ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে একসময় বলা হতো “The empire on which the sun never sets“; অর্থাৎ ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এত বড় ছিল যে সেখানে কখনো সূর্য ডুবত না। কারণ আর কিছুই না, পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্ত, সবখানেই কোনো না কোনো সময় সূর্য আলো দিয়ে চলেছে, আর প্রায় এ পুরোটা জুড়েই ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য। কিন্তু কীভাবে এর পতন হলো? সে এক বিশাল ইতিহাস। কিন্তু পতন হয়ে যাওয়া ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের এখনো রয়েছেন রানী, রয়েছেন রাজপুত্র, আর রাজপরিবারের কত আচার, নিয়ম কানুন, আছে প্রাসাদ। কখনো কি মনে হয়নি ঐ প্রাসাদের ভেতর রাজপরিবারের সদস্যরা কী করেন? বিশ্বে ঘটে চলা নানা ঘটনায় তাদের অবস্থানটা ঠিক কী? সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানো এ মানুষগুলোর জীবনে কোনো দুঃখ আছে কি?
জনপ্রিয় বিনোদন ও স্ট্রিমিং সার্ভিস Netflix আপনার এ প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতেই নিয়ে এসেছে উচ্চ বাজেটের ড্রামা সিরিজ The Crown; যার কেন্দ্রীয় চরিত্রে আছেন আর কেউ নন- বর্তমান রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ।
সিরিজটা দেখবার আগে পেছনের একটু ধারণা রাখা প্রয়োজন। সেটা নিয়েই লিখছি এখন। ১৯৩৬ সালে রাজা পঞ্চম জর্জ মারা যাবার পর তার বড় ছেলে এডওয়ার্ড রাজা হন, এবং তার নাম হয় রাজা অষ্টম এডওয়ার্ড। তিনি ছিলেন ভারতের শেষ সম্রাট। রাজা একজন আমেরিকান সমাজকর্মীর (ওয়ালিস সিম্পসন) এর প্রেমে পড়ে যান, কিন্তু ওয়ালিসের পূর্বে ডিভোর্স হয়েছিল। ইংল্যান্ডের চার্চ মোটেও অনুমতি দেয় না যে রাজপরিবারের কেউ কোনো ডিভোর্সিকে বিয়ে করবে। যদিবা করতে চায়ও তবে রাজত্ব ছাড়তে হবে। প্রেমের জন্য রাজা অষ্টম এডওয়ার্ড রাজত্ব ছেড়ে দিলেন মুকুট পড়বার আগেই এবং রাজত্ব দিয়ে গেলেন ছোট ভাই আলবার্টকে। আলবার্ট রাজা হয়ে নাম নিলেন ষষ্ঠ জর্জ। তার ছোট্ট দুই মেয়ে ছিল এলিজাবেথ আর মার্গারেট। এই এলিজাবেথই তার বাবা অসুখে মারা যাবার পর রানী হয়ে সিংহাসনে আরোহণ করলেন।
মাত্র ২৫ বছর বয়সের তরুণী হওয়ায় রাজকার্য শুরুতে চালাবার জন্য পরামর্শ নিতে হতো তাকে অনেকের কাছ থেকেই। এলিজাবেথ যখন ক্ষমতায় আসেন তখন সালটা ছিল ১৯৫২। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী এক পৃথিবী। এই সিরিজের প্রথম সিজনে তার রাজত্বের প্রথম কয়েক বছরের কাহিনীগুলো দেখানো হয়েছে। ফিলিপ মাউন্টব্যাটেনের সাথে তার বিয়ে কীভাবে হয়? ব্রিটেনের যদি গণতান্ত্রিক সরকার থেকেই থাকে তবে রাজা-রানীর কী প্রয়োজন? রানীর কাজটা আসলে ঠিক কী? প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিলের সাথে তার কেমন সম্পর্ক ছিল? যখন তার ছোট বোন মার্গারেট ডিভোর্স নেয়া একজন সামরিক পাইলটের প্রেমে পড়ে যান, তখন রানী কি সেটা মেনে নিয়েছিলেন? নাকি তার চাচার মতো তার বোনকে রাজপরিবার থেকে বের হতে বাধ্য করেছিলেন? রাজপ্রাসাদের ভেতরে কী কী নাটকীয় ঘটনা ঘটে থাকে? এসব জিজ্ঞাসার জবাব পেয়ে যাবেন এই অসাধারণ সিরিজটা দেখে নিলেই।
শুরুতে বলেছিলাম, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য ডুবত না। ১৮৯৮ সালের কানাডীয় স্ট্যাম্পটি থেকে লাল অঞ্চলগুলো খেয়াল করলেই সেটা বোঝা যায়ঃ
মূলত ভারতবর্ষের সাথে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের তিক্ত সম্পর্ক অনেক আগে থেকেই এবং সেটা অনেকটা সঙ্গত কারণেই। ১৯১৯ সালের পহেলা বৈশাখের উৎসবে পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মি নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ৩৭৯ জন মতান্তরে প্রায় ১০০০ জনকে হত্যা করে। এই গণহত্যার পর থেকেই মূলত নিশ্চিত হয়ে যায় যে এই সাম্রাজ্য আর টিকবে না, তাছাড়া নানা শোষণ ও নির্যাতন তো ছিলই। এই ক্ষীয়মাণ সাম্রাজ্যের রানী হিসেবে এলিজাবেথের কার্যকলাপ আর ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটের ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক চালগুলো দ্য ক্রাউন সিরিজে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। যদিও রূপালি পর্দার খাতিরে কিছু কল্পনার আশ্রয় নিতেই হয়েছে, তবুও এই সিরিজের ঐতিহাসিক খুঁতহীনতা বেশ।
IMDb সূত্রে জানা যায়, পিটার মর্গানের লেখনীতে নির্মিত এই সিরিজ ২০১৬ সালের ৪ নভেম্বর নেটফ্লিক্সে মুক্তি পায়। ১০ পর্বের প্রতিটি পর্ব প্রায় ১ ঘণ্টা করে। শুটিং হয়েছিল যুক্তরাজ্যে। এ সিরিজের অনুমিত বাজেট ছিল ১৫৬,০০০,০০০ মার্কিন ডলার!
এলিজাবেথের চরিত্রে নজরকাড়া অভিনয় করেছেন ক্লেয়ার ফয়। আর তার স্বামী ফিলিপের চরিত্রে আছেন ম্যাট স্মিথ, যাকে পূর্বে দেখা গেছে ব্রিটিশ সায়েন্স ফিকশন টিভি সিরিজ ‘ডক্টর হু’ এবং হলিউড মুভি সিরিজের টার্মিনেটরের পঞ্চম পর্বে। এ সিরিজের সঙ্গীত প্রযোজনা যারা করেছেন তাদের মধ্যে আছেন হ্যান্স জিমার- যিনি পাইরেটস অফ দ্য ক্যারিবিয়ান, ইন্টারস্টেলার, দ্য ডার্ক নাইট ইত্যাদি বিখ্যাত মুভির সঙ্গীত প্রযোজনা করে বিখ্যাত। আর সিরিজের সিনেমাটোগ্রাফি বা ক্যামেরার কাজ দেখে আপনি মুগ্ধ হবেনই হবেন!
২০১৭ সালের ‘সেরা টিভি সিরিজ’ এর গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার জিতে নেয় দ্য ক্রাউন। আর সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পেয়ে যান ক্লেয়ার ফয়।
ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল সিরিজগুলোর একটি দ্য ক্রাউন। প্রতি এপিসোডের পেছনেই ব্যয় ৫ মিলিয়ন ডলার! এমনকি সিরিজের একটি মাত্র এপিসোড শুটিং শেষ করবার আগেই এবং প্রচারিত হবার পূর্বেই আরও একটি সিজন বানাবার জন্য কমিশন হয়ে যায়! সিরিজে ছয়টা সিজন করবার পরিকল্পনা আছে। তবে এই অভিনেতা অভিনেত্রীগণ কেবল দু সিজনেই থাকবেন। এরপর তাদের স্থলাভিষিক্ত হবেন একটু বয়স্ক অভিনেতারা, কারণ পর্দায় যে তাদের বয়স বাড়ানো দেখাতে হবে!
উল্লেখ্য, রানী এলিজাবেথের চরিত্রে অভিনয়কারী ক্লেয়ার ফয় শুটিং সেটে অভিনয়ের ফাঁকে ফাঁকে তার সদ্য জন্ম নেয়া বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতেন। আর যেখানে অন্যদের মেক-আপ বা কস্টিউমের জন্য লেগে যেত ঘণ্টার পর ঘণ্টা, সেখানে চার্চিলের চরিত্রে অভিনয় করা জন লিথগো’র মেক-আপে সময় লাগত মোটে কুড়ি মিনিট! চার্চিলের গর্জে ওঠা চরিত্র এতো সুন্দর করে রূপায়ণ মনে হয় আর কেউ করতে পারতেন না। কিন্তু সত্যিকারের ৫ ফুট ৬ ইঞ্চির চার্চিলের জায়গায় অভিনেতা জন লিথগো’র উচ্চতা ছয় ফুট চার ইঞ্চি হওয়ার কারণে শুটিং সেতে ডাউনিং স্ট্রিটের দরজা বানাবার সময় বড় করে বানানো হয়েছিল, যেন দরজার তুলনায় চার্চিলকে বেশি বড় না মনে হয়!
২০১৬ সালের নভেম্বরের ১ তারিখ এই সিরিজের প্রথম দুটো এপিসোড থিয়েটারে মুক্তি দেওয়া হয়, যেটা পূর্বে আরেক জনপ্রিয় সিরিজ ডক্টর হু এর ক্ষেত্রে করা হয়েছিল। ২০১৭ সালের মার্চ থেকে ইংল্যান্ডের নানা জায়গায় সিরিজের দ্বিতীয় সিজনের শুটিং শুরু হয়েছে। সিরিজটি কি পারবে আশানুরূপ চমক দেখাতে? আইএমডিবি রেটিং যেখানে ১০ এ ৮.৮ আর রটেন টমেটো যে সিরিজকে ৯১% স্কোর দিয়েছে, সেটি কি না দেখে থাকা যায়?