
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন হচ্ছে, মেরুতে জমাট বাঁধা বরফ গলছে। পত্রিকায় ছবি দেখছি, অনলাইনে শত শত খবর-ছবি আর ভিডিও। উষ্ণায়নের এই খবরটি আপনার কাছে পৌঁছে দেওয়ার যতগুলো মাধ্যম আছে সবাই বৈশ্বিক উষ্ণায়নেই ভূমিকা রাখছে। পত্রিকার কাগজ তৈরি হয়েছে গাছ কেটে, অনলাইন ব্যবস্থাকে দাঁড় করিয়ে রাখতে চলছে বিদ্যুৎ উৎপাদন, আপনার-আমার মোবাইল ল্যাপটপটি চার্জ করতে ব্যবহার করছি সেই বিদ্যুৎ। এই বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বা গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের ফলে আমাদের সামনে ঘনিয়ে আসছে আরেক দুর্যোগ। এসব দুর্যোগের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হলো বরফ ও পার্মাফ্রস্ট গলে যাওয়া।
পার্মাফ্রস্ট কী?
উষ্ণায়নের ফলে মেরু অঞ্চলে থাকা পার্মাফ্রস্ট নামে চিরহিমায়িত অঞ্চল গলতে শুরু করেছে। পার্মাফ্রস্ট গলে গেলে আমাদের কি সমস্যা সেই ব্যাপারটিতে যাবার আগে পার্মাফ্রস্ট কী তা ব্যাখ্যা করা দরকার।

পার্মাফ্রস্ট হলো মেরু এবং মেরুসংলগ্ন এলাকায় মাটির সক্রিয় অংশের (সক্রিয় অংশ হলো সেই অংশ যেখানে গ্রীষ্মে কৃষিকাজ সম্ভব এবং বেশিরভাগ প্রাণীর অস্তিত্ব পাওয়া যায়) নীচের স্থায়ী বরফের স্তর। গ্রীষ্মে কিংবা তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে উপরের সক্রিয় অংশে জমা হওয়া বরফ গেলেও নীচের পার্মাফ্রস্ট সাধারণত গলে যায় না। পৃথিবীর মেরু এলাকায় বরং বছরের পর বছর ধরে পার্মাফ্রস্ট সঞ্চিত হয়েছে। পৃথিবীর বেশিরভাগ পার্মাফ্রস্ট সঞ্চিত হয়ে আছে উত্তর গোলার্ধে আর্কটিক এলাকার চারদিকে। তাই এই এলাকায় যখন কোনো প্রাণী মারা যায় তা সাধারণ প্রাণীর মতো মাটিতে মিশে যায় না, এরা পার্মাফ্রস্টে সঞ্চিত হয়ে থাকে, একটু কাব্যিক করে বললে দাঁড়াবে বরফের কুটুরীতে এরা মমি হয়ে থাকে।

পার্মাফ্রস্টের নীচে লুকানো ইতিহাস
পৃথিবীতে নানা প্রান্ত পার্মাফ্রস্টের নীচে দেখা মেলে এমন প্রাণীর মমির। তাদের দেহের আকার আকৃতিও প্রায় একইরকম থাকে। সাইবেরিয়ার ইয়াকুতিয়া রিপাবলিকে দেখা মিলে বরফ যুগের মমির। নীচের ছবিতে দেখানো লায়ুবা (Lyuba) নামের এক বাচ্চা ম্যামথকে দেখা যায়। ২০০৭ সালে রাশিয়ার আর্কটিক এলাকার ইয়ামাল পেনিনসুলা থেকে এর দেখা পাওয়া যায়, বিজ্ঞানীরা কার্বন ডেটিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই মমির যাবতীয় তথ্য উদঘাটনে সক্ষম হয়েছেন। প্রায় ৪১,৮০০ বছর আগে মারা যায় ৩০-৩৫ দিন বয়স্ক এই বাচ্চা ম্যামথটি। শুধুমাত্র এই লায়ুবার ঘটনাই প্রথম নয়, রাশিয়ার সাইবেরিয়ার গহীনে এবং আর্কটিক এলাকায় গলিত পার্মাফ্রস্টের নীচে লুকিয়ে আছে শত সহস্র বছরের ইতিহাস।

জলবায়ু পরিবর্তন এবং আমাদের ঝুঁকি
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে হাজার বছর ধরে জমাট বেঁধে থাকা ইতিহাস যেন গলতে শুরু করেছে। পার্মাফ্রস্টে জমাট বেঁধে থাকা প্রাণীর দেহে, সেখান জমা হয়ে ভাইরাস আর ব্যাকটেরিয়াও অবমুক্ত হতে শুরু করেছে। মানবজাতির সামনে কি ঘনিয়ে আসছে ঘোর বিপদের দিন?
২০১৬ সালের আগস্ট মাসের একটি ঘটনা দিয়েই শুরু করা যাক, সাইবেরিয়ান তুন্দ্রায় ইয়ামাল পেনিনসুলায় অজানা রোগে একটি ১২ বছর বয়স্ক ছেলে মারা যায়। অনেকেই একই ধরনের উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে থাকেন। শেষে জানা যায়, অ্যানথ্রাক্সের সংক্রমণ হয়েছে ইয়ামাল পেনিনসুলায়। শুধু মানুষের মাঝেই নয়, প্রায় আড়াই হাজারের মতো বলগা হরিণ এতে আক্রান্ত হয়।

ফিরে আসা অ্যানথ্রাক্স
অ্যানথ্রাক্স খুবই সংক্রামক একটি রোগ, এই রোগের পেছনে দায়ী ব্যাসিলাস এনথ্রাসিস (Bacillus anthracis) নামের একটি ব্যাকটেরিয়া, ১৯৪১ সালে শেষ ইয়ামালে অ্যানথ্রাক্সের সংক্রমণ হয়েছিল। রাশিয়ান বিজ্ঞানীদের গবেষণা বলছে, ৭৫ বছর আগে এই এলাকায় অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হয়ে বেশ কিছু বলগা হরিণ মারা গিয়েছিল। মারা যাওয়ার পরে এদের মৃতদেহ সঞ্চিত হয়ে থাকে পার্মাফ্রস্টে। এদের দেহে থাকা ঘাতক ভাইরাসও অক্ষত অবস্থায় থেকে যায়। দীর্ঘদিন পরে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে পার্মাফ্রস্ট একটু একটু গলতে শুরু করে, এবং সেই মৃত বলগা হরিণ আবার উন্মুক্ত হয়ে যায়। ফলে অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু আশেপাশের পানি এবং খাদ্যে ছড়িয়ে যায়।
আশেপাশে চড়তে থাকা প্রায় দুই হাজার বলগা হরিণ আক্রান্ত হয় এবং বলগা হরিণের রক্ষণাবেক্ষণ করা মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। জনবসতি অনেক কম হওয়ায় এবং সরকার সেনাবাহিনীর ‘বায়োলজিক্যাল ওয়েপন’ বিশেষজ্ঞদের দল দ্রুত প্রেরণ করে এবং আক্রান্ত এলাকা থেকে বাসিন্দাদের সরিয়ে নেয়। ফলে খুব বড় আকারে মহামারি ছড়িয়ে পড়েনি।
প্যান্ডোরার বাক্সে কী আছে?
পার্মাফ্রস্টকে বিজ্ঞানীরা বলে থাকেন প্যান্ডোরার বাক্স, কারণ বিজ্ঞানীরা বলছেন এই বাক্সে ঘাতক জীবাণু দীর্ঘ সময় ধরে অক্ষত অবস্থায় থাকতে পারে, রাশিয়ার ঘটনাটি এর একটি ছোট প্রমাণ মাত্র। ইতিহাসের পাতায় খুঁজে না পাওয়া কোনো জীবাণু যার সাথে আধুনিক মানুষের কোনো দেখা হয়নি, এমন কিছুও হয়তো বেরিয়ে আসতে পারে এই বরফের তোলা থেকে- এমন আশঙ্কাও করছেন বিজ্ঞানীরা।

ইতিহাসবিদেরা বলছেন, শুধু বিংশ শতাব্দীতেই অ্যানথ্রাক্সের মহামারিতে দশ লাখের অধিক বলগা হরিণ মারা গিয়েছিল সাইবেরিয়া এলাকায়। মহামারির সময়ে সেই হরিণদেরকে গভীর গর্ত খুঁড়ে চাঁপা দেওয়ার সময় কিংবা সুযোগ ছিলো না মানুষের হাতে। ফলে তাদেরকে মাটির অল্প গভীরেই পুঁতে রাখা হয়। দীর্ঘদিনের বরফ জমার ফলে সেই জায়গাগুলো ঢাকা পড়ে গিয়েছিল, রাশিয়ার উত্তরাঞ্চলে এই ধরনের সাত হাজার হরিণের সমাধিক্ষেত্র আছে। এই সমাধিক্ষেত্রগুলো অবমুক্ত হয়ে পড়লে মহামারি সময়ের ব্যাপার মাত্র।
স্প্যানিশ ফ্লু আর গুটিবসন্ত কি ফিরে আসবে?
শুধু মহামারিতে মারা যাওয়া প্রাণীই নয়, বিভিন্ন সময়ে রোগে আক্রান্ত মানুষকেও সমাহিত করা হয়েছে বরফের তলায়। ১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লুর সময় মানুষকে আলাস্কার তুন্দ্রা অঞ্চলে সমাহিত করার প্রমাণ পাওয়া যায়। সেই কবর থেকে বিজ্ঞানীরা স্প্যানিশ ফ্লু ভাইরাসের আরএনএ খণ্ড বের করতে সক্ষম হয়েছিলেন। স্থানীয় ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, বিশ্বজুড়ে মহামারি ছড়ানো প্লেগ আর গুটিবসন্তের সময় প্রচুর মানুষকে সাইবেরিয়ায় সমাহিত করা হয়েছে।
২০১১ সালের গবেষণা বলছে, পৃথিবীজুড়ে তাপমাত্রা যত বাড়ছে, পার্মাফ্রস্টের আশেপাশে সমাধিক্ষেত্রগুলো ততই উন্মুক্ত হয়ে পড়ছে। নতুন করে খনি খুড়তে গিয়ে, বসতি স্থাপনে কিংবা তুন্দ্রা এলাকায় পশুপালন করতে গিয়ে পার্মাফ্রস্টের ক্ষয়ে যাওয়ার চিহ্ন লক্ষ্য করছেন অনেকেই এবং একইসাথে প্রত্যন্ত এসব এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে নানা অজানা রোগ।
১৮৯০ সালে সাইবেরিয়া অঞ্চলে একটি ঐতিহাসিক গুটিবসন্ত প্রাদুর্ভাবের প্রমাণ পাওয়া যায়, যার ফলে ঐ এলাকার চল্লিশ শতাংশ লোকের মৃত্যু ঘটে। প্রচুর লোককে পার্মাফ্রস্টের উপরের অংশে কলইয়ামা নদীর তীর ঘেঁষে কবর দেওয়া হয়। ১২০ বছর পরে কলইয়ামা নদীর তীরে ভাঙতে শুরু করেছে ফলে পার্মাফ্রস্ট গলে গিয়ে আশেপাশের বিপুল এলাকায় ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

১৯৯০ সাল থেকেই নভোসাইবেরিস্কের ভাইরোলজি রিসার্চ সেন্টার বরফের নীচ থেকে পাওয়া নমুনায় ভাইরাসের অস্তিত্ব নিয়ে কাজ করছে। এমনকি সাইবেরিয়ার দক্ষিণাংশে প্রস্তরযুগের মমিতে ভাইরাসের উপস্থিতি নিয়ে কাজ করছে। বিশেষজ্ঞরা গবেষণা থেকে নিশ্চিত হয়েছেন গুটিবসন্ত ভাইরাসের ‘জেনেটিক ম্যাটেরিয়াল’ নমুনাগুলোতে পাওয়া যাচ্ছে।
শুধু সাইবেরিয়াতেই না…
তবে শুধু সাইবেরিয়াতেই নয় আলাস্কাতেও নাসার বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরেই এমন কিছু সম্ভাবনার প্রমাণ পেয়েছিলেন। ২০০৫ সালে আলাস্কার জমাটবদ্ধ একটি পুকুর থেকে বত্রিশ হাজার বছর পুরাতন একটি ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান পেয়েছেন তারা। ব্যাকটেরিয়াটির নাম ‘Carnobacterium pleistocenium’, পৃথিবীজুড়ে যখন লোমশ ম্যামথদের পাওয়া যেত, তখনকার নমুনায় পাওয়া যায় এদের। বরফ গলে গেলে এই ব্যাকটেরিয়া আবার পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। তবে সব ব্যাকটেরিয়া এই দীর্ঘ সময়ের সুপ্তাবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারে না। অ্যানথ্রাক্সের জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়া ‘স্পোর’ তৈরি করতে পারে। এই স্পোর দীর্ঘদিন প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে পারে।

বিজ্ঞানীরা অহরহই এমন উদাহরণ পাচ্ছেন যেখানে শত শত বছরের পুরাতন নমুনা থেকে ভাইরাস কিংবা ব্যাকটেরিয়ার অস্তিত্ব মিলছে। তবে আশার কথা ভাইরাস পোষকদেহ ছাড়া খুব বেশি সময় বেঁচে থাকতে পারে না। তবে মেরু এলাকায় মানুষের আনাগোনা যত বাড়ছে এই ভাইরাসগুলো দিয়ে সংক্রমণের সম্ভাবনা তত বাড়ছে। সম্প্রতি চীনের একটি শহর থেকে সারাবিশ্বে করোনাভাইরাস সংক্রমণের উদাহরণ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে একটিমাত্র শহর থেকে কীভাবে বৈশ্বিক মহামারি ছড়ানো সম্ভব।
তাই প্লেগ, স্প্যানিশ ফ্লুর যে রোগগুলোকে আমরা পেছনে ফেলে এসেছি বলে নিজেদের বাহবা দিচ্ছি অচিরেই সেগুলো কি আমাদের আক্রমণ করতে যাচ্ছে? বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কি মানবজাতিকে ঠেলে দেবে জীবাণুর আক্রমণের মুখে? শুধু সময়ই হয়তো এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে!