানুষ ও পাখির বন্ধুত্ব; Image Source: Woman’s World

আনুমানিক ১৬ কোটি বছর আগে জুরাসিক যুগে পাখিদের আগমন এই পৃথিবীতে। সামাজিক প্রাণী হওয়ায় মানুষের সাথে পাখির বসবাস বেশ প্রাচীন। মানুষ পাখিকে পোষ মানিয়েছে। এক ঘরে থেকেছে পোষ না মানিয়েও। নিরীহ এই প্রাণী মানুষের এতটাই কাছাকাছি এসেছে যে মেটাফোরিকে মানুষ তার প্রিয়তমাকে রীতিমতো ‘পাখি’ ডাকা শুরু করেছে! মানুষের স্বভাবসুলভ আচরণে পাখিদের পোষ মানিয়ে রাখতে চেয়েছে খাঁচায়। অথচ ভালোবাসাকে খাঁচায় বন্দী করে রাখতে হয় না , এটা যেন পাখিই বুঝিয়েছে বারবার। পাখি তার প্রয়োজনে পাড়ি দিয়েছে হিমালয়। সাইবেরিয়া থেকে দক্ষিণে, আরও দক্ষিণে এসে এই বঙ্গে। ইঙ্গিতে পরিযায়ী পাখি। আমরা আদর করে যাদের অতিথি পাখি ডাকি। এই অতিথি পাখিদের শুরুর গল্প জানা যাক আজ।

হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে এক দেশ হতে ভিনদেশে বিচরণ করে যাচ্ছে পাখিরা। দেখতে খুব বেশি বড় না হলেও, বিশেষ করে মানুষের মতো আকৃতিগত ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ না থাকলেও, বুদ্ধিমত্তায় এরা কিন্তু কম যায় না। ব্যাপারটা অতিরঞ্জিত শোনালেও কাকতালীয়ভাবে ঘটনা কিছুটা তা-ই বটে।   

পাখিদের কোনো আকাশসীমা নেই। রাডারে পাখিরা আটকায় না। মহীনের ঘোড়াগুলির মতো তাদের নেই দেশ, কাল, সীমানার গণ্ডি। পৃথিবীতে প্রায় লাখ পাঁচেক প্রজাতির পাখি আছে। এসবের মধ্যে অনেক প্রজাতিই বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় নিজ দেশ থেকে অন্য দেশে চলে যায় নেহাৎ প্রয়োজন বলেই। কিছু কিছু পাখি তাই প্রতি বছর ২২ হাজার মাইল পথ অনায়াসে উড়ে চলে যায় ভিনদেশে। আমাদের দেশে অতিথি পাখিরা অতটা পথ পাড়ি না দিলেও তাদের পেরোনো দূরত্ব কমও নয়। বরফ শুভ্র হিমালয় পেরিয়েই বেশিরভাগ অতিথি পাখির আগমন ঘটে। এসব পাখি হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত লাদাখ থেকে কেন্দ্রীয় এশিয়ান ইন্ডিয়ান ফ্লাইওয়ে দিয়ে প্রবেশ করে।

বেড়াতে যাচ্ছে পাখির দল; Image Source: Deutsche Welle

এরা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৬০০-১,৩০০ মিটার উপর দিয়ে উড়ে বেড়ায়। ছোট পাখিদের ঘণ্টায় গতি প্রায় ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত। দিনে-রাতে এরা প্রায় ২৫০ কিলোমিটার উড়তে পারে। যারা একটু পরিণত, এরা ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার অনায়াসে উড়তে পারে। আশ্চর্যের বিষয়, এই পাখিরা নিজেদের গন্তব্যস্থল সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারে!

এখন প্রশ্ন হতেই পারে, এসব পাখি এত দূর থেকে প্রতি বছর পথ চিনে আসে কী করে? তারা কি পথ হারায় না? পাখিরা পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র দিয়ে পথ চিনতে পারে। আমাদের গ্রহের একটি নিজস্ব চৌম্বকক্ষেত্র আছে, আর পাখিদের মস্তিষ্কে ম্যাগনেটাইট আছে প্রাকৃতিকভাবে। এটি ছোট্ট কম্পাসের মতো দিকনির্ণয়ে কাজ করে। অনেকে মনে করেন, পাখিদের চোখেই কিছু একটা থাকার দরুন তারা ঐ চৌম্বকক্ষেত্র সরাসরি টের পায় এবং এর সাহায্যে উত্তর-দক্ষিণ দিক চিনতে পারে অনায়াসে। পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র আমরা দেখতে পাই না, রেখাগুলো দেখে আপাতপক্ষে মনে হবে, দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে আড়াআড়ি ঢুকছে।    

পৃথিবীর চৌম্বকরেখা; Image Source: Stand For Magnet

উল্লেখ্য, উত্তর এবং দক্ষিণ মেরুতে অরোরা নামে যে সুন্দর প্রাকৃতিক আলোর খেলা দেখা যায়, তাতেও এ চৌম্বকক্ষেত্রের ভূমিকা রয়েছে। 

কিছু পাখি আবার সূর্য আর তারার অবস্থান থেকে পথ চিনে নেয়, রাস্তা বানায় নিজের মতো। এই পাখিরা সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি টের পায়। নরওয়েতে যখন সূর্যাস্ত হয়, তখন সূর্যের অবস্থান থেকে দিকনির্ণয় করতে পারে। পাখিদের মাঝে যারা বিজ্ঞান কম বোঝে, মানে ছাত্র খারাপ, তারা শর্টকার্টে দিক বুঝতে পারে তাদের চারপাশের পরিবেশ দেখে, যেমন- নদী, পাহাড়, রাস্তা ইত্যাদি।

নদীর বাতাসে শীতের আমেজ লাগতেই আমাদের হাওর, বিল, চরাঞ্চলে দেখা যায় সহস্রাধিক অতিথি পাখি। ইংল্যান্ডের নর্থ হ্যাম্পশায়ার, সাইবেরিয়া কিংবা এন্টার্কটিকার তীব্র শীত থেকে গা বাঁচাতে এরা পাড়ি জমায় দক্ষিণের কম শীতের দেশে।

উড়ন্ত পাখিরও আছে গণিত! Image Source: NPR

এই ফাঁকে একটা গল্প পাতা যাক। একদিন এক বালক আকাশে পাখি ওড়া দেখতে দেখতে খেয়াল করে, পাখিরা অদ্ভুত এক নিয়মে ওড়ে। দুনিয়া আমাদের জন্য যথেষ্ট নিয়ম বেধে দিয়েছে- একথা সত্য; কিন্তু পাখিদের জন্য এ কেমন নিয়ম! আকাশে পাখি ওড়া দেখে সেই বালক লিওনার্দো বোনাচি ওরফে ফিবোনাচ্চি এক রাশিমালা আবিষ্কার করে বসে। এ রাশিমালায় পাখিরা ইংরেজি অক্ষর ‘ভি’ আকৃতির মতো ওড়ে। ১ ,১, ২, ৩, ৫, ৮, ১৩, ২১, ৩৪ … এই ধারা অনুসরণ করে। এই রাশিমালাকে ফিবোনাচ্চি বা ফিবোনাক্কি রাশিমালা নাম দেয়া হয় পরে।

মজার ব্যাপার হলো, হাঁসেরা যখন দলবেধে হাঁটে, তখনও এ রাশিমালা অনুসরণ করে। সূর্যমুখীর পাতাও একইভাবে সজ্জিত থাকে। পাখিদের এই ‘ভি’ আকৃতি বা রাশিমালায় ওড়ার বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলা যাক। একটা পাখির পক্ষে একা তারা যে নিয়মে ওড়ে, তাতে একটানা সাড়ে চার হাজার কিলোমিটার অতিক্রম করা অনেক কঠিন। হয়তো সম্ভবই নয়। কারণ সব পাখির শক্তিমত্তা সমান থাকে না। পাখিকে  প্রচণ্ড বাতাসের চাপ পেরিয়ে উড়তে হয়।

উপরের ছবিতে একেবারে ডানে যে পাখিটাকে দেখা যাচ্ছে, সে এখানে দলনেতা। এতগুলো পাখির মধ্যে সে সবচেয়ে বেশি শক্তি ব্যয় করে, অর্থাৎ বাতাসের চাপ ক্রমেই কাটিয়ে যাচ্ছে। এর পরে যে আছে, সে অপেক্ষাকৃত একটু কম শক্তি ব্যয় করছে তার সামনেরজনের থেকে। ঠিক পরে যে দুটি পাখি আছে, তারা তার আগের পাখির চেয়ে আরেকটু কম শক্তি ব্যবহার করছে। প্রতিটি সারিতে এক্ষেত্রে একই নিয়ম প্রযোজ্য, এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটবে না। নির্দিষ্ট একটা সারির পাখিরা তার আগের চেয়ে কম শক্তি ব্যয় করে ওড়ে এবং তারপরের সারি এর চেয়ে বেশি শক্তি ব্যয় করে। কিছুক্ষণ পর পর তারা ক্রমানুসারে তাদের অবস্থানের পরিবর্তন করবে। এভাবেই চলে পাখিদের হাজার হাজার মাইলের অবিশ্বাস্য এক যাত্রা।

এসব পাখির মধ্যে বাংলাদেশের অতি পরিচিতি অতিথি পাখি নর্দান পিনটেইল; সেই সাথে স্বচ্ছ পানির বালিহাঁস, খয়রা চকাচকি, কার্লিউ, বুনোহাঁস, সারস পাখি, হেরন, ডুবুরি পাখি, কাদাখোঁচা, গায়ক রেন পাখি, রাজসরালি, পাতিকুট, গ্যাডওয়াল, পিনটেইল, নরদাম সুবেলার, কমন পোচার্ড, বিলুপ্ত প্রায় প্যালাস ফিস ঈগল (বুলুয়া) ইত্যাদিও উল্লেখযোগ্য।

নানা রং আর কণ্ঠবাহারিতে পাখিদের মধ্যে রয়েছে রাজহাঁস, বালি হাঁস, লেঞ্জা, চিতি, সরালি, পাতিহাঁস, নীলশীর,  বুটিহাঁস,  খঞ্জনা, পাতারি, জলপিপি, পানি মুরগি, নর্থ গিরিয়া, পাতিবাটান, কমনচিল, কটনচিল , বৈকাল, পিয়াং, চীনা, পান্তামুখি, রাঙামুড়ি, কালোহাঁস, রাজহাঁস, পেড়িভুতি, চখাচখি, গিরিয়া ইত্যাদি।

নর্দার্ন পিনটেইল; Image Source: Wikimedia Commons

অতিথি পাখি কেন আসে, আর যায়- এর উত্তর খুব সহজ। নিজের ভিটেতে শীত এলে এরা সহ্য করতে না পেরে অন্য দেশে যেখানে শীত অপেক্ষাকৃত কম, সেখানে চলে যায়। এ সময়ে শীতপ্রধান এলাকায় খাবারের অভাব পড়ে। সেই সাথে রয়েছে তুষারপাত। তাই কোনো গাছপালা জন্মাতেও পারে না।

আর এ কথা কার না জানা, প্রকৃতি, গাছগাছালি আর পাখিদের সম্পর্কটা বেশ অন্তরঙ্গ। পাখিরা গাছে বাসা বাধে, সেখান থেকেই খাদ্য সংগ্রহ করে। আবার খেয়ে ফেলা ফলের বা ফুলের বীজ এরা হজম করতে পারে না, তাই মলের সাথে বীজ চলে আসে। আর যেখানে সেই মল পড়ে, সেখানেই নতুন গাছ জন্মায়। এভাবে প্রকৃতিতে এক বিচিত্র উপায়ে বনায়ন হয়েছে। যেখানে গাছ লাগাবার কেউ নেই, সেখানে পাখিরা পৌঁছে যায়। পাখিরা মস্ত পরিবেশবাদী। 

কর্ডাটা পর্বের ভার্টিব্রাটা উপপর্বে এভিস শ্রেণীর এই প্রজাতির প্রজনন এক অতি পরিচিত প্রক্রিয়ায় হয়। পাখিরা ডিম পাড়ে আর ডিম ফুটে বাচ্চা হয়। কিন্তু এই ডিম এমনি এমনি খোলস  ছাড়িয়েই শিশু পাখি পাওয়া সম্ভব না। ডিমে নির্দিষ্ট সময় তা (উত্তাপ) দেয়ার পর এর ভেতর পাখির ভ্রুণ থেকে পরিণত পাখির জন্ম হয়। পাখির ডিমের এই তা দেয়ার কথা আমরা সবাই জানি। তা দেয়ার উষ্ণতা স্বাভাবিকভাবে ৩৭ ডিগ্রি হতে হয়। শীতপ্রধান দেশে শীতের মৌসুমে তা প্রায় অসম্ভব। তাই পাখিরা নতুন প্রজন্মকে বাঁচাতে আর বংশগতির ধারা ঠিক রাখতে আরব বেদুইনের মতো যাযাবরের জীবন বেছে নেয়।  

শীত এলেই উত্তর মেরু, সাইবেরিয়া, ইউরোপ, এশিয়ার কিছু অঞ্চল, হিমালয়ের আশপাশের কিছু অঞ্চলের পাখিরা ঝাঁকে ঝাঁকে চলে আসে কম ঠাণ্ডা অঞ্চলের দিকে। ডিসেম্বরের শহরে শীতের শেষে বসন্ত পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় না এলেও, পৃথিবীর পশ্চিম মেরিতে ঠিকই বসন্ত ধরা দেয়, বসন্তের সময় মানে মার্চ-এপ্রিলের দিকে শীতপ্রধান অঞ্চলের বরফ গলতে শুরু করে, ধীরে ধীরে গাছপালা জন্মাতে শুরু করে। পাখিরা তখন নিজ দেশে ফিরে যায়। নিজের শেকড়ের প্রতি টান মানুষের যেমন, পাখিরও তেমন। তবে মানুষ মাঝে মাঝে বিলেত গিয়ে দেশ ভুলে যায়, ফিরে আসে না। পাখিরা ঠিকই ফিরে আসে।

Related Articles