সকালে ঘুম থেকে ওঠার সাথে সাথে মানুষের কর্মব্যস্ততা শুরু হয়ে যায়। কেউ যায় অফিসে মানসিক শ্রম দিতে, কেউ মাঠে যায় শারীরিক শ্রম দিতে। তবে শুধুমাত্র শারীরিক শ্রম বা কায়িক শ্রমের বলে কিছু হয় না। একজন কৃষককে মাথা খাটিয়ে বের করতে হয় ফসলের জমিতে আর কতটুকু পরিচর্যা করতে হবে। আবার একজন অফিসের তুখোড় হিসাবরক্ষককে কী-বোর্ডে তুমুল গতিতে হাত চালিয়ে হিসেব কষতে হয়। একসময় দেহ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তখন কিছুক্ষণ বিশ্রাম আর খাবার খেয়ে দেহকে আবার ঝরঝরে করে তুলে কাজে লেগে পড়ে সবাই।
ঠিক যেন একটি জৈবিক যন্ত্র। আসলেই তাই। মানবদেহ নামক এই জৈবিক যন্ত্রে কম-বেশি ৩৭.২ ট্রিলিয়ন সজীব কোষ রয়েছে। এরাই হাজারো রকম কাজ করে সারাক্ষণ সচল রাখছে এই দেহকে। এই কাজ সম্পাদন করার জন্য প্রতিটি কোষের শক্তি দরকার। এই শক্তি আসে খাদ্য থেকে। আমরা যে খাবার খাই, সেই খাবার পরিপাকতন্ত্রে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় কোষের গ্রহণ উপযোগী সরল খাদ্যকণায় পরিণত হয়। এই খাদ্যকণা পৌঁছে যায় বিলিয়ন বিলিয়ন কোষের প্রতিটিতে। কোষের অভ্যন্তরে এই খাদ্যকণাকে ভেঙ্গে শক্তি উৎপাদন করতে আরেকটি অতিরিক্ত বস্তুর দরকার। তার নাম অক্সিজেন।
আমাদের শরীর এক জোড়া ফুসফুসের মাধ্যমে বাতাস থেকে টেনে নেয় অক্সিজেন। অক্সিজেন কোষের অভ্যন্তরে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় উৎপন্ন করে শক্তি। এই শক্তিই সচল রাখে দেহকে। কিন্তু এই উৎপাদন প্রক্রিয়ায় উপজাত হিসেবে তৈরি হয় এক অবাঞ্ছিত পদার্থের, তার নাম কার্বন ডাইঅক্সাইড। একে দ্রুত শরীরের বাইরে বের করে না দিলে ভয়ানক বিপদ। কিন্তু কে বের করে দেবে এই কার্বন ডাইঅক্সাইডকে? কে-ই বা প্রতিটা কোষে বয়ে আনবে খাদ্যকণা আর অক্সিজেনকে?
এর উত্তর একটাই- রক্ত! আমাদের শরীরে ট্রান্সপোর্ট সার্ভিস হলো এই রক্ত। দেহের কোষে কোষে বিভিন্ন কাঁচামাল পৌঁছে দেওয়া থেকে শুরু করে উৎপাদিত ক্ষতিকর পদার্থকে নিষ্কাশিত করার সমস্ত গুরুভার অর্পিত এই তরল যোজক কলা বা কানেকটিভ টিস্যুর উপর।
রক্ত কী?
আমাদের দেহে চার ধরনের টিস্যু আছে। এগুলো হলো-
- আবরণী কলা (Epithelial tissue), যার কাজ দেহকে আচ্ছাদিত করে রাখা।
- যোজক কলা (Connective Tissue), যা দেহের বিভিন্ন অঙ্গ বা তন্ত্রের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে।
- পেশীকলা (Muscular tissue), যা মূলত মাংসপেশী গঠন করে এবং
- স্নায়ুকলা (Nervous tissue), যা স্নায়ুতন্ত্র গঠন করে।
রক্ত একটি যোজক কলা বা কানেকটিভ টিস্যু, যার কাজ দেহের সংযোগ রক্ষা করা। এছাড়া আরো হাজার রকম কাজ সে করে থাকে।
মানুষের দেহের মোট ওজনের শতকরা আট ভাগের মতো রক্ত থাকে। সেই হিসেবে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দেহে সাধারণত পাঁচ থেকে ছয় লিটার রক্ত থাকে। রক্তের মূল উপাদান দুটি-
- রক্তরস এবং
- রক্তকণিকা।
রক্তের শতকরা ৫৫ ভাগ রক্তরস, যাকে প্লাজমা নামে অভিহিত করা হয়। এই প্লাজমা মূলত পানি দিয়ে গঠিত। এর শতকরা ৯২ ভাগই পানি। বাকি ৮ ভাগের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন জৈব পদার্থ, যেমন প্রোটিন, গ্লুকোজ, হরমোন এবং অজৈব উপাদান, যেমন সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ক্লোরাইড, বাইকার্বনেট জাতীয় আয়ন ইত্যাদি।
রক্তের বাকি ৪৫ ভাগ গঠিত রক্তকণিকা দিয়ে। রক্তকণিকাগুলোকে মোটা দাগে তিন ভাগে বিভক্ত করা যায়।
- লোহিত রক্তকণিকা
- শ্বেত রক্তকণিকা এবং
- অণুচক্রিকা।
লোহিত রক্তকণিকা
পরিমাণের দিক থেকে লোহিত রক্তকণিকা সবচেয়ে বেশি। প্রতি মাইক্রোলিটার রক্তে গড়পড়তা চার থেকে ছয় মিলিয়ন লোহিত রক্তকণিতা থাকতে পারে। ব্যাপারটি কল্পনা করতে কষ্ট হচ্ছে খানিকটা, তাই না? হিসেবের সুবিধার্থে আরেকটু সহজ করে দেয়া যাক তাহলে। এক ফোঁটা রক্তকে পঞ্চাশ ভাগ করলে এক মাইক্রোলিটার রক্ত পাওয়া যায়। এবার তাহলে বুঝুন ব্যাপারটি! আরেকটি কথা, লোহিত রক্তকণিকার পরিমাণ কিন্তু পুরুষদের দেহে অপেক্ষাকৃত বেশি থাকে।
এই কোষগুলোতে হিমোগ্লোবিন (এতে লোহার যৌগ থাকে) নামে একধরনের প্রোটিন থাকে। এগুলো ফুসফুস থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে একটি অস্থায়ী যৌগ গঠন করে, যার নাম অক্সি-হিমোগ্লোবিন। ফুসফুস থেকে অক্সিজেন নিয়ে রক্ত পৌঁছে যায় সমস্ত কোষে। সেখানে অক্সি-হিমোগ্লোবিন থেকে আবার অক্সিজেন আলাদা হয়ে যায়। এরপর পৌঁছে যায় কোষের অভ্যন্তরে। এভাবে লোহিত রক্তকণিকা দেহের সমস্ত কোষে অক্সিজেন ছড়িয়ে দেয়। আবার ঠিক উল্টো পথে কার্বন ডাইঅক্সাইডের সাথে কার্বোক্সি-হিমোগ্লোবিন নামের যৌগ তৈরি করে তা দেহের বাইরে পাঠিয়ে দেয়।
অক্সিজেন মিশ্রিত রক্ত সাধারণত ধমনীগুলো কর্তৃক পরিবাহিত হয়। এই রক্তের রঙ উজ্জ্বল লাল। আর কার্বন ডাইঅক্সাইড মিশ্রিত রক্ত শিরা দিয়ে পরিবাহিত হয়। এগুলো কালচে লাল বর্ণের হয়ে থাকে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের বইতে এজন্য ধমনীগুলোকে সবসময় লাল রঙ আর শিরাগুলোকে নীল রঙ দিয়ে দিয়ে চিহ্নিত করা থাকে।
ক্রাস্টেশিয়ান এবং মলাস্ক পর্বের কিছু প্রাণীর দেহে হিমোগ্লোবিনের পরিবর্তে হিমোসায়ানিন থাকে। হিমোসায়ানিনে কিন্তু লোহা থাকে না। বরং এর পরিবর্তে কপার বা তামার যৌগ থাকে। এদের কোনো রঙ থাকে না। এজন্যই চিংড়ির রক্তের কোনো রঙ নেই।
শ্বেত রক্তকণিকা
শ্বেত রক্তকণিকা আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সাথে জড়িত। এরা সংক্রামক রোগ এবং প্যাথোজেন (যারা রোগ সৃষ্টি করে) এর হাত থেকে দেহকে সুরক্ষিত রাখে। শ্বেত রক্তকণিকা লোহিত রক্তকণিকার মতো অস্থিমজ্জা থেকে তৈরি হলেও এই দুয়ের ভেতরে একটি মৌলিক পার্থক্য আছে। লোহিত রক্তকণিকার নিউক্লিয়াস না থাকলেও শ্বেত রক্তকণিকার নিউক্লিয়াস আছে।
আমাদের দেহে শ্বেত রক্তকণিকার পরিমাণ গড়ে প্রতি মাইক্রোলিটারে চার হাজার থেকে এগারো হাজার। এদের আবার অনেকগুলো ভাগ রয়েছে-
- নিউট্রোফিল (Nutrophil)
- ইওসিনোফিল (Eosinophil)
- ব্যাসোফিল (Basophil)
- মনোসাইট (Monocyte)
- লিম্ফোসাইট (Lymphocyte)
শ্বেত রক্তকণিকার ভেতরে নিউট্রোফিলই সবচেয়ে বেশি, শতকরা ৪০ থেকে ৮০ ভাগ। রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া কিংবা ফাঙ্গাসের আক্রমণকে এরা প্রতিহত করে। জীবাণুর আক্রমণে এরাই প্রথমে এগিয়ে আসে। আমাদের দেহে যে পুঁজ তৈরি হয় তা মূলত মৃত নিউট্রোফিল। জীবাণুকে নিউট্রোফিলগুলো গলাধঃকরণ (ফ্যাগোসাইটসিস) করে মেরে ফেলার পর এরাও মৃত্যুবরণ করে। কারণ নিউট্রোফিলের দেহে লাইসোজোম (কোষের মৃত্যুর থলে নামে এদের বিশেষ পরিচিতি আছে) নামে যে কণাগুলো আছে, সেগুলো পুনরুৎপাদন অযোগ্য। এদের গড় আয়ু ৫ দিনের মতো।
জীবাণু একটি নির্দিষ্ট আকারের চেয়ে বড় হয়ে গেলে নিউট্রোফিল তাদের গলাধঃকরণ করতে পারে না। তখন এদের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেয় ইওসিনোফিল। মোট শ্বেত রক্তকণিকার ১-৬ ভাগ এরা দখল করে আছে। বিভিন্ন পরজীবী, যেমন গোলকৃমি বা ফিতাকৃমি এ তালিকায় পড়ে। তাছাড়া এলার্জির সাথেও এদের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। বিভিন্ন ধরনের এলার্জিজনিত অবস্থা, যেমন এজমা, হে জ্বর প্রভৃতিতে রক্তে ইওসিনোফিলের পরিমাণ বেড়ে যায়।
ব্যাসোফিল এলার্জিজনিত প্রতিক্রিয়ার সাথে জড়িত। এরা হিস্টামিন ও হেপারিন নামে দুই ধরনের রাসায়নিক পদার্থ ক্ষরণ করে। হিস্টামিন রক্তনালী প্রসারিত করে এবং হেপারিন রক্তনালীতে রক্ত জমাট বাঁধতে বাধা দেয়। অর্থাৎ এদের মিলিত প্রতিক্রিয়া রক্ত চলাচল বাড়িয়ে দেয়। এদের পরিমাণ মোট শ্বেত রক্তকণিকার ১ থেকে ২ ভাগ।
লিম্ফোসাইট রক্তের চেয়ে লসিকাতে আরো বেশি পাওয়া যায়। রক্তে এদের পরিমাণ মোট শ্বেতকণিকার শতকরা ২০ থেকে ৪০ ভাগ পর্যন্ত হতে পারে। এদের তিনটি উপশ্রেণী রয়েছে। এরা হলো-
- টি সেল (T-Cell)- এরা থাইমাসে চূড়ান্ত রুপ লাভ করে। ভাইরাস আক্রান্ত কোষকে এরা ধ্বংস করে ফেলে।
- বি সেল (B-cell)- বোন ম্যারো বা অস্থিমজ্জায় এরা চূড়ান্ত রুপ লাভ করে বলে এরুপ নামকরণ করা। এরা এন্টিবডি তৈরি করে, যা প্যাথোজেনের সাথে যুক্ত হয়ে চূড়ান্ত পরিণতিতে এদের ধ্বংস নিশ্চিত করে।
- ন্যাচারাল কিলার সেল (Natural Killer Cell)- এরা ভাইরাস কিংবা ক্যান্সার আক্রান্ত কোষকে ধ্বংস করে ফেলে।
এছাড়া আমাদের শরীরে আরেক ধরনের শ্বেত রক্তকণিকা রয়েছে। এদের নাম মনোসাইট। বিভিন্ন শ্বেত রক্তকণিকার ভেতরে এরাই সবচেয়ে বড়। এরা নিউট্রোফিলের মতো ফ্যাগোসাইটোসিস ছাড়াও আরো অনেক জটিল প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত। এদের পরিমাণ ২ থেকে ১০ ভাগ।
অণুচক্রিকা
বিভিন্ন ধরনের রক্তকণিকার ভেতরে সবচেয়ে ছোট হলো অণুচক্রিকা। এদের পরিমাণ প্রতি মাইক্রোলিটারে দেড় থেকে তিন লক্ষ। অণুচক্রিকা গুচ্ছগুচ্ছ আকারে থাকে। এদের মূল কাজ ক্ষতস্থান থেকে রক্ত পড়া বন্ধ করা।
মানবদেহকে সচল রাখার মূল চালিকাশক্তি রক্ত। অতি প্রাচীনকাল থেকেই মানবসমাজে তাই রক্ত অন্যরকম মহিমায় ভূষিত। বিভিন্ন সমাজে রক্তকে পবিত্র পদার্থ কিংবা শক্তির আধার হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে রক্তের রহস্য মানুষ ভেদ করতে শিখেছে। একজন মানুষের দেহ থেকে জরুরি প্রয়োজনে অন্য একজন মানুষের দেহে রক্ত সরবরাহ করে জীবন বাঁচানোর পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। জানা গিয়েছে আরো অনেক অজানা তথ্য। সে সম্পর্কে অন্য একদিন আলোকপাত করা হবে রোর বাংলার পাতায়।
তথ্যসূত্র
Chapter 32 and 33; Textbook Of Medical Physiology by Guyton and Hall, 12 Edition, Published by Elsevier.
Feature Image: qimono