“ওরা আমাদের দেশে যখন খেলতে যায়, তখন আমরা ওদের যে ধরনের দল হিসেবে ট্রিট করি, এখানে ওদের একইভাবে ট্রিট করলে কঠিন হবে আমাদের জন্য।”
কথাগুলো বলছিলেন বাংলাদেশের হয়ে একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ২০০ উইকেট নেয়া প্রথম বোলার আবদুর রাজ্জাক। বর্তমানে দলের সঙ্গে আছেন নির্বাচক হিসেবে। আরও জানালেন, পরিচিত কন্ডিশনে সহায়তা পাবে জিম্বাবুয়ে৷ একদিন পর রাজ্জাকের সঙ্গে সুর মেলালেন প্রথমবার জিম্বাবুয়ে সফরে যাওয়া তাসকিন আহমেদও। তিনিও বললেন, বাংলাদেশকে খেলতে হবে কঠিন কন্ডিশনে কঠিন প্রতিপক্ষের বিপক্ষে।
আইসিসি র্যাংকিংয়ে ওয়ানডেতে ১৩তম, টেস্টে ১০ম, আর টি-টোয়েন্টিতে ১১তম অবস্থানে আছে জিম্বাবুয়ে। গত কয়েক ঘরের মাঠে বাংলাদেশ হেসেখেলেই হারিয়েছে জিম্বাবুয়েকে। গত দশকের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশকে বাংলাদেশের মাটিতে ওয়ানডেতে সর্বসাকুল্যে একবারই হারিয়েছে জিম্বাবুয়ে। তবে দেশের মাটিতে ৭৫ শতাংশ ওয়ানডে ম্যাচে জয়লাভ করলেও সংখ্যাটা ৪৬ শতাংশে নেমে আসে জিম্বাবুয়ের মাটিতে। সেখানে খেলা ২৮ ম্যাচের মধ্যে ১৩ জয়ের বিপরীতে টি ম্যাচেই হেরেছে টাইগাররা।
সাদা পোশাকেও জিম্বাবুয়ের মাটিতে রেকর্ড কথা বলে না বাংলাদেশের হয়ে। এর আগে সেখানে খেলা ৭ টেস্টে বাংলাদেশের জয় কেবল একটি; হার ৫টিতে। জিম্বাবুয়েতে বাংলাদেশ তাদের সবশেষ পূর্ণাঙ্গ সফর করেছিল ২০১৩ সালে। সেবার কোনো সিরিজই জিতে আসতে পারেনি বাংলাদেশ, উল্টো খুইয়ে এসেছিল ওয়ানডে সিরিজ। তার দু’বছর আগেও পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ ৩-২ এ হাতছাড়া করেছিল বাংলাদেশ। সেবার ছয় বছর পর স্বেচ্ছানির্বাসন থেকে ফিরে বাংলাদেশকে টেস্টেও হারিয়ে দিয়েছিল জিম্বাবুয়ে।
তবে সেই জিম্বাবুয়ের সাথে এই জিম্বাবুয়ের বিস্তর ফারাক, অন্তত টেস্ট ক্রিকেটে। সেই ২০১৩ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে জয়ের পর ৮ বছরে তারা কেবল জিততে পেরেছে ৩টি টেস্ট, যার দু’টিই যথাক্রমে বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের বিপক্ষে। টেস্টে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স খুব ভালো না হলেও নিজেদের স্বাভাবিক খেলা খেললে টেস্টে জিম্বাবুয়েকে হারাতে অন্তত বেগ পেতে হবে না।
তবে সমস্যাটা হতে পারে বাকি দুই ফরম্যাটে। জিম্বাবুয়ের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স অন্তত তারই আভাস দিচ্ছে। নিজেদের সর্বশেষ ওয়ানডে সিরিজে পাকিস্তানকে রীতিমতো নাচিয়ে ছেড়েছে তারা। তিন ম্যাচ সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে অল্পের জন্য জয় হাতছাড়া হলেও তৃতীয় ম্যাচে সুপার ওভারে জয় তুলে নেয় তারা।
একই ঘটনা টি-টোয়েন্টি সিরিজেও। ২-১ ব্যবধানে সিরিজ হারলেও অন্তত দুটো ম্যাচে জয়ের পরিস্থিতি তৈরি করতে পেরেছিলো জিম্বাবুয়ে। অথচ একই পাকিস্তান দলের বিপক্ষে গত বছর টি-টোয়েন্টি সিরিজে ধবলধোলাই হয়ে ফিরেছিলো বাংলাদেশ।
ব্যাট হাতে অভিজ্ঞ ব্রেন্ডন টেইলর, শন আরভিন, তরুণ ওয়েসলি মাধেভেরের পাশাপাশি বাংলাদেশকে বিপদে ফেলতে পারেন বল হাতে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা ব্লেসিং মুজারাবানি। গেল পাকিস্তান সফরের শেষ ওয়ানডেতে সুপার ওভারে দুই উইকেটসহ মোট সাত উইকেট নিয়ে জয়ের নায়ক ছিলেন ৬ ফুট ৬ ইঞ্চি উচ্চতার এই ফাস্ট বোলার।
আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গে আছেন আরেক পেসার লুক জঙ্গওয়ে। পাকিস্তানের বিপক্ষে সেই তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজে ৯ উইকেট শিকার করে পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানদের ভালোই বিপদে ফেলেছেন ২৬ বছর বয়সী এই ডানহাতি মিডিয়াম ফাস্ট বোলার।
এবার বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ে সিরিজের সবগুলো ম্যাচই অনুষ্ঠিত হবে হারারেতে। জিম্বাবুয়ের ভেন্যুগুলোর মধ্যে ঐতিহ্যগতভাবে হারারে বেশি পেস সহায়ক। পরিসংখ্যানও তার সাক্ষ্য দেয়। ২০১৫ থেকে এখন পর্যন্ত সব ফরম্যাটে হারারেতে অনুষ্ঠিত ম্যাচগুলোতে ৬০ শতাংশ উইকেটই গেছে ফাস্ট বোলারদের পকেটে।
বাংলাদেশ যখন শেষবার জিম্বাবুয়ে সফরে গিয়েছিলো, সেবার বাংলাদেশের হয়ে বল হাতে অসামান্য নৈপুণ্য দেখিয়েছিলেন ডানহাতি পেসার রবিউল ইসলাম। লম্বা স্পেলে ক্লান্তিহীনভাবে বোলিং করেছিলেন রবিউল, ছোট ছোট আউটসুইংয়ে জিম্বাবুয়ের ব্যাটসম্যানদের করে তুলেছিলেন অতিষ্ঠ। দুই ম্যাচের সিরিজে মাত্র ১৯.৫৩ গড়ে নিয়েছিলেন ১৫ উইকেট, যেকোনো সিরিজে বাংলাদেশি কোনো পেসারের পক্ষে যা সর্বোচ্চ। সিরিজে রবিউল বল করেছিলেন ১১০ ওভার। এর আগে-পরে বাংলাদেশের কোনো পেসারই এর চেয়ে বেশি ওভার বল করতে সমর্থ হননি। সিরিজটায় দু’বার পাঁচ উইকেট নিয়েছিলেন এই পেসার। বাংলাদেশের হয়ে টেস্টে পাঁচ উইকেট নেয়া সর্বশেষ পেসারও এই রবিউলই।
তবে আশা দেখাচ্ছেন আবু জায়েদ। রবিউলের মতো বল সুইং করানো ও লম্বা স্পেলে বল করা – দুটো দক্ষতাই আছে জায়েদের। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কা সফরটা ভালো না গেলেও জিম্বাবুয়েতে অবশ্যই ভালো করতে চাইবেন এই বাঁহাতি পেসার। শ্রীলঙ্কা সফরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮ উইকেট নিয়ে নতুনভাবে ফেরার আভাস দিয়েছেন তাসকিন আহমেদও।
পেসাররা বেশি সাফল্য পেলেও স্পিনারদের যে কোনো ভূমিকা থাকবে না, এমনটাও নয়। বাংলাদেশের নবনিযুক্ত ব্যাটিং পরামর্শক অ্যাশওয়েল প্রিন্সের মতে, বছরের এই সময়টায় স্পিনাররা বেশ সাহায্য পান৷ সেক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে হবে সাকিব আল হাসানকে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সব ফরম্যাট মিলিয়ে ১১৩ উইকেট নিয়েছেন সাকিব, যা বাংলাদেশিদের মধ্যে সর্বোচ্চ। বাংলাদেশের পক্ষে জিম্বাবুয়ের মাটিতেও সবচেয়ে বেশি উইকেট সাকিবের (৩২)।
তবে সাকিবের ব্যাটের দিকেও তাকিয়ে থাকবে বাংলাদেশ। জিম্বাবুয়ের নির্বাচিত একাদশের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে ৫৬ বলে ৭৪ রানের আক্রমণাত্মক ইনিংস খেলে ব্যাট হাতে ফর্মে ফেরার আভাস দিয়েছেন এই অলরাউন্ডার। বল হাতেও তিন-তিনজন ব্যাটসম্যানকে বোল্ড করেছেন সাকিব।
তামিম ইকবাল খেলতে পারছেন না একমাত্র টেস্ট। প্রস্তুতি ম্যাচে ফিফটির সুবাদে টেস্ট একাদশে জায়গা পেতে পারেন সাইফ হাসান, তামিমের অবর্তমানে লাইফলাইন পেয়ে যেতেই পারেন সাদমান ইসলাম। তবে ওয়ানডে বা টি-টোয়েন্টিতে তামিম পেতে পারেন ভিন্ন দুই সঙ্গী। ক্রমাগত ব্যর্থ হওয়া লিটন দাসের জায়গায় শ্রীলঙ্কা সিরিজের শেষ ম্যাচে জায়গা পেয়েছিলেন নাঈম শেখ। ওয়ানডেতে তাকে সুযোগ দেবার পক্ষপাতী ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম। টি-টোয়েন্টিতে নিজের জায়গা ধরে রাখার সম্ভাবনা আছে লিটনের।
দল ঘোষণার দু’দিন পর টেস্ট দলে নতুন করে ডাক পাওয়া মাহমুদউল্লাহকে দেখা যেতে পারে বেঞ্চ গরম করতেই৷ তবে তামিমের ইনজুরির কারণে শেষ মুহূর্তে দলে ঢুকে যাওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া চলে না। প্র্যাকটিস ম্যাচে পোশাকি মহড়াটাও দিয়ে রেখেছেন, শাণিয়ে নিয়েছেন নিজের ব্যাটটাকে। বাকি দুই ফরম্যাটের দলে তার জায়গাটা যে পাকা, সেটা বলাই বাহুল্য।
ঘরোয়া ক্রিকেটে অসাধারণ নৈপুণ্য দেখিয়ে তিন ফরম্যাটের দলেই জায়গা করে নিয়েছেন নুরুল হাসান সোহান। সদ্যসমাপ্ত ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ টি-টোয়েন্টিতে প্রায় দেড়শ স্ট্রাইক রেটে ৩৮৯ রান করেছেন সোহান, ছিলেন আসরের তৃতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। মুশফিকুর রহিম টি-টোয়েন্টি সিরিজ থেকে ছুটি নেয়ায় তার জায়গায় সুযোগ পাবার জোর সম্ভাবনা রয়েছে সোহানের।
টি-টোয়েন্টি দলে সুযোগ হতে পারে প্রথমবারের মতো ডাক পাওয়া তরুণ তুর্কি শামীম হোসেনেরও। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে লোয়ার অর্ডারে ব্যাটিং করে ১৪৬ স্ট্রাইকরেটে করেছেন ২৪৩ রান। জাতীয় দলে ফিনিশারের ভূমিকায় ভাবা হচ্ছে তাকে।
তিন ফরম্যাটের স্কোয়াড মিলিয়ে মাত্র ছয়জনেরই এর আগে অভিজ্ঞতা আছে জিম্বাবুয়ে সফর করার। তারা হলেন তামিম ইকবাল, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ, মুমিনুল হক ও রুবেল হোসেন। এর মধ্যে শুধু তামিম আর সাকিবই সব ফরম্যাটে খেলবেন, রুবেল দলে এখন অনেকটাই অনিয়মিত। তাই বাংলাদেশের সাফল্য অনেকাংশেই নির্ভর করছে তরুণদের উপর।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দেশের বাইরে বাংলাদেশের সর্বশেষ সিরিজ জয় তিন বছর আগে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। সেবার ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি দুই ফরম্যাটেই সিরিজ জিতেছিল টাইগাররা। টেস্ট ক্রিকেটে বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের প্রথম ও একমাত্র টেস্ট সিরিজ জয়ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেই। তবে ২০০৯ এর সেই সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলটা ছিল দ্বিতীয় সারির।
যেকোনো ফরম্যাটে বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের সর্বশেষ জয়টা দেড় বছর আগে ভারতের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে। এবার কি তবে ‘ডেডলক’টা ভাঙছে? সেটা যে জিম্বাবুয়ে খুব সহজে হতে দেবে না, সেটা তো বলার আর অপেক্ষা রাখে না!