নক্ষত্রের জীবন কাহিনী
নক্ষত্রগুলো সাধারণত সবচেয়ে সরল মৌল হাইড্রোজেন দিয়ে গঠিত হয়ে থাকে। নক্ষত্রের ভর প্রচণ্ড বেশি হয়ে থাকে। ফলে এর অভ্যন্তরের পদার্থগুলো প্রচণ্ড চাপ অনুভব করে। সাধারণত এক পরমাণু আরেক পরমাণুর ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না কিংবা একাধিক পরমাণু একত্রে মিলে একটি পরমাণু তৈরি করতে পারে না। কিন্তু নক্ষত্রের অভ্যন্তরের প্রবল চাপে হাইড্রোজেন পরমাণুগুলো একটি আরেকটির সাথে মিলে গিয়ে হিলিয়াম তৈরি করে। এক পরমাণু আরেক পরমাণুর সাথে মিললে প্রবল শক্তি অবমুক্ত হয়। সেই শক্তিগুলো তাপ ও আলোর আকারে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের গায়ে লাগা রোদের তাপ আর চোখে লাগা সূর্যালোক আসলে এই প্রক্রিয়াতেই তৈরি হয়েছে। তাপ ও আলোকের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকার বিকিরণও নিঃসরণ করে।
নক্ষত্র একদিকে প্রবল অভিকর্ষীয় আকর্ষণ বলে সংকুচিত হয়, আবার অন্যদিকে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার শক্তিশালী ঊর্ধ্বমুখী বল তাকে বাইরের দিকে স্ফীত করতে চেষ্টা করে। সংকোচন ও প্রসারণ এই দুই দিকের সাথে দফারফা করে নক্ষত্র একটি পর্যায়ে এসে সাম্যাবস্থায় অবস্থান করে। খুব বেশি সংকুচিতও হয় না, আবার খুব বেশি স্ফীতও হয় না, মাঝামাঝিতে থাকে। নক্ষত্রের আকার মূলত দুই বলের বলের ভারসাম্যের ফল। যতক্ষণ পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক মতো আছে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই ভারসাম্য বা নক্ষত্রের আকার একই থাকে। কয়েক বিলিয়ন বছর ধরে এভাবে জ্বলে জ্বলে যখন নক্ষত্রের হাইড্রোজেন জ্বালানীর যোগান শেষ হয়ে যায়, তখন এটি বহির্মুখী বল প্রদান করতে পারে না। ফলে প্রবল শক্তিশালী মহাকর্ষ বল নক্ষত্রকে চাপিয়ে সংকুচিত করে ফেলে।
বিজ্ঞানীদের পক্ষে নক্ষত্রের জীবন পর্যবেক্ষণ করা অসম্ভব। কারণ সমস্ত জীবন ব্যাপীও যদি তারা পর্যবেক্ষণ করে যান, তাহলে নক্ষত্রের জীবনের এক ঝলকের বেশি পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন না। তবে সৌভাগ্যক্রমে বিজ্ঞানীরা টেলিস্কোপ ও অন্যান্য কৌশল ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। এসব বৈচিত্র্যময় মাঝে একদম ‘শিশু’ নক্ষত্র যেমন আছে, তেমনই ক্রান্তিকালে উপনীত হওয়া নক্ষত্রও আছে। মোদ্দা কথা নক্ষত্রের জন্মদশা থেকে শুরু করে শেষ দশা পর্যন্ত সকল পর্যায়ের নক্ষত্রই পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছেন জ্যোতির্বিদরা।
একদম শিশু বা নবজাতক নক্ষত্ররা তাদের জীবন শুরু করে ধূলি ও গ্যাসের বিশাল মেঘের একত্রীকরণের মাধ্যমে। সাড়ে চার বিলিয়ন বছর আগে আমাদের সূর্যও এরকম ধূলি ও গ্যাসের বিশাল সংগ্রহ থেকে জীবন শুরু করেছিল। সূর্য এখন যে অবস্থায় আছে, সে অবস্থায় আরো কয়েক বিলিয়ন বছর থাকবে।
জ্যোতির্বিদরা বিভিন্ন আকার ও আকৃতির নক্ষত্রের খুব সমৃদ্ধ একটি তালিকা বা উপাত্ত তৈরি করেছেন। আকার ও আকৃতির পাশাপাশি নক্ষত্রগুলো তাদের জীবন চক্রের কোন পর্যায়ে আছে তার বিবরণও আছে জ্যোতির্বিদদের কাছে। এসব নক্ষত্রের সকলেই অন্য নক্ষত্রের সাক্ষী হিসেবে কাজ করছে। প্রত্যেক নক্ষত্রই বলছে অন্য নক্ষত্রগুলো আগে কেমন ছিল কিংবা ভবিষ্যতে কেমন হবে। যেমন- সূর্য কেমন ছিল তা সূর্যের সমভরের কোনো শিশু নক্ষত্রকে পর্যবেক্ষণ করলেই জানা যাবে। কিংবা ভবিষ্যতে সূর্যের অবস্থা কেমন হবে তা-ও জানা যাবে সমভরের বুড়ো কোনো নক্ষত্রকে পর্যবেক্ষণ করলে।
সূর্যের মতো সাধারণ নক্ষত্রগুলো জ্বলে ওঠার পর থেকে অনেক অনেক বছর পর্যন্ত হাইড্রোজেনকে পুড়িয়ে জীবিত থাকে তথা আলো ও উত্তাপ ছড়ায়। এরকম নক্ষত্রের অভ্যন্তরে দুটি হাইড্রোজেন পরমাণু নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার মাধ্যমে একটি হিলিয়াম পরমাণু তৈরি করে। পুড়তে পুড়তে একসময় হাইড্রোজেনের মজুদ শেষ হয়ে যায়। হাইড্রোজেন না থাকাতে বাইরের দিকে জ্বলুনী শক্তি প্রয়োগ হয় না, ফলে অভ্যন্তরের দিকে নক্ষত্রের অভিকর্ষীয় চাপ প্রচণ্ডভাবে বাড়তে থাকে।
চাপের মাত্রা বেড়ে গেলে এর অভ্যন্তরে থাকা হিলিয়াম জ্বলতে শুরু করে। এই স্তরে থাকা নক্ষত্রকে বলা হয় রেড জায়ান্ট বা লোহিত দানব। আমাদের সূর্যও পাঁচ বিলিয়ন বছর পর লোহিত দানবে পরিণত হবে। এ থেকে বোঝা যায়, সূর্য এই মুহূর্তে তার জীবন চক্রের প্রাথমিক অবস্থাতেই আছে। নাক্ষত্রিক বিবেচনায় সূর্য এখনো তরুণ।
সূর্য দানব অবস্থায় উপনীত হবার অনেক আগে আমাদের এই ছোট্ট পৃথিবী এতটাই উত্তপ্ত হয়ে যাবে যে সেখানে বসবাসই করা যাবে না। সূর্য এখন যেমন উজ্জ্বল আছে, দুই বিলিয়ন বছর পর তার উজ্জ্বলতা বেড়ে যাবে আজকের উজ্জ্বলতার ১৫%। যার মানে হচ্ছে, পৃথিবী হয়ে যাবে শুক্র গ্রহের মতো। আজকে শুক্র গ্রহ যেমন শুষ্ক ও রুক্ষ, দুই বিলিয়ন বছর পর পৃথিবীও হয়ে যাবে তেমনই শুষ্ক ও রুক্ষ।
শুক্র গ্রহে বসবাসের কথা কল্পনাও করা যায় না। এর পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ৪০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও উপরে। তবে দুই বিলিয়ন বছর অনেক লম্বা সময়, এই সময়ের ভেতর মানুষ কিছু না কিছু একটা করে ফেলবে বা মানুষের কিছু না কিছু একটা হয়ে যাবে। হয়তো মানুষ এতো লম্বা সময়ব্যাপী নিজেদের টিকিয়ে রাখতে না পেরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে কিংবা প্রযুক্তিগতভাবে এতটাই উন্নত হয়ে যাবে যে সহজেই অন্য কোনো বাসযোগ্য গ্রহে চলে যেতে পারবে সকলে।
এরও পরে হিলিয়ামও যখন জ্বলে শেষ হয়ে যাবে, তখন সূর্য ফুঁস করেই একদম ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। চারদিকে ধূলি ও ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে এর মাঝে একদমই চুপসে যাবে। চুপসে যাওয়া অংশটায় থাকবে না কোনো উত্তাপ, থাকবে না কোনো আলো এবং এটি হবে আকারে বেশ ছোট। মরে যাওয়া বা প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়া এই অংশটিকে বলে হয় হোয়াইট ডোয়ার্ফ বা শ্বেত বামন।
সুপারনোভা ও নক্ষত্রের সন্তান
কোনো নক্ষত্র যদি সূর্য থেকে যথেষ্ট পরিমাণ বেশি ভারী ও বেশি উত্তপ্ত হয় তাহলে তার মৃত্যু সূর্যের মতো স্বাভাবিকভাবে হয় না। এর সমাপ্তি ঘটে একদম ভিন্নভাবে। বড় নক্ষত্রের ভর বেশি বলে তার মাঝে থাকা মহাকর্ষীয় চাপও বেশি। অধিক চাপের কারণে হাইড্রোজেন জ্বালানীগুলো দ্রুত শেষ হয়ে যায়। এরপর হাইড্রোজেন থেকে উৎপন্ন হিলিয়াম জ্বালানীও দ্রুত শেষ হয়ে যায়।
কম ভরের নক্ষত্র এই পর্যায়ে এসে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেলেও অধিক ভারী নক্ষত্রগুলো আভ্যন্তরীণ শক্তিশালী চাপের প্রভাবে হিলিয়াম থেকে উৎপন্ন কার্বন পরমাণুও নিউক্লিয় বিক্রিয়ার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। শুধু এটিই নয়, আরো ভারী মৌলও শক্তিশালী চাপের প্রভাবে নিউক্লিয় বিক্রিয়ায় অংশ নেয়। এভাবে এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকে, যতক্ষণ না খুব বেশি ভারী কোনো মৌল তৈরি হচ্ছে। এই প্রক্রিয়াতেই নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, লোহা ইত্যাদি মৌলগুলো তৈরি হয়। পৃথিবীতে যত ধরনের ভারী মৌল দেখা যায় তার সবই এসেছে এরকম কোনো নক্ষত্রের অভ্যন্তর থেকে।
তবে লোহার চেয়ে ভারী মৌল এভাবে তৈরি হয় না। নক্ষত্রের ভর যদি অধিক পরিমাণ বেশি হয়, তাহলে এই পর্যায়ে আসার পর তা ভয়ানক বিস্ফোরণের মাধ্যমে নিজের জীবনের সমাপ্তি ঘটায়। এ ধরনের বিস্ফোরণকে বলে সুপারনোভা বিস্ফোরণ এবং ঐ পর্যায়ে থাকা নক্ষত্রকে বলে সুপারনোভা। বিস্ফোরণের ফলেই লোহার চেয়েও ভারী মৌলগুলো তৈরি হয়। সুপারনোভা বিস্ফোরণের প্রভাবে সীসা তৈরি হতে শুরু করে, এমনকি ইউরেনিয়ামও তৈরি হয়। অন্যদিকে নক্ষত্র ও তার আশেপাশের গ্রহ তৈরি হয় মহাকাশের বিশাল বিস্তৃত গ্যাস ও ধূলির মেঘ থেকে। সৌরজগৎও এভাবেই গঠিত হয়েছে। সৌরজগৎ গঠনের সময় সুপারনোভার এরকম বিস্ফোরণের ধ্বংসাবশেষই স্থান করে নিয়েছিল আমাদের পৃথিবীর মাঝে। যার কারণে আমরা এসব মৌলের দেখা পাই। এমনিতে স্বাভাবিকভাবে সৌরজগতের কোনো প্রক্রিয়ায় এত ভারী মৌল তৈরি হওয়া সম্ভব নয়।
ইতিহাসে মাত্র ২০টি সুপারনোভার কথা লিপিবদ্ধ আছে। এখন পর্যন্ত মাত্র ২০টি সুপারনোভা পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছে মানুষ। পদার্থবিজ্ঞানের নায়ক, জার্মানের জোহানেস কেপলাও একটি সুপারনোভা বিস্ফোরণ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন ১৬০৪ সালের ৯ অক্টোবর। নিচের ছবিটি হচ্ছে কেপলারের পর্যবেক্ষণ করা সুপারনোভাটির বর্তমান অবস্থার চিত্র। কেপলারের সময়ের অবস্থা থেকে বর্তমান অবস্থা স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা ভিন্ন হবে, কারণ সময়ের সাথে সাথে এর ভগ্নাবশেষ বা ধ্বংসাবশেষ বাড়তে থাকে। এই বিস্ফোরণের শুরু হয়েছিল মূলত প্রায় ২০ হাজার বছরেরও আগে।
সাধারণ নক্ষত্র থেকে সুপারনোভা কিছুটা ভিন্ন। কারণ এর দ্বারা লোহার চেয়েও ভারী মৌল তৈরি হয়। সীসা ও ইউরেনিয়াম তার উদাহরণ। অত্যন্ত বৃহৎ ও শক্তিশালী এই বিস্ফোরণের মাধ্যমে সুপারনোভারা মৌলগুলোকে মহাবিশ্বের চতুর্দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয়। এই ধ্বংসাবশেষগুলোই পরবর্তীতে আবারো নক্ষত্র তৈরি করার কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। নতুন নক্ষত্র ব্যবস্থা তৈরির সময় এই ধ্বংসাবশেষগুলোই প্রাথমিক ধূলি মেঘ হিসেবে গণ্য হয়। স্বভাবতই এসব ধূলি মেঘে ভারী মৌল থাকে।
সূর্যকে নিয়ে যখন সৌরজগৎ তৈরি হয়, তখনও এরকম কোনো মেঘের ভেতর দিয়েই সৌরজগতের কাঁচামাল গঠিত হয়। এই কারণেই দেখা যায় পৃথিবীতে ভারী ভারী মৌলের অস্তিত্ব আছে। জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য অক্সিজেন, নাইট্রোজেন কার্বন সহ অন্যান্য সকল ভারী মৌলই আসলে এসেছে সৌরজগতের জন্মের অনেক অনেক আগে ধ্বংস হয়ে যাওয়া কোনো এক বা একাধিক সুপারনোভা বিস্ফোরণের ফলে।
প্রাণের বিকাশ বা উৎপত্তিতেও আসলে উপাদান হিসেবে কাজ করেছে সুপারনোভা বিস্ফোরণের ধ্বংসাবশেষ। বলা হয়ে থাকে আমরা মানুষেরা নক্ষত্রের সন্তান (We are stardust)। এদিক থেকে এটা আসলেই সত্য। আমরা আসলেই নক্ষত্রের সন্তান। আমাদের প্রত্যেকটা কোষে কোষে লেগে আছে বিলিয়ন বিলিয়ন বছর আগে জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাওয়া নক্ষত্রের উপাদান। সুপারনোভা আকারে নক্ষত্রের এমন বিস্ফোরণ না হলে হয়তো আজ প্রাণের কোনো অস্তিত্বই থাকতো না। আজকে যে পৃথিবী ফুলে ফলে প্রাণে ভরপুর অবস্থায় আছে তার ভিত রচিত হয়েছে বিলিয়ন বিলিয়ন বছর আগের সেই অজানা নক্ষত্রদের বুকে।
নক্ষত্রের উপাদানে যে আমরা গঠিত এই বিষয়ের উপর পদার্থবিজ্ঞানী লরেন্স ক্রাউসের একটি কাব্যিক উক্তি আছে-
আমাদের মহাবিশ্ব সম্পর্কে সবচেয়ে কাব্যিক যে সত্যটা আমি জানি তা হলো, আপনার দেহের প্রতিটি অণু-পরমাণু একসময় লুকিয়ে ছিল একটি বিস্ফোরিত নক্ষত্রের অভ্যন্তরে। অধিকন্তু আপনার বাম হাতের পরমাণুগুলো হয়তো এসেছে এক নক্ষত্র থেকে আর ডান হাতেরগুলো এসেছে ভিন্ন আরেকটি নক্ষত্র থেকে। আমরা আক্ষরিক অর্থেই সবাই নক্ষত্রের সন্তান, আমাদের সবার দেহ তৈরি হয়েছে নাক্ষত্রিক ধূলিকণা দিয়ে।