কংগ্রেস অধ্যক্ষ রাহুল গান্ধীর পরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আগামী দিনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে রাজি হয়েছেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবেগৌড়াও। সম্প্রতি তিনি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর উদাহরণ দেখিয়ে বলেছেন যে সবসময় পুরুষরাই প্রধানমন্ত্রী হবেন, তার কী মানে রয়েছে? নারীরাও তো প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন।
দক্ষিণ ভারত-কেন্দ্রিক দল জনতা দল (সেকুলার)-এর এই বর্ষীয়ান নেতার কথা শুনে তৃণমূল নেত্রীর পুলকিত হওয়ার কম কারণ নেই। পাশাপাশি কংগ্রেসের মতো একটি জাতীয় দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বও যখন তাদের দলের বাইরে যে কারও (আরএসএস-এর সমর্থন রহিত) প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনাকে সমর্থন জানানোর কথা ব্যক্ত করেছে ভারতীয় জনতা পার্টিকে হারানোর জন্যে, তখন শ্রীমতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের তার জাতীয় মিশনে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠার কারণ রয়েছে বৈকি।
মোদী বিরোধীরা প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী খুঁজতে ব্যস্ত
কিন্তু রাজনীতিতে মুখের প্রতিশ্রুতির দাম যে বিশেষ নেই, সেটাও বহু পরীক্ষিত। গত কয়েক মাস যাবৎ ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে মোদী-বিরোধী ঐক্যকে যেভাবে দানা বাঁধতে দেখা যাচ্ছে, তাতে রাহুল বা মমতা আশাবাদী হচ্ছেন ২০১৯-এর জাতীয় নির্বাচনের আগে। আর তাদের এই আশা ক্রমশ বেড়েছে মাস কয়েক আগে কর্ণাটকে বিজেপির আত্মঘাতী গোল করার পরে। দেশের বিভিন্ন আঞ্চলিক নেতা-নেত্রীরা কর্নাটকের ঘটনার পরে একসঙ্গে এসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং তার সেনাপতি অমিত শাহকে পরাজিত করার সম্ভাবনার ব্যাপারে আশা দেখছেন। আর যেহেতু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই জাতীয় জোট তৈরি করার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন, তাই বিকল্প প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার নামটিকেই এগিয়ে দিচ্ছে অনেকেই। যদিও এই বিষয়টির নিস্পত্তি হওয়া খুব সহজ নয়।
কয়েক দশক আগে এই বিকল্প খোঁজার রাজনৈতিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা তা-ও বা কিছু সফল হলেও বর্তমান সময়ে সেই প্রয়াস সহজে সফল হওয়ার নয়। ১৯৭৭ বা ১৯৮৯ সালে আমরা দেখেছি ইন্দিরা গান্ধী বা রাজীব গান্ধীকে হারাতে নির্বাচনের আগে বা পরে ছোট দলগুলোকে একজোট হতে এবং ক্যারিশম্যাটিক সেই নেতাদের হারিয়েও বিকল্প নেতৃত্ব বেশিদিন ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেননি। ১৯৮০-তেই ইন্দিরা ফেরেন ক্ষমতায়। ১৯৯১ এ উগ্রপন্থীদের হাতে খুন না হলে রাজীব গান্ধীরও ফেরার সম্ভাবনা ছিল অনেকটাই। অর্থাৎ, বড় নেতাদের প্রতি আনুগত্য ছোট দলগুলোর পক্ষে খুব বেশিদিন খর্ব করা সম্ভব হয় না। নরেন্দ্র মোদীর ক্ষেত্রেও তার বিরোধীরা ১৯৭৭ বা ১৯৮৯-এর মতোই কিছু একটা করে দেখাতে চাইছেন কিন্তু এখন সময়কে পেছনে হাঁটানো অসম্ভব না হলেও যথেষ্টই কঠিন।
১৯৭৭ বা ১৯৮৯ সালে কংগ্রেসের পরাজয়ের কারণ ছিল
১৯৭৭ বা ১৯৮৯ সালে যথাক্রমে ইন্দিরা এবং রাজীবের হেরে যাওয়ার কারণ ছিল। প্রথমজন হারেন দেশে প্রায় দুই বছরব্যাপী জরুরি অবস্থা জারি করার খেসারত দিয়ে। দ্বিতীয়জন হারেন বোফোর্স-এর মতো দুর্নীতিজনিত কাণ্ডের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ। তবে, কড়া প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাওয়াকে কাজে লাগানোর মতো বিরোধী নেতৃত্বও তখন ছিল। যেমন সত্তরের দশকে জয়প্রকাশ নারায়ণ; আশির দশকের শেষাশেষি বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহ, লালকৃষ্ণ আদবানি, জ্যোতি বসু প্রমুখ। বিকল্প সরকারের স্থায়িত্ব এরা সুনিশ্চিত না করতে পারলেও দাপুটে কংগ্রেসি শাসনকে তারা যে নাড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন, সে কথা অনস্বীকার্য।
আজকে মোদীর জমানায় কিন্তু একদিকে যেমন প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাওয়া সেভাবে দানা বাঁধেনি, তেমনই মোদীর শাসনের ভিত্তি নাড়িয়ে দেওয়ার মতো নেতৃত্বও আজ নেই। মমতা, রাহুল বা অন্যান্য নেতারা চিল্লামিল্লি করছেন ঠিকই মোদীর জমানায় সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদকে অভিযুক্ত করে, আসামে সম্প্রতি এনআরসি বিতর্ক নিয়ে. কিন্তু এই সমস্ত নেতার নিজস্ব ভাবমূর্তি এখন এতটাই ক্ষুণ্ণ যে সাধারণ মানুষের কাছে মোদীর বিকল্প হিসেবে এদের গ্রহণযোগ্যতা প্রায় কিছুই নেই। আর তাই আরেকটা জয়প্রকাশ নারায়ণ বা বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ এই নেতা-নেত্রীদের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসতে পারে, এমন চিন্তা তাদের সবচেয়ে বড় অনুগামীরাও করে না।
মোদী-বিরোধী নেত্রী হিসেবে মমতা কতটা গ্রহণযোগ্য?
এই ধরা যাক মমতাদেবীর কথা। তার ব্যক্তিগত সততা নিয়ে হয়তো কারও বিশেষ সন্দেহ নেই, কিন্তু প্রশাসক হিসেবে তাকে খুব বেশি নম্বর দিতে চাইবেন না এক বড় অংশের বাঙালিও। আসামে এনআরসি বিতর্কে মমতা ভেবেছিলেন যে নাগরিকপঞ্জী থেকে ৪০ লক্ষ মানুষের বাদ পড়ার ঘটনায় তার সামনেই একটি জাতীয় স্তরে প্রভাব বিস্তারের পথ খুলে গেল। সেই সুযোগকে কাজে লাগাতে তিনি উঠেপড়ে লাগেনও, কিন্তু পাশাপাশি তার নিজের বিরোধীরাও মুখ খুলতে লাগলেন। বলা হতে লাগলো যে তৃণমূল নেত্রী আসলে নিজের ভোটবাক্সটিকে মজবুত করতে চাইছেন, হিন্দু-মুসলমান/বাঙালি-অবাঙালি বিভেদ করতে চাইছেন। একজন বিরোধী নেত্রী হিসেবে মমতা হয়তো ঠিক পদক্ষেপই নিয়েছিলেন কিন্তু প্রশাসক হিসাবে তার নিজের দুর্নাম অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।
মোদী এবং তার দলের কাছে এটাই সুবিধা। এমনিতেই সমসাময়িক ভারতীয় রাজনীতিতে আর্থ-সামাজিক বা আর্থ-রাজনৈতিক নানা কারণেই বর্তমান শাসকদলের ও রঙের সোনায় সোহাগা। একজন উন্নয়ন-মুখী প্রধানমন্ত্রী এবং তার ধুরন্ধর নির্বাচনী বিশেষজ্ঞ সেনানী; পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে উচ্চাশাপূর্ণ মধ্যবিত্ত তারা রাজনীতিতে রোজকার ডামাডোল চায় না, চায় স্থিতিশীলতা এবং সর্বোপরি, এক দুর্নামপূর্ণ বিরোধী যাদের অতীত দেখে আর কেউ তাদের ভরসা করতে চায় না- এই তিন কারণে বর্তমান ভারতে বিকল্প রাজনীতির দিশা সহজে নিরূপণ করা বেশ কষ্টসাধ্য কাজ। আর যে এজেন্ডাগুলি দেখিয়ে বিরোধীরা আজকে মোদীর মাস্তুলের হাওয়া কেড়ে নিতে চাইছেন, সেগুলিতে বেশিরভাগ মানুষই সমর্থন জানান স্বয়ং মোদীকেই। যেমন নোটবন্দি, জিএসটি, এনআরসি, কাশ্মীরনীতি, ইত্যাদি।
মুখটা বড় নয়, বড় অর্থনীতি এবং রাজনীতি
এই পরিস্থিতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিরোধী শিবিরের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী করা হলো কী হলো না, সে বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। সামনের বছর যখন ভারত নির্বাচনে যাবে, তখন মোদীর বিকল্প নেতা হিসেবে মানুষ মমতা বা রাহুল গান্ধীকে খুঁজবেন বলে মনে হয় না। তারা খুঁজবেন আরও ভালো অর্থনীতি এবং রাজনীতির হদিশ। সেটা কি এই বিরোধীদের দেওয়ার ক্ষমতা আছে? মুখে হ্যাঁ বললে চলবে না। মানুষ দেখবেন এই বিরোধী নেতারা তাদের স্ব-স্ব ক্ষেত্রে শাসক হয়ে কী প্রকৃত বদল এনেছেন। আর যদি না এনে থাকতে পারেন, তাহলে কীসের ভরসায় মানুষ তাদের কেন্দ্রে ক্ষমতায় আনবে?
কয়েকটি রাজ্যে মোদীর বিজেপি গত চার বছরে হেরেছে বলে বিরোধীরা ধরেই নিয়েছেন যে চাকা ঘুরছে। কিন্তু একই সঙ্গে, তারা কি এটা বুঝতে পারছেন যে সারা দেশে তাদের নিজেদের জনপ্ৰিয়তা আদৌ মোদীকে টেক্কা দেওয়ার মতো আছে কি না? জোটের রাজনীতি করে হয়তো সারা দেশব্যাপী একটা মঞ্চ তৈরি করা যায়, কিন্তু ঠিকঠাক নেতৃত্ব না পেলে যে সে মঞ্চের পাটাতন খুলে পড়তে বেশিদিন লাগে না, তার পরিচয় পাওয়া গিয়েছে সত্তর এবং আশির দশকেও। ২০১৪ সালে, তিন দশক পরে, ভারতের নির্বাচকরা একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারকে ক্ষমতায় এনেছিলেন কারণ জুলিমিলিদের হৈ-হট্টগোলে তাদের নাভিশ্বাস ওঠার অবস্থা হয়েছিল । গত পাঁচ বছরে কি সে স্বভাব বদলেছে? উত্তরটা বোধহয় খুব কঠিন নয়।
Featured Image Source: The Straits Times