
সিনেমা, নাটক বা বই পড়ার বদৌলতে ‘হিপনোসিস’ বা ‘সম্মোহন’ সম্পর্কে আমরা কম-বেশি সবাই পরিচিত। কিন্তু জানার থেকে অজানার পরিমাণই বেশি। গল্প বা সিনেমায় হিপনোটাইজ ব্যাপারটিকে যে অতিরঞ্জিত করে দেখানো হয়, তা বলতে মানা নেই। ফলশ্রুতিতে অনেকেই এর সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণ করেন। অনেকেরই ধারণা হিপনোটাইজের মাধ্যমে একজনকে পুরোপুরি নিজের বশে এনে নিজের পছন্দানুযায়ী কাজ করানো সম্ভব। অন্তত নাটক, সিনেমা দেখে এই ধারণা হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।

হিপনোসিস করার মুহূর্তে। Image Source: https://i.warosu.org/sci/
অস্কারবিজয়ী বিখ্যাত পরিচালক সত্যজিত রায়ের ‘গুপি বাঘা ফিরে এলো” চলচ্চিত্রটি দেখলে ধারণাটি আরও বদ্ধমূল হয়। এতে দেখানো হয়, একজন তান্ত্রিক তার মন্ত্রবলে রাজ্যের সকল দ্বাদশবর্ষীয় বালকদের আটকে এনে সম্মোহিত করছে বিক্রম নামে একজনের খোঁজে। সিনেমাটির উপস্থাপনা ছিল অনবদ্য, কিন্তু কথার জাদুতে এতোগুলো বাচ্চাকে হিপনোটাইজ করার ব্যাপারটা খানিকটা অতিরঞ্জিত ছিল বৈকি।

সত্যজিৎ রায়। Image Source: http://live.priyo.com
সত্যজিত রায়ের ‘হিপনোসিসের’ ব্যাপারে ছিল দারুণ মোহ। তার বিভিন্ন গল্পে ‘হিপনোসিস’ প্রসঙ্গটি বারবার উঠে এসেছে। সোনার কেল্লা গল্পেও দেখা যায় হিপনোসিসের কেরামতি। হিপনোটাইজের মাধ্যমে ‘মুকুল’ নামে এক শিশুর আগের জন্মের কথা মনে পড়ে যায় আর তার উপর ভিত্তি করে নকল ডাক্তারের সোনার কেল্লা খোঁজার অভিযান।
কাকাবাবু যারা পড়েছি, তাদের কাছে কাকুবাবুর হিপনোটাইজ করার ক্ষমতা অজানা নয়। সেই ক্ষমতার ব্যবহার করে তিনি কত যে রহস্যের সমাধান করেছেন, তা সন্তুর মুখে অনেক শোনা। আসলে হিপনোসিস বা সম্মোহন ভাবনাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে হাজারো গল্প, উপন্যাস। আর এই শব্দের সাথে বহুল আলোচিত আদিকালের তান্ত্রিক, সাধু সন্যাসী। তারা নাকি এই ক্ষমতার জোরে মানুষের উপর তাদের আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল।

কাকাবাবু।
‘হিপনোসিস’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘সম্মোহন’। এটি মূলত বিজ্ঞানসম্মত একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞ তার রোগীর কাছ থেকে অবচেতন অবস্থায় বিভিন্ন কথা বের করে আনার চেষ্টা করেন। এর সফলতা রোগীর অবস্থার তারতম্যে পরিবর্তন হতে পারে। পুরো হিপনোসিস প্রক্রিয়ায় রোগী বা যাকে হিপনোসিস করা হচ্ছে তার শরীরে শিথিলতা নেমে আসে। তীব্র কল্পনা শক্তির কারণে একটি অস্বাভাবিক স্বপ্নায়ন মোহগ্রস্তের অবস্থার বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে, যা অনেকটা ঘুমের মতো মনে হলেও আসলে কিন্তু ঘুম নয়। কারণ এই হিপনোসিস প্রক্রিয়াটিতে পুরো সময়জুড়ে হিপনোটাইজড ব্যক্তিটিকে সজাগ থাকতে হয়।

হিপনোসিসরত একজন। Image Source: http://hypnosisinmelbourne.com
অধিকাংশ সময় একে দিবাস্বপ্নের মতো মনে হয়। অথবা কোনো বই বা মুভিতে আমরা যেমন অনেক সময় নিজেকে হারিয়ে ফেলি, গল্পের মধ্যে ঠিক সেরকম। হিপনোসিস চলাকালীন সময়ে মস্তিষ্কের সচেতন অংশকে সাময়িকভাবে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ঐ ব্যক্তির বিক্ষিপ্ত চিন্তাগুলোকে কেন্দ্রীভূত করা হয় এবং তাকে মানসিকভাবে শিথিল করার দিকে মনোনিবেশ করানো হয়।

মানসিক শিথিলতা আনার প্রক্রিয়া। Image Source: http://www.mindbodyvortex.com
প্রাচীনকাল থেকেই সম্মোহন বিদ্যা প্রচলিত রয়েছে মানব সমাজে। সেকালে এই বিদ্যাকে যাদুবিদ্যা, বশীকরণ বিদ্যা বা অলৌকিক ক্ষমতা বলে মানুষ বিশ্বাস করা হতো। অষ্টাদশ শতকে সম্মোহন বিদ্যার নামকরণ হয় ‘মেজমেরিজম’। অষ্ট্রিয়ার ভিয়েনা শহরের ড. ফ্রাণ্ডস্ অ্যান্টন মেজমার সম্মোহন বিদ্যার চর্চা শুরু করেন। ফলে এর ব্যাপক প্রচার শুরু হয় এবং পরবর্তীতে তার নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় ‘মেজমেরিজম’।

ড. ফ্রাণ্ডস্ অ্যান্টন মেজমার। Image Source: http://www.swr.de
১৮৪০ সালে স্কটল্যান্ডের আরেক ডাক্তার জেমস ব্রেড নতুন নামকরণ করেন। গ্রিক শব্দে ঘুমের দেবতার নাম ‘হুপ্নস’। এই শব্দের অর্থ হলো ঘুম। সম্মোহিত ব্যক্তি যেহেতু এক প্রকার ঘুমের ঘোরে কাজ করে যায়, তাই ড. ব্রেড এই বিদ্যার নাম দিলেন ‘হিপনোটিজম’। এ নামই বর্তমানে প্রচলিত হয়ে আসছে।

ডাঃ জেমস ব্রেড। Image Source: http://www.jamesbraidsociety.com/
পৃথিবীতে অনেককিছুই যুক্তিযুক্তভাবে ঘটে, কিন্তু মানুষের কাছে সেই যুক্তি খুব সহজেই পৌঁছায় না। তখন সেটাকে উপযুক্ত জ্ঞান ও প্রমাণের অভাবে দৈব কোনোকিছু বলে ধরে নিতে বদ্ধপরিকর হয়ে পড়ে সে। ব্রিটিশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক নিযুক্ত একটি কমিটি বিস্তর অনুসন্ধানের পর রায় দেয় যে, হিপনোটিজম একটি বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি। এরপর যত দিন এগোচ্ছে, বড় বড় চিকিৎসক-বিজ্ঞানীরা এই বিদ্যাটির উপর অত্যুৎসাহী হয়ে বিভিন্ন গবেষণা চালিয়ে আসছেন। বর্তমানে এটি সর্বজনস্বীকৃত যে, হিপনোটিজম একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি।

হিপনোসিস। Image Source: http://ultimateperformancesolutions.com
অনেকেরই একটি ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে যে, প্রবল ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন মানুষকে হিপনোটাইজ করা যায় না। মূলত সকল মানুষকেই হিপনোটাইজ করা সম্ভব। মোটামুটিভাবে কোনো জনসংখ্যার ৯০ শতাংশকে হিপনোটাইজ করা যায়। বাকিদের ক্রমশ উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে হিপনোথেরাপিতে অভ্যস্ত করে তোলা যায়। হিপনোথেরাপি পদ্ধতি খুব সহজ। অবশ্য হিপনোথেরাপির আসল জোর মোটেই পদ্ধতিতে নয়, সাজেশনে। হিপনোথেরাপির উদ্দেশ্য কাউকে হিপনোটাইজ করা নয়, রোগীকে তাঁর সমস্যা থেকে উদ্ধার করা। হিপনোথেরাপি হলো ‘প্রোগ্রামিং অফ সাবকনসাস মাইন্ড’ যা সমস্যার মূলে সরাসরি আঘাত হানতে পারে। তবে সাজেশন ঠিকঠাক হওয়া বাঞ্ছনীয়।

একজন হিপনোথেরাপিস্ট। Image Source: http://hypnosisforcancercare.com
হিপনোসিস বা সম্মোহনকে কেন্দ্র করে অনেক ধরনের অসুখ-বিসুখ সারানো সম্ভব বলে দাবি করা হচ্ছে। অনেক বিজ্ঞানী আবার একে এমনই এক ধরনের বিদ্যা বলে আখ্যায়িত করছেন, যার মাধ্যমে যেকোনো অসুখ শুধু সারানো নয়, একেবারে নির্মূল করাও সম্ভব হয়! হয়তো কিছুটা অতিরঞ্জিত, কিন্তু অনেক হিপনোটিস্ট বা হিপনোথেরাপিস্টের দাবি, বিদ্যাটি ঠিকঠাক প্রয়োগ করতে পারলে আর্থ্রারাইটিস, হাইপারথাইরয়েডিজম থেকে শুরু করে অ্যাজমা, ক্রনিক হজমের সমস্যা, মদ বা ধূমপান অভ্যাস, বন্ধ্যাত্ব, স্ট্রোকের ফলে হওয়া পঙ্গুত্ব, দুশ্চিন্তা, মাইগ্রেন, বাত বা ক্যানসারের যন্ত্রণা, অনিদ্রা, ফোবিয়া, উচ্চরক্তচাপ, ওজন বৃদ্ধি সমূলে মিটিয়ে দেয়া সম্ভব।
খেলাধুলার মধ্যেও হিপনোসিসের ব্যবহার? শুনলেই চমক লাগে। আর সেই ঘটনা সত্যি হয়ে দেখা দিয়েছে দাবা খেলার মতো এক মনস্তাত্ত্বিক খেলায়। দাবা খেলায় এর প্রয়োগ দেখে পুরো বিশ্ব হতবাক হয়ে যাওয়ার অবস্থা। বিশ্ব দাবা চ্যাম্পিয়ন ম্যাগনাস কার্লসেনের সম্বন্ধে বলা হয়, তিনি নাকি তুখোড় হিপনোটিস্ট। খেলতে বসেই প্রতিপক্ষের চোখের দিকে তাকিয়ে তার মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণ করে ফেলা নাকি তার হাতের খেল। আর এই কারণেই কার্লসেনের সাথে গ্র্যান্ডমাস্টার হিকারু নাকামুরা কালো সানগ্লাস পড়ে খেলতে নেমেছিলেন। তাকে জিজ্ঞেস করা হলে জবাবে বলেন, “এই পৃথিবীতে কত কিছুই তো ঘটে, হতে পারে তার এই ক্ষমতা রয়েছে। আর আমি নিশ্চয় চাইবো না তার হাতের পুতুল হয়ে খেলতে।”

ম্যাগনাস কার্লসেন। Image Source: http://geeksnation.org
১৯৭৮ সালে বিশ্ব দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে এনাটলি কার্পোভ এবং ভিক্টর কর্চনয়ের মধ্যকার খেলা চলছিল ফিলিপাইনের বাগুইও শহরে। খেলার একটি পর্যায়ে কর্চনয় তার বিরুদ্ধে হিপনোসিসের অভিযোগ তুলেন এবং বিচারককে রঙিন চশমা সরবরাহ করতে অনুরোধ করেন।

দাবায় হিপনোসিসের ব্যবহার ঠেকাতে সানগ্লাস। Image Source: http://www.worldchesschampionship
প্রায় ২০০ বছরেরও অধিক সময় ধরে লোকজন হিপনোসিস বা সম্মোহন নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করে আসছে। এই বিষয় নিয়ে রয়েছে হাজারো তর্ক-বিতর্ক। কিভাবে সম্মোহন করা হয় তা নিয়ে একটি ধারণা পাওয়া গেলেও ঠিক কী কারণে সম্মোহিত হয়, তার পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা এখনও বিজ্ঞান দিতে পারেনি। মানুষের মন আসলেই একটি জটিল জায়গা। কি দেখে ভাল লাগে? কিসে প্রেমে পড়ে? কিসে বিপথে যায়? এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া দুরূহ ব্যাপার। মানুষ আপন মনে তার মনকে নিয়ে খেলে। তাই তো এই পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষই আলাদা। আলাদা তাদের চিন্তা ভাবনা, ধ্যান ধারণা। এই মনকে নিয়েই তাই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই চলে আসছে হিপনোসিস বা সম্মোহনের খেলা।