যেকোনো অঞ্চল বা ভাষাকে কেন্দ্র করে কোনো জাতির যে সংস্কৃতি ও দীর্ঘদিনের অভ্যাস গড়ে উঠে, তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ থাকে পোশাক। আমাদের দেশের কথাই যদি ভাবি, পোশাকের দিক থেকে কত ধরনের, কত বর্ণের পোশাকই তো এখানে আছে, সবই কি আবহমান কাল ধরে আমাদের সংস্কৃতির অংশ ছিল? নিশ্চয়ই না। এই অঞ্চলে যেমন পৃথিবীর বহু জায়গার মানুষ এসেছে, তেমনি আমরাও ছড়িয়ে পড়েছি সারা দুনিয়ায়। উদারভাবে বহু অঞ্চলের সংস্কৃতিকে আপন করে নেওয়ার মাধ্যমে আমাদের ভাষা, চলন কিংবা পোশাকে এসেছে বহু বৈচিত্র্য। সেই বৈচিত্র্যেরই একটি বিশেষ অংশ নিয়ে আজকের লেখা, ওয়েস্টার্ন পোশাক।
আজকে আমাদের দেশের শহরগুলোতে চারিদিকে তাকালেই মানুষের পরনে দেখা যায় বহুবিধ ওয়েস্টার্ন পোশাক। কিন্তু ঠিক কবে থেকে কীভাবে ওয়েস্টার্ন পোশাক এদেশের মানুষের এত প্রিয় হয়ে উঠল তা জানতে হলে উল্টাতে হবে ইতিহাসের বহু পাতা। শুরুতে যাওয়া যাক সেই মুঘল আমলে।
ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের হাত ধরে মুঘল আমল থেকেই বাংলায় ইউরোপীয় পোশাক, বিশেষ করে পশমের পোশাক আসা শুরু হয়ে গিয়েছিল। যদিও খুব কম মানুষই সেসব ব্যবহার করত। তবে মূলধারার পশ্চিমা বা ইংরজদের পোশাকের শুরুটা ছিলো খুব স্বাভাবিকভাবেই ইংরেজরা উপমহাদেশে আসার পর। তবে বলে রাখা ভালো, এসব পোশাকের প্রভাব দেখা শুরু হয় ইংরেজ শাসন শুরু হবার ৭০-৮০ বছরেরও পর। এমনকি ১৮৩৫ সালের সমাচার দর্পণ ও ১৮৪৬ সালে আঁকা এক ছবি থেকে বোঝা যায়, তখনকার সমাজের অভিজাতরা মুঘল বেশভূষাতেই অভ্যস্ত ছিলেন। যদিও ১৮৩১ সালে সংবাদ প্রভাকরের এক প্রতিবেদনে হিন্দু কলেজের ছাত্ররা ‘ফিরিঙ্গি’ পোশাক পরে বলে প্রতিবেদন বেরিয়েছিল। কিন্তু সেটিও অনেক বেশি তেমন ছাত্রদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সাধারণের পশ্চিমা পোশাক তখনও স্রেফ জুতাতেই সীমাবদ্ধ ছিল।
এই আলোচনায় এখন আসতে পারে মাইকেল মধুসূদন দত্তের নাম। ফ্যাশন বা পোশাক নিয়ে লেখায় হুট করে কালজয়ী এই সাহিত্যিক এলেন কোথা থেকে? এলেন, কারণ তিনিই প্রথম ব্যক্তি, যিনি ১৮৪৩ এর শুরুর দিকে পশ্চিমা বেশভূষায় হিন্দু কলেজে গিয়ে বেশ একটা হইচই আর চমক সৃষ্টি করেছিলেন। যদিও মাইকেল নিজেই এরপর খুব বেশি এই বেশ ধরে কলেজে যাতায়াত করেছেন কিনা, তার কোনো উল্লেখ নেই।
পুরুষদের মধ্যে পশ্চিমা পোশাকের প্রচলন আরও বাড়ে ১৯ শতকের দ্বিতীয় ভাগে। ইংরেজ আমলে যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত থাকায় অনেকেই কলকাতায় ইংরেজি শিক্ষা নিতে যেতেন। অনেকে বিলেত তথা ইংল্যান্ডে যেতেন বিদেশী শিক্ষায় শিক্ষিত হতে। তারা বিদেশে যেসব পোশাক পরে অভ্যস্ত ছিলেন, দেশে এসেও সেই পোশাকই পরতেন। তবে তখনও পশ্চিমা পোশাক ঠিক জনমানুষের পোশাক হয়ে উঠতে পারেনি, বরং তা ছিল বিলাসিতা বা আভিজাত্যেরই একটা প্রতীক। তবে গলাবন্ধ কোটের কথা না বললেই নয়, কারণ ১৮৮০-৯০ এর মধ্যে তোলা কয়েকটি ছবিতে খোদ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই তা পরে ছিলেন, যার চল ছড়িয়ে পড়েছিল বিভিন্ন রাজপরিবার ও অন্যান্য অভিজাত পুরুষদের মধ্যে। তবে ১৯৩০ এর আগে কোটছাড়া প্যান্ট পরার চল থাকার সম্ভাবনা তেমন ছিল না। মূলধারা, অর্থাৎ আমজনতার সংস্কৃতিতে পশ্চিমা জামা স্থান পাওয়া শুরু করে ২০ শতকে এসে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের এক মিছিল আর ১৯৪১ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মিছিলের দু’টি ছবি যদি তুলনা করি, তাহলে দেখা যাবে, ১৯০৫ এর তুলনায় ১৯৪১ সালে শার্টের ব্যবহার অনেক বেড়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরও স্যুট-টাইয়ের ব্যবহার অনেকাংশেই বেড়ে যায়।
এ তো গেলো পুরুষদের কথা। নারীদের অবস্থা কেমন ছিল? তারা কী পরতেন? তাদের বেশভূষা সময়ের ব্যবধানে কতটা পাল্টেছে?
এখনকার আধুনিক সময়ে পোশাক দেখে ধর্ম পরিচয় নির্ণয় করাটা ঠিক সম্ভব না, সেটি শোভনও নয়, তবে ইংরেজ শাসন বা ভারত ভাগের পরও বাংলায় পুরুষদের ধর্মপরিচয় নির্ণয় করা যেত তাদের পরনের পোশাক দেখে। তবে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি নারীরা শাড়ি পরতেন। এমনকি শ’খানেক বছর আগে কিন্তু শাড়ির সাথে ব্লাউজ পেটিকোট পরার রীতি এমনকি অভিজাতদের মধ্যেও ছিল না, আর নিম্নবিত্তদের কথা তো বাদই দেওয়া যায়। একসময় সালোয়ার কামিজের উপর কিছুটা নির্ভরতা এলেও, শাড়ি এখনও আছে বহাল তবিয়তে। তবে আধুনিক সময়ে, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার পোশাকের কথা যদি বলতে হয়, তাহলে এখন দেখা যাবে আমাদের শহরের নারী সমাজের বেশ বড় একটা অংশ, বিশেষ করে তরুণী ও যুবতীরা এখন অনেকেই পছন্দ করেন টিশার্ট, টপস, জিন্সসহ বিভিন্ন ওয়েস্টার্ন পোশাক। নানান ধরনের ওয়েস্টার্ন পোশাক নানান জায়গাতেই বেশ স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে পরা যায়, মানানসইও হয়, সেকারণে এর প্রতি মানুষের আগ্রহও বাড়ছে।
তবে ঠিক কখন আর কীভাবে যে বাংলার আমজনতার গায়ে জিন্স আর টিশার্ট উঠে এলো, তা সঠিক বলাটা খুব মুশকিল। ‘৪৭ এ ভারত ভাগ হবার পর থেকেই অবশ্য দেশীয় ফ্যাশনে একটা বড় আকারের পরিবর্তন আসে। নতুন দেশের পরিস্থিতি কিছুটা থিতু হয়ে আসার পর পশ্চিমা সিনেমা-গান যেভাবে প্রবেশ করে আমাদের সংস্কৃতিতে, একইভাবে প্রবেশ করে সিনেমার নায়ক আর গায়কদের পরিচ্ছদ। ডেনিম জিন্সের উত্থান, ১৯৫০ এর দিকে ‘ব্যাড বয় জিন্স’ এর কাটতি আর নায়কদের অনুকরণপ্রিয়তা- সব মিলিয়ে পোশাক সংস্কৃতিতে একটা ভালো রকম পরিবর্তন শুরু হয়েছিল সেসময়। ‘৬০ এর দিকে যখন হিপ্পি আন্দোলন শুরু হলো, আমেরিকায় একটা বিরাট সাংস্কৃতিক পরিবর্তন দেখা দেয় তখন। সেই পরিবর্তনের ছোঁয়াও যে বেশ লেগেছিলো এই বাংলাতেও, পাকিস্তান আমলের বেল বটম প্যান্ট পরা যুবকসমাজ আর নায়কদের ছবি তারই প্রমাণ দেয়। স্বাধীনতার পরও এই চল অব্যাহত ছিল। বিশেষত একটা বড় সময় পরে এসে আমাদের দেশে হিপহপ ক্রেজ তৈরির পর ব্যাগি বা ঢোলা জিন্স, বেসবল ক্যাপ আর ফুলহাতা টিশার্টের ফ্যাশন ছিলো দারুণভাবে চোখে লাগার মতো।
তবে উপমহাদেশের রক্ষণশীল সমাজের কারণে পুরুষদের মতো অত দ্রুত এগোতে না পারলেও কিন্তু পিছিয়ে ছিলেন না নারীরা, সময়ের সাথে সাথে তাল মিলিয়ে নিজেদের ফ্যাশনে পরিবর্তন তারা এনেছেনই। সত্তরের দশক থেকেই অভিজাত ও ধনী তরুণীরা ডেনিমের স্কার্ট আর ভেস্ট পরতে পছন্দ করতেন। ১৯৮০তে ডিজাইনার জিন্স আর ১৯৯০ এ ‘গ্রাঞ্জ’ মিউজিকের বদৌলতে ওভারঅলের মতো দেখতে আপাদমস্তক জিন্সের পোশাকও চলেছিল দেশে। আর ২০০০ এর পর ব্রিটনি স্পিয়ার্সের মতো পপ তারকাদের প্রভাবে স্কিনি জিন্সের যে চল শুরু হয়েছিল শহুরে আধুনিক তরুণী সমাজের মধ্যে, তা এখনও চলছে, তবে আর সেটা কোনো সুপারস্টারের অনুকরণে নয়, একেবারে নিজস্ব অভ্যাস হিসেবেই। সেই সাথে কুর্তী, প্লাজো, শেমিজ, ফতুয়া- ফ্যাশন অনুসঙ্গগুলোতে পরিবর্তন এসেছে বেশ ক’বার, কখনো সরাসরি পশ্চিমা বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে, কখনো বা হলিউড কিংবা বলিউড থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। নারীরা শুধুই যে পশ্চিমা পোশাক পরেছেন, তা নয়, বরং দেশি শাড়ি কিংবা সালোয়ার কামিজের সাথে পশ্চিমা আনুষাঙ্গিক মিলিয়ে নিজেরাই তৈরি করেছেন ফ্যাশনের নতুন ধারা। আর জ্যাকেট, হুডি, স্যুটের মতো ওয়েস্টার্ন পোশাকগুলো তো নারী-পুরুষ উভয়েই এখন পরে থাকেন স্বচ্ছন্দে।
একসময় পোশাকি নামে ওয়েস্টার্ন হিসেবে পরিচিত হলেও, প্যান্ট, শার্ট, কোট, জিন্স, টিশার্ট, টপস, স্কার্ট এধরনের পোশাক কিন্তু এখন আমাদের একদম নিজস্ব পোশাকে পরিণত হচ্ছে। বরং বিশেষ করে শহরগুলোতে নিজেদের মতো করে নকশার পরিবর্তন ঘটিয়ে এসব পোশাককে আমরা একেবারে আপন করে নিয়েছি। আসছে সময়ে হয়তো আরও নতুন নতুন পোশাকের আগমনের কালে আজকের এই পোশাকগুলো হয়ে উঠবে একেবারেই আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি। দেশে দেশে কালে কালে, মানুষের রুচি আর পছন্দ যে এভাবেই বদলায়!