মানুষে মানুষে স্বার্থের দ্বন্দ্ব চিরন্তন, প্রায়শই সেই দ্বন্দ্ব রূপ নেয় সংঘাতে। সম্পদের উপর কর্তৃত্বমূলক নিয়ন্ত্রণ তৈরির জন্য অনেক সময় মানুষ সংঘাত তৈরি করে, সংঘাত তৈরি করে সম্পদের উপর জোরপূর্বক দখল তৈরি করতেও। সম্প্রতি মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিসর বেড়েছে, প্রায় সব দেশের অর্থনীতির আকারই বড় হচ্ছে। একই সময়ে আবার সম্পদের উপর জোরপূর্বক নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার ঘটনাও বাড়ছে, যেগুলোকে রাষ্ট্র ফৌজদারী অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে।
ফৌজদারী অপরাধগুলোতে সব বয়সের মানুষই জড়ায়, বিঘ্নিত করে অন্যের নাগরিক অধিকার, রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত নিরাপত্তার অধিকার। সম্প্রতি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এই ধরনের অপরাধগুলোর সাথে কিশোরদের জড়িত থাকার প্রবণতা বাড়ছে, কিশোরদের দ্বারা সংগঠিত অপরাধের ঘটনাগুলো হয়ে উঠেছে বৈশ্বিক ইস্যু। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গত তিন দশকে কলেজ থেকে ঝড়ে পড়ার হার কমেছে, একই সাথে কমেছে কিশোর অপরাধের সংখ্যা। কিন্তু, এর ঠিক বিপরীত চিত্র উঠে এসেছে লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা, মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অঞ্চলগুলোতে; কিশোর অপরাধের সংখ্যা বেড়েছে রাশিয়া, ভেনিজুয়েলা, এল সালভাদর, কলম্বিয়ার মতো দেশগুলোতে। মধ্যপ্রাচ্য আর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গৃহযুদ্ধপ্রবণ অঞ্চলগুলোতে এই হার আরো অনেক বেশি।
কিশোর অপরাধ
আন্তর্জাতিকভাবে, ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগপর্যন্ত প্রতিটি মানুষই শিশু। এর মধ্যে, মানুষের শৈশবের সময়টি অন্তর্ভুক্ত, অন্তর্ভুক্ত মানুষের কৈশোরও। সাধারণত, ১২ বছর বয়স থেকে মানুষের বয়ঃসন্ধিকাল শুরু হয়, যে সময় মানুষের ব্যাপক দৈহিক এবং মানসিক পরিবর্তন সাধিত হয়। সাধারণত, এই সময়কেই মানুষের কৈশোর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই সময়ে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বিচ্যুতির কারণে অনেক কিশোরই বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, অনেকে আবার জড়ায় সংঘবদ্ধ অপরাধে। কৈশোরের সময় করা অপরাধগুলোকে বিবেচনা করা হয় কিশোর অপরাধ হিসেবে।
কোন কিশোররা জড়াচ্ছে সংঘবদ্ধ অপরাধে?
বেকারের (১৯৬৮) গবেষণা দাবি করছে, সব বয়সের মানুষই অপরাধ করে অপরাধের আয়-খরচের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে, অপরাধের সাথে যুক্ত হওয়া লাভজনক হলে মানুষ সুচিন্তিতভাবেই জড়ায় অপরাধে। আবার, হেগডর্নের (২০০৮) গবেষণা বলছে, মানুষের অপরাধ প্রবণতা সামাজিক সংস্কৃতি, রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, দেশ বা রাষ্ট্রের কাঠামোর উপরও নির্ভর করে। অপরাধবিজ্ঞানী লুইসের (২০১২) মতে, মানুষের অপরাধে জড়িয়ে যাওয়ার প্রাথমিক কারণ হিসেবে কাজ করে সীমাহীন দারিদ্র্য এবং বিভিন্ন জিনিস না পাওয়ার ঘটনা। সমাজবিজ্ঞানী ভ্যান স্ক্যেন্ডেলের (২০০৯) মতে, সাম্প্রতিক দুর্যোগও কিশোর অপরাধ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। এই দুর্যোগ প্রাকৃতিক হতে পারে, আবার মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মতো মানবসৃষ্ট দুর্যোগও হতে পারে।
এরকম অনেকগুলো মৌলিক প্রভাবক আছে, যেগুলো পৃথিবীর সব প্রান্তের কিশোর অপরাধে জড়িয়ে যাওয়া কিশোরদের প্রেক্ষাপটগুলোকে মূল্যায়ন করতে পারে। এই আর্টিকেলে আলোচনা করা হবে সেই প্রভাবকগুলো নিয়েই, যেগুলো কিশোর অপরাধের মতো নেতিবাচক ঘটনা বিস্তারের কারণ হিসেবে কাজ করে।
ব্যক্তিগত জীবনবোধ
প্রতিটি মানুষ জৈবিকভাবে প্রায় একইরকম হলেও আচরণের দিক থেকে প্রত্যেকের অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু গড়ে ওঠা বৈশিষ্ট্য আছে, আছে পরিবেশ থেকে শেখা আচরণের প্রভাব। কিছু কিশোর স্বাভাবিকভাবেই সমাজের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গড়ে ওঠে, সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার অভাবে তারা মানুষকে ভয় পেয়ে আত্মরক্ষার অনুভূতি থেকে আগ্রাসী আচরণ করে। অসামাজিক হিসেবে পরিচিত, এই আক্রমণাত্মক শিশুরাই দ্রুত জড়িয়ে যায় কিশোর অপরাধীদের সংঘগুলোতে।
অনেক কিশোরকে আবার অল্প বয়সেই বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার ঘটনার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, শারীরিক নিপীড়নের পাশাপাশি অনেকেই আবার শিকার হতে হয় যৌন নির্যাতনেরও। ব্যক্তিগতভাবে, অনেকের মধ্যেই আবার বন্ধুদের ‘না’ বলার ক্ষমতার স্বল্পতা থাকে, এই স্বল্পতা থেকেই অনেক কিশোর আবার বন্ধুদের প্ররোচনায় জড়িয়ে যায় কিশোর অপরাধে। মানসিক স্বাস্থ্যে সমস্যা থাকা কিশোররাও সহিংস অপরাধে জড়িয়ে পড়ার উদাহরণ আছে, অনেক কিশোরই আবার একের পর এক অপরাধের নেশার মধ্যে আটকে যায়।
পরিসংখ্যান বলছে, যেসব পরিবারের মধ্যে বয়োজ্যোষ্ঠদের অপরাধে জড়িত হওয়ার ঘটনা আছে, পরিবারের মধ্যে সহিংসতার ঘটনা ঘটে, সেসব পরিবারের কিশোরদের অপরাধে জড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা বেশি। আবার, যেসব পরিবারের কাঠামো দুর্বল, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া কম, পরিবারের নিয়মিত বিভিন্ন বিষয়ে ঝগড়া হয়, বাবা-মায়ের দ্বন্দ্বের রূঢ় প্রকাশ ঘটে সন্তানদের সামনে, সেসব পরিবারের কিশোরদেরও অপরাধে জড়িয়ে যাওয়ার উচ্চ প্রবণতা আছে।
এর বাইরে, এই বয়সে প্রতিটি মানুষই একটি অদ্বিতীয় সময়ের মধ্যে দিয়ে যায়, যখন ব্যাপক শারীরিক আর মানসিক পরিবর্তনের সাথে পরিবর্তন আসে দৃষ্টিভঙ্গিতে। ফলে, অনেক কিশোরই কেবল রোমাঞ্চের জন্য জড়িয়ে যায় কিশোর অপরাধে। অনেকে কিশোর অপরাধে জড়ায় নিরাপত্তাবোধের অভাব থেকেও।
পরিবার
মানুষের মূল্যবোধের প্রাথমিক বিকাশ ঘটে পরিবারের মাধ্যমে। পরিবার থেকেই মানুষের বিশ্বাস আর অবিশ্বাস তৈরি হয়, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়, তৈরি হয় আচরণের প্যাটার্নও। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপের ইতিবাচক বা নেতিবাচক মোড়েই প্রভাব থেকে যায় পরিবারের, প্রবল সংকটময় সময়গুলোতেও মানুষ নিরাপত্তা আর নির্ভরতার সন্ধান করে পরিবারের কাঠামোর মধ্যেই। ফলে, একজন কিশোরের অপরাধী হয়ে ওঠার পেছনেও পরিবারের দায়বদ্ধতাগুলো মূল্যায়নের প্রয়োজন আছে।
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত অক্সফোর্ড হ্যান্ডবুক অব ক্রিমিনোলজিতে অপরাধবিজ্ঞানী মাইকেল লেভির একটি নিবন্ধ আছে, কিশোরদের অপরাধী সংঘগুলোর সদস্য রিক্রুটের উপায়ের উপরে। কার্ডিফ ইউনিভার্সিটির এই অধ্যাপকের গবেষণা দেখাচ্ছে, বাবা-মায়ের বৈবাহিক সম্পর্কের ধরণ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখে কিশোরদের অপরাধী হয়ে উঠার ক্ষেত্রে। যেসব পরিবারে বাবা-মায়ের মধ্যে স্থিতিশীল বৈবাহিক সম্পর্ক থাকে, সেসব পরিবারের চেয়ে অস্থিতিশীল, বিভাজিত বা আলাদা থাকা পরিবারগুলোর কিশোরদের অপরাধী হয়ে ওঠার ঘটনা বেশি। সম্প্রতি পারিবারিক সম্পর্কগুলো ভেঙে যাওয়ার ঘটনা বাড়ছে, ডিভোর্সের ঘটনা বাড়ছে দ্রুতগতিতে, বাড়ছে বাবা-মায়ের আলাদা থাকার ঘটনাও।
বাবা-মায়ের বৈবাহিক সম্পর্কের বাইরের, বাবা-মায়ের শিক্ষার স্বল্পতা, সন্তানদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে কঠোর শাস্তি দেওয়ার প্রবণতা কিশোরদের বিকাশে নেতিবাচক ভূমিকা রাখে। কিশোরদের এই মানসিক অবস্থা তাদের অপরাধী সংঘগুলোতে জড়িয়ে দেয়।
স্কুল
সাধারণত কিশোর অপরাধীদের বেশিরভাগের বয়সই ১৫-১৮ বছরের মধ্যে। এই বয়সের কিশোররা সাধারণত নবম শ্রেণি থেকে কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে পড়াশোনা করে। এই শ্রেণির বাইরে, বর্তমানে ১২-১৫ বছরের কিশোররাও জড়াচ্ছে অপরাধে, স্কুলে সাধারণত তারা ৬ষ্ঠ-৮ম শ্রেণিতে পড়ে।
কিশোররা সাধারণত বন্ধুদের সাথে দিনের বড় একটা সময় কাটায়, স্কুলের পরে খেলার মাঠে তারা একসঙ্গে থাকে, একসঙ্গে থাকে বৈকালিক আড্ডাগুলোতে। বর্তমানে মোবাইল প্রযুক্তির বিকাশের ফলে এই যোগাযোগ সার্বক্ষণিক হয়ে উঠেছে। ফলে, তারা সাধারণভাবেই তাদের বন্ধুদের দ্বারা ব্যাপক প্রভাবিত হয়।
ফলে, বন্ধুমহলে কেউ কিশোর অপরাধের সাথে জড়িয়ে গেলে বা অপরাধী সংঘের সাথে যুক্ত হয়ে গেলে বাকিদের কিশোর অপরাধে জড়িয়ে যাওয়া সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। সমাজবিজ্ঞানী হেইনইন (২০১১) কিশোরদের অপরাধে জড়িয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বন্ধুমহলের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করেছেন ইথিওপিয়াতে। ইথিওপিয়ায়তে জাতিগত সংঘাত রয়েছে, গোষ্ঠীকেন্দ্রিক কাঠামোতে রয়েছে অস্ত্রের বিপুল উপস্থিতি। এই প্রভাবগুলোকে একপাশে রেখেও, ইথিওপিয়াতে কিশোরদের অপরাধে জড়িয়ে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ বন্ধুমহল, যে বন্ধুমহল সাধারণত স্কুল থেকে তৈরি হয়।
বন্ধুমহলের বাইরেও, স্কুলে শিক্ষকদের দ্বারা যথাযথ মূল্যায়ন না পেলে, শিক্ষকদের কাছ থেকে দুর্ব্যবহারের শিকার হলে, খারাপ ফলাফলের জন্য ক্রমাগত মানসিক চাপ বা অবহেলার শিকার হলে, শারীরিক শাস্তির মুখোমুখী হলে, কিশোরদের মধ্যে অপরাধে জড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের অভিজ্ঞতা আমাদের বলছে, যেসব শিক্ষার্থী নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রমের সাথে যুক্ত থাকে, সেসব কিশোর অপরাধের সাথে কম জড়ায়। যেসব শিক্ষার্থী স্কুলের কার্যক্রমের সাথে অনিয়মিত হয়ে পড়ে, স্কুল থেকে ড্রপআউট হয়, তাদের মধ্যে অপরাধে জড়াবার প্রবণতা বেশি থাকে।
সামাজিক কাঠামো
মানুষের বিকাশের ক্ষেত্রে পরিবারের পরেই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা থাকে সমাজের। সমাজবদ্ধ জীবনে মানুষ অন্য মানুষের আচরণের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়, অন্যদের জীবনবোধের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়, প্রভাবিত হয় অন্যদের জীবনযাপনের ধরনের জন্যও।
যেসব সমাজে অ্যালকোহলের সহজলভ্যতা আছে, তামাকজাতীয় পণ্যের বহুল ব্যবহার আছে, সমাজের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের মাদকে আসক্ত লোকজনের উপস্থিতি আছে, সেসব সমাজের কিশোররা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে বেশি জড়ায়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর অভিজ্ঞতা বলছে, সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে অস্ত্রের বিপুল উপস্থিতি ও সহজলভ্যতা থাকলে কিশোররা অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রে কিশোরদের সংঘবদ্ধ অপরাধের ঘটনা কম ঘটে, তুলনামূলকভাবে বেশি ঘটে একক অপরাধের সংখ্যা। কিশোররা এককভাবে যেসব অপরাধের সাথে জড়ায়, তার বড় এক দায় অস্ত্রের সহজলভ্যতার।
হ্যারিস, টার্নার এবং গ্যারেটের (২০১২) যৌথ গবেষণা বলছে, প্রতিবেশীদের মধ্যে অপরাধী কেউ থাকলে, অপরাধীদের দ্বারা কিশোররা নিরাপত্তাহীন অনুভব করলে, কিশোররা অপরাধী সংঘগুলোর সাথে জড়িয়ে যেতে পারে। প্রতিবেশীদের বড় ভূমিকা থাকে কিশোরদের ইতিবাচক বা নেতিবাচক বিকাশের ক্ষেত্রে। হারিস, টার্নার এবং গ্যারেটের যৌথ গবেষণাটি হয় যুক্তরাজ্য সরকারের বিচার বিভাগের অধীনে।