
প্রতিটি বছর আমাদের জন্য আনে কিছু বৈজ্ঞানিক উপহার। বিজ্ঞানীরা বছরজুড়ে আমাদের উপহার দেন বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফল, যা মানবসভ্যতাকে প্রতিনিয়ত অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যায়। ২০২২ সালও এর ব্যতিক্রম ছিল না। চলুন দেখে নেয়া যাক একনজরে গেল বছরজুড়ে বিজ্ঞানজগতের প্রাপ্তির একাংশ।
নাসার ডার্ট মিশন
দুই জ্যোতির্বিদ আবিষ্কার করলেন, পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে অচেনা এক ধূমকেতু, যা পৃথিবীকে পরিণত করতে পারে নরকক্ষেত্রে। তবে তাদের কথায় গুরুত্ব দিচ্ছে না মিডিয়া বা হোয়াইট হাউজ, এবং এর পরিণতি হয় ভয়াবহ। স্যাটায়ারিকাল সাইফাই মুভি ডোন্ট লুক আপ -এ এভাবেই মুভির প্লট শুরু।
তবে বাস্তবের চিত্র একেবারেই উল্টো। গত বছরের শেষ দিকে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস কমিউনিটির উদ্যোগে নাসা-ইসা’র জয়েন্ট মিশন ডার্ট (ডাবল অ্যাস্টেরয়েড রিডিরেকশন টেস্ট) পরিচালনা করা হয়। লক্ষ্য ছিল ১৭০ মিটার ব্যাসের গ্রহাণুর কক্ষপথ পরিবর্তন করা মহাকাশযানের মাধ্যমে। না, কোনো গ্রহাণু বা ধূমকেতু পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসেনি। পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে এই টেস্ট এক্সপেরিমেন্টে ধারণার থেকেও অনেক বেশি সফলতার দেখা মিলেছে বলে জানিয়েছে নাসা।

পৃথিবী থেকে ৬.৮ মিলিয়ন দূরের মাইনর-প্ল্যানেট দিদিমসের মুন ডাইমরফাস (Dimorphos) এর বুকে সেকেন্ডে চার মাইল বেগে আছড়ে ফেলা হয় স্পেসক্রাফটটি। ফলে এটি কক্ষপথ থেকে কিছুটা সরে আসে। পর্যাপ্ত সময় পেলে পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসা কোনো ধূমকেতুকেও সরিয়ে ফেলা এখন সম্ভব।
আচ্ছা, ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে কি ডাইনোসরদের বাঁচাতে পারতো নাসা ধূমকেতুর আঘাত থেকে?
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নতুন অ্যান্টিবায়োটিক
কয়েক বছর ধরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাফল্য আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই সাফল্য নিয়ে অনেকে শঙ্কা প্রকাশ করলেও দিনশেষে মানুষের উপকারেই ব্যবহার হচ্ছে এআই। বিগত দুই-তিন বছরে মলিক্যুলার বায়োলজির রূপ অনেকটাই বদলে দিয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।
এর মধ্যে বিজ্ঞানমহলে আলোড়ন তুলেছে গুগলের আলফাফোল্ড। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই এটি প্রোটিনের জটিল ত্রিমাত্রিক গঠন বলে দিতে পারে। এই কাজ করতে আগে সময় লাগতো দিনের পর দিন, কখনও বা বছর। প্রোটিনের গঠন থেকে জানা সম্ভব এটি কোন ধরনের কাজে প্রয়োগ করা যেতে পারে, এবং কোন ধরনের ঔষধ তৈরি সম্ভব।

অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স মানবসভ্যতার জন্য হুমকিস্বরুপ। ল্যান্সেটের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৯ সালে প্রায় ৫ মিলিয়ন মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের জন্য। অন্যদিকে, নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারও একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এখানেই এআই অসাধারণ ভূমিকা দেখাতে শুরু করেছে। মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম ব্যবহার করে ২,৩৪৯টি অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল পেপটাইড চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। এর মধ্যে ২১৬টি কেমিক্যাল পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১৮১টি অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ধর্ম প্রদর্শন করছে। এসব পেপটাইড ইঁদুরের নিউমোনিয়ার নিয়ামক হিসেবে ব্যবহার করে সফলতা পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য ছাড়া এই কাজ বেশ সময়সাপেক্ষ একটি প্রক্রিয়া।
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ
হাবল স্পেস টেলিস্কোপের উত্তরসূরী জেমস ওয়েব যদিও লঞ্চ করা হয় ২০২১ সালের শেষের দিকে, কিন্তু টেলিস্কোপটি সম্পূর্ণভাবে চালাতে লেগে যায় ‘২২ সালের শুরুর অনেকটা সময়। ১১ জুলাই, ২০২২ এ জেমস ওয়েবের মাধ্যমে ধারণ করা মহাবিশ্বের প্রথম ছবিটি প্রকাশ করা হয়।

হাবল টেলিস্কোপের থেকেও আরো কয়েক হাজার মাইল দূরের কক্ষপথের আবর্তন করছে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (JWST)। এটি সূর্যের আলো থেকে সম্পূর্ণভাবে আড়ালে থাকায় -৩৭০ ডিগ্রী ফারেনহাইট তাপমাত্রায় অপারেট করে, মাল্টি-লেয়ার সানশিল্ডসহ যা ইনফ্রারেড সাইটের জন্য উপযুক্ত।
বিজ্ঞানীদের দ্বারা আগে কখনও দেখা সম্ভব হয়নি এমন ছায়াপথগুলোর ছবিও ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে JWST। এমনকি এখনও পর্যন্ত শনাক্ত করা সবচেয়ে দূরবর্তী গ্যালাক্সির রেকর্ড ভেঙেছে এই যুগান্তকারী টেলিস্কোপ।
১৩ বিলিয়ন বছরের পুরনো গ্যলাক্সির খোঁজ দেয়া থেকে শুরু করে এক্সোপ্ল্যানেটগুলোকে সরাসরি দেখা সম্ভব হবে, যেসবের বিষয়ে বিজ্ঞানীদের কাছে সামান্য তথ্য ছিল। জানা যাবে কীভাবে নক্ষত্র এবং ছায়াপথগুলো কোন পদার্থ থেকে গঠিত হয়েছে। এসবের বিষয়ে হাবল অনেক কম তথ্য সংগ্রহ করতে পারত।

ডিজিটাল আর্টিস্ট থেকে ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলে এআই চমক
বছড়জুড়ে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি জগতের হটকেক ছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ডিজিটাল আর্টের মিডজার্নি এবং ডাল-ই। অন্যদিকে ওপেন-এআইয়ের জিপিটি-৩.৫ মডেলের চ্যাটজিপিটি কনভার্সেশনাল এআই-এর চমকপ্রদ পারফর্মেন্সে চোয়াল ঝুলে পড়েছে অনেকেরই।
ওপেন-এআইয়ের ডাল-ই এবং মিডজার্নি প্রায় একই ধাঁচের ডিজিটাল আর্টিস্ট কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। টেক্সট ডেস্ক্রিপশন থেকে ছবি জেনারেট করতে পারে এআই দুটি। কমান্ড টেক্সট যত বর্ণনামূলক হবে, ছবি হবে ঠিক ততটাই নিখুঁত।

অন্যদিকে, দিব্যি মানুষের মতো চ্যাট করতে পারে চ্যাটজিপিটি। শুধু কথা বলা পর্যন্তই না; কোড করা, গান লেখা, যেকোনো বিষয়ের এক্সপার্টের মতো আইডিয়া দেয়া থেকে শুরু করে গাণিতিক সমস্যা সমাধানসহ যেকোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম এটি।
বলে রাখা ভাল, এই লেখার ফিচার ইমেজও মিডজার্নি এআইয়ের তৈরি।
করোনার ফাইনাল ভ্যাকসিন ডোজ?
করোনার বুস্টার ডোজ আমাদের ইমিনিউটি সিস্টেম নিঃসন্দেহে বুস্ট করেছে। সার্স-কোভ-২ এর পর ওমিক্রন ছিল সবার মাথাব্যথার কারণ। ‘২২ এর মাঝামাঝিতে বুস্টার ভ্যাকসিন ডোজে করোনার এই ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে লড়তে পারে এমন ভ্যাকসিন বাইভ্যালেন্ট বুস্টার ডোজ আমরা পেয়েছি। যুক্তরাজ্যে গেল অটাম বুস্টার ডোজে চতুর্থ ডোজ সম্পন্ন করা হয়েছে।
কিন্তু ভবিষ্যতে যদি আরও নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট আসে? নতুন একটি ভ্যারিয়েন্টের জন্য ভ্যাকসিন তৈরি বেশ সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। তাহলে কি করোনার কোনো শেষ ভ্যাকসিন আনা সম্ভব নয় যা যেকোনো ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধেই লড়তে পারবে?
ন্যাচারে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখানো হয়, মিউকোস্যাল ভ্যাকসিন বুস্টার ডোজের থেকে দীর্ঘ সময়ের সুরক্ষা দিতে সম্ভব। এমনকি, বিভিন্ন ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে লড়তেও সক্ষম। ২০২২ সালে চীন এই প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু করেছে সফলভাবে।

এই প্রক্রিয়ায় সূঁচের মাধ্যমে ভ্যাকসিন গ্রহণ করা হয় না। বরং শ্বসনপ্রক্রিয়া বা নিঃশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করতে হয়। যদিও এটি কিছুটা নতুন প্রক্রিয়া মনে হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু ফ্লুর চিকিৎসায় এটি অনেক আগে থেকে ব্যবহার হয়ে আসছে।
করোনাভাইরাস সাধারণত মুখ, নাকের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করে। মিউকোস্যাল ইমিউন সিস্টেম ঠিক এখানেই কাজে আসে, করোনার প্রবেশপথে প্রতিরোধী দেয়াল তৈরি করে। খুব শীঘ্রই এই ভ্যাকসিনের ডোজ শুরু হতে পারে বলে জানিয়েছেন ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টারের শীনা ক্রুকশ্যাঙ্ক।
দূর থেকে ভুতুড়ে কান্ড
ঠিক এভাবেই কোয়ান্টাম এন্টাঙ্গলমেন্টকে পরিচয় করিয়েছিলেন আলবার্ট আইন্সটাইন। অর্থাৎ দুটি কোয়ান্টাম কণা একটি একক কণার মতো আচরণ করে শত আলোকবর্ষ দূরে থাকলেও একটির উপর কোনো ক্রিয়া করা হলে তার প্রতিক্রিয়া অপরটির উপরও পড়বে।
গেল বছর অক্টোবরে এন্টাঙ্গলমেন্টের গবেষণায় অবদানের জন্য কোয়ান্টাম ইনফরমেশন সায়েন্সের তিন অগ্রদূতকে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত করা হয়। অ্যালান অ্যাস্পেক্ট (ইউনিভার্সিটি অব প্যারিস-স্যাক্লে), জন ক্লজার (জেএফ ক্লজার এন্ড অ্যাসোসিয়েটস), অ্যান্টন জাইলিঙ্গার (ইউনিভার্সিটি অব ভিয়েনা)।

তাদের এই অবদান কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞান, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এবং কোয়ান্টাম এনক্রিপশনকে আরও ত্বরান্বিত করবে। একইসাথে আরোও একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সাহায্য করবে- আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বের সাথে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সমন্বয় কীভাবে করা যায়?
নাসার আর্টেমিস – ১
শেষ পর্যন্ত সফলভাবে যাত্রা করেছে নাসার বহুল প্রত্যাশিত আর্টেমিসI জ্বালানি লিক এবং হারিকেনের কারণে গেল বছরে বেশ কয়েকবার স্থগিত করা হয় মিশনটি। শেষ পর্যন্ত গত ১৬ নভেম্বর কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী রকেটটি লঞ্চ করা হয়I আর্টেমিস প্রোগ্রামের প্রথম মিশন এটি, যার লক্ষ্য চাঁদে আবারও অভিযাত্রী পাঠানো। তবে এই উদ্বোধনী মিশনটি ক্রুবিহীন ছিল, এর উদ্দেশ্য ছিল বিশাল এসএলএস রকেট এবং ওরায়ন ক্রু ক্যাপসুল পরীক্ষা করা।

এই উৎক্ষেপণের পর, ওরায়ন প্রায় ২৫.৫ দিন চাঁদকে ভালোভাবে পরীক্ষানিরীক্ষা করে এরপর পৃথিবীর উদ্দেশ্যে রওনা হয়। মহাকাশযানটি ১১ ডিসেম্বর প্রশান্ত মহাসাগরে আছড়ে পড়ে। বর্তমানে এর পোস্ট-ফ্লাইট বিশ্লেষণে সময় দিচ্ছে নাসা, যা মহাকাশ অনুসন্ধানের এই নতুন অধ্যায়ে কী কী সম্ভব তা প্রকাশ করতে সাহায্য করবে।
সবচেয়ে প্রাচীন ডিএনএ আবিষ্কার
১৬ বছরের দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর গত ৭ ডিসেম্বর প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে ২ মিলিয়ন বছরের পুরনো ডিএনএ আবিষ্কারের খবরটি জানানো হয়। ২০০৬ সালে ইউনিভার্সিটি অব ক্যামব্রিজের এস্কে উইলারস্লেভ তার ল্যাব মেম্বারদের নিয়ে উত্তর গ্রিনল্যান্ডের সেডিমেন্ট কোর নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করেন।
এরপর দীর্ঘ ১৬টি বছর কেটে যায় ডিএনএ এক্সট্র্যাকশন এবং সিকোয়েন্সিংয়ের কাজে। অনেক ব্যর্থতার পর এই বছরের শেষ প্রান্তে সফলতার মুখ দেখে দলটি।

এর মাধ্যমে যে কেবল প্যালাএন্টোলোজির এক বিপ্লব শুরু হলো শুধু তা-ই নয়, বরং প্রাচীন সভ্যতার এক নতুন দ্বার উন্মোচিত হলো। এই গবেষণা থেকে জানা গেছে ২ মিলিয়ন বছর আগের গ্রিনল্যান্ডের উদ্ভিদ এবং প্রাণী বৈচিত্র্যের বিষয়ে।