১.
আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শুরুতে বেন স্টোকস ছিলেন একজন বোলার, যিনি ব্যাট হাতেও বেশ পারদর্শী ছিলেন। এরপর তিনি হয়ে উঠলেন একজন অলরাউন্ডার, যে ব্যাট হাতে দলের হয়ে অবদান রাখার পাশাপাশি বোলিংয়ে এবং ফিল্ডিংয়েও দলের হয়ে অবদান রাখবেন। বর্তমানে বেন স্টোকস পুরোদস্তুর একজন ব্যাটসম্যান। নিয়মিত মিডল-অর্ডারে ব্যাট করে থাকেন। ক্রিকেট বিশ্বে সেরা কয়েকজন মিডল-অর্ডার ব্যাটসম্যানের তালিকা করা হলে তার নাম হয়তো শুরুর দিকে থাকবে না, তবে কার্যকারিতার দিক থেকে স্টোকস বেশ উপরেই থাকবেন।
স্টোকস এখন নিয়মিত পাঁচ নাম্বারে ব্যাট করেন। দ্রুত রান তোলা কিংবা দলের বিপর্যয়ে মুখে, সবসময়ই পরিস্থিতি অনুযায়ী দুর্দান্ত ব্যাটিং করে যাচ্ছেন তিনি। ফিল্ডার হিসাবে অসাধারণ ক্যাচ, কিংবা রান বাঁচানো সব কিছুই ক্রমশ আরও ধারালো হচ্ছে। বর্তমানে ইংল্যান্ড দলে বেশ গুরুত্বপূর্ণ সদস্যে পরিণত হয়েছেন তিনি। স্টোকস ছাড়াও ইংল্যান্ড আরও পাঁচজন স্পেশালিষ্ট বোলার নিয়ে খেলে, এবং তিনি ছাড়াও আরও পাঁচজন স্পেশালিষ্ট ব্যাটসম্যান নিয়ে খেলে ইংল্যান্ড। একাদশে জাত অলরাউন্ডারের মতোই ভূমিকা পালন করেন তিনি। দ্রুত রান তোলা, উইকেটে টিকে থাকা, প্রয়োজনীয় সময়ে দলকে উইকেট এনে দেওয়া সবকিছুতেই তিনি পারদর্শী।
২.
একজন স্পেশালিষ্ট ব্যাটসম্যানের জন্য সবচেয়ে কঠিন ব্যাটিং পজিশন পাঁচ নাম্বার। বেন স্টোকস বর্তমানে স্পেশালিষ্ট ব্যাটসম্যানদের মতোই খেলছেন। একজন ব্যাটসম্যান পাঁচ নাম্বারে যখন ব্যাট করতে নামেন, তখন দলের সেরা ব্যাটসম্যানরা সাজঘরে থাকেন। সেইসময় তাকে পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যাট করতে হয়। কখনও দলের বিপদের মুখে টপ-অর্ডার ব্যাটসম্যানদের মতো ধীরেসুস্থে ব্যাট করে ইনিংস বড় করতে হয়, আবার কখনও ফিনিশারের ভূমিকা পালন করে দ্রুত রান তুলতে হয়।
টপ-অর্ডারের ব্যাটসম্যানরা যেমন শুরুতে বেশ কয়েক ওভার দেখেশুনে খেলার সময় পায় এবং ডট বল খেলতে পারে, তেমনি পাঁচ নাম্বারে নামা ব্যাটসম্যান সেই সুযোগ পায়না। তারা এমন পরিস্থিতিতে ব্যাট করে যখন ডট বল খেললে আরও চাপের মুখে পড়ে যাবে। আবার নিয়মিত পাঁচে খেলা ব্যাটসম্যানরাও ক্রিজে এসেই ধুন্ধুমার ব্যাটিং করতে পারে না।
বেন স্টোকস পাঁচ নাম্বারে গত চার বছর ধরে নিখুঁত ব্যাটিং করে আসছেন। তিনি প্রায় প্রতি ম্যাচেই পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যাট করে আসছেন। দ্রুত উইকেট পড়ে গেলে যেমন দেখেশুনে ব্যাট করেন, তেমনি বাউন্ডারি হাঁকিয়ে দ্রুত রানও তুলতে পারেন। পাঁচ নাম্বারে নেমে তিনি মোট যত রান করেছেন, তার অর্ধেকের বেশি করেছেন বাউন্ডারি হাঁকিয়ে। পাঁচ নাম্বারে অন্যান্য সফল ব্যাটসম্যানদের মধ্যে রয়েছেন মহেন্দ্র সিং ধোনি, অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউস ও শোয়েব মালিক। তারা পাঁচ নাম্বারে মোট রানের ৪০% করেছেন বাউন্ডারি থেকে। পাঁচে আরেকজন সফল ব্যাটসম্যান হলেন বাংলাদেশের সাকিব আল হাসান। তিনি এই পজিশনে মোট রানের অর্ধেকের বেশি রান করেছেন বাউন্ডারি থেকে। বর্তমানে তিনিও টপ-অর্ডারে ব্যাট করছেন এবং বেশ সফলতা লাভ করছেন। এতেই বোঝা যায় পাঁচ নাম্বারে নামা ব্যাটসম্যানদের সীমাবদ্ধতা।
৩.
বাউন্ডারি হাঁকাতে ব্যাটসম্যানদের বাড়তি ঝুঁকি নিতে হয়। কিন্তু স্টোকস নিজেকে এমনভাবে প্রস্তুত করেছেন যে, গত চার বছর ধরে বাউন্ডারি হাঁকাতে তার তেমন কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তিনি রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে খেলতে পারেন, চাপমুক্ত ব্যাটিং করতে পারেন, এবং প্রান্ত বদল করে ব্যাট করার ক্ষেত্রেও তিনি বেশ পারদর্শী। দলের বিপর্যয়ে বুক চিতিয়ে ব্যাট করতে পারেন, প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ঝুঁকি না নিয়েও বাউন্ডারি হাঁকাতে পারেন অনায়াসে।
বেন স্টোকস ২০১৫ সালের বিশ্বকাপের পর থেকে ৯৭.১০ স্ট্রাইকরেটে রান করেছেন। এর মধ্যে তার খেলা প্রথম ২০ বলে গড়ে তার স্ট্রাইকরেট ৮০ থেকে সামান্য উপরে। তার মানে, তিনি যদি ইনিংস বড় করতে পারেন, তাহলে শেষদিকে দ্রুত রান তুলতে পারেন। তিনি এমন একজন ব্যাটসম্যান, যিনি পরিস্থিতি অনুযায়ী তার ব্যাটিংয়ের গতি পরিবর্তন করতে পারেন। বিশেষ করে ব্রিস্টলের ঘটনার পর থেকে তার ব্যাটিংয়ে পরিপক্বতা এসেছে।
৪.
বেন স্টোকস ২০১৫ সালের বিশ্বকাপের পর থেকে ৪৬ ইনিংসে তিনটি শতক এবং ১২টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৫০.৭৭ ব্যাটিং গড়ে এবং ৯৩.২৬ স্ট্রাইকরেটে ১,৮২৮ রান সংগ্রহ করেছেন। এই সময়ে সব মিলিয়ে পাঁচ নাম্বারে নামা ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিং গড় ছিল ৩২.৯৭ এবং স্ট্রাইকরেট ছিল ৮৫.৪৩। স্টোকস অন্যান্য ব্যাটসম্যানদের চেয়ে গড়ে প্রায় ১৮ রান বেশি করেছেন, তার স্ট্রাইকরেটও আট বেশি।
রান তাড়ায় আরও দুর্দান্ত ব্যাটিং করেছেন তিনি। রান তাড়া করতে নেমে পাঁচ নাম্বারে মোট ২৫ ইনিংস ব্যাট করে একটি শতক এবং ছয়টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৬০.১৩ ব্যাটিং গড়ে ৯০২ রান করেছেন তিনি। উপমহাদেশের বাইরের ব্যাটসম্যানদের স্পিনারদের বিপক্ষে দুর্বলতা বেশ স্পষ্ট। স্টোকস যখন ব্যাট করতে নামেন, তখন স্পিনাররা তাদের হাত ঘোরাতে ব্যস্ত থাকেন। সেসময় ব্যাট করেও বেশ সফল স্টোকস। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিনি স্পিনারদের বিপক্ষেই বেশ সাবলীল। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপের পর থেকে পাঁচে ব্যাট করে ৬৫.৪৪ ব্যাটিং গড়ে এবং ৯৮.৭৪ স্ট্রাইকরেটে ৭৮৫ রান করেছেন।
তিনি পেসারদের বিপক্ষেও সফল ছিলেন। তাদের বিপক্ষে ৪৪.৬৪ ব্যাটিং গড়ে এবং ৯২.০০ স্ট্রাইকরেটে ১,১১৬ রান সংগ্রহ করেছিলেন। প্রথম ইনিংসে ব্যাটিং করে ৪৪.০৯ ব্যাটিং গড়ে এবং ৯০.৭৮ স্ট্রাইকরেটে ৯২৬ রান করেছিলেন। আর দ্বিতীয় ইনিংসে তার ব্যাটিংয়ে সাফল্যের কথা তো উপরেই বলা হয়েছে।
৫.
বেন স্টোকস ২০১৫ সালের বিশ্বকাপ পর্যন্ত ছিলেন একজন সাদামাটা ব্যাটসম্যান। এই সময়ে ২৪ ম্যাচে ১৫.৬৬ ব্যাটিং গড়ে মাত্র ২৮২ রান সংগ্রহ করেছিলেন তিনি। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপেও খেলা হয়নি তার। বিশ্বকাপের পরই বদলে যায় তার ক্যারিয়ার। এরপর থেকে মাত্র আটজন ব্যাটসম্যান ওয়ানডেতে ৪৭.৫০ ব্যাটিং গড়ের পাশাপাশি ৯৫+ স্ট্রাইকরেট বজায় রেখে ব্যাট করতে পেরেছিলেন, তাদের মধ্যে একজন বেন স্টোকস। মিডল-অর্ডার কিংবা লোয়ার মিডল-অর্ডারে ব্যাট করা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে এই তালিকায় তিনি ছাড়া নাম আছে মাত্র দুইজনের। এবি ডি ভিলিয়ার্স এবং জস বাটলার। স্টোকস এই সময়ে ৬১ ইনিংসে ব্যাট করে তিনটি শতক এবং ১৮টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৪৮.২৫ ব্যাটিং গড়ে এবং ৯৭.১০ স্ট্রাইকরেটে ২,৩১৬ রান সংগ্রহ করেছেন।
ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ২০১৯ সালের বিশ্বকাপেও তিনি বেশ সফল। এখন পর্যন্ত নয় ইনিংস ব্যাট করে চারটি অর্ধশতক হাঁকিয়ে ৫৪.৪২ ব্যাটিং গড়ে ৩৮১ রান সংগ্রহ করেছেন। পাঁচ নাম্বার ব্যাটিং পজিশনে ব্যাট করেছিলেন পাঁচবার, যার মধ্যে চার ইনিংসেই অর্ধশতক হাঁকিয়েছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে উদ্বোধনী ম্যাচে ইংল্যান্ডের যখন তিনশ’র নিচে আটকে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল, তখন তিনি ৭৯ বলে ৮৯ রান করে দলকে জয়ের পুঁজি এনে দিয়ে ম্যাচসেরার পুরস্কার জেতেন। এরপর শ্রীলঙ্কা এবং অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দলের বিপর্যয়ের সময় অপরাজিত ৮২ এবং ৮৯ রানের ইনিংস খেলে একাই লড়াই চালিয়ে যান। ভারতের বিপক্ষে বাঁচা-মরার লড়াইয়ে খেলেছিলেন ৫৪ বলে ৭৯ রানের ইনিংস। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের অপ্রতিরোধ্য একাদশে বেন স্টোকস গুরুত্বপূর্ণ একজন সদস্য, যিনি ব্যাট হাতে দুর্দান্ত পারফর্ম করার পাশাপাশি বোলিংয়ে এবং ফিল্ডিংয়েও দলের জয়ে ভূমিকা রাখেন।