
১৯৬৬ সালের ১৩ ডিসেম্বর এক সকালে মুম্বাইয়ের ব্রাবোর্ন স্টেডিয়ামে ব্যাট হাতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে প্রথম টেস্ট ক্রিকেট খেলতে নামেন ভারি রিমের চশমা পরা এক ক্রিকেটার; নাম ক্লাইভ রবার্ট লয়েড, যার দৃপ্ত পদচারণায় পরবর্তী কয়েক দশক ক্রিকেট বিশ্ব মজেছিল। একাধারে মুগ্ধতা ছড়ায় তার ব্যাটিং প্রতিভা ও ক্রিকেট মাঠে তার অসাধারণ ব্যক্তিত্ব।
৬ ফুট ৬ ইঞ্চি লম্বা এই ছিপছিপে তরুণ বাঁহাতি ব্যাটসম্যানটি ভারতের বিরুদ্ধে জীবনের প্রথম টেস্ট খেলতে নেমে ইনিংসের শুরুতেই ক্যাচ দিলেন স্লিপে দাঁড়ানো অজিত ওয়াড়েকারের হাতে। স্নিকটি মুঠোর ধরে রাখতে পারেননি ওয়াড়েকার। বল গড়িয়ে পড়লো মাটিতে। ধুলো থেকেই উঠে দাঁড়ালেন লয়েড। খেললেন ৮২ রানের এক অনবদ্য ইনিংস। শুধু প্রথম ইনিংসেই নয়, দ্বিতীয় ইনিংসেও খেললেন ৭৮ রানের এক ম্যাচজয়ী ইনিংস। সেই টেস্টে ঐ নতুন যুবার খেলা দেখে অনেক ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরই বুঝতে কোনো অসুবিধা হয়নি যে ক্রিকেটে এক নতুন প্রতিভার আগমন ঘটেছে। সে শুধু কয়েকটি টেস্ট খেলার জন্যই আসেনি, ক্রিকেট বিশ্ব দেখেছে পরবর্তী দুই দশক ক্রিকেট বিশ্বে কীভাবে দাপটের সঙ্গে রাজত্ব করেছেন এই অসাধারণ ক্রিকেটার। কেবল ব্যাটিংয়েই নয়, বোলিং, ফিল্ডিং, এমনকি অধিনায়ক হিসেবেও তিনি রেখে গেছেন তার অনন্য প্রতিভার স্বাক্ষর।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের বাঁহাতি ব্যাটসম্যান ক্লাইভ লয়েড; Source: Pinterest
লয়েডের জন্ম ১৯৪৪ সালের ৩১ আগস্ট গায়ানার জর্জ টাউনে। ১৯ বছর বয়সে তার ক্রিকেট জীবনের শুরু। ১৯৬৭ সালে ল্যাঙ্কাশায়ার লীগে হ্যাসিংডনের হয়ে প্রথম পেশাদার লীগে পদার্পণ ঘটে লয়েডের। তার ক্রিকেট প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে ওয়ারউইকশায়ার এবং ল্যাঙ্কাশায়ার উভয় দলই তাকে দলে নেয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়ে। তবে জয়ী হয় ল্যাঙ্কাশায়ার। ১৯৬৮ সালে ল্যাঙ্কাশায়ারের হয়ে খেলার জন্য চুক্তিবদ্ধ হন লয়েড। তিনি ছিলেন মূলত মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান এবং পয়েন্ট ফিল্ডার। ১৯৬৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ত্রিনিদাদে অনুষ্ঠিত ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট ম্যাচে লয়েড করেন তার প্রথম টেস্ট শতক।

দুরন্ত ফিল্ডার ক্লাইভ লয়েড; Source: The Maitland Mercury
১৯৭৪ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিনায়ক নির্বাচিত হন লয়েড। অধিনায়ক হিসেবে প্রথম পা রাখেন ভারতের মাটিতে। অধিনায়কত্বে অভিষিক্ত হয়েই লয়েড ব্যাঙ্গালোরে সেঞ্চুরি করলেন। সিরিজের শেষ টেস্টে করলেন তার টেস্ট জীবনের সর্বোচ্চ স্কোর ২৪২। বলা বাহুল্য, নতুন অধিনায়কের পক্ষে এ যেন এক স্বপ্নময় সূচনা।
১৯৭৪ সালে অধিনায়ক হিসেবে যোগদানের পর থেকে পরবর্তী দশ বছর দায়িত্ব এবং দক্ষতায় ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেটারদের প্রতিনিয়ত উদ্বুদ্ধ করে গেছেন লয়েড। বয়স যত বেড়েছে, ততই বেড়েছে তার ব্যাটিং গড়। ১৯৭৫ এবং ১৯৭৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রুডেনশিয়াল কাপ জয়ের ঘটনায় লয়েডের অবদান ছিল অনেকখানি।

১৯৭৫, ১৯৭৯ এবং ১৯৮৩ সালের অধিনায়ক হিসেবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের নেতৃত্ব দেয়া ক্লাইভ লয়েড ; Source: Getty Images
১৯৭৫ এর প্রুডেনশিয়াল কাপে ক্লাইভ লয়েড ছিলেন তার সেরা ফর্মে। তিনটি ম্যাচে ব্যাট হাতে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে খুব একটা কিছু করতে না পারলেও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে খেলেন ৫৩ রানের একটি ইনিংস। আর ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে তার অধিনায়কোচিত ইনিংসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রথম বিশ্বকাপেই জিততে সক্ষম হয়। মাত্র ৮৫ বলে ১২ চার ও ২ ছক্কায় সাজানো তার দৃষ্টিনন্দন ১০২ রানের ইনিংসে ভর করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ২৯২ রানের বিশাল টার্গেট ছুঁড়ে দিতে সক্ষম হয়। তার অসাধারণ সব স্ট্রোক আর পুলে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন ডেনিস লিলির মতো অজি বোলাররা। এই শতকটিই ছিল লয়েডের একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে করা প্রথম এবং একমাত্র শতক।

১৯৭৫ সালের বিশ্বকাপে জয়ী দলের অধিনায়ক হিসেবে কাপ হাতে ক্লাইভ লয়েড; Source: Guyanese Online
২৯২ রানের লক্ষ্যে তাড়া করতে নেমে অস্ট্রেলিয়া সব উইকেট হারিয়ে ২৭৪ রান করতে সমর্থ হয়। ক্লাইভ লয়েড তার ডানহাতি মিডিয়াম পেস বোলিংয়ে অজি ব্যাটসম্যানদের আটকে রাখতে সক্ষম হন। তখনকার ৬০ ওভারের খেলায় লয়েড ১২ ওভারের পুরো কোটা বল করে মাত্র ৩৮ রান দিয়ে ১ উইকেট লাভ করেন এবং তার অসাধারণ ফ্লিডিংয়ে ইয়ান চ্যাপেলের মতো সেট ব্যাটসম্যানকে রান আউট করেন। তাই ফাইনালে ম্যান অব দ্য ফাইনাল বেছে নিতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি নির্বাচকদের। প্রথম বিশ্বকাপের ম্যান অব দ্য ফাইনালের মুকুট লাভ করেন ক্লাইভ লয়েড। তবে ১৯৭৯ এর বিশ্বকাপে লয়েড তেমন কোনো কার্যকর ইনিংস না খেললেও তার স্বভাবসুলভ অধিনায়কত্বে এবং অসাধারণ সব বোলার ও ব্যাটসম্যানের কল্যাণে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ জিততে সক্ষম হয়।

১৯৭৯ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে ইংল্যান্ডকে পরাজিত করে জয়ী দলের অধিনায়ক হিসেবে কাপ হাতে ক্লাইভ লয়েড; Source: Skysports.com
এই লয়েডের নেতৃত্বেই ১৯৮৩ সালে তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কিন্তু ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ছিটকে যায় কপিল দেবের ভারতের কাছে। ঘটনাটি লয়েডকে এতোটাই দুঃখ দেয় যে তিনি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের নেতৃত্ব থেকে ছুটি চেয়েছিলেন। কিন্তু লয়েড নামক ক্রিকেটারের প্রতি আস্থা হারায়নি ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড। তার রয়েছে যথাযথ কারণও। লয়েডের প্রচন্ড ব্যক্তিত্ব, সীমাহীন গাম্ভীর্য দলের মধ্যে বেচাল কিছু ঘটার সুযোগ দেয়নি কখনও। ক্রিকেটারদের মধ্যে চাপা অসন্তোষ কিংবা ব্যক্তিত্বের লড়াইয়ে কখনও ভুগতে হয়নি ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। শুধু ওয়েস্ট ইন্ডিজেরই নয়, সেসময়ে ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে বেশিবার অধিনায়কত্ব করার বিশ্বরেকর্ড, সাত হাজার রান, শতাধিক টেস্ট খেলার কৃতিত্ব এবং দু-দু’বার ওয়ার্ল্ড কাপ জেতার গৌরব অর্জন করেন লয়েড।

ধৈর্যশীল এবং ক্ষুরধার ক্রিকেট মস্তিষ্ক ক্লাইভ লয়েড; Source: Getty Images
১৯৮১ এর ডিসেম্বর থেকে ১৯৮৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত একটানা ২৭টি টেস্টে অপরাজিত থাকার অবিশ্বাস্য কৃতিত্বের পেছনে লয়েডের ক্রিকেট মস্তিষ্ক এবং তার অসাধারণ ব্যাটিং প্রতিভার দ্যুতি সমভাবেই ছিল। ১৯৮৪ সালে পুনরায় লয়েডকে দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হলো ভারত সফরে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের উন্মাদ আক্রমণে বিশ্বকাপ জয়ী ভারত সবকটি একদিনের ম্যাচে তো হারলোই, টেস্ট সিরিজও খোয়ালো ০-৩ ব্যবধানে। বিশ্বকাপে পরাজয়ের বদলা নিলেন লয়েড।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের অসাধারণ ব্যাটিং প্রতিভা ক্লাইভ লয়েড; Source: Under The Lid
আন্তর্জাতিক ম্যাচের পাশাপাশি কাউন্টি ক্রিকেটেও লয়েড তার ক্রিকেট প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। ১৯৭৮ সালে তিনি ল্যাঙ্কাশায়ারের হয়ে গ্লুচেস্টারশায়ারের বিরুদ্ধে একটি একদিনের ম্যাচ খেলতে নেমেছিলেন। গ্লুচেস্টারশায়ার প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ২৬৭ রানের বড় স্কোর তোলে। ল্যাঙ্কাশায়ারের হয়ে লয়েড যখন ব্যাট করতে নামেন, তখন দলের স্কোর ৩ উইকেটে ৩৩ রান। গ্লুচেস্টারশায়ারের বোলার মাইক প্রক্টরের একটি বল লয়েড মিস শট খেলেন। ফলে বল ব্যাটের কানায় লেগে ছয় হয়ে যায়। প্রক্টর খেপে গিয়ে লয়েডকে কিছু কটু কথা বলেন। শান্ত স্বভাবের লয়েড ক্ষিপ্ত হয়ে যান প্রক্টরের কথায়। তার ফল হলো মারাত্মক। প্রক্টরের পরের বলে প্যাভিলিয়নের উপর দিয়ে ছক্কা হাঁকান লয়েডে। যে প্রক্টরকে খেলতে অন্যরা হিমশিম খাচ্ছিল, সেসময় সেই তাকেই অবলীলায় বলে-কয়ে ছক্কা মারেন লয়েড। এমনই ব্যাটিং প্রভার অধিকারী ছিলেন তিনি।

বোলারদের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন ক্লাইভ লয়েড; Source: Getty Images
লয়েড ৭৪টি টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের অধিনায়কত্ব করেছেন। একসময় তার নেতৃত্বে একটানা ১০টি টেস্ট জয়ের বিশ্ব রেকর্ড গড়েছিলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ১৯৮৪’র ৩০ ডিসেম্বরে ক্লাইভ লয়েড তার জীবনের শেষ টেস্টটি খেলেন অস্ট্রেলিয়ার বিরদ্ধে। সেই টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে অস্ট্রেলিয়ান ফাস্ট বোলার ম্যাকডারমটের বলে আউট হওয়ার আগে ৭২ রানের এক অনবদ্য ইনিংস খেলেন। শেষ একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ১৯৮৫ সালে। সেই ম্যাচে ২৫ রানে মুদাসসর নজরের বলে আউট হন।

ক্রিকেট থেকে অবসর নেয়ার পর আইসিসির ম্যাচ রেফারির দায়িত্ব পালন করা ক্লাইভ লয়েড; Source: Sportskeeda.com
লয়েড তার ক্রিকেট জীবনে ১১০টি টেস্ট খেলেছেন। ৪৬.৬৮ গড়ে রান করেছেন ৭,৫১৫, যার মধ্যে সেঞ্চুরির সংখ্যা ১৯টি। অপরাজিত ছিলেন ১৪ বার, সর্বোচ্চ রান ২৪২। তিনি টেস্ট ক্রিকেটে ১৪ তম ব্যাটসম্যান, যিনি তার টেস্ট ক্যারিয়ারে ৭০টি ছক্কা মেরেছেন। আর ৮৭টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেন ৩৯.৫৪ গড়ে রান করেন ১,৯৭৭।
তার ব্যাটিং প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে প্রখ্যাত সাংবাদিক জন আরলট বলেছিলেন, “A stroke of a man knocking a thistle top with a walking stick“। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ১৯৭৫ আর ১৯৭৯ বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক বলেই নয়, একজন দুরন্ত ক্রিকেটার হিসেবে তার নাম ক্রিকেট ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে।