১৯১৪ সাল; ইউরোপের শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে চলছে প্রতিযোগিতা, সহজে কাঁচামাল সংগ্রহের উৎসের সন্ধানে আর শিল্পে উৎপাদিত পণ্যের জন্য বাজার খুঁজতে। উক্ত সময়ের পূর্ববর্তী কয়েক দশকের মধ্যে হওয়া বসনিয়া সংকট, মরক্কো সংকট আর বলকান যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ইউরোপের রাজনীতি বিভক্ত হয়ে ছিল বেশ কয়েকটি শিবিরে। এরই মধ্যে উগ্র সার্বিয়ান জাতীয়তাবাদীদের হামলায় নিহত হন অস্ট্রিয়ার যুবরাজ ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দ। এ ঘটনায় সার্বিয়ান সরকারের যুক্ত থাকার সরাসরি কোনো প্রমাণ পাওয়া না গেলেও অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের ক্ষমতায় থাকা রাজতন্ত্র তখন সিদ্ধান্ত নেয় সার্বিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক আক্রমণের, অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যবিরোধী জাতীয়তাবাদীদের আশ্রয় দেওয়া সার্বিয়ান সরকারকে ‘শিক্ষা দিতে’।
একে একে বড় বড় শক্তিগুলো এই সংঘাতে জড়িয়ে পড়া শুরু করে, শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। সার্বিয়ার সমর্থনে শুরুতে এগিয়ে আসে রাশিয়ান সাম্রাজ্য; একে একে যুক্ত হয় যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, যারা পরিচিতি পায় মিত্রশক্তি নামে। অপর পক্ষে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের পক্ষে যুক্ত হয় ওসমানীয় সাম্রাজ্য, জার্মান সাম্রাজ্য ও বুলগেরিয়া, যারা পরিচিতি পায় কেন্দ্রীয় শক্তি হিসেবে।
প্রায় পাঁচ বছর স্থায়ী এই বিশ্বযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিহত হন কয়েক কোটি মানুষ, ভেঙে পড়ে ইউরোপের অর্থনীতি, স্থায়ীভাবে ইউরোপের রাজনীতির সাথে সাথে বদলে যায় বৈশ্বিক রাজনীতিও। কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সেভা গুনিস্কায়ের আধুনিক গণতন্ত্রের বিবর্তনের উপর আলোচনায় উঠে এসেছে সপ্তম ঢেউ হিসেবে, ২০১৮ সালে প্রকাশিত তার ‘ডেমোক্রেটিক ওয়েভস ইন হিস্ট্রিকাল পার্সপেকটিভ‘ আর্টিকেলে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী রাজনৈতিক পরিবর্তন
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রেনেসাঁর ছোঁয়া উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে লাগলেও, রাশিয়ায় রেনেসাঁর ছোঁয়া লাগে বিংশ শতাব্দীতে এসে। এর মধ্যে শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতির আকার প্রতিবছর বড় হলেও, জারতন্ত্রের অধীনে থাকা রাশিয়া ব্যর্থ হয় ইউরোপীয় শক্তিগুলোর সাথে তাল মেলাতে। ১৯০৫ সালের রুশ বিপ্লব সাংবিধানিক রাজতন্ত্র আনলেও জাররা নিজেদের ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে ইচ্ছুক ছিলেন না নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সাথে। এর মধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে একেবারে প্রথমদিকে জড়িয়ে পড়া দেশগুলোর একটি ছিল রাশিয়ান সাম্রাজ্য। জার্মান সাম্রাজ্যের পরোক্ষ সমর্থন নিয়ে যখন অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য সার্বিয়া সার্বিয়া আক্রমণ করে, তখন সার্বিয়া সরকারের পক্ষে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে রুশ সাম্রাজ্য।
যুদ্ধে প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্রের অভাবে নিহত হয় বিপুল সংখ্যক রুশ সৈন্য, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ আর সরঞ্জাম ছাড়াই বাধ্যতামূলকভাবে যুদ্ধে পাঠানো হয় কৃষকদের। যুদ্ধে রাশিয়ানদের ২০ লাখ সৈন্য নিহত হওয়ার পাশাপাশি যুক্ত হয় রাজনৈতিক ব্যর্থতাও। ফলে অচল হয়ে যাওয়া, পুরনো স্বৈরতান্ত্রিক জারতন্ত্রের প্রতিবাদে যুদ্ধের মধ্যেই শুরু হয় গণবিক্ষোভ।
১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে সফল হয় বিপ্লবীরা, জারকে ক্ষমতাচ্যুত করে সরকার গঠন করে তারা, যে বিপ্লব পরিচিতি পায় ফেব্রুয়ারি রেভ্যলুশন নামে। অক্টোবরে (আধুনিক ক্যালেন্ডারে নভেম্বর) এই বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে পাল্টা অভ্যুত্থান হয় ভ্লাদিমির লেনিনের নেতৃত্বে। আমাদের আধুনিক গণতন্ত্রের আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকবে ফেব্রুয়ারির বিপ্লবের পরে গঠিত হওয়া বিপ্লবী সরকারের উপরই।
ফরাসি বিপ্লবের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে এই বিপ্লবীরা রাশিয়ান প্রতিষ্ঠা করতে চাছিলেন পশ্চিমা ধাঁচের উদার গণতন্ত্র। আলেক্সান্ডার কেরেনস্কির নেতৃত্বাধীন সরকার আইন তৈরি করে ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণে, নিশ্চিত করা হয় নারীদের সম-অধিকার, বিলুপ্ত করা হয় পুরনো বংশগত পদবি। অক্টোবরে ভ্লাদিমির লেনিনের সমর্থকদের আক্রমণে পতন হয় এই উদারনৈতিক সরকারের, জারতন্ত্র থেকে সাত দশকের জন্য আরো কঠোর স্বৈরশাসনে ঢুকে যায় রাশিয়া।
উনবিংশ শতাব্দীতে অস্ট্রিয়ান ও হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য একীভূত হওয়ার পর থেকে ইউরোপের অন্যতম প্রভাবশালী সাম্রাজ্য ছিল অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য। আয়তনে ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম সাংবিধানিক রাজতন্ত্র ছিল এটি, ছিল ইউরোপের তৃতীয় জনবহুল দেশ। অস্ট্রো-প্রুশিয়ান যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তৈরি হওয়া এই রাজতন্ত্রের ছিল ইউনিয়নের প্রকৃত কাঠামো, ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করা ছিল বিভিন্ন জাতিগত গোষ্ঠীর কাছে। অর্ধশতাব্দী এই ইউনিয়ন জাতিগত মিথস্ক্রিয়ার মধ্যে কাজ করলেও জাতীয়তাবাদের উত্থান রাজনৈতিক বিভাজনের দিকে ঠেলে দেয় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে।
রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে জাতীয়তাবাদের ধারণায় উজ্জ্বীবিত গোষ্ঠীগুলো, যাতে যুক্ত হয় সংস্কারকামী বামেরাও। নতুন অর্থনৈতিক সমীকরণ বিভাজন তৈরি করছিল অভিজাত শ্রেণী আর উঠতি মধ্যবিত্তদের মধ্যে, ছিল অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণের রাষ্ট্রকে প্রভাবিত করার সংঘাতও। এর মধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের পরাজয় নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি করে স্বাধীনতাকামী জাতীয়তাবাদীদের কাছে, পতন হয় বহুজাতির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এই সাম্রাজ্যের। এই সাম্রাজ্য ভেঙে তৈরি হয় রিপাবলিক অব অস্ট্রিয়া, প্রথম হাঙ্গেরিয়ান রিপাবলিক, প্রথম চেকোশ্লোভাকিয়া রিপাবলিক, পশ্চিম ইউক্রেন পিপলস রিপাবলিক, কিংডম অব রুমানিয়া, কিংডম অব ইতালি ও রিপাবলিক অব যুগোস্লোভিয়া।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয় পতন ঘটায় জার্মান সাম্রাজ্যের, জার্মানরা হারায় তাদের ঔপনিবেশিক ভূমিগুলো। যুদ্ধের পরে জার্মানিতে সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের পরিবর্তে প্রতিষ্ঠিত হয় সংসদীয় গণতান্ত্রিক কাঠামো, গঠিত হয় ভাইমার প্রজাতন্ত্র (জনতন্ত্র)। সংবিধানের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, নিশ্চিত করা হয় মানবাধিকার আর সংসদকে করা হয় আইন তৈরির প্রতিষ্ঠান। গণতান্ত্রিক কাঠামোর অধিকাংশ মৌলিক মূল্যবোধ নিয়ে ভাইমার প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও, বিজয়ী মিত্রশক্তির অপমানজনক চুক্তি আর ক্ষতিপূরণের দাবি পরবর্তীতে ফ্যাসিবাদের দিকে ঠেলে দেয় জার্মানিকে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আরেক পরাজিত শক্তি ছিল ওসমানীয় সাম্রাজ্য। উনবিংশ শতাব্দী মধ্যভাগ থেকেই ক্রমাগত রাজনৈতিক পশ্চাদপসরণ আর সামরিক শক্তির ক্ষয়ের মধ্যে দিয়ে যাওয়া এই সাম্রাজ্য ব্যর্থ হয় নতুন আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সমীকরণের সাথে তাল মেলাতে, সামরিক প্রযুক্তিতে ইউরোপীয় শক্তিগুলোর সাথে পাল্লা দিতে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের সাথে সাথে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে উপনিবেশগুলোর উপর অধিকার হারায় ওসমানীয় সাম্রাজ্য, সাম্রাজ্যের কেন্দ্রেও বদলে যায় শাসনব্যবস্থা। সুলতানতন্ত্রের পরিবর্তনে জার্মানির মতো তুরস্কেও প্রতিষ্ঠিত হয় রিপাবলিকান কাঠামো। জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ তুর্কিরা শাসনব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করে গণতন্ত্রকে, প্রতিষ্ঠিত হয় সেক্যুলার তুরস্ক।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রভাব পড়ে গ্রীসেও, যেখানে রক্ষণশীল রাজতন্ত্রের সমর্থক আর কট্টর রিপাবলিকানদের মধ্যে বিজয়ী হয় রিপাবলিকানরাই। বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব পড়ে বুলগেরিয়া, ফিনল্যান্ড, লাটভিয়া, এস্তোনিয়া, বেলজিয়াম, সুইডেন আর স্পেনের উপরও। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী মিত্রশক্তির দেশগুলোতে তেমন কোনো পরিবর্তন না আসলেও আন্তর্জাতিক রাজনীতির ধরন বদলে দেয় এরাই।
আধুনিক গণতন্ত্রের সপ্তম ঢেউ
আধুনিক গণতন্ত্র আটলান্টিক রেভ্যলুশন থেকে শুরু করে অনেকগুলো বিপ্লব আর বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে গিয়েছে, সংস্কারপন্থী জাতীয়তাবাদীদের চেষ্টায় সাম্রাজ্যবাদকে হটিয়ে শাসনব্যবস্থা হিসেবে বিভিন্ন দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে গণতন্ত্র। এই ক্রমবিবর্তনের পথে প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনগুলো চিহ্নিত হয়েছে সপ্তম ঢেউ হিসেবে, গণতান্ত্রিক বিবর্তনের আলোচনায় অন্যান্য ঢেউয়ের মতোই রয়েছে ঐতিহাসিক গুরুত্ব।
প্রথমত, সাম্রাজ্যবাদের যুগ থেকে জাতিরাষ্ট্রের যুগে প্রবেশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে ভাষা, ধর্ম, অঞ্চল, নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের উপর গড়ে ওঠা সংস্কারপন্থী জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলো। আবার, এই সংস্কারপন্থী গোষ্ঠীগুলোর এক বড় অংশই ছিল সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর উপনিবেশ শাসনের অধীনে। ফলে বি-উপনিবেশায়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে জাতিরাষ্ট্রের যুগে প্রবেশের ক্ষেত্রে। উনবিংশ শতাব্দীতে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর স্বাধীনতা অর্জনের পর বড় আকারের বি-উপনিবেশায়ন হয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী রাজনৈতিক পরিবর্তনের মাধ্যমে। অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের পতনের মাধ্যমে স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে অস্ট্রিয়া, পোল্যান্ড, যুগোস্লোভিয়া, চেকোস্লাভাকিয়া, রুমানিয়া, ইতালি ও হাঙ্গেরি। ওসমানীয় সাম্রাজ্যও হারায় তাদের উপনিবেশগুলো, যদিও এগুলোর অধিকাংশই স্বাধীন হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে।
দ্বিতীয়ত, এই সময়ে মোটাদাগে চারটি শক্তিশালী সাম্রাজ্যের পতন হয়। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালেই পতন হয় রুশ সাম্রাজ্যের, জারের পরিবর্তে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার বিপ্লবীরা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকে পতন তৎকালের বিবেচনায় অন্যতম ক্ষমতাধর অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের, বিভাজিত হয়ে তৈরি হয়ে বেশ কয়েকটি জাতিরাষ্ট্রের। যুদ্ধের ব্যর্থতা পতন ঘটনায় জার্মান সাম্রাজ্যেরও, প্রতিষ্ঠিত হয় ভাইমার রিপাবলিক। সৈন্যদের আত্মত্যাগের পরও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ব্যর্থতায় বিশ্বযুদ্ধে ব্যর্থ হয়েছে ওসমানীয় সাম্রাজ্য।
তৃতীয়ত, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী রাজনীতিতে বদলে যায় বৈশ্বিক রাজনীতির ভরকেন্দ্র। ওসমানীয় সাম্রাজ্যের পতন, জার্মান সাম্রাজ্যের পতন, রুশ আর অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের পতন বৈশ্বিক রাজনীতির ভরকেন্দ্রকে পশ্চিমের আটলান্টিক মহাসাগরের পাড়ের দেশগুলোর দিকে ঠেলে দেয়। বৈশ্বিক একক পরাশক্তি হিসেবে উঠে আসে যুক্তরাজ্য, পরাশক্তি হিসেবে উত্থান ঘটতে থাকে যুক্তরাষ্ট্রেরও। এই দেশগুলোর অর্থনৈতিক সুবিধার স্বার্থে বিশ্বব্যাপী শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের পক্ষে অবস্থান ভূমিকা রাখে গণতন্ত্রের ক্রমবিবর্তনে।
চতুর্থত, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তি আর কেন্দ্রীয় শক্তির পক্ষে যুদ্ধ করা প্রায় দুই কোটি সৈন্য নিহত হয়, যুদ্ধের পরোক্ষ কারণে প্রাণ হারায় আরো পাঁচ কোটি মানুষ। ইউরোপীয় জনসংখ্যার বাস্তবতায় এই সংখ্যাটি বেশ বড়। ফলে যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে বিশ্বনেতারা চেষ্টা করতে থাকেন একটি বৈশ্বিক সংগঠন তৈরির, যেখানে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটগুলো সংলাপের মাধ্যমে সমাধান সম্ভব হবে, সম্ভব হবে যুদ্ধ আর যুদ্ধের অবশ্যম্ভাবী ক্ষতি এড়ানো। ফলে বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী রাজনৈতিক বাস্তবতায় তৈরি হয় জাতিপুঞ্জ, যাতে ভূমিকা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের ১৪ দফারও।
এই ইতিবাচক পরিবর্তনগুলোর পরেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা কমে এক ডজনে এসে দাঁড়ায়। তবে এরপরও অব্যাহত থেকে গণতন্ত্রের বিস্তার, আধুনিক গণতন্ত্রের ক্রমবিবর্তন এরপরও বজায় থেকেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জাতিসংঘ, পরিবর্তন হয়েছে বৈশ্বিক পরাশক্তি। এশিয়ার পাশাপাশি বি-উপনিবেশায়নের ঢেউ লেগেছিল আফ্রিকাতেও। স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তির পর সমাজতন্ত্র আর ফ্যাসিবাদকে হটিয়ে একমাত্র গ্রহণযোগ্য শাসনব্যবস্থা হিসেবে উঠে এসেছে গণতন্ত্র। সেই আলোচনা উঠে আসবে আধুনিক গণতন্ত্রের বিবর্তনের উপর পরবর্তী পর্বগুলোর আলোচনায়।