১.
ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে এক সিরিজে কোনো ব্যাটসম্যান কমপক্ষে ২৫০ রান করেছেন, এমন ঘটনা কম নয়। অন্তত ৪৫০ রান করেছেন, এমন ঘটনাই আছে ৬১টি।
এক সিরিজে কোনো বোলার ১০ উইকেট নিয়েছেন, এমন ঘটনাও কম নেই। কমপক্ষে ১৮ উইকেট নেবার কীর্তিই রয়েছে ৫৬টি।
তবে এই দু’টি শর্ত যখন এক করে দেওয়া হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই কাজটা বেশ কঠিন হয়ে যায়। একই সাথে সিরিজে কমপক্ষে ২৫০ রান করেছেন এবং কমপক্ষে ১০ উইকেট নিয়েছেন, এমন কীর্তি রয়েছে মাত্র ২২টি। তিনজন ক্রিকেটার ২ বার করে কাজটা করায় খেলোয়াড়ের সংখ্যাটা ১৯।
তবে এসবের তুলনায় উইকেটকিপার বাদে কেবল ফিল্ডার হিসেবে এক সিরিজে ১০টি ক্যাচ নেওয়ার রেকর্ড খুবই কম। সিরিজে কমপক্ষে ১০টি ক্যাচ নিয়েছেন, এমন ঘটনা ঘটেছে মাত্র ৯ বার।
এখন কোনো খেলোয়াড় যদি একই সিরিজে ব্যাটিংয়ে কমপক্ষে ২৫০ রান, বোলিংয়ে কমপক্ষে ১০টি উইকেট এবং ফিল্ডিংয়ে কমপক্ষে ১০টি ক্যাচ নেওয়ার কৃতিত্ব ঘটান, তাহলে কাজটা কেবল অসাধারণই নয়, প্রায় অসম্ভবের কাছাকাছি স্বীকৃতি পাবে। ‘প্রায় অসম্ভব’ বলেই হয়তো ওয়ানডে ক্রিকেট এই ঘটনা দেখতে পেরেছে মাত্র ১ বার।
অসাধ্য সাধনকারী সেই ক্রিকেটারের নাম অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস।
২.
এই একটা জায়গাতেই ‘সর্বজয়ী’ অস্ট্রেলিয়ার কিছুটা দুর্বলতা ছিল।
‘সর্বজয়ী অস্ট্রেলিয়া’ বলতে সেই ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত টানা তিনটি একদিনের আন্তর্জাতিক বিশ্বকাপজয়ী অস্ট্রেলিয়া। হেইডেন-গিলক্রিস্টকে সর্বকালের সেরা ওপেনিং জুটির একটা ধরা হয়ে থাকে, কিপার হিসেবেও হয়তো ওয়ানডের সর্বকালের সেরা গিলক্রিস্টই। তিন নম্বর পজিশনে ওয়ানডে ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি রান করার কৃতিত্ব পন্টিংয়ের, মাইকেল বেভানকে সর্বকালের সেরা ফিনিশার হিসেবেই বিবেচনা করা হয়, শেন ওয়ার্ন আর ম্যাকগ্রা তো সর্বকালের যেকোনো ওয়ানডে একাদশেই সুযোগ পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন। কেবলমাত্র অলরাউন্ডারের জায়গাটাতেই তাদের সর্বকালের সেরা তো দূরে থাক, সময়ের সবচেয়ে সেরা খেলোয়াড়টিও ছিলেন না। মার্ক ওয়াহ, স্টিভ ওয়াহ, শেন লি, ইয়ান হার্ভি, ব্র্যান্ডন জুলিয়ান, টম মুডি, ব্র্যাড হগ… এরকম আরো অসংখ্য খেলোয়াড়কে দিয়ে চেস্টা করা হলেও কেউ আসলে মানের দিক থেকে সেই সময়ের ক্রিস কেয়ার্নস কিংবা জ্যাক ক্যালিস টাইপের ছিলেন না। সেই অভাবেরই কিছুটা পূরণ করেছিলেন অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস।
অথচ ক্যারিয়ারটা তিনি শুরু করতে পারতেন ইংল্যান্ড কিংবা ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়েও। জন্মসূত্রে তিনি ইংল্যান্ডের নাগরিক ছিলেন, কিন্তু তার বাবা মা ওয়েস্ট ইন্ডিজের নাগরিক হবার কারণে সে দেশের হয়েও খেলতে পারতেন। কিন্তু তিনি সিদ্ধান্ত নেন অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলার।
গ্লস্টারশায়ারের হয়ে ১৯৯৫ সালে তার কাউন্টি ক্রিকেটে অভিষেক হয়। একটা সফল মৌসুম কাটানোর পর ‘বছরের সেরা তরুণ ক্রিকেটার’ এর পুরস্কার পান। এর ফলে তিনি ইংল্যান্ড ‘এ’ দলের হয়ে পাকিস্তান সফরের সুযোগ পান। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলার ইচ্ছে থাকার কারণে তিনি প্রস্তাবটা ফিরিয়ে দেন।
১৯৯৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে তার অভিষেকও হয়। ভারতের বিপক্ষে ক্যারিয়ারের তৃতীয় ম্যাচেই অপরাজিত ৬৮ রানের একটা ইনিংস খেলে সম্ভাবনার জানানও দেন। কিন্তু পরবর্তীতে দলে নিজের জায়গা পাকা করতে ব্যর্থ হন। ২০০৩ বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত ৫৪ ম্যাচে মাত্র ২৩.৮১ গড়ে তার রান ছিল মাত্র ৭৬২। এই সময়ে অবশ্য বল হাতে ৪৪টি উইকেট তিনি দখল করতে পেরেছিলেন।
এই সাধারণ ক্যারিয়ার নিয়েও অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপ দলে তিনি সুযোগ পান মূলত অলরাউন্ডার শেন ওয়াটসনের ইনজুরির কারণে। কিন্তু প্রাপ্ত সুযোগের সদ্ব্যবহার সাইমন্ডস এমনভাবে করে ফেলবেন, সেটা হয়তো তিনি নিজেও বুঝতে পারেননি।
৩.
বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ম্যাচটা ছিল পাকিস্তানের বিপক্ষে। আগের বিশ্বকাপের দুই ফাইনালিস্টের ম্যাচটা নিয়ে দর্শকদের আগ্রহও ছিল। পাকিস্তানের প্রতিশোধ নেবার একটা বিষয়ও পাকিস্তান সমর্থকদের মাথায় হয়তো বা ঘুরঘুর করছিল। ম্যাচটা শুরু হবার পর বোঝা গেল, পাকিস্তানি খেলোয়াড়দের ভেতরেও এরকম একটা বিষয় কাজ করছে।
অস্ট্রেলিয়া দলে তখন নানাবিধ সমস্যা। ডোপ টেস্ট কেলেঙ্কারির কারণে শেন ওয়ার্ন দেশে ফিরে গিয়েছেন, ড্যারেন লেহম্যান নিষেধাজ্ঞার কারণে এবং মাইকেল বেভান ইনজুরির কারণে ম্যাচটা মিস করছেন। এর মধ্যে মাত্র দশম ওভারের মাঝেই অস্ট্রেলিয়ার তিনটি উইকেট পড়ে গেল, সবগুলো উইকেটই ওয়াসিম আকরামের। ১৫তম ওভারে আউট হলেন জিমি মাহের। ৩০তম ওভারে যখন পঞ্চম ব্যাটসম্যান হিসেবে পন্টিং আউট হলেন, তখন দলীয় সংগ্রহ মাত্র ১৪৬। মাঠে থাকা ব্যাটসম্যানের সেই মুহূর্তে কাজ হচ্ছে, ইনিংসটা ধরে পুরো ওভার খেলার চেষ্টা করা। আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান সাইমন্ডসের উপর নির্ভর না করাটাই তাই স্বাভাবিক ছিল।
তবে সবাইকে অবাক করে দিয়ে আক্রমণাত্মকভাবে খেলেই ইনিংস গড়া শুরু করলেন সাইমন্ডস। ব্র্যাড হগকে নিয়ে ৫০ রানের জুটি গড়লেন মাত্র ৩৩ বলে, যেখানে সাইমন্ডসের অবদানই ৪৪ রান। ব্যক্তিগত শতরান করলেন মাত্র ৯২ বলে; শেষ পর্যন্ত অপরাজিতও রইলেন ১৪৩ রানে, সেটাও মাত্র ১২৫ বলে। অস্ট্রেলিয়া ৩১০ রান করার পর জয়টা কেবল সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো। মাঝে নামিবিয়ার বিপক্ষে একটা ৫৯ রানের ইনিংস খেললেও সেরা ইনিংসটা খেললেন শ্রীলংকার বিপক্ষে সেমিফাইনালে।
একটা দল যত ভালোই খেলুক না কেন, একটা বাজে দিন তাদের যেতেই পারে। সেই বাজে দিনটা অস্ট্রেলিয়ার আসলো বড় অসময়ে। দলগতভাবে শ্রীলংকা কিছুটা পিছিয়েই ছিল অস্ট্রেলিয়ার তুলনায়। কিন্তু শ্রীলংকানদের একটা স্বভাব হচ্ছে, হার না মেনে শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়া।
গিলক্রিস্টদের মতো ব্যাটসম্যান যেদিন ছন্দে থাকেন, সেদিন উইকেট নিয়ে অনুমান করাটা বোকামি। মাত্র ১৯ বলে ১ ছক্কা আর ২ চারের সুবাদে ২২ রান করে ফেলার পর ২০তম বলটা উপরে উঠে গেলো। অ্যাম্পায়ার ভেবেছিলেন, বলটা ক্যাচ ধরার আগে মাটি ছুঁয়ে গিয়েছে। কিন্তু গিলক্রিস্ট নিজেই উইকেট ছেড়ে বের হয়ে গিয়ে ভদ্রতার পরিচয় দিলেন। এরপর থেকেই উইকেট যেন হুট করেই ব্যাটসম্যানদের বধ্যভূমিতে পরিণত হলো। ১৩তম ওভারের মাঝেই পন্টিং এবং হেইডেন আউট হবার পর যখন সাইমন্ডস মাঠে নামলেন, তখন রান মাত্র ৫১। গিলক্রিস্ট আউট হবার পরের ৭ ওভারে রান এসেছে মাত্র ১৭।
সাইমন্ডসের মতো আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যানকে নিয়ে লেহম্যান কী করতে পারবে, সেই মুহূর্তে সেটা দুশ্চিন্তার বিষয়ই হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। তবে ৩৫তম ওভারে যখন লেহম্যান ৩৬ রান করে আউট হলেন, তখন দেখা গেল ঘটনা উল্টো ঘটেছে। ২৩ ওভারে দু’জনের ৯৩ রানের জুটিতে সাইমন্ডসের অবদানই ছিল ৫৯। এরপর মাঠে নামলেন মাইকেল বেভান। কিন্তু প্রথম বলেই বেভান আউট হবার পর অস্ট্রেলিয়া আক্ষরিক অর্থেই চাপে পড়ে গেল। কিন্তু লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যানদেরকে সঙ্গী করে অপরাজিত ৯১ রানের একটা দায়িত্বশীল ইনিংস খেলে ২১২ রানের একটা লড়াই করার মতো স্কোর দিলেন অস্ট্রেলিয়ান বোলারদেরকে।
খারাপ অবস্থান থেকে ম্যাচে ফেরত এসে অস্ট্রেলিয়ান বোলাররা আর ভুল করেননি। তবে সেই ইনিংসের পর সবাই বুঝতে পারলেন, আক্রমণের সাথে সাথে পরিস্থিতি বুঝে দায়িত্বশীল ইনিংস খেলার বিষয়টাও সাইমন্ডস আয়ত্ত করে নিয়েছেন।
৪.
সেই বিশ্বকাপের পর থেকে দলে নিজের জায়গা নিয়ে আর ভাবতে হয়নি সাইমন্ডসকে। ২০০৫ সালে ভিবি সিরিজের প্রথম ফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৯১ রানের ইনিংস, কিংবা ২০০৬ সালের ভিবি সিরিজে শ্রীলংকার বিপক্ষে মাত্র ১০ রানেই ৩ উইকেট পড়ার পর ১৫১ রানের ইনিংসগুলো প্রমাণ দেয়, সাইমন্ডস আসলে বড় আসরের খেলোয়াড়ই ছিলেন। এছাড়া ফিল্ডার হিসেবেও খুব দক্ষ ছিলেন, ওয়ানডেতে ৮২টি ক্যাচ নেবার কৃতিত্বও রয়েছে তার।
অল্প কিছুদিন টেস্টও খেলেছেন। টেস্টে ২টি সেঞ্চুরিসহ ৪০.৬১ গড় খুব ভালো না হলেও লোয়ার-মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানের জন্য খুব বাজে রেকর্ডও নয়। তবে এরপরও টেস্ট দলে জায়গা হারান অস্ট্রেলিয়ার স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যান দিয়ে টেস্ট দল গড়ার নীতির কারণে।
২০০৭ বিশ্বকাপেও অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য ছিলেন সাইমন্ডস। ব্যাটে-বলে ভালো পারফরম্যান্স থাকা সত্ত্বেও ২০০৯ সালে অস্ট্রেলিয়া দল থেকে বাদ পড়েন শৃঙ্খলাজনিত কারণে। ২০০৮ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে সিরিজের আগে টিম মিটিংয়ে অংশ না নিয়ে মাছ ধরতে যাওয়া, কিংবা মদ্যপানজনিত কারণগুলো অস্ট্রেলিয়া দলের ইমেজের বিরুদ্ধে চলে যাওয়ায় বাদ পড়াটা স্বাভাবিকই ছিল।
তবে জাতীয় দল থেকে বাদ পড়লেও আইপিএলে পারফর্ম করে গিয়েছেন। ২০০৮ থেকে ২০১০ মৌসুম পর্যন্ত খেলেছেন ডেকান চার্জার্সের হয়ে, আর ২০১১ মৌসুম খেলেছেন মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের হয়ে। রাজস্থান রয়েলসের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করার কৃতিত্বও রয়েছে।
২০১২ সালে ৩৬ বছর বয়সে সব ধরণের ক্রিকেট থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। কারণ হিসেবে তিনি জানান,
‘মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স এবং আইপিএল সবসময়ই আমাকে সমর্থন দিয়ে এসেছে। কিন্তু আমার পরিবারে আমার প্রথম সন্তানের আগমন হচ্ছে, সেটাই আমার কাছে প্রাধান্য পাবে।’
ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ৫০০০+ রান আর ১৩৩টি উইকেট তাকে কার্যকরী একজন অলরাউন্ডারের মর্যাদা দিলেও ইতিহাসের একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে এক সিরিজে ২৫০ রান, ১০ উইকেট আর ১০ ক্যাচ নেবার কীর্তিই তাকে অমর করে রেখেছে। আপনি-আমি তাকে ভুলতে চাইলেও এই কীর্তি তাকে আজীবন বাঁচিয়ে রাখবে, সেটা নিশ্চিন্তে বলে দেওয়া যেতে পারে।