[রিভিউ নেওয়ার ক্ষেত্রে মহেন্দ্র সিং ধোনির সুনাম সর্বজনবিদিত, ডিআরএসকে তো অনেকেই ডাকেন ‘ধোনি রিভিউ সিস্টেম’ বলে। সত্যিই কি তাই? ক্রিকভিজের পরিসংখ্যান আর অভিষেক মুখার্জীর উইসডেনের লেখাটা যে ভিন্ন কথা বলছে!]
আইপিএল ২০২৩ এর ৩৭তম ম্যাচ। রাজস্থান রয়্যালসের মুখোমুখি হয়েছিল চেন্নাই সুপার কিংস।
রাজস্থানের দুই ওপেনার যশস্বী জয়সওয়াল আর জস বাটলার ইনিংসের দারুণ শুরু এনে দিয়েছিলেন। প্রথম তিন ওভারেই তাঁরা তুলে ফেলেছিলেন ৪২ রান। উইকেটের খোঁজে থাকা অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি এরপরই বোলার তুষার দেশপান্ডেকে সরিয়ে আক্রমণে আনলেন শ্রীলঙ্কান ডানহাতি অফ স্পিনার মাহিশ থিকসানাকে। ঐ ওভারের প্রথম বলে সিঙ্গেল পেলেন জস বাটলার। দ্বিতীয় বলটা জয়সওয়ালের প্যাডে আলতো ছুঁয়ে চলে গেল শর্ট ফাইন লেগের দিকে। ডট বল। তৃতীয় বলে সুইপ করার চেষ্টা করলেন জয়সওয়াল, মিস করলেন। বলটা আবারও আঘাত হানলো তাঁর প্যাডে, চেন্নাই সুপার কিংসের ফিল্ডাররা সমস্বরে আবেদন করলেন। মাঠের আম্পায়ার সিদ্ধান্ত জানালেন “নট আউট”, অধিনায়ক ধোনি শরণাপন্ন হলেন থার্ড আম্পায়ারের।
টেলিভিশন রিপ্লেতে দেখা গেল, বাঁহাতি জয়সওয়ালের বিরুদ্ধে থিকসানার বলটা পিচ করেছিল লেগ স্ট্যাম্পের বাইরে। স্বাভাবিকভাবেই আম্পায়ার আর বলের গতিপথ দেখার প্রয়োজন মনে করলেন না।
তবে ধোনিকে এমন ভুল রিভিউ নিতে দেখে ধারাভাষ্যকক্ষে ভীষণ অবাক হয়েছিলেন সুনীল গাভাস্কার। সত্যিই তো, শুধু গাভাস্কার কেন, মহেন্দ্র সিং ধোনি রিভিউ নিবেন আর সেটা সঠিক হবে না, এমন ধারণা পোষণকারীর সংখ্যা তো হাতেগোনা। ডিআরএস বলতে তো ‘ধোনি রিভিউ সিস্টেম’ও বোঝানো হয়!
এবার একটু ক্রিকভিজের পরিসংখ্যান দেখা যাক। ডিআরএস ব্যবহৃত হয়েছে, এমন যতগুলো ম্যাচের পরিসংখ্যান পাওয়া যায়, তাতে দেখা যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক এবং ঘরোয়া ক্রিকেট মিলিয়ে সব ফরম্যাটে মোট ১১২ জন অধিনায়ক অন্তত একবার রিভিউ ব্যবহার করেছেন। এক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো, দ্বিপক্ষীয় সিরিজে ভারত পুরোদমে ডিআরএস ব্যবহার শুরু করেছে ২০১৬ সালে। ঐ বছরেই ধোনির আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সীমিত ওভারের ফরম্যাটে অধিনায়কত্বের সমাপ্তি ঘটে, টেস্ট থেকে সরে গিয়েছিলেন আরো আগেই।
যাই হোক, এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, রিভিউ নিয়ে সাধারণত ৪০ শতাংশ ক্ষেত্রে সফল হয়েছেন অধিনায়কেরা।
আরো দেখা যাচ্ছে, ১১২ জনের মধ্যে অন্তত ২০ বার রিভিউ নিয়েছেন ৪১ জন অধিনায়ক। তাদের ক্ষেত্রেও সফলতার হারটা ঐ ৪০ শতাংশের কাছাকাছিই। তাই ম্যাচ প্র্যাকটিসই যে আপনার ডিআরএস নেওয়ার ক্ষেত্রে সফলতার চাবিকাঠি, এমনটা জোর দিয়ে বলার সুযোগ নেই।
সর্বোচ্চ রিভিউ নেওয়া অধিনায়কদের মধ্যে সবার উপরে রয়েছেন বাবর আজম, ১৭২ বার তিনি গেছেন তৃতীয় আম্পায়ারের কাছে। এরপরই রয়েছেন জো রুট (১৬২), বিরাট কোহলি (১৪৪), দিমুথ করুণারত্নে (১২৪), এবং কেন উইলিয়ামসন। তবে সফলতার বিবেচনায়, সবার উপরে রয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার ফাফ ডু প্লেসি, ৫৭ শতাংশ ক্ষেত্রে তিনি সফল হয়েছেন। এর আগে যে ৪১ জন অধিনায়কের কথা বলা হলো, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ রেকর্ড নিকোলাস পুরানের, মাত্র ২১ শতাংশ ক্ষেত্রে তিনি সফল হয়েছেন। যদি কাট-অফ হিসেবে ২০ রিভিউর পরিবর্তে ১০ রিভিউ নেওয়া হয়, সেক্ষেত্রে সবচেয়ে সফল অধিনায়ক দিনেশ চান্দিমাল এবং এইডেন মার্করাম (৬৩ শতাংশ), সবচেয়ে ব্যর্থ ওয়াহাব রিয়াজ (১৪ শতাংশ)।
ধোনির ক্ষেত্রে আসা যাক। স্বাভাবিকভাবেই ধোনির ডিআরএস ক্যারিয়ার মূলত আইপিএল-নির্ভর। আইপিএলে ধোনি মোট রিভিউ নিয়েছেন ২২টা, যার মধ্যে সঠিক হয়েছে ৯টা, অর্থাৎ সাফল্যের হার ঠিক ৪১ শতাংশ। সব অধিনায়কদের সফলতার হারের সাথে প্রায় কাঁটায় কাঁটায় মিলে যায় সংখ্যাটা!
তবে ফাফ ডু প্লেসি ছাড়াও ধোনির উপরে রয়েছেন কেএল রাহুল, বেন স্টোকস, আজিঙ্কা রাহানে, বিরাট কোহলি, দিমুথ করুণারত্নে, কেন উইলিয়ামসনরা। সফলতার দিক দিয়ে বাংলাদেশী দুই অধিনায়ক, মুমিনুল হক আর তামিম ইকবালও রয়েছেন ধোনির চেয়ে এগিয়ে।
এবার আসা যাক উইকেটকিপারদের আলোচনায়। স্ট্যাম্পের পেছনে থাকেন বলে স্বাভাবিকভাবেই অন্যদের চেয়ে ভালোভাবে বলের গতিপথটা বুঝতে পারার কথা উইকেটকিপারদের। ধোনিও পুরো ক্যারিয়ার কাটিয়েছেন কিপিং করেই, তাহলে উইকেটকিপারদের মধ্যে তার অবস্থান কোথায়?
ক্রিকভিজের পরিসংখ্যান অনুসারে, উইকেটকিপার-অধিনায়কের সংখ্যা পাওয়া যায় মোট ২১ জন। এঁদের সাফল্যের হারও একটু বেশি, ৪২ শতাংশ। অন্তত ১৫টা রিভিউ নিয়েছেন ৯ জন উইকেটকিপার-অধিনায়ক, তারা সফল হয়েছেন গড়ে ৪৩ শতাংশ ক্ষেত্রে। আরো একবার প্রমাণিত হলো, ম্যাচ প্র্যাকটিস বা ‘খেলতে খেলতে শেখা’র ব্যাপারটা অন্তত রিভিউ নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
এই নয়জনের মধ্যে সবচেয়ে সফল উইকেটকিপার-অধিনায়ক ঋষভ পন্ত (৬০ শতাংশ)। ঠিক উল্টো প্রান্তে অবস্থান করছেন মোহাম্মদ রিজওয়ান (২৫ শতাংশ)। ধোনির সফলতার হার তো আগেই বলা হয়েছে, ৪১ শতাংশ। শুধুমাত্র দুই পাকিস্তানি অধিনায়ক সরফরাজ আহমেদ আর মোহাম্মদ রিজওয়ানই রয়েছেন তাঁর নিচে। কেএল রাহুলের পরিসংখ্যানটা অবশ্য বেশ মজার। কিপার হিসেবে ১৬ রিভিউয়ের মধ্যে সফল ছিলেন ৭ ক্ষেত্রে, ফিল্ডার হিসেবে সেটা ৩৪ এর মধ্যে ১৮।
তবে ধোনি তো কিপিং করেছেন ভারতের জার্সিতেও, বিরাট কোহলির অধীনে। তেমন ক্ষেত্রে ডাটাবেজে রয়েছে মাত্র সাতটি উপাত্ত, যেখানে সফল-অসফল রিভিউয়ের সংখ্যা ৪-৩ (অর্থাৎ ৫৭ শতাংশ)। তবে মাত্র সাতটা রিভিউয়ের এই ছোট্ট স্যাম্পল সাইজকে নিশ্চয়ই ধর্তব্যের মধ্যে নেবেন না কেউ, আর তাছাড়া এক্ষেত্রেও ধোনির চেয়ে সফল হিসেবে পাওয়া যায় অনেককেই।
উইকেটকিপার | অধিনায়ক | সফল রিভিউ | অসফল রিভিউ | সাফল্যের হার (%) |
কুইন্টন ডি কক | কেএল রাহুল | ৪ | ১ | ৮০ |
রহমানউল্লাহ গুরবাজ | রশিদ খান | ৭ | ৩ | ৭০ |
এবি ডি ভিলিয়ার্স | বিরাট কোহলি | ৬ | ৩ | ৬৭ |
দিনেশ কার্তিক | ফাফ ডু প্লেসি | ৫ | ২ | ৭১ |
জস বাটলার | বেন স্টোকস | ৬ | ৩ | ৬৭ |
নিরোশান ডিকভেলা | দিনেশ চান্দিমাল | ১০ | ৬ | ৬৩ |
সঞ্জু স্যামসন | শিখর ধাওয়ান | ৬ | ৪ | ৬০ |
ঋষভ পন্ত | আজিঙ্কা রাহান | ৭ | ৫ | ৫৮ |
মহেন্দ্র সিং ধোনি | বিরাট কোহলি | ৪ | ৩ | ৫৭ |
যেমনটা দেখা যাচ্ছে, কুইন্টন ডি কক, এবি ডি ভিলিয়ার্স, দিনেশ কার্তিক, জস বাটলার, প্রত্যেকের অবস্থানই ধোনির চেয়ে উপরে। তবে হ্যাঁ, এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই যে, দারুণ ক্রিকেট-মস্তিষ্ক দিকে বিভিন্ন সময়ে বেশ কিছু সফল রিভিউ নিয়েছেন ধোনি। এই আইপিএলেই যেমন, মুম্বাই ইন্ডিয়ানসের বিপক্ষের ম্যাচে অসাধারণ এক রিভিউ নিয়ে সূর্যকুমার যাদবকে কট বিহাইন্ড করে প্যাভিলিয়নের পথ দেখিয়ে দিয়েছিলেন ধোনি। কিন্তু সময়ে সময়ে এমন কিছু তাক লাগানো রিভিউ নিলেও পরিসংখ্যানের খাতায় তার আহামরি প্রভাব পড়ছে না।
অধিনায়ক হিসেবে ধোনি কতটা সফল, সেটা নতুন করে না বললেও চলে। ভারতের হয়ে সম্ভাব্য সব আন্তর্জাতিক শিরোপা, চেন্নাই সুপার কিংসের হয়ে আইপিএল এবং চ্যাম্পিয়নস লিগের সাফল্য, মহেন্দ্র সিং ধোনি অনেকটা এগিয়ে থাকবেন সর্বকালের সেরা অধিনায়ক হওয়ার দৌড়েই। তবুও পরিসংখ্যানের আলোকে প্রশ্নটা থেকেই যায়, রিভিউ নেওয়ার ক্ষেত্রে ধোনিকে যেমন কিংবদন্তিরূপে উপস্থাপন করা হয়, সত্যিই কি ধোনি ততটা সফল?
[ব্যবহৃত সকল তথ্য ০২ মে ২০২৩ পর্যন্ত]