১০ জুলাই, ২০১৬
ঘরের মাঠে ইউরো ফাইনালে পর্তুগালের মুখোমুখি ফ্রান্স। পুরো টুর্নামেন্টে দাপুটে খেলা উপহার দেওয়া ফরাসিরা খর্বশক্তির পর্তুগালকে হেসেখেলে হারিয়ে ইউরোর ট্রফিটা নিজেদের ঘরে রেখে দেবে সেই প্রত্যাশায় পুরো স্টেডিয়াম কানায় কানায় ভর্তি ছিল সেদিন। কিন্তু হায়! এডারের সেই গোলে ঘরের মাঠে পর্তুগালের কাছে হেরে যায় ফ্রান্স! পুরো টুর্নামেন্টে অসাধারণ ফুটবল খেলা ফ্রান্স শিরোপার এত কাছে এসেও খালি হাতেই ফিরে যায় সেদিন। প্রিয় দলের এমন হারে সেদিন স্টেডিয়ামে উপস্থিত প্রায় ৭৬ হাজার দর্শককে এক বুক যন্ত্রণা নিয়েই বাড়ি ফিরতে হয়।
সেই ট্র্যাজেডির ২ বছর ৫ দিন পর মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে আরেক ফাইনালে ক্রোয়েশিয়ার মুখোমুখি হয় ফ্রান্স। এবারের মঞ্চটা আরো বিশাল, দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ খ্যাত বিশ্বকাপ জয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে দুই বছর আগের ট্র্যাজেডির কথা ফ্রান্সের খেলোয়াড়দের নিশ্চয়ই মনে পড়ছিলো। ভক্তদের মনেও হয়তো আশঙ্কার কালো মেঘ উঁকি দিচ্ছিলো, সেদিনের মতো এদিনের প্রতিপক্ষও যে ছিল এক আন্ডারডগ দল! নাহ, এবার আর ফরাসিদের স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় নীল হতে হয়নি। ক্রোয়েশিয়াকে ৪-২ গোলে হারিয়ে দ্বিতীয়বারের মতোন বিশ্বজয়ের সাথে দুই বছর আগে ঘরের মাঠে ইউরো ফাইনাল হারের শাপমোচনটাও পূরণ করলো ফ্রান্স।
ফাইনালের আগে শক্তিমত্তা বিচার করলে প্রতিপক্ষ ক্রোয়েশিয়ার চেয়ে সবদিক থেকেই এগিয়ে ছিল ফ্রান্স। তাছাড়া ফ্রান্সের ফাইনালে ওঠার পথটাও বেশ বন্ধুর ছিল। আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, বেলজিয়ামের মতো প্রতিপক্ষকে হারানোয় ফরাসিরা যে আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণ থাকবে তা আগে থেকেই বলা হচ্ছিলো। অন্যদিকে দলীয় শক্তির দিক থেকে ক্রোয়েশিয়া বেশ পিছিয়েই ছিল। বিশ্বকাপ শুরুর আগে ক্রোয়েশিয়ার বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলার কথা বললে অধিকাংশ দর্শকই সেই কথাকে হেসে উড়িয়ে দিতো। কিন্তু অদম্য মানসিক শক্তি ও দলগত সমন্বয়ের মাধ্যমে সেই অসম্ভবকেই সম্ভব করেছিলো ক্রোয়াটরা। নকআউট পর্বে বারবার পিছিয়ে পড়েও ক্রোয়াটরা যেভাবে ফিরে আসার ইতিহাস তৈরি করেছিলো তাতে ফাইনালে ফ্রান্সের চেয়ে দলীয় শক্তিতে পিছিয়ে থাকলেও তাদের খাটো করে দেখার কোনো উপায় ছিল না।
দুই দলই সেমিফাইনালের একাদশ অপরিবর্তিত রেখে সেই একাদশকেই ফাইনালের মঞ্চে নামান। ফরাসি কোচ দিদিয়ের দেশম আগের ম্যাচগুলোর মতো এ ম্যাচেও দলকে ৪-২-৩-১ ফর্মেশনে খেলানোর সিদ্ধান্ত নেন। ক্রোয়াট কোচ দালিচের ফর্মেশনও ছিল ৪-২-৩-১। খেলার শুরু থেকেই ফ্রান্সের উপর চড়াও হয়ে খেলতে থাকে ক্রোয়েশিয়া। এতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু ছিল না কারণ যারা এই বিশ্বকাপে ফ্রান্সের খেলা দেখেছেন তারা মোটামুটি সবাই জানেন যে এই ফ্রান্স ধীরেসুস্থে নিজেদের কাজ করতে বিশ্বাসী। প্রায় প্রতি ম্যাচেই দেখা গিয়েছে যে প্রতিপক্ষ শুরুতে ফ্রান্সের বিপক্ষে আক্রমণের ফোয়ারা সাজালেও পরে ফ্রান্স ঠিকই পাল্টা আক্রমণের বিষে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে খেলায় ফিরে এসেছে। তাই ধারণা করা হচ্ছিলো এ ম্যাচেও এমন কিছু হবে।
কিন্তু পুরো টুর্নামেন্টে অসাধারণ ফুটবল খেলা ফরাসি হোল্ডিং মিডফিল্ডার এনগোলো কান্তে নিজের স্বাভাবিক খেলাটা খেলতে না পারায় সময় যাওয়ার সাথে কিছুতেই নিজেদের ফিরে পাচ্ছিলো না ফ্রান্স। কান্তের বাজে পাসিংয়ের সুযোগ নিয়ে খেলার প্রথম ১৫ মিনিটে টানা আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিলো ক্রোয়েশিয়া। কিন্তু ভারানে-উমতিতিদের অসাধারণ রক্ষণ দৃঢ়তায় ক্রোয়াটরা ডি-বক্সে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলছিলো। কিন্তু ধারার বিপরীত দিক থেকে উল্টো ফ্রান্সই গোল পেয়ে যায়। ১৮ মিনিটে গ্রিজম্যানের নেওয়া ফ্রি-কিক হেড করে ক্লিয়ার করতে গিয়ে উল্টো নিজেদের জালে বল জড়িয়ে দেন মারিও মানজুকিচ! বিশ্বকাপ ফাইনালের ইতিহাসে প্রথম আত্মঘাতী গোল করার এক লজ্জাজনক রেকর্ডের মালিক বনে যান এই ক্রোয়াট স্ট্রাইকার।
এরকরম দুর্ভাগ্যজনক গোল খেয়েও ক্রোয়েশিয়া দমে যায়নি, আগের মতোই টানা আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিলো তারা। সেটার ফলও পেয়ে যায় তারা, ২৮ মিনিটে ইভান পেরিসিচের বাঁ পায়ের অসাধারণ এক শটে খেলায় ১-১ গোলে সমতা ফিরে আসে। কিন্তু এই সমতা খুব বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারেনি ক্রোয়েশিয়া। গ্রিজম্যানের নেওয়া কর্ণারে মাতুইদির হেডার ইভান পেরিসিচের হাতে লাগলে পেনাল্টি পায় ফ্রান্স। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস। যে পেরিসিচের গোলে ক্রোয়েশিয়া খেলায় ফিরেছিলো সেই পেরিসিচের ভুলেই প্রতিপক্ষ ফ্রান্স আবারো এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে যায়। আঁতোয়ান গ্রিজম্যান সেই সুযোগ মিস করেননি। ৩৮ মিনিটে তার নেওয়া পেনাল্টিতে গোল পেয়েই ২-১ গোলে এগিয়ে যায় ফ্রান্স। ফ্রান্সের ২-১ গোলে এগিয়ে থাকার মাধ্যমেই প্রথমার্ধ শেষ হয়।
দ্বিতীয়ার্ধে সমতা ফেরাতে নিজেদের সব শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্রোয়েশিয়া। ৪৮ মিনিটে সেই লক্ষ্যে পৌঁছেও যেতে পারতো। কিন্তু রেবিচের নেওয়া শট ফরাসি গোলকিপার হুগো লরিস অসাধারণ দক্ষতায় ফিরিয়ে দিলে ক্রোয়েশিয়ার সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। খেলায় ক্রোয়েশিয়ার এমন দাপট দেখে পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নিলেন ফরাসি কোচ দেশম। পুরো ম্যাচে নিজের ছায়া হয়ে থাকা কান্তেকে উঠিয়ে এনযনযিকে নামান দেশম। কান্তের মতোন খেলোয়াড়কে উঠিয়ে দেওয়ায় অনেকেই অবাক হলেও দেশমের এই পরিবর্তনটা জাদুর মতোই কাজ করে। ৫৯ মিনিটে ডান প্রান্ত দিয়ে দারুনভাবে বল নিয়ে ক্রোয়েশিয়া রক্ষণভাগে ঢুকে যান এমবাপ্পে, তার দেওয়া ক্রস গ্রিজম্যানের কাছে চলে আসে। গ্রিজম্যান সেই বল বাড়িয়ে দেন পগবার দিকে, পেনাল্টি বক্সের বাইরে থেকেই শট করেন পগবা। প্রথম শট ক্রোয়েশিয়ার খেলোয়াড়দের গায়ে লেগে ফিরে আসলে ফিরতি বলে তৎক্ষণাৎ আবার শট মারেন পগবা।পগবার সেই বুলেট শট ঠেকানোর ক্ষমতা ক্রোয়েশিয়ার গোলরক্ষক সুবাসিচের ছিল না। ৩-১ গোলে এগিয়ে গিয়ে শিরোপার আরো কাছে চলে যায় ফ্রান্স।
পগবার গোল যদি ফরাসিদের শিরোপার কাছে নিয়ে থাকে তবে সেই শিরোপাজয় নিশ্চিত করার কৃতিত্বটা পাবেন এমবাপ্পে। লুকাস হার্নান্দেজের পাস থেকে দূরপাল্লার এক শটে অসাধারণ এক গোল করে ফ্রান্সকে ৪-১ গোলে এগিয়ে নেন কিলিয়ান এমবাপ্পে। এই গোলের ফলে পেলের পর দ্বিতীয় টিনেজার হিসেবে বিশ্বকাপ ফাইনালে গোল করার কৃতিত্ব গড়লেন এমবাপ্পে। এমবাপ্পের এই গোলের পর আক্ষরিক অর্থেই ফ্রান্সের বিশ্বজয় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলো, চার মিনিট পর লরিসের হাস্যকর ভুলে মানজুকিচের করা গোলেও সেই অনিশ্চয়তার দেয়ালে ফাটল ধরাতে পারেনি। বাকি সময় নিজেদের সহজাত ফুটবল খেলে রক্ষণভাগটা সামলে রেখে ৪-২ গোলের জয়ে ২০ বছর পর আবারো বিশ্বচ্যাম্পিয়নের মুকুট অর্জন করে ফ্রান্স।
ইতিহাস গড়ার এত কাছে এসেও এভাবে হেরে যাওয়াটা ক্রোয়েশিয়ার জন্য মেনে নেওয়া সত্যিই খুব কষ্টকর। পুরো ম্যাচের পরিসংখ্যান যদি আমরা দেখি তাহলে দেখা যাবে যে বল দখলের লড়াইয়ে ফ্রান্সের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে ছিল ক্রোয়েশিয়া। নিজেদের দখলে ৬৬% সময় বলের দখল রেখেছিলো ক্রোয়েশিয়া, শুরুর পনেরো মিনিটে তাদের দাপটটাও ছিল দেখার মতোন। কিন্তু ক্রোয়েশিয়া আসলে নিজেদের ভুলেই মার খেয়ে গিয়েছে, মানজুকিচের অমন আত্মঘাতী গোলের পর তা-ও ক্রোয়েশিয়া আবার খেলায় ফিরেছিলো।
কিন্তু পেরিসিচের হ্যান্ডবলটা ক্রোয়েশিয়ার জন্য বড় একটা ধাক্কা হয়েই আসে। আসলে এতবড় একটা ম্যাচ খেলার চাপ ক্রোয়েশিয়ার অনেক খেলোয়াড়েরাই নিতে পারেননি যেটা তাদের খেলা দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো। দ্বিতীয়ার্ধে ক্রোয়েশিয়াকে দেখে ভীষণ ক্লান্ত লাগছিলো। টানা তিন ম্যাচে ১২০ মিনিট লড়াইয়ের পর এই ক্লান্তিটা অস্বাভাবিক নয়। তবে ফলাফল যা-ই হোক, বিশ্বকাপ ফাইনালে উঠে নতুন ইতিহাস গড়ায় মাথা উঁচু করেই দেশে ফিরতে পারবে মদ্রিচরা। তাছাড়া লুকা মদ্রিচ গোল্ডেন বলের পুরস্কার জেতায় ক্রোয়েশিয়ার অর্জনের খাতায় আরেকটা পালকও যুক্ত হয়েছে।
অন্যদিকে এবারের চ্যাম্পিয়ন দল ফ্রান্সের প্রশংসা যতই করা হোক হয়তো সেটা যথেষ্ট হবে না। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে সমালোচকরা এই ফ্রান্স দলের নানা ধরনের খুঁত ধরায় ব্যস্ত ছিল। এই দলের অভিজ্ঞতা নেই, এই দল ইউরো ফাইনালে চোক করেছিলো – এই ধরনের নানা কথা ফ্রান্স দলকে নিয়ে বলা হয়েছিলো। আর কোচ দিদিয়ের দেশমকে নিয়ে সমালোচনার মাত্রা তো আরো এক ধাপ উপরে ছিল। কিছু লোক পারলে বিশ্বকাপের এক মাস আগে দেশমকে সরিয়ে নতুন কাউকে নিয়োগ দিয়ে ফেলে! কিন্তু দেশম এসব সমালোচনায় কান না দিয়ে নিজের কাজটা ঠিকভাবে করে গিয়েছেন।
টুর্নামেন্টে ফ্রান্সের জয়ের ধারা অব্যাহত থাকলেও কিছুটা রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলায় অনেকেই ফ্রান্সের সমালোচনা করছিলো। কিন্তু দেশম নিজের কৌশল থেকে সরে আসেননি। তিনি জানতেন, যদি রক্ষণভাগটা ঠিকভাবে সামলাতে পারেন তাহলে পাল্টা আক্রমণে গ্রিজম্যান-এমবাপ্পে-পগবারা ঠিকই গোল আদায় করতে পারবে। আর ঠিক সেটাই হয়েছে। এ কারণেই মাত্র ৩৪ ভাগ সময় বলের দখল থাকলেও ফাইনালে জয়ী দলের নামটা কিন্তু ফ্রান্সই। ১৯৯৮ সালে অধিনায়ক হিসেবে বিশ্বজয়ের পর এবার কোচ হিসেবে বিশ্বকাপ জিতে বেকেনবাওয়ারের পাশে নিজের নামটা স্বর্ণাক্ষরে লিখলেন দিদিয়ের দেশম।
এই বিশ্বকাপজয় শুধুমাত্র আগামী চার বছরের জন্যই নয়, হয়তো আরো দীর্ঘ সময়ের জন্যে ফুটবলে ফরাসিদের সুসময়ের ভিত গড়ে দিয়ে গেলো। ফ্রান্সের এবারের দলের অধিকাংশ খেলোয়াড়েরাই তরুণ, তারা আগামী বিশ্বকাপে আরো পরিণত হয়ে আসবে। কিলিয়ান এমবাপ্পে ১৯ বছর বয়সেই যে দাপট দেখালেন, চার বছর পর আরো শাণিত হয়ে এসে তিনি কতটা ভয়ঙ্কর হবেন তা কি অনুমান করতে পারছেন? তাই আগামী বেশ কিছু বছর ফুটবলের এই রঙ্গমঞ্চে ফরাসি শিল্পীদের একচ্ছত্র দাপট দেখলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আচ্ছা, ভবিষ্যতটা নাহয় আগামীর জন্যই তোলা থাক, আজকের দিনটা দ্বিতীয়বারের মতোন বিশ্বকাপ জিতে উরুগুয়ে, আর্জেন্টিনার পাশে নাম লেখানো ফ্রান্সকে অভিনন্দন জানানোর জন্যই নাহয় বরাদ্দ থাক।
ফিচার ইমেজ : The Independent