২০শে জুলাই ২০২০, জাপানের থ্যানগাশিমা স্পেস সেন্টার, কিছুক্ষণ পর এখান থেকেই যাত্রা শুরু করবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রথম মঙ্গল ‘মিশন হোপ’ (Hope)। কন্ট্রোল রুমে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে একদল বিজ্ঞানী, চলছে কাউন্টডাউন- থ্রি… টু… ওয়ান। প্রত্যেকের দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে কন্ট্রোল রুমের বড় ডিসপ্লেতে ভেসে থাকা একটি রকেটের দিকে। কাউন্টডাউন শেষ হতেই গর্জে উঠলো রকেটের ইঞ্জিন, প্রবল বেগে ছুটে চললো উর্ধ্বাকাশের দিকে। সবকিছু ঠিকঠাকভাবে শুরু হয়েছে বুঝতে পারলো কন্ট্রোল রুমে থাকা সকলেই, মুহুর্তেই সকলের করতালিতে নীরবতা ভাঙলো। ভীষণ উৎকন্ঠায় আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লো একেকজন।
কন্ট্রোল রুমের বাকি সবার চেয়ে একজন একটু বেশি উচ্ছ্বসিত আজ। কারণ আজকের এই সফলতম মুহুর্তের কারিগর তিনি। তিনি সারাহ্ আল-আমিরি, আরব আমিরাতের প্রথম মঙ্গল মিশন হোপ-এর টিম লিডার। ২০১৬ সালে টিম লিডার পদে নিয়োগ পাওয়ার পর এই মুহূর্তটিই ছিল তার জীবনের প্রধান লক্ষ্য।
সারাহ্ আমিরির যখন ১২ বছর বয়স, তখন এক অদ্ভুত কারণে জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রেমে পড়েন। কোনো এক রাতের পরিষ্কার আকাশে একবার অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি দেখেন। সেই থেকেই আকাশ, তারা, মহাশূন্য এসবের প্রতি আগ্রহের শুরু, তখনও অবশ্য সারাহ্ জানতেন না এগুলোই জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রধান বিষয়বস্তু। যখন বুঝতে শিখেছেন জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে, তখন অবশ্য এটাও বুঝতে পেরেছিলেন যে, এ বিষয়ে পড়াশোনা করে তার উজ্জ্বল ক্যারিয়ার গড়া সম্ভব নয়। কারণ সেসময় পর্যন্ত তার দেশে মহাকাশ গবেষণা নিয়ে কোনো পরিকল্পনা ছিল না।
স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চশিক্ষিত হলেন একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। নিজের ক্যারিয়ারও শুরু করলেন অন্যসব প্রকৌশলীর মতোই। কিন্তু কে জানত যে এই তিনিই একদিন দেশের এক ঐতিহাসিক অর্জনের নেপথ্যে কাজ করবেন!
সারাহ আল-আমিরি
দুবাই শহরে অবস্থিত আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অভ শারজাহ থেকে কম্পিউটার প্রকৌশলে স্নাতক এবং মাস্টার্স ডিগ্রি শেষ করেন সারাহ আমিরি। কম্পিউটার প্রকৌশলে পড়াশোনা করলেও জ্যোতির্বিজ্ঞানে তখনও তার আগ্রহ কমেনি। হঠাৎই চমৎকার এক চাকরির সুযোগ আসে, যেখানে তিনি কাজ করবেন একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে, আবার মহাকাশ বিজ্ঞানচর্চার সুযোগও রয়েছে। তাই তিনি একটুও না ভেবে যোগ দেন এমিরেটস ইনস্টিটিউশন ফর অ্যাডভান্সড সায়েন্স এন্ড টেকনোলজির অধীনে মুহাম্মদ বিন রশিদ স্পেস সেন্টারে।
সারাহ্ আমিরি যে সময়ে এই স্পেস সেন্টারে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দেন, সেসময় আরব আমিরাতের প্রথম স্যাটেলাইট প্রোগ্রাম দুবাইস্যাট-১ (DubaiSat-1) এর কাজ চলছিল। প্রথম প্রোগ্রামেই চমৎকারভাবে নিজের দক্ষতার পরিচয় দেন। দুবাইস্যাট-১ এর সফল উৎক্ষেপণের পর কাজ করেন দুবাইস্যাট-২ (DubaiSat-2) প্রোগ্রামে। দ্বিতীয় মিশনটিও ছিল সফল। এরপর তিনি আমিরাতের আরও একটি স্যাটেলাইটে মিশন খলিফাস্যাট (KhalifaSat)-এও কাজ করেন এবং সেখানেও প্রশংসিত হন।
আমিরির ছিল মহাকাশ গবেষণায় প্রবল আগ্রহ, কাজের প্রতিও ছিলেন অত্যন্ত দায়িত্বশীল। ফলে ক্যারিয়ারের শুরুতেই তিনি বেশ সফলতা পেতে শুরু করেন। কয়েক বছরের মধ্যেই মুহাম্মদ বিন রশিদ স্পেস সেন্টার ও দুবাইয়ের বেশ পরিচিত ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন তিনি।
২০০৯ সালে সারাহ্ আমিরি তার ক্যারিয়ার শুরু করেন। এরপর মাত্র ৫ বছর পরেই আরব আমিরাত সরকার তাকে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত করেন। ২০১৪ সালে তাকে আরব আমিরাতের অ্যাডভান্সড এরিয়াল সিস্টেমস প্রোগ্রাম (Advanced Aerial Systems Program) স্থাপনের দায়িত্ব দেওয়া হলে তিনি তা শুরু করেন এবং সফলভাবে একটি HAPS স্যাটেলাইট নির্মাণ সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করেন।
HAPS স্যাটেলাইট হলো ড্রোন এবং স্যাটেলাইটের মাঝামাঝি একধরনের আকাশযান। গোলমেলে হয়ে গেল নিশ্চয়ই? বুঝিয়ে বলা যাক। বিশেষ ধরনের HAPS স্যাটেলাইট মূলত অবস্থান করে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলেই, তবে এটি ড্রোনের চেয়ে অধিক উচ্চতায় উড়তে সক্ষম। এর মাধ্যমে ব্যস্ততম এয়ার স্পেস থেকেও সহজেই গোয়েন্দা তৎপরতা চালানো যায়। ড্রোনের তুলনায় এর সুবিধা হলো এটি অধিক উচ্চতায় ওড়ে বলে রাডারে ধরা পড়ে না। আর স্যাটেলাইটের তুলনায় এর সুবিধা হচ্ছে, চাইলে একে ম্যানুয়ালি নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং দ্রুত রিয়েল টাইম আপডেট পাওয়া যায়।
HAPS প্রোগ্রামের ১ বছর পর সারাহ্ আমিরি তার জীবনের আরও এক উল্লেখযোগ্য মাইলফলক স্পর্শ করেন। ২০১৫ সালে ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের বর্ষসেরা ৫০ তরুণ বিজ্ঞানীর একজন নির্বাচিত হন। কাজের প্রতি দায়িত্বশীলতা আর জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা তাকে একের পর এক সফলতা এনে দেয়। ২০১৬ সালে তিনি এমিরেটস সায়েন্স কাউন্সিলের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
সফলতার গল্প কি এখানেই শেষ? না, এখনো অনেক বাকি। ২০১৬ সাল অবধি তার জীবনে যত অর্জন, তখনও তার বয়স সবেমাত্র ২৯!
২০০৯ সালে একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরুর পর তার উপর যে দায়িত্বই এসেছে, সবগুলোই তিনি সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন। ফলে তিনি রাষ্ট্রীয়ভাবেও আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। তাই হয়তো মঙ্গল স্যাটেলাইট ‘মিশন হোপ’- এর জন্যও তাকে টিম লিডার হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।
সারাহ্ আমিরি তার জীবনের নতুন আরেকটি অধ্যায় শুরু করেন। বিগত বছরগুলোতেও তার বেশ কিছু সফল কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে, তবে এবারের লক্ষ্যটা ৬২ মিলিয়ন কিলোমিটার দূরের মঙ্গল গ্রহ। তাই সমস্ত লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের কেন্দ্রবিন্দু এখন একটিই- মিশন হোপ।
মিশন হোপ
মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ ধনী রাষ্ট্রগুলোর একটি সংযুক্ত আরব আমিরাত। ৭টি পৃথক আমিরাত নিয়ে গঠিত এই দেশটি। আর্থিকভাবে প্রাচুর্যের অধিকারী হলেও দেশটির প্রায় সম্পূর্ণ অর্থনীতি তেল নির্ভর। শুধুমাত্র একটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে কোনো দেশ দীর্ঘদিন সচ্ছলভাবে টিকে থাকতে পারে না, যদিও আমিরাতে যথেষ্ট তেলের মজুদ রয়েছে।
মূলত তেলের উপর অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা কমাতেই প্রযুক্তিখাতকে ঢেলে সাজাতে উদ্যোগী হয়েছে আরব আমিরাত। ফলে বিভিন্ন রকমের প্রযুক্তিগত আধুনিকায়ন করা হচ্ছে দেশটিতে। তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন প্রযুক্তিখাত, যেগুলোতে গড়ে উঠবে পরবর্তী প্রজন্মের কর্মক্ষেত্র।
সেই লক্ষ্যেই ২০১৪ সালে দেশটি মঙ্গল গ্রহের অরবিটে স্যাটেলাইট পাঠানোর পরিকল্পনা হাতে নেয়। ২০১৭ সালে দেশটি গড়ে তোলে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স মন্ত্রণালয়। এরপরই কিছু বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়তায় সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তি ও দেশীয় প্রকৌশলীদের মাধ্যমে সারাহ্ আল-আমিরির নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ‘মিশন হোপ’ এর কার্যকর এক বিজ্ঞানী দল।
আপাতত মঙ্গলের অরবিটে স্যাটেলাইট পাঠানো হলেও পরবর্তী ১০০ বছর পর অর্থাৎ ২১১৭ সালের পর মঙ্গলে জনবসতি গড়ে তুলতে চায় দেশটি।
২০ জুলাই ২০২০-এ জাপানের থ্যানগাশিমা স্পেস সেন্টার থেকে প্রথমবারের মতো আরব বিশ্বের কোনো দেশ মঙ্গলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলো। এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত থাকা, আবার এই দলটির নেতৃত্বে থাকা সারাহ্ আমিরির কাছে এটি ছিল আমেরিকার প্রথমবার চন্দ্রাভিযানের মতোই আনন্দের।
আনুমানিক ৭ মাস পর প্রায় ৬২ মিলিয়ন কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে স্যাটেলাইটটি মঙ্গলের কক্ষপথে পৌঁছাবে। এই দীর্ঘ যাত্রাপথে স্যাটেলাইটটি সোলার প্যানেলের মাধ্যমে চালু থাকবে। এতে রয়েছে একটি ইনফ্রারেড স্পেক্ট্রোমিটার, একটি আল্ট্রাভায়োলেট স্পেক্ট্রোমিটার ও একটি ক্যামেরা।
স্যাটেলাইটের মাধ্যমে মঙ্গলের আবহাওয়া ও জলবায়ু সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। পুরো এক মঙ্গল বর্ষের (এক মঙ্গল বর্ষ পৃথিবীর প্রায় ২ বছরের সমান) আবহাওয়া কীভাবে পরিবর্তিত হয় সেই বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা মিলবে। এছাড়াও এটি মঙ্গলের ধূলিঝড় ও বায়ুমণ্ডলের অবস্থা সম্পর্কে ধারণা দেবে।
মোট দু’বছরের এই মিশনটি নিঃসন্দেহে পুরো বিশ্বের কাছে মঙ্গল গ্রহ সম্পর্কে নতুন ধারণা ও অনেক অজানা বিষয় তুলে ধরবে, যা হয়তো পরবর্তী মঙ্গল মিশনগুলোতে বেশ কাজে লাগবে।
আগামী ১০০ বছর পর মঙ্গলে জনবসতি গড়ে উঠুক বা না উঠুক, আরব আমিরাতের প্রথম মঙ্গল যাত্রা নিশ্চয়ই দেশটির নতুন প্রজন্মকে মহাকাশ বিজ্ঞানে উৎসাহী করে তুলবে। হয়তো এই সফল মঙ্গল যাত্রার প্রেরণা থেকেই উন্মোচিত হবে নতুন কোনো সম্ভাবনার দুয়ার। সেই সাথে দেশটির প্রথম মঙ্গল অভিযানের সফল কারিগর হিসেবে ইতিহাসে সম্মানিত হয়ে থাকবেন সারাহ্ আমিরিও।