আরব উপদ্বীপের উত্তর-পূর্ব উপকূলে অবস্থিত পারস্য উপসাগরের একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র ‘স্টেট অব কাতার’। প্রায় ১১,৫৮১ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের দেশটির স্থল সীমান্তের পুরোটা দক্ষিণ দিকে সৌদি আরবের সাথে সংযুক্ত এবং দেশটির বাকি অংশ পারস্য উপসাগর দ্বারা বেষ্টিত। বাহরাইন উপসাগর দেশটিকে নিকটবর্তী রাষ্ট্র বাহরাইন থেকে পৃথক করেছে। প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ কাতার বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে পরিচিত।
১৯৭১ সালের তেসরা সেপ্টেম্বর ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করা কাতারের বর্তমান শাসনক্ষমতা ‘আল–থানি’ রাজবংশের নিয়ন্ত্রণে। সাংবিধানিক রাজতন্ত্র শাসনব্যবস্থায় কাতারের মূল ক্ষমতার অধিপতি হিসেবে আমির দায়িত্ব পালন করেন। প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ ও মন্ত্রিপরিষদ গঠনের ক্ষমতাও তার উপর ন্যস্ত।
কোনো রাষ্ট্র অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে রূপরেখা অনুসরণ করে, সেটাই হচ্ছে পররাষ্ট্রনীতি। কাতারের পররাষ্ট্রনীতিতে দেশটির সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা রক্ষা করা; আরব ও অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রের সাথে সহাবস্থান বজায় রাখা; বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তি ও কনভেনশনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা; আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা সুসংহত করা; রাষ্ট্রীয় এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে স্বাধীনতা ও মানবাধিকার নিশ্চিত করা– এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে এবং পারস্য উপসাগরের তীরবর্তী আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার সম্পর্ক জোরদারের লক্ষ্যে কাতার ১৯৮১ সালের ২৫ মে ‘উপসাগরীয় সহযোগিতা সংস্থা’য় যোগদান করে। এছাড়াও কাতার আরব দেশগুলোর সহযোগিতা সংস্থা ‘আরব লীগ’ এবং বিশ্বে মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র ‘ওআইসি’র অন্যতম সদস্য।
ধর্মীয়, ভৌগোলিক, সংস্কৃতিগত এবং বাণিজ্যিক কারণে সৌদি আরবের সাথে কাতারের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকেই দেশটির শাসকগোষ্ঠী ‘আল–থানি’ রাজবংশের সাথে সৌদি আরবের শাসকগোষ্ঠীর গভীর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে ১৯৯০ দশকে এসে সৌদি আরব এবং কাতারের মধ্যবর্তী সীমান্ত নির্ধারণ নিয়ে দুই পক্ষ বিরোধে জড়িয়ে পড়ে।
১৯৯২ সালের সেপ্টেম্বরে সৌদি আরবের নিরাপত্তা বাহিনী সীমান্ত চৌকিতে হামলা করলে কয়েকজন কাতারি সৈন্য নিহত হন। ১৯৯৯ সাল নাগাদ দুই পক্ষ একটি সীমানা চুক্তিতে পৌঁছায় এবং ২০০১ সালে দেশ দুটোর মধ্যে সীমানা বিরোধ নিরসনে চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
রক্তপাতহীন প্রাসাদ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ১৯৯৫ সালের ২৭ জুন পিতা খলিফা বিন হামাদ আল–থানিকে ক্ষমতাচ্যুত করে কাতারের আমির হন হামাদ বিন খলিফা আল–থানি। হামাদ বিন খলিফা আল–থানি আমির হওয়ার পর পূর্বসূরীদের থেকে একটি স্বতন্ত্র পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করেন, যেখানে সৌদি আরবের উপর নির্ভরশীলতা হ্রাসের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি ২০১৩ সালের ২৫ জুন পর্যন্ত কাতারের আমির হিসেবে দায়িত্ব পালন করা হামাদ বিন খলিফা আল–থানি বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে দেশটিকে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে একটি প্রভাবশালী অবস্থানে পৌঁছে দেন।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা কর্তৃক সৌদি-বিরোধী প্রচারণার অভিযোগ তুলে সৌদি আরব ২০০২ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত দোহা থেকে দেশটির রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে রেখেছিল। এছাড়াও কাতারের বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অভিযোগ করে ২০১৪ সালের মার্চ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইন দেশটি থেকে আবারও তাদের রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে।
২০১৭ সালের ৫ জুন সৌদি আরব ও তার মিত্র রাষ্ট্রসমূহের সাথে কাতারের কূটনৈতিক সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতি ঘটে। ইরানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক হ্রাস করা, তুরস্কের সাথে সামরিক সম্পর্ক হ্রাস করা, মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডকে সমর্থন প্রদান বন্ধ করা, সংবাদমাধ্যম ‘আল জাজিরা’র সম্প্রচার বন্ধ করা, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ বন্ধ করাসহ আরও কয়েকটি দাবি মানতে বাধ্য করতে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও মিসরসহ আরও কয়েকটি মিত্র দেশ কাতারের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে।
সৌদি আরব কাতারের সাথে বিদ্যমান স্থলসীমা বন্ধ করে দিয়েছিল এবং এই ইস্যুতে সৌদি আরবের মিত্র দেশগুলো তাদের জলসীমা ও আকাশপথে ব্যবহারে কাতারের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও কুয়েতের মধ্যস্থতায় দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালের ৫ জানুয়ারি সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত ‘উপসাগরীয় সহযোগিতা সংস্থা’র ৪১তম বার্ষিক সম্মেলন উপলক্ষে কাতার ও সৌদি মিত্রদের মধ্যে এই কূটনৈতিক সংকটের সমাধান হয়েছে। বর্তমানে কাতারের সাথে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইনের স্থিতিশীল কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রয়েছে।
সম্প্রতি তুরস্কের সাথে কাতারের কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার হয়েছে। সৌদি জোটের সাথে কূটনৈতিক সংকটের সময় তুরস্ক কূটনৈতিক সমর্থন ও খাদ্য সহায়তা প্রদান করে কাতারের পাশে দাঁড়িয়েছিল। তুরস্ক কাতারে বিভিন্ন সময় সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানি করেছে। কাতারে তুরস্কের একটি সামরিক ঘাঁটি স্থাপিত হয়েছে এবং দেশটিতে তুর্কি সামরিক উপস্থিতি রয়েছে। মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতি কাতারের পাশাপাশি বর্তমান তুরস্ক সরকারেরও সমর্থন রয়েছে।
মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতনের পর লিবিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে রাজধানী ত্রিপোলি কেন্দ্রিক জাতিসংঘ-স্বীকৃত জাতীয় ঐকমত্যের সরকারের প্রতি কাতার ও তুরস্ক সমর্থন অব্যাহত রয়েছে। ২০১৬ সালের ১৫ জুলাই তুরস্কে সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টার বিরুদ্ধে কাতার জোরালো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। এছাড়াও বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশ দুটোর মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক বজায় রয়েছে।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে মতপার্থক্য থাকলেও ইরান ও কাতারের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সহযোগিতা সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে। সৌদি জোটের সাথে কূটনৈতিক সংকটের সময় ইরান কাতারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল। বর্তমানে দেশ দুটোর মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কূটনৈতিক সম্পর্কের পরিধি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ যুক্তরাষ্ট্র কাতারের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে।
কাতারে অবস্থিত আল-উদেইদ বিমানঘাঁটি মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। যুক্তরাষ্ট্র ও কাতারের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ এবং পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ও আঞ্চলিক বিভিন্ন ইস্যুতে কাতার যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কাজ করে যাচ্ছে।
অন্যদিকে, কাতারের সাথে রাশিয়ার কূটনৈতিক সম্পর্ক ১৯৮৮ সালের ১লা আগস্ট সেই সোভিয়েত ইউনিয়নের সময় থেকেই শুরু। গত ২-৫ জুন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত সেন্ট পিটার্সবার্গ আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ফোরামে অতিথি রাষ্ট্র হিসেবে কাতার যোগদান করে। উক্ত ফোরামে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যোগদান করেন কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল–থানি। তিনি দেশটিকে রাশিয়ার অন্যতম বৃহৎ বিদেশি বিনিয়োগকারী হিসেবে উল্লেখ করে ভবিষ্যতে রাশিয়ায় আরও বেশি বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছেন। এদিকে, কাতার চীনের অন্যতম কৌশলগত মিত্র। দেশ দুটোর মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্কের মাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বর্তমানে কাতার বিভিন্ন ইস্যুতে বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে আলোচনার আয়োজন অব্যাহত রেখেছে। কাতারের মধ্যস্থতায় বিভিন্ন সময়ে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে। সম্প্রতি, আফগানিস্তানের শান্তি আলোচনায় কাতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এমনকি, সৌদি আরব এবং ইরানের মধ্যকার বিরোধ নিরসনে কাতার মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছে। এছাড়া, কাতার ‘হর্ন অব আফ্রিকা’ অঞ্চলসহ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মানবিক সহায়তা প্রদানের কাজ করে যাচ্ছে। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ‘আল জাজিরা’কে বিশ্বে দেশটির প্রভাব বিস্তারের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এছাড়াও, দেশটি ২০২২ সালে ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপের আয়োজক।
সাধারণত পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণের মূল ভূমিকা পালন করে থাকে কূটনীতি। একটি রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের সাথে তার সম্পর্ক নির্ধারণের জন্য যে পদ্ধতি বা কৌশল অবলম্বন করে, সেই প্রক্রিয়াগুলো হচ্ছে কূটনীতি। কাতার একদিকে সৌদি জোটের দেশগুলোর সাথে বিরোধ মীমাংসা করে স্থিতিশীলতা তৈরি করেছে, আবার অন্যদিকে তুরস্ক ও ইরানের সাথে সম্পর্ক জোরদারে তৎপর রয়েছে। একদিকে দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র, আবার অন্যদিকে রাশিয়া ও চীনের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্কের মাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধি করছে।
বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ এবং ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতির মাধ্যমে কাতার বিশ্বে একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারস্য উপসাগরের এই ক্ষুদ্র রাষ্ট্রটি কতটা ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতি বজায় রাখতে পারবে, তা সময়ই বলে দেবে।