
“বড় হওয়ার সময় আমি ফুটবল ম্যানেজারে (একটি জনপ্রিয় ভার্চুয়াল ফুটবল গেইম) বুঁদ হয়ে গিয়েছিলাম। আমি ও আমার ভাই গেইমটি একটানা খেলেই যেতাম। আমাদেরকে কোনো প্লেস্টেশন কিনে দেয়া হয়নি ছোটবেলায়। তাই আমরা আমাদের বাসার কম্পিউটারেই গেমটি খেলতাম। আমাদের কাজ ছিল একটি স্কোয়াড গড়ে তোলা। প্রথমে একটি দল নির্বাচন করো, এরপর দলের খেলোয়াড়দের অনুশীলন করাও। দলটি ঠিকঠাকমতো পরিচালিত হচ্ছে– এটা নিশ্চিত করো। দলের খুঁটিনাটি সব কিছুই তোমার নখদর্পণে থাকতে হবে। সেই সময় আমাদের কাছে এই গেইমের চেয়ে ভালো কিছুই ছিল না, এমনকি এটি শুধু একটি ভার্চুয়াল গেইম হওয়ার পরও!”
উপরের কথাগুলো উইল স্টিল নামের একজন কোচের। ইউরোপের ফুটবল সম্পর্কে সাম্প্রতিক খবরগুলো জানা থাকলে এই ব্যক্তির নাম নিশ্চিতভাবেই আপনি শুনেছেন। ফরাসি ক্লাব ‘রেইমস’-এর এই কোচের বয়স মাত্র ত্রিশ বছর! ক্লাবের স্কোয়াডে দুজন খেলোয়াড় রয়েছেন, যাদের বয়স কোচ উইল স্টিলের চেয়ে বেশি। এর মধ্যে অতিরিক্ত গোলকিপার নিকোলাস পেন্নেতাউয়ের বয়স বিয়াল্লিশ বছর। অর্থাৎ কোচের চেয়ে তিনি বারো বছরে বড়!
পেশাদার ফুটবলের কোচিংয়ের ক্ষেত্রে বয়স একটি বড় ব্যাপার। ইউরোপের শীর্ষ লীগগুলোতে সাধারণত যারা কোচিং করান, তারা বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দলে লম্বা সময় পার করে এরপর কোনো ছোট বা মাঝারি ক্লাবের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রত্যাশানুযায়ী ফলাফল দেখাতে পারলে এরপর বড় ক্লাবগুলো তাদের দিকে নজর দিতে শুরু করে। বড় ক্লাবে যেতে যেতে তাদের বয়স বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পঁয়তাল্লিশ ছুঁই ছুঁই করে বা পার হয়ে যায়। তবে অনেক ক্লাব বর্তমানে পারফর্মেন্সের উপর ভিত্তি করে তরুণ কোচ নিয়োগ দিতেও আগ্রহী হচ্ছে। যেমন- জার্মান ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখ যখন সদ্য সাবেক হওয়া কোচ ইউলিয়ান নাগেলসম্যানকে নিয়োগ দেয়, তখন তার বয়স ছিল মাত্র তেত্রিশ বছর!

খেলোয়াড় হিসেবে উইল স্টিলের যাত্রা মোটেও সুখকর ছিল না। ‘হোল্ডিং মিডফিল্ডার’ পজিশনে খেলতেন তিনি। তার ভাষায়, “আমি ছিলাম একজন হোল্ডিং মিডফিল্ডার। কিন্তু আমার মধ্যে মোটেও গতি ছিল না। আমি বোধহয় একশো মিটার দূরত্ব দশ দিনে পার করতাম।” বেলজিয়ামের বেশ কিছু নিচের সারির ক্লাবের বয়সভিত্তিক দলে উইল স্টিল খেললেও তিনি বুঝতে পেরেছিলেন খেলোয়াড় হিসেবে তিনি তেমন কোনো ক্যারিয়ার গড়তে পারবেন না। তারা বাবা-মা জাতিতে ব্রিটিশ হলেও তিনি জন্মেছিলেন বেলজিয়ামে। তবে মাঠে ফুটবল খেলায় পারদর্শী না হলেও তিনি কৈশোরেই ফুটবল ম্যানেজার গেইমে ঘন্টার পর ঘন্টা ব্যয় করতেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন, খেলাধুলায় ক্যারিয়ার না হলেও কোচ হিসেবে তার সম্ভাবনা আছে। তাই একসময় তিনি তার পিতৃভূমি ইংল্যান্ডে এসে মায়ার্সকফ কলেজে ব্যবস্থাপনা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। এর পাশাপাশি ইংলিশ ফুটবলের দ্বিতীয় সারির ক্লাব ‘প্রেস্টব নর্থ এন্ড’ এর অনূর্ধ্ব-১৪ দলের সহকারী কোচ হিসেবে তারা কোচিং ক্যারিয়ার শুরু হয়।
প্রেস্টন নর্থ এন্ডের পর তিনি কোনো মূল দলের দায়িত্ব পাবার জন্য আবার বেলজিয়ামে ফিরে যান। কিন্তু বার বার তাকে হতাশ হতে হয়। বয়স একেবারেই কম এবং মূল দল সামলানোর কোন অভিজ্ঞতা না থাকায় কেউই তাকে নিতে চাচ্ছিল না। শেষপর্যন্ত তিনি তার শৈশবের ক্লাব বেলজিয়ামে দ্বিতীয় স্তরের দল সিন্ট-ট্রুইডেনে নিয়োগ পান। সেখানে প্রথমদিকে তার কাজ ছিল বিপক্ষ দলের বিভিন্ন ভিডিও ক্লিপ বিশ্লেষণ করে মূল কোচের কাছে উপস্থাপন করা। তবে তার আগ্রহ ও দক্ষতার কারণে একসময় সিন্ট-ট্রুইডেনে সহকারী কোচ হিসেবে নতুন করে নিয়োগ দেয়া হয় তাকে। সিন্ট-ট্রুইডেন একপর্যায়ে বেলজিয়ামের সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত হয়। কিন্তু তার আগেই দলের মূল কোচ আরেক ক্লাব স্ট্যান্ডার্ড লিয়েগেতে চলে যান, উইং স্টিল তাকে অনুসরণ করেন। এরপর আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে যায়। তিনি যেসময় সহকারী কোচের দায়িত্ব পালন করছিলেন, তখন প্রত্যাশিত ফলাফল না পাওয়ার ক্লাবের মূল কোচকে বরখাস্ত করে তাদের মূল কোচ বানিয়ে দেয়া হয়, তা-ও মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে!

বেলজিয়ামে আরও কিছু ক্লাবে সফলতার পর ফ্রান্স ফুটবলের শীর্ষ স্তর লীগ ওয়ানে ক্লাব রেইমস তাকে তৎকালীন কোচ অস্কার গার্সিয়ার সহকারী হতে আহ্বান জানায়। এটি ছিল তার কোচিং ক্যারিয়ারের বিশাল এক মাইলফলক। এত কম বয়সে ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লীগের কোনো ক্লাব তাকে নিয়োগ দিতে আগ্রহ প্রকাশ করবে– এটি ছিল তার ধারণারও বাইরে। তিনি বিলম্ব না করে রেইমসের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। এরপর রেইমস একটি সাহসী পদক্ষেপ নেয়। ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে বাজে পারফর্মেন্সের জন্য রেইম মূল কোচ অস্কার গার্সিয়াকে বরখাস্ত করে। এরপর স্বয়ং ক্লাবের মালিক তাকে কল দেন, “হ্যালো উইল, এগুলো হচ্ছে তোমার সাথে ক্লাবের চুক্তির শর্তাবলি। আমরা তোমাকে ছাড়ছি না। আমরা চাই তুমি ক্লাবের দায়িত্ব গ্রহণ করো।” উইল স্টিলের রাজি না হয়ে উপায় ছিল না।
খেলোয়াড় হিসেবে উইল স্টিলের ক্যারিয়ার ছিল বেলজিয়ের চতুর্থ সারির কিছু দলের বয়সভিত্তিক দলে খেলা। কোচ হিসেবেও তার মূল অভিজ্ঞতা ছিল বেলজিয়ামের প্রথম ও দ্বিতীয় সারির কিছু দল সামলানো। মাত্র দশ বছর আগে যিনি একটি দ্বিতীয় সারির ক্লাবের অনূর্ধ্ব-১৪ দলের সহকারী কোচ ছিলেন, সেই উইল স্টিলই কিনা এখন প্যারিস সেইন্ট-জার্মেইনেরের নেইমার-মেসি-এমবাপ্পেদের বিপক্ষ দলের মূল কোচ হিসেবে মাঠে পা রাখবেন! উইল স্টিলের খেলোয়াড়ি জীবন না ছিল যতটা বিবর্ণ, তার কোচিং ক্যারিয়ারের উত্থান ছিল ততটাই বর্ণিল।

গেল বিশ্বকাপের আগে ছয় ম্যাচে তাকে দায়িত্ব দেয়া হয় পরীক্ষামূলকভাবে। রেইমস তখন রেলিগেশন জোনে বাঁচার লড়াইয়ে লিপ্ত ছিল। ধুঁকতে থাকা রেইমসের এই ছয় ম্যাচের দায়িত্ব সামলানোর সবগুলোতেই ক্লাবটি অপরাজিত ছিল। একেবারে শেষের দিক থেকে লীগ টেবিলে এগারোতম অবস্থানে উঠে আসে রেইমস। ক্লাবটির কর্মকর্তারা কোচ হিসেবে উইল স্টিলের এই নৈপুণ্যে যারপরনাই খুশি ছিলেন। এরপর উইলকে পূর্ণকালীন কোচ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। তবে একটি জায়গা সমস্যা ছিল। উইল স্টিলের কোনো পেশাদার কোচের লাইসেন্স ছিল না। উয়েফার নিয়ম হচ্ছে, কোচের লাইসেন্স না থাকলে প্রতি ম্যাচেই পঁচিশ হাজার ইউরো করে জরিমানা প্রদান করতে হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ক্লাবটির কর্মকর্তাদের প্রতি ম্যাচ শেষে এই জরিমানা প্রদান করতে কোনো আপত্তি নেই। রেইমসের অতি সাদামাটা স্কোয়াড নিয়েও যেভাবে উইল স্টিল দলটি পরিচালনা করছেন, তাতে ক্লাবটির কর্মকর্তারা ডাগআউটে অন্য কোনো কোচকে কল্পনা করতে পারছেন না।
কোচ উইল স্টিলের অধীনে ক্লাবটি কেমন করছে, তার একটি চিত্র দেখা যাক। এই মৌসুমে সব মিলিয়ে উইল স্টিলের অধীনে একুশ ম্যাচ খেলেছে ক্লাবটি। এর মধ্যে জয় পেয়েছে এগারো ম্যাচে, ড্র করেছে আট ম্যাচ, এবং হেরেছে মাত্র দুটি ম্যাচে। এই পরিসংখ্যান হয়তো ‘বিস্ময়কর’ নয়, কিন্তু রেইমসের স্কোয়াড বিবেচনায় এই পরিসংখ্যান যথেষ্ট ভালো। আর্সেনাল থেকে লোনে আসা তরুণ স্ট্রাইকার ফোলারিন বালোগান সতেরটি গোল প্রতিপক্ষের জালে জড়িয়ে লীগের সর্বোচ্চ গোল সংগ্রাহকদের তালিকায় চার নম্বরে রয়েছেন। গত ২৯ জানুয়ারির ম্যাচে তারকায় ঠাসা প্যারিস সেইন্ট-জার্মেইনের বিপক্ষে লীগের ম্যাচে তাদের মাঠ থেকে পয়েন্ট নিয়ে ফিরেছেন। দলের স্ট্রাইকার ফোলারিন বালোগান একেবারে শেষ মুহুর্তে গোল করে এক পয়েন্ট নিশ্চিত করেছিলেন। এরপরই ত্রিশ বছর বয়সী উইল স্টিলকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। উইল স্টিল কতদূর যাবেন, তা সময়ই বলে দেবে। কিন্তু একেবারে সাদামাটা একটি স্কোয়াড নিয়ে তার দারুণ পথচলা নিয়ে নিশ্চয়ই আলোচনা হবে অনেকদিন।