Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

আর্জেন্টিনা বনাম ক্রোয়েশিয়া: প্রথম সেমিফাইনালের ট্যাকটিক্যাল ব্যবচ্ছেদ

ফিফা বিশ্বকাপ ২০২২-এর প্রথম সেমিফাইনালে কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামে মুখোমুখি হয় আর্জেন্টিনা এবং ক্রোয়েশিয়া। প্রথম ম্যাচে সৌদি আরবের সাথে হোঁচট খেলেও খুবই শক্তিশালীভাবে ঘুরে দাড়ায় আলবিসেলেস্তেরা।

অন্যদিকে লুকা মদরিচের নেতৃত্বে ক্রোয়েশিয়া এবারের বিশ্বকাপের শক্তিশালী দলগুলোর একটি। কোয়ার্টার ফাইনালে উদীয়মান তারকায় ঠাসা বিশ্বকাপের অন্যতম দাবিদার শক্তিশালী ব্রাজিলকে রুখে দিয়ে তারা সেমিফাইনালে এসেছে যোগ্য দল হিসেবেই। তাই দু’দলের মধ্যে বেশ হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের অপেক্ষায় উন্মুখ ছিলেন ফুটবলভক্তরা। অথচ খেলায় দেখা গেল না তার ছিটেফোঁটাও! আর্জেন্টিনার কোচ লিওনেল স্কালোনির অসাধারণ ফুটবল বুদ্ধিমত্তায় ক্রোয়েশিয়াকে ৩-০ গোলের ব্যবধানে উড়িয়ে দিয়ে প্রথম দল হিসেবে বিশ্বকাপের ফাইনালে পা রাখলো মেসি-বাহিনী। 

আজ আমরা দুই দলের ট্যাকটিক্স এবং স্কালোনি কীভাবে ক্রোয়েশিয়ার শক্তিশালী মিডফিল্ডলাইনকে আটকে দিয়েছেন, সেটা নিয়ে আলোচনা করব।

image credit: Opta Analyst

শট অ্যাটেম্পট কিংবা বল পজেশন – দুইদিক থেকেই এই ম্যাচে ক্রোয়েশিয়া আর্জেন্টিনার চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে ছিল। কিন্তু এরপরও তারা পুরো ম্যাচে বলার মতো কোনো আক্রমণ করতে পারেনি। খেলার দখল বেশিরভাগ সময় ক্রোয়েশিয়ার পায়ে থাকলেও দু’দলের এক্সপেক্টেড গোলের পার্থক্যই বলে দিচ্ছে যে যোগ্য দলই ম্যাচটা জিতে বিশ্বকাপের ফাইনালে পা বাড়িয়েছে।

ম্যাচের শুরুতে আর্জেন্টিনা ৪-৪-২ এবং ক্রোয়েশিয়া তাদের প্রথাগত ৪-৩-৩ ফর্মেশনে খেলতে নেমেছিল। এবারের বিশ্বকাপে স্কালোনি আর্জেন্টিনাকে ৪-৩-৩ এবং ৩-৫-২, এই দু’টি ভিন্ন ফর্মেশনে খেলিয়েছেন। কিন্তু সেমিফাইনালের মতো ম্যাচে এভাবে হুট করে ফর্মেশন পরিবর্তন করায় ম্যাচ শুরুর আগে সমর্থকদের মধ্যে বেশ উৎকণ্ঠা দেখা যাচ্ছিল৷ তাদের ভয় বাড়িয়ে দিতেই কি না ক্রোয়েশিয়া ম্যাচের শুরু থেকেই মুহূর্মুহূ আক্রমণ করে আর্জেন্টিনার রক্ষণে ভয় ধরাচ্ছিল।

দু’দলের অ্যাটাকিং থ্রেটের ডায়াগ্রাম; image credit: Opta Analyst

ম্যাচে দু’দলের অ্যাটাকিং থ্রেটের ছবিটার দিকে যদি খেয়াল করি, ম্যাচের শুরুতে আর্জেন্টিনার চেয়ে ক্রোয়েশিয়াই বেশ গুছিয়ে আক্রমণ করছিল। তাদের মিডফিল্ডাররা ক্রমাগত ওয়ান-টাচ পাস খেলে খুব দ্রুতগতিতে আর্জেন্টিনার বক্সের কাছাকাছি চলে আসছিল। আর্জেন্টিনার চারজনের মিডফিল্ড লাইনকে তখন একেবারেই দিশেহারা মনে হচ্ছিল। 

ম্যাচের শুরুতে আর্জেন্টিনার মিডফিল্ডাররা একজন আরেকজনের থেকে অনেকটা দূরে অবস্থান করছিলেন, যে কারণে তাদের মধ্যে বোঝাপড়ার অভাব স্পষ্টভাবে ফুটে উঠছিল। মদরিচ-ব্রোজোভিচ-কোভাচিচ ‘ত্রয়ী’কে নিয়ে গড়া ক্রোয়েশিয়ার মিডফিল্ড লাইন এই বিশ্বকাপের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ধারাবাহিক পারফর্ম করেছে। আর্জেন্টিনার চার মিডফিল্ডারের মধ্যে ডি পল এবং ম্যাকঅ্যালিস্টার কিছুটা ওয়াইড এরিয়ায় চেপে গিয়েছিলেন, যে কারণে এনজো ফার্নান্দেজ আর পারেদেস মিডফিল্ড ব্যাটেলে কোনোমতেই ক্রোয়েশিয়ার মিডফিল্ড-ত্রয়ীর সাথে পেরে উঠছিলেন না।

অন্যদিকে, আর্জেন্টিনার দুই ফরোয়ার্ড মেসি এবং জুলিয়ান আলভারেজ ছিলেন বাকিদের থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন। আলভারেজ ক্রোয়েশিয়ার দুই সেন্টারব্যাককে ক্রমাগত প্রেস করে গেলেও মেসিকে প্রেসিংয়ে অংশ নিতে দেখা যায়নি; যে কারণে ক্রোয়াট সেন্টারব্যাক গাভার্দিওল বারবারই বল পায়ে মিডফিল্ডে উঠে আসছিলেন।

আর্জেন্টিনার মিডফিল্ডার এবং ফরোয়ার্ডরা একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকায় বিটুইন দ্য লাইনের মধ্যকার ফাঁকা জায়গায় ক্রোয়েশিয়ার মিডফিল্ডাররা খুব সহজেই নিজেদের মধ্যে বলের আদান প্রদান করে উপরে উঠে আসছিলেন। তবে এই সমস্যার সমাধান করতে স্কালোনি খুব একটা সময় নেননি। তিনি ম্যাকঅ্যালিস্টারকে ক্রোয়েশিয়ার ডিফেন্ডারদের প্রেস করতে উপরে উঠিয়ে দেন। ফলে তখন বাধ্য হয়েই ব্রোজোভিচ ডিফেন্সলাইনে নেমে গিয়ে ব্যাক-থ্রি তৈরি করেন।

image credit: Author

আর্জেন্টিনার বিল্ডআপের সময় পারেদেস দুই সেন্টারব্যাকের সাথে নিচে ড্রপ করে বল প্রোগ্রেস করতে সাহায্য করেন। এনজো ফার্নান্দেজ এবং ডি পল তখন মাঝমাঠে অবস্থান করে বল প্রোগ্রেশনে সাহায্য করছিলেন। আবার মেসি কিংবা ম্যাকঅ্যালিস্টার – দু’জনের একজন মিডফিল্ডে নেমে এসে ক্রোয়েশিয়া মিডফিল্ডারদের সাথে নিউমেরিক্যাল সুপেরিওরিটি তৈরি করেন। এ সময় আর্জেন্টিনার রক্ষণভাগে রোমেরো-পারেদেস-ওটামেন্ডি মিলে ক্রোয়েশিয়ার ক্রামারিচ-পেরিসিচের বিপক্ষে ৩-ভার্সেস-২ অবস্থানের সৃষ্টি করেন। অন্যদিকে মিডফিল্ডে এনজো-ডি পল-ম্যাকঅ্যালিস্টার মিলে মদরিচ-কোভাচিচের বিপক্ষে ৩-ভার্সেস-২ অবস্থানের সৃষ্টি করেন৷ ফলে ধীরে ধীরে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ আর্জেন্টিনার দিকে হেলতে শুরু করে।

পারেদেসের পাসিং ম্যাপ; image credit: Opta Analyst

এই ম্যাচে আর্জেন্টিনার মিডফিল্ডারদের মধ্যে পারেদেসের কথা আলাদা করে বলতেই হয়। সৌদি আরবের সাথে ম্যাচে পরাজয়ের পর স্কালোনির কাছে পারেদেস অনেকটাই ব্রাত্য হয়ে পড়েছিলেন৷ এনজো ফার্নান্দেজের দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের কারণে খুব একটা সুযোগও পাচ্ছিলেন না। কিন্তু ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে শুরুর একাদশে সুযোগ পেয়ে সেটা দারুণভাবেই কাজে লাগিয়েছেন। পুরো ম্যাচজুড়েই তিনি দুর্দান্ত পারফর্ম করেছেন; রক্ষণ থেকে বল নিয়ে আক্রমণভাগে সাপ্লাই দিয়েছেন, ক্রোয়েশিয়ার মিডফিল্ডারদের নিজের দিকে টেনে এনে সতীর্থদের জন্য স্পেস তৈরি করে দিয়েছেন।

প্রথাগত কোনো উইঙ্গার না থাকায় ম্যাচের শুরুর দিকে আর্জেন্টিনার আক্রমণগুলো ছিল একেবারেই ছন্নছাড়া। কিন্তু স্কালোনি যে সব জায়গাতেই সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে দলকে খেলতে নামিয়েছিলেন, সেটা সময় যত গড়িয়েছে সবার কাছে ততটাই পরিষ্কার হয়েছে। মিডফিল্ডের কন্ট্রোল ক্রোয়েশিয়ার থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার পর আর্জেন্টিনার দুই ফুলব্যাকই ক্রোয়েশিয়ার টাচলাইন এরিয়ায় ওভারল্যাপ করে তাদের ফুলব্যাকদের দুইপাশে ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য করে। এসময় ম্যাকঅ্যালিস্টার ফরোয়ার্ড লাইনে উঠে আসলে ক্রোয়েশিয়ার ৪ ডিফেন্ডারের বিপক্ষে ৫-ভার্সেস-৪ অবস্থান তৈরি হয়। এই সমস্যা সমাধানে ক্রোয়েশিয়ার রাইট উইঙ্গার পাসালিচ ডিফেন্সে নেমে ব্যাক-ফাইভ তৈরি করেন।

ক্রোয়েশিয়ার গোছানো রক্ষণ আর মিডফিল্ডারদের আঁটসাঁট অবস্থানের কারণে আর্জেন্টিনা সেন্টার দিয়ে তেমন কোনো আক্রমণ করার সুযোগ পাচ্ছিল না। মেসি তখন নিচে নেমে গাভার্দিওলকে নিজের দিকে টেনে আনেন। এতে করে ক্রোয়েশিয়ার বক্সে আলভারেজ-মলিনাদের সামনে অনেকটা স্পেস ক্রিয়েট হয়। আর্জেন্টিনার বেশিরভাগ আক্রমণগুলোই হয়েছে এই প্যাটার্ন বজায় রাখার মাধ্যমে।

এবার ক্রোয়েশিয়ার দিকে ফেরত আসা যাক। পুরো ম্যাচে ৬১ শতাংশ সময় বলের দখল ক্রোয়েশিয়ার পায়ে ছিল। কিন্তু এরপরও তারা খুব একটা গুছানো আক্রমণ করতে পারেনি। ক্রোয়েশিয়ার মিডফিল্ডারত্রয়ী বল কন্ট্রোল করে খেলা গড়ে দেওয়ার কাজে দুর্দান্ত হলেও তারা কেউই ম্যাচে পার্থক্য গড়ে দেওয়ার মতো কিছু করতে পারেননি।

image credit: Football Made Simple

ম্যাচের বেশিরভাগ সময়ই দেখা গেছে বিল্ডআপের সময় ক্রোয়েশিয়ার তিন মিডফিল্ডারই একইপাশে অবস্থান করে নিজেদের মধ্যে বলের আদান প্রদান করে বল সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এতে করে মাঠের অপর প্রান্তে ফাঁকা জায়গা তৈরি হয়েছে। কিন্তু ক্রোয়েশিয়ার উইঙ্গাররা আর্জেন্টিনার ফুলব্যাকদের কাছে ম্যান-টু-ম্যান মার্কড হয়ে থাকায় এবং বিল্ডআপের শুরুতে ক্রোয়েশিয়ার দুই ফুলব্যাকই অনেক নিচে অবস্থান করায় এই স্পেসের সুযোগ নিয়ে তারা আক্রমণে উঠতে পারেননি। এজন্য পুরো ম্যাচেই ক্রোয়েশিয়ার মিডফিল্ডারদের বল সুইচ করার প্রবণতা একেবারেই চোখে পড়েনি।

ক্রোয়েশিয়ার তিন মিডফিল্ডারই এই বিশ্বকাপে দারুণ ছন্দে আছেন, তবে এর মধ্যেও আলাদাভাবে উঠে আসবে লুকা মদরিচের নাম। আর্জেন্টিনার বিপক্ষেও এই মিডফিল্ডারের পারফরম্যান্স আলাদাভাবে চোখে পড়েছে; বারবারই নিচে নেমে প্রেস করতে আসা আর্জেন্টিনার মিডফিল্ডারদের ড্রিবল করে পরাস্ত করে বল নিয়ে উপরে উঠে যাচ্ছিলেন। কিন্তু মদরিচের থেকে তার সতীর্থরা যেটা আশা করেছিল, সেটা তিনি একেবারেই পূরণ করতে পারেননি।

মদরিচের পাসিং ম্যাপ; image credit: StatsBomb

ক্রোয়েশিয়ার চান্স ক্রিয়েটরদের তালিকা করলে প্রথমেই উঠে আসবে মদরিচ এবং পেরিসিচের নাম। মদরিচের গত ম্যাচের পাসিং ম্যাপ থেকে একটা জিনিস পরিষ্কার: তিনি পুরো মাঠজুড়েই সতীর্থদের দিকে পাস বাড়িয়েছেন। কিন্তু বক্সের বাইরে কিংবা বক্সের ভেতরে কার্যকরী পাস খুব একটা দিতে পারেননি; যে কারণে ম্যাচের কন্ট্রোল ক্রোয়েশিয়ার কাছে থাকলেও তারা গোলের সুযোগ তেমনভাবে তৈরি করতে পারেনি।

ক্রোয়েশিয়ার তিন মিডফিল্ডারই বিল্ডআপের সময় নিচে অবস্থান করায় আর্জেন্টিনার রক্ষণ এবং মাঝমাঠের মধ্যকার ‘বিটুইন দ্য লাইন’-এর স্পেস একেবারেই ফাঁকা হয়ে যাচ্ছিল। এজন্য তাদের স্ট্রাইকার ক্রামারিচ বারবারই নিচে নেমে ‘বিটুইন দ্য লাইন’-এর স্পেসে এসে বল রিসিভ করছিলেন। কিন্তু তিনি প্রথাগত স্ট্রাইকার, তার বলের কন্ট্রোল খুব একটা ভালো নয়; যে কারণে তিনি বল রিসিভ করলেও ঠিকঠাক পাস বাড়াতে পারেননি। ওটামেন্ডিও বারবার তার লাইন ছেড়ে ক্রামারিচকে প্রেস করতে উঠে আসছিলেন, যে কারণে ক্রোয়েশিয়ার আক্রমণগুলো নষ্ট হয়ে যায়।

image credit: FIFA

বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই সৌদি আরবের সাথে পরাজয়ের পর গ্রুপপর্বেই আলবিসেলেস্তেদের বিদায় দেখে ফেলেছিলেন অনেকে। কিন্তু লিওনেল স্কালোনি তার খেলোয়াড়দের উপর আস্থা হারাননি; খেলোয়াড়রাও দলকে ফাইনালে তুলে কী দারুণভাবেই না তার আস্থার প্রতিদান দিলেন!

বিশ্বকাপের সোনালী ট্রফিটা দ্বিতীয়বারের মতো মেসির হাত ছোঁয়া দূরত্বে। এবার কি মেসি পারবেন বিশ্বকাপের ট্রফিটাকে আলিঙ্গন করে উদযাপন করতে, নাকি আবারও হতাশাই হবে সঙ্গী? আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জিততে পারবে কি না, সেটা সময়ই বলে দেবে; তবে ফুটবল-ঈশ্বর নিশ্চয়ই আরেকবার চাইবেন না আর্জেন্টিনাকে হতাশ করতে, ঠিক যেমন বিশ্বকাপের সোনালী ট্রফিটা চাইবে না ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফুটবলারের হাতের ছোঁয়া পাওয়া থেকে বঞ্চিত হতে! 

This article is in Bangla language. It is about the tactical analysis of the match between Argentina and Croatia.

Feature Image: Getty Images

Related Articles