১.
বিশ্বকাপের সময় যখন ঘনিয়ে আসে, তখন হঠাৎ করেই অস্ট্রেলিয়া অপরাজেয় দলে পরিণত হয়ে। বিশ্বকাপের আগের বছরগুলোতে যেমনি খেলুক না কেন, বিশ্বকাপে দুর্দান্ত একটা দল দাঁড় করিয়ে ফেলে তারা। কয়েকমাস আগেও ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখেছিলো না অনেকেই। কারণটা খুব স্বাভাবিক। অস্ট্রেলিয়া ২০১৭ সালের ২৭শে জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালে ৫ই মার্চ পর্যন্ত ২৮টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলে মাত্র চারটিতে জয়ের মুখ দেখেছিল। তাছাড়া দলের ভেতরকার পরিবেশও খুব একটা ভালো ছিল না। দলের দুই তারকা ব্যাটসম্যান ক্রিকেট থেকে এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। দল হয়ে পড়েছিল নেতৃত্বশূন্য।
এমন ভঙ্গুর অবস্থার পরেও অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপে এসে নিজেদেরকে ঠিকই গুছিয়ে নিয়েছে। ইংল্যান্ডে আসার আগে ভারতের মাটিতে টানা তিন ম্যাচ জিতে সিরিজ জয়ের পর পাকিস্তানকেও আবুধাবিতে হোয়াইটওয়াশ করে জানান দিয়েছিল তারা প্রস্তুত। বর্তমান বিশ্বচ্যাম্পিয়ন এবং সর্বোচ্চ পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ার সাথে বিশ্বকাপের রয়েছে মধুর সম্পর্ক। বিশ্বকাপের আগে-পরে দলের অবস্থা যেমনই থাকুক না কেন, বিশ্বকাপে নতুন এক অস্ট্রেলিয়াকে দেখা যায়। যাদের চোখেমুখে থাকে জয়ের জন্য ক্ষিপ্রতা।
ইংল্যান্ডে আসার আগে এবং বর্তমানেও অস্ট্রেলিয়া দলে বেশকিছু যদি-কিন্তু ছিল। লোয়ার মিডল-অর্ডারে দুর্বলতা কিংবা দলের চতুর্থ এবং পঞ্চম বোলারের অভাবটা ভারতের মতো শক্তিশালী দলগুলোর বিপক্ষে ঠিকই ফুটে উঠেছিল। তবে অন্য দলগুলোর বিপক্ষে সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে দলগত পারফরমেন্সে ঠিকই জয়ের দেখা পেয়েছিল অস্ট্রেলিয়া।
বিশ্বকাপের আগে অস্ট্রেলিয়া সবচেয়ে বড় সমস্যা এবং দুশ্চিন্তার কারণ ছিল অ্যারন ফিঞ্চ। স্মিথ, ওয়ার্নারের নিষেধাজ্ঞার ফলে তাকে অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়। অধিনায়কের দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনি ছিলেন চরম ব্যর্থ। ব্যাট হাতে রানের দেখা পাচ্ছিলেন না, দল জয়ের মুখ দেখছিল না। তখন বিশ্বকাপের জন্য নতুন অধিনায়ক খুঁজে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা উসমান খাজাকে ওয়ার্নারের সাথে ইনিংস গোড়াপত্তন করানোর জন্য অনেকেই পরামর্শ দিয়েছিল। আর যদি ফিঞ্চকে খেলাতেই হয় তাহলে মিডল-অর্ডারে ব্যাট করতে পাঠানো হোক এমন পরামর্শ দিয়েছিল। সেই অনুযায়ী পরিকল্পনাও সাজানো হচ্ছিলো। ফিঞ্চও দলের প্রয়োজনে মিডল-অর্ডারে ব্যাটিং করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন।
২.
অ্যারন ফিঞ্চকে নিয়ে প্রশ্ন ওঠাটা স্বাভাবিক ছিল। বিশেষ করে ওয়ার্নারের টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটার পর তিন ফরম্যাটেই রানের দেখা পাচ্ছিলেন না সীমিত ওভারের ক্রিকেটের দুর্দান্ত এই ব্যাটসম্যান। টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটার পর ওয়ানডেতে পরবর্তী নয় ইনিংসে ১৫.৭৭ ব্যাটিং গড়ে মাত্র ১৪২ রান সংগ্রহ করেছিলেন তিনি। টি-টোয়েন্টিতেও ছিলেন নিষ্প্রভ। দশ ইনিংস ব্যাট করে তিনবার শূন্য রানে সাজঘরে ফিরেছিলেন। মাত্র ৭.৫০ ব্যাটিং গড়ে সর্বসাকুল্য ৭৫ রান সংগ্রহ করেছিলেন দশ ইনিংসে।
বিশ্বকাপকে সামনে রেখে দলের অধিনায়কের এমন শ্রীহীন ব্যাটিংয়ে বিকল্প ভাবনা ভাবার পরামর্শ আসছিল চারদিক থেকে। তবে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া তার উপর আস্থা রেখেছে। যার প্রতিদিন তিনি ব্যাট হাতেই দিচ্ছেন। ভারতের বিপক্ষে সর্বশেষ ওয়ানডে সিরিজের তৃতীয় ম্যাচ থেকে রানে ফিরেছিলেন তিনি। তারপর থেকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। নিজের প্রিয় ওপেনিং পার্টনার ডেভিড ওয়ার্নার এবং প্রিয় ব্যাটিং পজিশন ওপেনিংয়ে ব্যাট করার জন্য সব প্রস্তুতি সেরে নিয়েছিলেন পাকিস্তানের বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে। পাঁচ ম্যাচে তিনি দুটি শতক এবং দুটি অর্ধশতক হাঁকিয়েছিলেন।
অ্যারন ফিঞ্চ নিজের সর্বশেষ ১৫টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে চারটি শতক এবং ছয়টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৭৬.২১ ব্যাটিং গড়ে ১,০৬৭ রান সংগ্রহ করেছেন। বর্তমানে ওয়ানডে ক্রিকেটে তার শতকের সংখ্যা ১৫টি। ১১২ ইনিংস ব্যাট করে তিনি ১৫টি শতক হাঁকিয়েছেন। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ওয়ানডেতে তার চেয়ে বেশি শতক হাঁকিয়েছেন মাত্র চারজন ব্যাটসম্যান। দ্বিতীয় স্থানে থাকা মার্ক ওয়াহর চেয়ে মাত্র তিনটি শতকে পিছিয়ে আছেন তিনি। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান স্টিভ স্মিথের চেয়েও সাতটি শতক বেশি হাঁকিয়েছেন তিনি।
৩.
বিশ্বকাপের আগে আবুধাবিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে দুর্দান্ত ব্যাটিং করেছিলেন অ্যারন ফিঞ্চ। যার ধারাবাহিকতা বিশ্বকাপেও বজায় রেখেছেন তিনি। বিশ্বকাপে নিজেদের সাত ম্যাচ শেষে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকদের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করছেন তিনি। তার উপরে আছেন শুধুমাত্র ডেভিড ওয়ার্নার। তার উদ্বোধনী উইকেট জুটির সঙ্গী ওয়ার্নার থেকে মাত্র চার রান কম করেছেন তিনি। সাত ম্যাচে দুটি শতক এবং তিনটি অর্ধশতকের সাহায্যে ৭০.৮৫ ব্যাটিং গড়ে তার মোট রান ৪৯৬ রান।
বিশ্বকাপ শুরু করেছিলেন আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৪৯ বলে ছয়টি চার এবং চারটি ছয়ের মারে ৬৬ রানের ইনিংস দিয়ে। আফগানিস্তানের দেওয়া ২০৮ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ডেভিড ওয়ার্নারের সাথে ৯৬ রানের জুটি গড়ে দলকে সহজ জয়ের ভিত গড়ে দিয়েছিলেন তিনি। তার দ্রুতগতির ব্যাটিংয়ের কারণে বহুদিন পর জাতীয় দলে ফিরে আসা ওয়ার্নার ধীরে-সুস্থে ব্যাট করার সময় পেয়েছিলেন এবং দলকে জিতিয়ে মাঠ ছেড়েছিলেন তিনি। নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ফিরে আসা ডেভিড ওয়ার্নারের জন্য ইনিংসটি ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও ভারতের বিপক্ষে ইনিংস বড় করতে না পারা ফিঞ্চ পাকিস্তানকে পেয়ে আবারও ছন্দে ফিরে আসেন। পাকিস্তানের বিপক্ষে তিনি ৮৪ বলে ছয়টি চার এবং চারটি ছয়ের মারে ৮২ রানের ইনিংস খেলার পথে উদ্বোধনী উইকেট জুটিতে ওয়ার্নারের সাথে ১৪৬ রান যোগ করেছিলেন। পরবর্তী ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে খেলেন ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেও ডেভিড ওয়ার্নার এবং অ্যারন ফিঞ্চ অস্ট্রেলিয়াকে শুভসূচনা এনে দিয়েছিলেন। তারা উদ্বোধনী উইকেট জুটিতে ৮০ রান যোগ করেছিলেন। জুটিতে ওয়ার্নারের অবদান ছিল মাত্র ২৬ রান
ওয়ার্নারের বিদায়ের পর দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন অধিনায়ক ফিঞ্চ। ৪২.৪ ওভারে দলীয় ২৭৩ রানে তৃতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হওয়ার আগে ১৩২ বলে ১৫টি চার এবং পাঁচটি ছয়ের মারে ১৫৩ রান করেছিলেন তিনি।
বাংলাদেশের বিপক্ষে পরবর্তী ম্যাচেও ডেভিড ওয়ার্নার এবং অ্যারন ফিঞ্চ দলকে বড় সংগ্রহের ভিত গড়ে দিয়েছিলেন। তারা উদ্বোধনী উইকেট জুটিতে ১২১ রান যোগ করেছিলেন। এতে ফিঞ্চের অবদান ৫৩ রান। তিনি পাঁচটি চার এবং দুটি ছয়ের মারে এই রান করেছিলেন। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইংল্যান্ডের বিপক্ষেও ডেভিড ওয়ার্নারকে সাথে নিয়ে দলকে ভালো সূচনা এনে দিয়েছিলেন। উদ্বোধনী উইকেট জুটিতে ১২৩ রান যোগ করার পর ওয়ার্নার ব্যক্তিগত ৫৩ রানে সাজঘরে ফিরলেও আসরে নিজের দ্বিতীয় শতক হাঁকিয়েই থামেন ফিঞ্চ। ১১৬ বলে ১১টি চার এবং ২টি ছয়ের মারে ১০০ রানের ইনিংস খেলে তিনি ম্যাচসেরার পুরস্কার জিতেছিলেন তিনি।
দুর্দান্ত ফর্মে থাকা অ্যারন ফিঞ্চ এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপের ইতিহাসে ১৫ ম্যাচে ৫১.৭৩ ব্যাটিং গড়ে ৭৭৬ রান সংগ্রহ করেছেন। শতক হাঁকিয়েছেন তিনটি এবং অর্ধশতক চারটি। শতক হাঁকানোর দিক থেকে বিশ্বকাপে রিকি পন্টিং এবং মার্ক ওয়াহর পরেই অবস্থান করছেন তিনি।
৪.
এবারের বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার সাফল্যের পিছনে অবদান রেখেছেন তাদের প্রথম দুজন ব্যাটসম্যান এবং প্রথম দুজন বোলার। তারা শুরুতেই ম্যাচের পার্থক্য গড়ে দিচ্ছেন। অস্ট্রেলিয়ার দুই ওপেনার ডেভিড ওয়ার্নার এবং অ্যারন ফিঞ্চ এখন পর্যন্ত আসরের সর্বোচ্চ দুই রান সংগ্রাহক। তারা দুজন মোট ৯৯৬ রান সংগ্রহ করেছেন নিজেদের মধ্যে। বল হাতে মিচেল স্টার্ক প্রতি ম্যাচেই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এসে উইকেট তুলে নেন। এতে করে মিডল ওভারে দলের অন্য বোলারদের উপর চাপ কমে যায়।
গত আসরের টুর্নামেন্ট সেরা মিচেল স্টার্ক এবারও দুর্দান্ত ছন্দে আছেন। এখন পর্যন্ত সাত ম্যাচে ১৮.২৬ বোলিং গড়ে ১৯ উইকেট শিকার করে আসরের সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রাহকদের তালিকায় শীর্ষস্থানে আছেন। বিশ্বকাপে দুর্দান্ত পারফর্ম করে আসা স্টার্ক বিশ্বকাপে গ্লেন ম্যাকগ্রার পরে অস্ট্রেলিয়ান বোলারদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকার করেছেন। তিনি এখন পর্যন্ত ১৫ ম্যাচে ১৩.৯২ বোলিং গড়ে ৪১ উইকেট শিকার করেছেন। স্টার্কের পাশাপাশি এই আসরে কামিন্সও ১১ উইকেট শিকার করেছেন। তাদের বোলিং জুটিও ভালোভাবেই জমে উঠেছে। বিশ্বকাপের আগে যা অস্ট্রেলিয়ার দুর্বলতা ছিল, তা-ই এখন তাদের শক্তির জায়গা।