২০২২ সালের ২৫ জানুয়ারি থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী প্রায়ুথ চান ওচা সৌদি আরব সফরে গেলেন। সৌদি আরবে থাই প্রধানমন্ত্রীর এই সফর ‘ঐতিহাসিক’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই সফরে প্রায় তিন দশক ধরে চলমান বিরোধ মীমাংসার মাধ্যমে সৌদি আরব এবং থাইল্যান্ডের মধ্যে পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিশ্বের দুটো দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপোড়েন কিংবা দীর্ঘকালীন বৈরিতা নতুন কিছু না। কিন্তু থাই এবং সৌদি দুই রাষ্ট্রের এই শিথিলতার মূলে ছিল গয়না। ১৯৮৯ সালে সৌদি রাজপ্রাসাদ থেকে গয়না চোরাচালানের ঘটনার পর থেকে এই দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক তিক্ততার সূত্রপাত ঘটে।
১৯৮৯ সালে সৌদি আরবের বাদশাহ ছিলেন ফাহাদ বিন আবদুল আজিজ। তার জ্যেষ্ঠ পুত্র যুবরাজ ফয়সাল বিন ফাহাদের রাজপ্রাসাদের বিশ্বস্ত কর্মচারী হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন থাইল্যান্ডের নাগরিক ক্রিয়াংক্রাই তেচামং। সেই বছরের কোনো এক সময়ে সস্ত্রীক যুবরাজ ফয়সাল বিন ফাহাদ তিন মাসের ছুটিতে অবকাশ যাপনের জন্য রাজপ্রাসাদের বাহিরে অবস্থান করছিলেন।
পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে যুবরাজ ফয়সালের রাজপ্রাসাদে কর্মরত ক্রিয়াংক্রাই তেচামং রাজপ্রাসাদের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখতেন। এমনকি অধিকাংশ সময়ে যুবরাজ যে বহু অমূল্য গয়না সম্বলিত চারটি সিন্দুকের মধ্যে তিনটি সিন্দুকের তালা খোলা রাখতেন– সেই সম্পর্কেও ক্রিয়াংক্রাই তেচামং জানতে পেরেছিলেন। সেই সময়ে, রাজপ্রাসাদের কর্মচারীদের আবাসস্থলে জুয়া খেলে হেরে যাওয়া ক্রিয়াংক্রাই তেচামং চরম আর্থিক সংকটে বিপর্যস্ত। একদিকে সংকট, আরেকদিকে ঝুঁকির ওপারে সংকট থেকে উদ্ধারের সুযোগ। মানুষ তেচামংয়ের লোভ সেই ঝুঁকির শেকল ভাঙল।
রাজপ্রাসাদ থেকে দূরবর্তী স্থানে ফয়সাল বিন ফাহাদের অবকাশ যাপনের সুযোগ নিয়ে, ক্রিয়াংক্রাই তেচামং অমূল্য গয়নার ভাণ্ডার লোপাটের ছক কষে ফেলল। সৌদি আরবে প্রচলিত আইন অনুযায়ী চুরির শাস্তি অঙ্গচ্ছেদের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে একদিন সন্ধ্যায় তেচামং অত্যন্ত কৌশলে রাজপ্রাসাদে অবস্থানের একটি অজুহাত বের করে। এরপর ধৈর্য সহকারে রাজপ্রাসাদ থেকে অন্য কর্মচারীদের চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা! রাজপ্রাসাদের অন্য কর্মচারীরা চলে যাওয়ার পর পরই তেচামং রাজপুত্র ফয়সাল বিন ফাহাদের শয়নকক্ষে লুকিয়ে পড়ে। রাজপুত্রের শয়নকক্ষে প্রবেশের পর কিছু গয়না নিজের শরীরের সাথে স্কচটেপ দিয়ে ভালোভাবে বেঁধে নিল। ঘর পরিষ্কার করার যন্ত্র ‘ভ্যাকুয়াম ক্লিনার’-এর ভেতরে করেও আরো কিছু অলংকার সরানো গেল। তার চুরি করা গয়না এবং অলংকারের মধ্যে ছিল কয়েকটি সোনার ঘড়ি আর মূল্যবান রুবি পাথর। পরবর্তী সময়ে জানা যায়, ক্রিয়াংক্রাই তেচামং চুরি করেছিলেন সব মিলিয়ে ৩০ কেজি পরিমাণ সোনা ও অলংকার। আর বাজারমূল্যের হিসেবে প্রায় দুই কেটি মার্কিন ডলার!
এদিকে, রাজপুত্রের কক্ষ থেকে চুরি করার পর ক্রিয়াংক্রাই তেচামং সেসব স্বর্ণালংকার ও গয়না সেই রাতে রাজপ্রাসাদের ভেতরে বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে রাখলেন। এর প্রায় এক মাসেরও বেশি সময় পর তিনি চুরি করা সামগ্রীগুলো স্থানান্তরিত করেন এবং পরবর্তীতে একটি কার্গো পরিবহনের মধ্যে লুকিয়ে থাইল্যান্ডে প্রেরণ করেন। সৌদি রাজপুত্রের প্রাসাদ থেকে এই দুর্ধর্ষ চুরির ঘটনা যখন ফাঁস হয়, সেই সময়ে ক্রিয়াংক্রাই তেচামং সৌদি আরব থেকে থাইল্যান্ডে পাড়ি জমান। থাইল্যান্ডের অভ্যন্তরে সেই চুরি হওয়া স্বর্ণালংকার ও গয়না প্রবেশের জন্য ক্রিয়াংক্রাই অত্যন্ত ধূর্ততার আশ্রয় নিয়েছিল। সেই কার্গো না খোলার জন্য দেশটির শুল্ক বিভাগের কর্মকর্তাদের বিপুল অংকের ঘুষ প্রদান করেছিল। সৌদি রাজপ্রাসাদ থেকে গয়না চোরাচালানের ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর থেকেই সৌদি কর্তৃপক্ষ সন্দেহভাজন হিসেবে ক্রিয়াংক্রাইয়ের খোঁজে থাই পুলিশের সাথে যোগাযোগ শুরু করে। ক্রিয়াংক্রাই সেই সময় থাই শুল্ক বিভাগের কর্মকর্তাদের চোখ ফাঁকি দিতে পারলেও বেশ কিছুদিন পর দেশটির ল্যাম্পাং প্রদেশের নিজ বাড়ি থেকে তাকে আটক করা হয়।
ক্রিয়াংক্রাইকে আটকের পর থাই পুলিশ সেই চোরাচালান করে বিক্রি করা গয়নাগুলোও উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। তবে চুরি করা ৫০ ক্যারেটের দুর্লভ নীল হীরা পরে কখনোই আর উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এরপর, থাই কর্তৃপক্ষ উদ্ধার করা সকল গয়না এবং অলংকার সৌদি আরবে ফেরত পাঠানোর দাবি করে। কিন্তু সেই গয়না পৌঁছানোর পর সৌদি কর্তৃপক্ষ অভিযোগ করে, চোরাচালান করা অলংকারের প্রায় আশি শতাংশের হদিস তখনও পাওয়া যায়নি, এবং যেসব অলংকার ফেরত পাঠানো হয়েছিল, তার একটা অংশ ছিল নকল! ওদিকে সন্দেহের ডালপালা বের হয় উচ্চপদস্থ এক থাই কর্মকর্তার স্ত্রীর গলায় এমন একটি অমূল্য অলংকার শোভা পাওয়ায়। সেটি দেখতেও প্রায় অবিকল প্রাসাদ থেকে চুরি যাওয়া অলংকারের মতো ছিল।
গয়না চোরাচালানের ঘটনায় অভিযুক্ত ক্রিয়াংক্রাই তিন বছরেরও কম কারাগারে থাকার পর অনুতপ্ত বোধ এবং সদাচরণের জন্য মুক্তি পান। তবে, এই চোরাচালানের ঘটনার পর থাইল্যান্ডে অবস্থিত সৌদি দূতাবাসের কয়েকজন কূটনীতিক নিহতের ঘটনা দুই দেশের মধ্যে কূটনীতিক টানাপোড়েন সৃষ্টি করে। সৌদি কর্তৃপক্ষ থাইল্যান্ডের একাধিক ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চোরাচালান হওয়া গয়নাগুলো আত্মসাৎ করে ঘটনার তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অভিযোগ করেন।
১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে থাইল্যান্ডে অবস্থিত সৌদি দূতাবাসের গাড়িতে বন্দুকধারীদের গুলিতে দূতাবাসের ভিসা বিভাগের দুজন কর্মকর্তা নিহত হন। প্রায় একইসময়ে একজন বন্দুকধারী একটি বাসায় প্রবেশ করে নিহত একজন কর্মকর্তার সহকর্মীকেও গুলি করে হত্যা করে। এসব হত্যাকাণ্ডের কয়েক সপ্তাহ পর, গয়না চোরাচালান ঘটনার অনুসন্ধানের দায়িত্ব দিয়ে মোহাম্মদ আল-রুয়াইলি নামের এক সৌদি ব্যবসায়ী থাইল্যান্ডে অপহৃত হন এবং পরবর্তী সময়ে তার আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। তিনিও হত্যাকাণ্ডের শিকার হন বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। ২০১৪ সালে ‘যথাযথ প্রমাণের অভাবে’ সৌদি ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আল-রুয়াইলি হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ থেকে একজন ঊর্ধ্বতন থাই পুলিশ কর্মকর্তাসহ মোট পাঁচ ব্যক্তিকে অব্যহতি দেওয়া হয়। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, সৌদি আরব থাইল্যান্ড থেকে জনশক্তি নেওয়া বন্ধ করে দেয়, এবং পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে থাইল্যান্ড সৌদি পর্যটকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
সম্প্রতি সফরকালে থাই প্রধানমন্ত্রী প্রায়ুথ চান ওচা ১৯৮৯ সালের গয়না চোরাচালান এবং এই ঘটনার পরম্পরায় কয়েকজন সৌদি কূটনীতিক নিহতের জন্য দেশটির নিকট দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এমন পরিস্থিতিতে, থাই-সৌদি কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনরায় স্বাভাবিক হওয়ার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে।