প্রাচীনকাল থেকে মানবজাতির অনুসন্ধিৎসু মন আকাশের পানে চেয়ে এই মহাবিশ্বের নিগুঢ় রহস্যের মোড়ক উন্মুক্ত করতে চেয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞানের সহযোগিতায় সে তৃষ্ণা খানিকটা মিটলেও মহাবিশ্বের বিশালতার সাথে তুলনা করলে এখনও অবশ্য লক্ষ-কোটি যোজন ক্রোশ পথ পাড়ি দেওয়া বাকি। মানবমস্তিষ্ক এমন ভাবতেই পারে যে, এই মহাবিশ্বের অন্য কোনো গ্রহে পা রাখলে, সেখানে উচ্চ তাপ-চাপ-অভিকর্ষ এবং চরম প্রতিকূলতার কারণে তার দেহ নিমিষেই পুড়ে ছাই-ভস্মে পরিণত হবে। কিন্তু যদি বলা হয় আমাদের চিরচেনা সৌরজগতের বাইরে এমন গ্রহের অস্তিত্ব আছে, যেখানে অবতরণ করলে নিজেকে এতটা সতেজ এবং শক্তিশালী মনে হবে যে, যেন শরীরে নতুন কোনো সুপারপাওয়ার প্রবেশ করেছে! সাম্প্রতিক সময়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সৌরজগতের বাইরে বাসযোগ্য এমন কিছু এক্সোপ্ল্যানেটের সন্ধান পেয়েছেন, যাতে জীবন বিকশিত হবার সকল উপাদানই বিদ্যমান। কাগজে-কলমে এই গ্রহগুলোতে জীবন দ্রুত, ও লম্বা সময় ধরে বিবর্তিত হবার সুযোগ রয়েছে।
এযাবতকাল পর্যন্ত অর্জিত জ্ঞানের পরিসরে আমরা জানি, পুরো মহাবিশ্বে শুধুমাত্র পৃথিবীই একমাত্র গ্রহ যেখানে জীবন সরল থেকে জটিলে বিবর্তিত হয়েছে, এবং হচ্ছে। এজন্য পৃথিবীকে এক অনন্য গ্রহ হিসেবে মানা হয়। ২০২০ সালের ৫ অক্টোবর ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটি এবং টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব বার্লিনের অ্যাস্ট্রোবায়োলজিস্ট ডার্ক মাকুচ এক নতুন মিশন শুরু করেন। এই মিশনে তিনি এমন সব গ্রহকে লক্ষ্য বানিয়েছেন, যেগুলো বসবাসের দিক দিয়ে পৃথিবীর সমমানের বা অনেক দিক দিয়ে পৃথিবীর চেয়ে উত্তম। মজার ব্যাপার হলো, মহাবিশ্বে খোঁজ করে তারা এই পর্যন্ত একটি-দুটি নয়, সর্বমোট চব্বিশটি বাসযোগ্য গ্রহের সন্ধান পেয়েছেন। তিনি এবং তার দল এই গ্রহগুলোকে খোঁজার জন্য আলাদা এক পর্যবেক্ষণের সিদ্ধান্ত নেন। সেজন্য তিনি কিছু বৈশিষ্ট্য সম্বলিত এক তালিকা তৈরি করেছেন। যে গ্রহ এই বৈশিষ্ট্যসমূহ ধারণ করে না, তা সুপার হ্যাবিট্যাবল প্ল্যানেট বা বাসযোগ্য গ্রহের অন্তর্ভুক্ত নয়।
তো একটি গ্রহে জীবের টিকে থাকার জন্য কোন কোন জিনিস জিনিস সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয়? অবশ্যই উপযুক্ত তাপমাত্রায়, আবহাওয়া-জলবায়ু, পানির কথা শুরুতেই উঠে আসবে। এসব মাথায় রেখেই বিজ্ঞানীদের দল আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু বৈশিষ্ট্য মানদণ্ডে যুক্ত করেছেন। সেগুলো নিয়ে চলুন জানা যাক।
মাতৃনক্ষত্রের আয়ুষ্কাল
হোস্ট স্টার বা মাতৃনক্ষত্র হলো সেই নক্ষত্র, যাকে কেন্দ্র করে কিছু গ্রহ নির্দিষ্ট কক্ষপথে আবর্তিত হয়। সাধারণত যখন এক্সোপ্ল্যানেট বা বহির্গ্রহ অনুসন্ধানে নামা হয়, তখন বিজ্ঞানীদের পূর্ণ মনোযোগ থাকে ইয়োলো ডোর্ফ স্টার (হলুদ বামন নক্ষত্র) অর্থাৎ সূর্যের মতো নক্ষত্রদের খুঁজে বের করা। সূর্য নিজেও এমন একটি হলুদ বামন নক্ষত্র। তবে এবার স্কুলজ মাকুচের দল হলুদ বামন নক্ষত্রের সাথে অরেঞ্জ ডোর্ফ স্টারকেও অন্তর্ভুক্ত করলেন, যা অধিকতর শীতল, এবং কম ভরযুক্ত। এটা করার মূল কারণ ছিল সেসকল নক্ষত্রের আয়ুষ্কাল। ইউনিভার্সে যত হলুদ বামন নক্ষত্র আছে, তাদের আয়ুষ্কাল মোটামুটি দশ বিলিয়ন বছরের কাছাকাছি হয়ে থাকে। আর কমলা বামন নক্ষত্রের আয়ুষ্কাল ২০-৫০ বিলিয়ন বছর। তাই কমলা বামন নক্ষত্রের প্ল্যানেটারি সিস্টেমে অন্তর্ভুক্ত গ্রহগুলো স্বাভাবিকভাবেই দুই/তিনগুণ বেশি সময় ধরে প্রাণের বিবর্তন ঘটাতে পারবে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে সকল নক্ষত্র দীর্ঘ আয়ুষ্কালের অধিকারী হতে হবে। লম্বা আয়ুষ্কাল সম্বলিত নক্ষত্রের গ্রহগুলোর আভ্যন্তরীণ ভূ-তাপীয় শক্তি সময়ের সাথে সাথে হ্রাস পায়। ফলে ম্যাগনেটিক ফিল্ড ক্রমশ নড়বড়ে হয়ে আসে।
পানি
বিজ্ঞানীরা যুতসই প্ল্যানেটারি সিস্টেমের কোনো বাসযোগ্য গ্রহের সন্ধান পেলে প্রথমেই ওই গ্রহ এবং এর হোস্ট স্টারের মধ্যবর্তী দূরত্ব বের করে থাকেন। এই পরিমাপ দ্বারা বোঝা যায় গ্রহটি হ্যাবিটেবল জোনে আছে কিনা। এবং এর থেকে ধারণা করা যায়, ওই গ্রহে কী পরিমাণ পানি মজুত আছে।
গ্রহের আকার ও ভর
বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুযায়ী, গ্রহের আকার এবং ভর জীবের বিকাশে সাহায্য করে। গ্রহের আকার যত বৃহৎ, তত বড় এর ভূপৃষ্ঠ। যত বেশি ভর, তত বেশি মধ্যাকর্ষণ বল। মাধ্যাকর্ষণ বল বেশি থাকার সুবিধা হলো, এই গ্রহের বায়ুমণ্ডল হবে অধিক ঘন, যা প্রাণ বিকাশের অনুকূল। তবে ঐ বাসযোগ্য গ্রহের ভর পৃথিবীর তুলনায় দেড়-দুই গুণ বেশি হতে হবে। তাতে গ্রহের কেন্দ্র লম্বা সময় ধরে উত্তপ্ত থাকবে, আর এই তাপ গ্রহের কেন্দ্রকে গলিত আকারে রাখতে সাহায্য করবে। ফলে গ্রহের চারিপাশে অনেক বেশি সময় ধরে প্রোটেক্টিভ ম্যাগনেটিক ফিল্ড সক্রিয় থাকবে, যা প্রাণ বিবর্তনের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেবে।
তাপমাত্রা
কোনো গ্রহের তাপমাত্রা চরম মাত্রার অসহনীয় পর্যায়ের হলে সেখানে প্রাণ টিকে দুষ্কর হয়ে যাবে। তাই, বিজ্ঞানীরা বাসযোগ্য গ্রহের জন্য এমন তাপমাত্রা বেছে নিয়েছেন, যা পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম বা বেশি।
বাসযোগ্য যে চব্বিশটা গ্রহের খোঁজ পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা, তার মধ্যে দুটোতে প্রাণ বিকাশের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। গ্রহ দুটো হলো ‘KOI 5725.01‘ এবং ‘KOI 5554.01’। এই পর্যন্ত পাওয়া তথ্যানুযায়ী, এরা জীব বিবর্তনের জন্য সবদিক থেকেই যুতসই। ‘KOI 5725.01‘ গ্রহের পৃষ্ঠ তাপমাত্রা পৃথিবী থেকে মাত্র ২.৪ ডিগ্রি কম এবং ভর ৭ গুণ বেশি। অধিক ভরের জন্য এর মধ্যাকর্ষণও বেশি। এটি আকারে পৃথিবীর চেয়ে ৮ গুণ বড়। এজন্য এই গ্রহের ভূপৃষ্ঠে জমির পরিমাণও বেশি। সব মিলিয়ে এই গ্রহের বায়ুমণ্ডল জীবন বিকাশের অনেক বেশি উপযুক্ত। মাতৃনক্ষত্র এবং গ্রহের দূরত্ব দেখে বিজ্ঞানীরা অনুমান করেছেন, ঐ গ্রহে অধিক পরিমাণ পানির সম্ভার রয়েছে। এই গ্রহের বয়স ৫৫০ কোটি বছর এবং সেটি পৃথিবী থেকে ২,৯৬৫ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত।
প্রায় ৬৫০ কোটি বছর বয়স্ক KOI 5554.01 গ্রহের পৃষ্ঠ তাপমাত্রা হলো ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা মানবশরীরের জন্য যথাযথ। পৃথিবী থেকে এর গড় দূরত্ব ৭০০ আলোকবর্ষ। এই গ্রহের টেকটনিক প্লেট প্রতিনিয়ত স্থান পরিবর্তন করে বলে এখানে অনবরত নাইট্রোজেন চক্র চলমান থাকে। এই নাইট্রোজেন চক্র পৃথিবীর জন্য খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই চক্র দ্বারা জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় নাইট্রোজেন হরেক রকম রাসায়নিক বিন্যাসে পরিবর্তিত হয়। জীবন ধারণের অতীব প্রয়োজনীয় রাসায়নিক উপাদান, যেমন- অ্যামিনো এসিড, প্রোটিন, ডিএনএ সবকিছুতেই নাইট্রোজেনের সরব উপস্থিতি বিদ্যমান। এছাড়াও নাইট্রোজেন বায়ুমণ্ডল পরিষ্কারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
তাই, ওই গ্রহে নাইট্রোজেন থাকা মানে আরও দ্রুতগতিতে জীবন বিকাশ এবং বায়ুমণ্ডল জীবন ধারণের অনুকূল হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ আছে। তবে এই গ্রহ সম্প্রতি আবিষ্কার হওয়ায় বিজ্ঞানীদের কাছে এই গ্রহ সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য হাতে নেই। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ দিয়ে তারা গ্রহটিকে আরও নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণের চেষ্টা করছেন। এগুলো ছাড়াও, আরও দুটো বাসযোগ্য গ্রহ নিয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা চালাচ্ছেন।
‘এমআর্থ প্রজেক্ট’ এর সাহায্যে ২০১৭ সালের ২০ এপ্রিল ‘LHS 1140 b‘ গ্রহটি আবিষ্কার করা হয়। এমআর্থ প্রজেক্ট হলো এক রোবট-চালিত গবেষণাগার, যেটাতে লাল বামন নক্ষত্রের উজ্জ্বলতাকে অবলোকন করা হয়। এই প্রজেক্ট দ্বারা ওই সব গ্রহকে খোঁজা হয়, যেসব গ্রহ লাল বামন নক্ষত্রের সামনে দিয়ে অতিক্রম করে। LHS 1140 b আবিষ্কারের পর দেখা যায়, আয়রন-নিকেল লাভার রূপে এই গ্রহের ভূপৃষ্ঠের ৭৫% জমি দখল করে রেখেছে। লাভা দ্বারা আবৃত থাকলেও বিজ্ঞানীরা এই গ্রহের ভূ-অভ্যন্তরে পানির সন্ধান পেয়েছেন। তাদের মতে, সেখানে বহু পরিমাণ পানি মজুত আছে। আর গ্রিন হাউজ ইফেক্ট এই গ্রহের জলবায়ুর সাথে একটা সামঞ্জস্যপূর্ণ ভারসাম্য তৈরি করে রেখেছে।
এরপরের গ্রহটির ব্যাপারে বিজ্ঞানীমহল আরও বেশি উৎসুক। জীবনের সন্ধান করতে এই গ্রহে তারা কয়েকটি বার্তা পর্যন্ত পাঠিয়েছেন। গ্রহটির নাম হলো ‘Luyten b। ২০১৭ সালের ১৭ মার্চ রেডিয়াল ভেলোসিটি ব্যবহার করে এটি আবিষ্কার করেন বিজ্ঞানীরা।
রেডিয়াল ভেলোসিটির মাধ্যমে মূলত এক নক্ষত্রের সাপেক্ষে আরেকটা নক্ষত্রের অবস্থা নির্ণয় করা হয়। যদি এদের মধ্যে বিদ্যমান শূন্যস্থানে কোনো তারতম্য দেখা দেয়, তাহলে ধরে নেওয়া হয় বিশালাকৃতির কোনো গ্রহ ওই নক্ষত্রের অধীনে বিদ্যমান এবং সেটি ওই নক্ষত্রকে মহাকর্ষ দ্বারা প্রভাবিত করছে।
লুইটেন বি গ্রহের স্থানাঙ্ক পরিমাপ করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, এই গ্রহে প্রচুর পরিমাণে পানি থাকতে পারে। পানির পাশাপাশি এখানে অ্যামিনো এসিড, হাইড্রো-কার্বনও থাকার সম্ভাবনা বেশি। ২০১৭ সালের অক্টোবরে ‘Messaging Extraterrestrial Intelligence’ এবং ‘METI Organization‘ আলাদা আলাদা বার্তা প্রেরণ করে এই গ্রহে। এদের মধ্যে একটা বার্তা ছিল শর্ট মিউজিক্যাল কম্পোজিশন, আরেকটা ছিল মহাবিশ্বে পৃথিবী অবস্থান নির্ণয়ের বৈজ্ঞানিক টিউটোরিয়াল।
শুধু সৌরজগতের বাইরেই নয়, আমাদের সৌরজগতেও পৃথিবী বহির্ভূত একটি বাসযোগ্য স্থানের খোঁজ পেয়েছে বিজ্ঞানীরা। তবে সেটি কোনো গ্রহ নয়। তা হলো বৃহস্পতি গ্রহের দ্বিতীয় বৃহত্তম উপগ্রহ ক্যালিস্টো। প্রথম আবিষ্কারের পর একে নিষ্প্রাণ, রুক্ষ এবং পাথুরে উপগ্রহ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। কিন্তু ১৯৯০ সালে প্রমাণিত হয়েছে, এতে বরফ বিদ্যমান। এর বরফ পৃষ্ঠের নিচে লবণাক্ত সাগর আছে।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এই উপগ্রহের পৃষ্ঠে আরেকটি বায়ুমণ্ডল শনাক্ত করেছেন, এবং তাদের দাবি, এই বায়ুমণ্ডলে মানুষের ভালোভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস চালিয়ে নিতে কোনো অসুবিধা হবে না। কিন্তু যত সমস্যা পাকিয়ে যায় বৃহস্পতি থেকে আসা অধিক হারের বিকিরণ নিয়ে, যা জীবের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এই একটা দিক বাদ দিলে ক্যালিস্টোকে সুপার হ্যাবিটেবল প্ল্যানেটের তালিকায় রাখা যায়। দেখা যাক, ভবিষ্যতে বিজ্ঞানীরা মঙ্গল গ্রহের পর ক্যালিস্টোতে বসতি গড়ে তোলার চেষ্টা চালান কিনা।