Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অগাস্টিন হেরেরিন: পিচ ডেলিগেট থেকে রিয়াল মাদ্রিদের সৌভাগ্যের প্রতীক

‘লাকি চার্ম’ বা সৌভাগ্যের প্রতীক জিনিসটা বিজ্ঞানের নিরিখে অবান্তর হতে পারে, কিন্তু আশ্চর্য বিষয় হলো, সেই অতীত হতে বর্তমান পর্যন্ত খেলোয়াড় কিংবা ক্লাবে বারবার এই বিষয়গুলো সামনে উঠে এসেছে। এই যে বিভিন্ন ক্লাবের বিভিন্ন মাসকট দেখা যায়, যেমন: ম্যানইউ এর ‘ফ্রেড দ্য রেড’, আর্সেনালের ‘গানার্সারাস’, বেনিফিকার জীবন্ত ঈগল ‘আগুইয়া ভিতোরিয়া’– এর সবগুলোর পেছনেই রয়েছে কোনো না কোনো ঐতিহাসিক বা পৌরাণিক গল্প।

খেলোয়াড়দের মধ্যেও কুসংস্কার দেখা যায়। রোনালদো যেমন মাঠে নামার আগে টাচলাইনে এসে লাফ দেন বা কাফু তার বাম পায়ের ফিতা আগে বাঁধতেন, এমন কাহিনী হরহামেশাই দেখা যায়। কিন্তু রিয়াল মাদ্রিদের ‘লাকি চার্ম’ কোনো প্রাণী বা মাসকট নয়, স্বয়ং একজন মানুষ। নাম অগাস্টিন হেরেরিন। কাগজে কলমে-রিয়াল মাদ্রিদের পিচ ডেলিগেট তিনি, আর ‘আনঅফিসিয়ালি’ রিয়াল মাদ্রিদের ঐতিহ্যের নীরব অভিভাবক, নিখাদ একজন মাদ্রিদিস্তা আর নবাগত খেলোয়াড়দের পরম বন্ধু।

অগাস্টিন হেরেরিন; Image Source: Managing Madrid

কে এই অগাস্টিন হেরেরিন?

আগেই বলা হয়েছে তিনি একজন পিচ ডেলিগেট। অনেকেই হয়তো জানেন না পিচ ডেলিগেটের কাজ কী। একটি ক্লাবে পিচ ডেলিগেট ম্যাচ শুরুর আগে পিচের যাবতীয় হালচাল, ম্যাচের সরঞ্জামাদি, যেমন- বল, নেট, বার, ফ্লাগ ইত্যাদি দেখে থাকেন। পিচ ডেলিগেটের একটা বড় দায়িত্ব হলো রেফারির প্রয়োজনীয় দিকগুলায় সাহায্য করা। কোনো একজন রেফারি তার প্রয়োজনীয় যেকোনো কিছুর জন্য পিচ ডেলিগেটের সাথে যোগাযোগ করেন।

অগাস্টিন এই কাজটি করে আসছিলেন দীর্ঘদিন যাবত। ছেলেবেলা থেকে বেড়ে ওঠা সব কিছু এই ক্লাবে হওয়ায় সবার কাছের ব্যক্তি তিনি। রোনালদোর কথাই ধরা যাক। সদ্য মাদ্রিদে যোগ দেয়া এই তারকাকে আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপন করা হবে। টানেলে দাঁড়িয়ে রোনালদো, ভেতরে প্রচন্ড উত্তেজনা। বুঝতে পেরে এগিয়ে এলেন অগাস্টিন। একটু মিথ্যাই বললেন, “তোমার ভয় লাগছে? ভয় পেয়ো না, ফিগোর তো বারবার টয়লেট চাপছিল! ব্যাপার না, এগুলা হয়েই থাকে।” এভাবেই অনেক নবাগত খেলোয়াড়ের সঙ্গী হয়েছেন তিনি। নতুন খেলোয়াড়দের ক্লাব চেনানো, বাসা ঠিক করে দেয়া, সঙ্গ দেয়া– এগুলো নিজে থেকেই করতেন। তাই তো খেলোয়াড়দের কাছে তিনি ছিলেন ‘গ্র্যান্ডপা অগাস্টিন’।

যেভাবে বনে গেলেন রিয়াল মাদ্রিদের সৌভাগ্যের প্রতীক

একটু পেছন থেকে শুরু করা যাক। রিয়াল মাদ্রিদ ১৯৬৫ সালে সর্বশেষ তাদের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতে। এরপর থেকে ৩২ বছর পেরিয়ে যায়, এই ট্রফি তাদের অধরাই রয়ে যায়। ঘরোয়া সাফল্য তৃপ্ত করতে পারছিল না সমর্থকদের। প্রেসিডেন্ট আসে, প্রেসিডেন্ট যায়, সবাই আসেন এই প্রতিশ্রুতি নিয়ে। কিন্তু এই সাফল্য আর ধরা দিচ্ছিলো না।

১৯৯৭-৯৮ মৌসুম। কোচ তখন জাপ হেইংকেস। ঘরোয়া লিগে রিয়াল মাদ্রিদের তথৈবচ অবস্থা। লিগ টেবিলে ৫ম স্থানে, মানে পরের মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ না খেলার সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে। কিন্তু রিয়াল মাদ্রিদ উঠে আসে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমি ফাইনালে। প্রতিপক্ষ তৎকালীন চ্যাম্পিয়ন বরুশিয়া ডর্টমুন্ড। পাখির চোখ তখন দুই কারণে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। এক, ৩২ বছরের শিরোপা খরা ঘোচানো, আর দুই, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতে পরের মৌসুমে কোয়ালিফিকেশন নিশ্চিত করা।

১৯৯৭-৯৮ মৌসুমের রিয়াল মাদ্রিদ; Image Source: Twitter

সেমি ফাইনালের প্রথম লেগ ঘরের মাঠ সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে। ম্যাচ শুরুর ৪৫ মিনিট আগে এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটে গেল। দুই গোলপোস্টের একটি আচমকা ভেঙে পড়ে গেল। এদিকে রিয়াল মাদ্রিদের স্টেডিয়ামের মূল ভান্ডারে অতিরিক্ত কোনো গোলপোস্ট নেই। কয়েকজন স্টাফ চেষ্টাও করেন ঠিকঠাক করার, কিন্তু এতে কাজ হয়নি।

রেফারিরা রিয়াল কর্তৃপক্ষকে ডেকে বলে দেন, সময়মতো গোলপোস্ট ঠিক না হলে ম্যাচ পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হবে। আর উয়েফার নিয়ম অনুযায়ী, কোনো ম্যাচ স্বাগতিকদের দোষে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা মানে হলো প্রতিপক্ষকে ০-৩ গোলে জয়ী ঘোষণা করা। যদি গোলপোস্ট ঠিক করা না হয়, তবে বরুশিয়াকে ০-৩ গোলে বিজয়ী ঘোষণা করা হবে, যার আক্ষরিক অর্থ দাঁড়ায়, রিয়াল মাদ্রিদ মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই বাদ পড়ে যাবে। মূহুর্তেই কানায় কানায় পরিপূর্ণ স্টেডিয়ামে ভয়ের চোরাস্রোত বয়ে যায়। নীরব হয়ে যায় গোটা স্টেডিয়াম।

ঠিক তখন যখন সবাই রিয়ালের যুবদলের মাঠের দিকে ছুটছিল, তখন হেরেরিনের মনে হলো যুবদলের মাঠের যে গোলপোস্ট তা মাটিতে স্থায়ীভাবে পোঁতা। চেষ্টা করেও এত সহজে তোলা যাবে না। হঠাৎ তার মনে হয়, রিয়াল মাদ্রিদের পুরাতন ট্রেনিং গ্রাউন্ডের গুদাম ঘরে দুটি গোলপোস্টের সেট রাখা আছে। সেই পুরোনো স্টেডিয়ামটি মাইল দুয়েক দূরত্বে অবস্থিত। তিনি দৌড়ে এলেন রেফারির কাছে। প্রায় ৩২ বছর ধরে রিয়াল মাদ্রিদের পিচ ডেলিগেটর থাকায় এমন কোনো রেফারি নেই যার সাথে তার চেনা-জানা ছিল না। তিনি রেফারিকে জিজ্ঞাসা করেন সময় কতক্ষণ দিয়েছে ঠিকঠাক করার জন্য? রেফারি জানালেন ৪০ মিনিট। এবার অগাস্টিন নিজের ব্যক্তিগত সম্পর্ককে সামনে নিয়ে এলেন। চেয়ে নিলেন আরো ২০ মিনিট। ততক্ষণে ঘড়ির কাটা আরো তিন কদম এগিয়ে ফেলেছে। অর্থাৎ হাতে আর সাকুল্যে ৪৫ মিনিট।

শিল্পীর স্কেচে অগাস্টিন; Image Source: Managing Madrid

দৌড়ে বেরিয়ে এসে একটা ভ্যান পেলেন। ড্রাইভারকে রীতিমতো পাঁজাকোলা করে নিয়ে দিলেন ছুট। বললেন, “লাগে তো সব ট্রাফিক আইন ভাঙো, একঘন্টা পর আমি জেলে জেতেও রাজি। কিন্তু এখন তাড়াতাড়ি পৌঁছাও।” চলে এলেন আগের ট্রেনিং গ্রাউন্ডে। স্টোরের দরজার সামনে এসে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। তিনি উত্তেজনার চোটে চাবিই নিয়ে আসেননি। যদি ফিরে যান চাবি আনতে তবে ম্যাচ শুরুর সময়ের মধ্যে কাজ করা সম্ভব হবে না। এমন সময় চোখ পড়লো একটা ট্রাকের দিকে। খানিকটা সৌভাগ্য। রিয়াল মাদ্রিদ ক্লাবেরই একটি ট্রাক রাস্তার অন্য পাশের দোকানের সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে ড্রাইভার খাচ্ছেন। অগাস্টিনের মনে হলো, ছোট্ট ভ্যান দিয়ে দরজা খুললেও গোলবার নিয়ে যেতে পারবেন না। বড় একটা কিছু লাগতোই। দৌড়ে গিয়ে খাওয়া শেষ করার আগেই চালককে টেনে নিয়ে গাড়িতে তুললেন। বললেন জোরে চালিয়ে স্টোরের দরজা ভাঙতে!

চালক হতভম্ব! পিচ ডেলিগেট নিজেই বলছেন গাড়ি চালিয়ে দরজা ভাঙতে! অগত্যা দিলেন গাড়ি সজোরে দরজায় তুলে। তিনজনে পাঁজাকোলা করে কোনোমতে গোলপোস্ট নিয়ে চলে এলেন স্টেডিয়াম গেটে। ততক্ষণে সবার মুখে আশাভঙ্গের ছাপ। কেননা যুবদলের মাঠে গিয়ে তারা ব্যর্থ। অগাস্টিনের ট্রাকে গোলপোস্ট দেখেই উদ্বেলিত হয়ে পড়েন সদ্য করোনাভাইরাসে প্রাণ হারানো প্রেসিডেন্ট লরেঞ্জো সাঞ্জ। সেই ট্রাক ড্রাইভার পরে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমি ভাবছিলাম অগাস্টিন সেদিন একটা হার্ট অ্যাটাক করেই ফেলবেন। এতটা উত্তেজিত ছিল ও। আর সেদিন যেহেতু করেননি, আর করবেন বলেও আমার বিশ্বাস হয় না!

রামোস আর মার্সেলো অগাস্টিনের হাতে তুলে দিচ্ছেন বিশেষ সম্মাননা; Image Source: Tribuna.com

হাতে আর মিনিট দশেক বাকি। মাঠের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা সব স্টাফ একযোগে ছুটে এলেন। অগাস্টিন যখন গোলবার নিয়ে মাঠে ঢুকছিলেন গোটা স্টেডিয়াম উল্লাসে ফেটে পড়ে। দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানান সবাই। নির্ধারিত সময়ের ৭ মিনিট পর গোলবার রেডি হয়। হাল ছেড়ে দেয়া খেলোয়াড়রাও নতুন করে জেগে ওঠেন। আর পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি। ২-০ গোলে রিয়াল মাদ্রিদ হারিয়ে দেয় জার্মান জায়ান্ট ও তৎকালীন চ্যাম্পিয়ন বরুশিয়া ডর্টমুন্ডকে।

ফিরতি লেগে ০-০ ড্র করে উঠে যায় ফাইনালে। আর সেই চিরায়ত প্রবাদ, “রিয়াল মাদ্রিদ ফাইনাল খেলার জন্য খেলে না, জেতার জন্য খেলে” অনুযায়ীই অদম্য এক জুভেন্তাসকে ১-০ তে হারিয়ে দীর্ঘ ৩২ বছর পর চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা জিতে নেয়। এরপর আর রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাসে এত বড় সময়ের ট্রফি খরা আসেনি। বলা বাহুল্য, খোদ রিয়াল মাদ্রিদের অধিনায়ক তার চ্যাম্পিয়ন্স লিগের মেডেলটি দিয়ে দিয়েছিলেন আগাস্টিনকে। ক্লাব তাঁকে আজীবনের সিনিয়র পিচ ডেলিগেট করে এবং বিশেষ সংবর্ধনার আয়োজন করে।  

সাবেক-বর্তমান সবার কাছেই তাঁর বিশেষ স্থান রয়েছে; Image source: AS English-Diario AS

অগাস্টিনের মূল কাজ ছিল পিচ ডেলিগেটের, কিন্তু নিজেকে শুধু এই কাজেই আবদ্ধ রাখেননি। ’৯০ এর শুরুর দিকে শহরে ঘুরতে ঘুরতে রাউল গঞ্জালেস নামে এক তরুণের খেলা তার চোখে লেগে যায়। রাউল তখন অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের যুবদলে খেলছেন। খেলা দেখেই তার মনে ধরে যায়। শুরু করলেন প্রেসিডেন্টের কাছে এসে ধর্ণা দেয়া। প্রেসিডেন্ট বাধ্য হলেন স্কাউটিং দল পাঠাতে। স্কাউটিং রিপোর্টে রাউলকে দলে ভেড়ানোর সুপারিশ করা হলো। কিন্তু বিপত্তি হলো রাউল খেলে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদে। এবার সেই দায়িত্ব অগাস্টিন নিজের কাঁধেই নেন। নিজেই রাউলকে রাজি করান রিয়ালে যোগ দিতে, আর সেই রাউল হয়ে যান রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা, তথা রিয়াল মাদ্রিদের প্রতীক।

কোনো খেলোয়াড় হতাশায় ভুগছে, ফর্ম বাজে– ব্যস, অগাস্টিন হাজির হয়ে যেতেন তার বাসায়। বন্ধুর মতো মিশতেন। তাই তো ফিগো, জিদান, কার্লোস থেকে ধরে বহু বড় তারকা রিয়াল স্টেডিয়ামে এসেছেন আর ‘গ্র্যান্ডপা অগাস্টিন’ এর সঙ্গে দেখা করে যাননি এমনটা হয়নি। রোনালদো, রামোসদের মতো অনেকেই তাদের নিজেদের মেডেল কৃতজ্ঞতাস্বরুপ দিয়ে গেছেন তাকে। ২০১৯ সালে না ফেরার দেশে চলে যান রিয়াল মাদ্রিদের এই সৌভাগ্যের প্রতীক। হার না মানা যে স্বভাবের কারণে রিয়াল মাদ্রিদ পরিচিত, তার কিছুটা রুপ দেখা গিয়েছিল সেদিন গোলবার আনার সময়। আজীবন ক্লাবকে ধারণ  করেছেন নিজের মনের সবচেয়ে পবিত্র আসনে। হাজারও সমর্থকের কাছে আজও সেই ‘গ্র্যান্ড পা’র স্মৃতি অমলিন।

 

This is a bengali article about  Agustín Herrerín who was not only a pitch delegator but someone more than that in Real Madrid. Information sources are hyperlinked inside.

Feature Image: Libertad digital

Related Articles