হতে পারতো অনেক কিছুই। ম্যাচ শেষে উদ্দাম উল্লাস হতে পারতো, স্ট্যাম্প নিয়ে কাড়াকাড়ি লাগতে পারতো। এমন ম্যাচ জয়ের পরে যা খুবই স্বাভাবিক মনে হতে বাধ্য।
এর কিছুই যে হলো না, তা নয় অবশ্য। তবে এই ম্যাচের কথা মনে এলে সব ছাপিয়ে তো ওই দৃশ্যটাই ফাস্ট-ফরওয়ার্ডে সামনে চলে আসে। ব্রেট লি’র সামনে ফ্লিনটফ হাঁটু গেড়ে বসে, মুখে সান্ত্বনার বুলি, ক্রিকেটের সবচাইতে বিখ্যাত সান্ত্বনা।
শেষ দৃশ্যটা ক্রিকেটকে শুধু খেলার গণ্ডিতে বেঁধে রাখেনি বলেই তো সবার আগে এটা মাথায় এলো। নইলে এই ম্যাচকে মনে রাখার জন্যে কেবল ক্রিকেটই তো যথেষ্ট।
এমন নয় যে ক্রিকেটে এর চাইতে নাটুকে ম্যাচ আর হয়নি। এই তো, দিনকয়েক আগেই আপনার চোখজোড়া সাক্ষী হয়েছিল এক লর্ডস-কাব্যের। টেস্ট ক্রিকেটও তো এর চাইতেও কম ব্যবধানে জয়-পরাজয় দেখেছে, দেখেছে ব্রিসবেনের টাই ম্যাচও। তবুও ক্রিকেট রোমাঞ্চের কথা বললেই কেন যেন ক্রিকেট রোমান্টিকেরা ফিরে যান ২০০৫ সালে, ৭ আগস্টের এজবাস্টনে।
এজবাস্টনে তো সেবার নাটক হয়েছিল!
নাটকের পটভূমি
একাশিতে তো দেবদূত হয়ে এসেছিলেন ইয়ান বোথাম। ‘বোথাম’স অ্যাশেজ’-এ যাচ্ছেতাই করে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দিয়েছিলেন ৩-১ ব্যবধানে। মাঝে এক আসর বিরতি দিয়ে জয় এসেছিল পরের দুইবারেও। ১৯৮৫ সালের অ্যাশেজ তো শেষ হয়েছিল ইংল্যান্ডের একচ্ছত্র আধিপত্যে, নিজ ডেরায় ক্যাঙারুদের পেয়ে শেষ দুই টেস্টেই ব্রিটিশ সিংহরা জিতেছিল ইনিংস ব্যবধানে।
তবে ইংল্যান্ডকে বোধহয় এর চেয়েও বেশি তৃপ্তি দিয়েছিল পরের বছরে পাওয়া আরেক ইনিংস ব্যবধানে জয়। ইনিংস ও ১৪ রান ব্যবধানের জয়টা যে এসেছিল মেলবোর্নে; যে জয় নিশ্চিত করেছিল, অ্যাশেজটা ইংল্যান্ডেই থাকছে।
এরপরে তো এক বিশাল খরা। মাঝের সময়টায় অস্ট্রেলিয়া ইংল্যান্ডে এসেছে, ইংল্যান্ডও চারবার অস্ট্রেলিয়ার উড়ান ধরেছে, তবে ওই ছাইদানি আর তাসমান সাগরপাড়ের দেশ থেকে গ্রীনিচের দেশে আসেনি।
১৯৮৬-২০০৫, মাঝের এই একুশ বছরে, ৪৩টি অ্যাশেজ ম্যাচে ইংল্যান্ড জয়ী হয়েছিল মোটে সাতবার। শুধু অ্যাশেজ নয়, ইংল্যান্ড তলানিতে পড়েছিল সবখানেই। নব্বই দশকের প্রায় পুরোটা জুড়েই তারা কাটিয়েছিল র্যাঙ্কিংয়ের ছয় নাম্বারে। সে লজ্জার ষোলকলা পূর্ণ হয়েছিল ১৯৯৯ সালে; নিউ জিল্যান্ডের কাছে সিরিজ হারের পর ‘ক্রিকেটের বাইবেল’খ্যাত উইজডেন ঘোষণা দিয়েছিল, এই ধরায় সবচেয়ে বাজে টেস্টখেলুড়ে দলটা ইংল্যান্ডই। বিপরীতে অস্ট্রেলিয়া যেন লড়াই চালাচ্ছিল নিজেদের ছাড়িয়ে যেতেই; অ্যালান বোর্ডারের হাতে যে ‘পরিবর্তনের যাত্রা’ শুরু হয়েছিল, উত্তরসূরি মার্ক টেলর আর স্টিভ ওয়াহর হাত ঘুরে তা যখন রিকি পন্টিংয়ের হাতে পৌঁছাল, ততদিনে এ পৃথিবী জেনে গিয়েছিল, ‘পৃথিবীতে কোনোকিছুই অসম্ভব নয়, তবে অস্ট্রেলিয়াকে র্যাঙ্কিংয়ের দুইয়ে পাঠানোও সম্ভব নয়!’
২০০৫ সালের মাঝামাঝিতে বিলেত-সফরে আসবার পূর্বে অস্ট্রেলিয়া সিরিজ হারেনি টানা ১৬ সিরিজে। ইন্ডিয়ার মাটিতে ‘ফাইনাল ফ্রন্টিয়ার’ হারার পর আর ২০০৫ অ্যাশেজের আগে টেস্টই হেরেছিল মাত্র ৬টি। অ্যাশেজ কে জিতবে, এই প্রশ্নের চেয়েও তখন বড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল, ‘অস্ট্রেলিয়া কত ব্যবধানে জিতবে?’ কোনো ম্যাচে ৩৮৪ রানে, কোনো ম্যাচে ইনিংস ব্যবধানে জিতে অস্ট্রেলিয়া প্রমাণ করেছিল সে বিশ্বাসের যথার্থতা।
তাই ইংল্যান্ড সর্বশেষ ১৮ টেস্টের ১৪টিতেই জয়ীর বেশে ফিরলেও ২০০৫ অ্যাশেজের পূর্বে ম্যাকগ্রা যখন বলেছিলেন, ‘অস্ট্রেলিয়া ৫-০তে জিততে পারে’, দ্বিমত পোষণের লোক পাওয়া যায়নি খুব একটা।
প্রথম ম্যাচটা তো চলেছিল এই ধারা মেনেই। টস জিতে ব্যাটিং নিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। ম্যাচের দ্বিতীয় বলে জাস্টিন ল্যাঙ্গারকে আঘাত করে বসিয়ে দেয়া, হেইডেনের হেলমেট ভেঙে ফেলা, কিংবা পন্টিংয়ের গাল থেকে রক্ত ঝরানো, ব্যস, ম্যাচে ইংল্যান্ডের সাফল্য এতটুকুই। হার্মিসনের তোপে পড়ে অস্ট্রেলিয়া প্রথম ইনিংসে মাত্র ১৯০ রানে গুটিয়ে গেলেও লিড নিয়েছিল অস্ট্রেলিয়াই। দ্বিতীয় ইনিংসে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন অজি ব্যাটসম্যানরা, আর গ্লেন ম্যাকগ্রার সাথে ধ্বংসযজ্ঞে নেমেছিলেন শেন ওয়ার্ন, দু’জনের চার দুগুণে আট উইকেটে ইংল্যান্ড দু’শো পেরুতে পারেনি দ্বিতীয় ইনিংসেও, ম্যাচ হেরেছিল ২৩৯ রানের বিশাল ব্যবধানে। অবশ্য এমন তো হবার কথাই ছিল, লর্ডসের বুকে অস্ট্রেলিয়া যে অপরাজিত সেই ১৯৩৪ সাল থেকে। অস্ট্রেলিয়া তাই এজবাস্টনের পথ ধরেছিল বিগত ২৬ বছরের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে। আর ইংল্যান্ড? তাদের দুঃস্বপ্নের ইতি টানতে!
নাটক হলো শুরু
অস্ট্রেলিয়া দলে আগমনের পরের নয় বছরে গ্লেন ম্যাকগ্রা টেস্ট মিস করেছিলেন মাত্র নয়টি। দশম ম্যাচ মিস করলেন ২০০৫ অ্যাশেজে। তাও খুব অদ্ভুতভাবে, ম্যাচের দিন সকালবেলা রাগবি বলে ওয়ার্মআপ করতে গিয়ে গোড়ালি মচকে ফেলেন। ইংল্যান্ড বোধহয় হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছিল ওখানেই। ২০য়ের কম গড়ে যার বলে হারাতে হয়েছিল ১৩৬ উইকেট (৪ জুলাই, ২০০৫ অব্দি), তিনি ম্যাচ থেকে ছিটকে গেলে নিজেকে জয়ীর বেশে কল্পনা করতে সমস্যা কোথায়!
ম্যাকগ্রাকে হারিয়ে এমনিতেই বোলিং আক্রমণে কিছুটা ভেঙে পড়ার দশা, উপরন্তু টস জিতে পন্টিং নিয়েছিলেন ফিল্ডিং, যে সিদ্ধান্তকে ওয়ার্ন পরবর্তীতে আখ্যা দিয়েছিলেন, তার খেলোয়াড়ি জীবনে মুখোমুখি হওয়া সবচেয়ে বাজে সিদ্ধান্ত। কেননা, সিদ্ধান্তটা নেয়া হয়েছিল স্রেফ কিছু পরিসংখ্যান আর অস্ট্রেলিয়ান ইগোকে প্রাধান্য দিয়ে! এজবাস্টনের পাটা পিচে টস জিতে বোলিংয়ের সিদ্ধান্ত? ইগো ছাড়া আর কী-ই বা বলা যাবে একে!
ইংল্যান্ডের অবশ্য তা নিয়ে ভাবতে বয়েই গেছিলো। ম্যাচের গতিপথও যেন বাঁধা হয়ে গিয়েছিল ম্যাচের প্রথম সেশনেই, আরও নির্দিষ্ট করে বললে উদ্বোধনী জুটিতেই।
মার্কাস ট্রেসকোথিক আর অ্যান্ড্রু স্ট্রাউস মিলে ২৩তম ওভারেই পূর্ণ করেছিলেন দলীয় শতক। ট্রেসকোথিক তুলেছিলেন ব্যক্তিগত অর্ধশতক, পাঁচ ছুঁইছুঁই রানরেটে ইংল্যান্ড প্রথম সেশন শেষ করেছিল ১ উইকেটে ১৩২ রানে।
মাঝের সেশনে ইংল্যান্ড তো হয়ে উঠেছিল আরও বিধ্বংসী। প্রথম পঞ্চাশ তুলতে ট্রেসকোথিক খেলেছিলেন ৭৬ বল, অতঃপর মধ্য সেশনে আউট হবার আগে খেলেছিলেন আরও ২৬ বল, তাতে রান তুলেছিলেন ৪০, ইংল্যান্ডের বাকি ব্যাটসম্যানদের কানে যেন ছড়িয়ে গিয়েছিলেন একটাই বার্তা, ‘আক্রমণই সেরা রক্ষণ!’
প্রথমে ফ্লিনটফ, পরে পিটারসেন কিংবা হার্মিসন ট্রেসকোথিককেই মেনেছিলেন অক্ষরে অক্ষরে। ফ্লিনটফ ফিফটি করেছিলেন বিদ্যুৎগতিতে, তিন চার আর চার ছয়ের মারে ৪৪ বলে। পিটারসেনের ওয়ানডে স্টাইলের ৭১ আর হার্মিসনের শেষাংশের ক্যামিও মিলে ইংল্যান্ড প্রথম দিনেই তুলেছিল ৪০৭ রান, মাত্র ৭৮.১ ওভারে। ঝড়টা কম-বেশি গিয়েছে সবার ওপর দিয়েই, তার মাঝেও ব্রেট লি’র ওপর দিয়েই সবচেয়ে বেশি। ওয়ার্নকে সবচেয়ে সফল বোলার হিসেবে চালিয়ে দিতে গেলেও তো বিবেক সায় দিচ্ছে না, চার উইকেটের তিনটিই যে লেজের তিন ব্যাটসম্যানের। তার চেয়ে তো ক্যাসপ্রোভিচের তিন উইকেটই প্রশংসার খাতায় পেয়ে যাচ্ছে বেশি নাম্বার!
ইংল্যান্ডের ইনিংস শেষ হতেই শেষ হয়েছিল প্রথম দিনের খেলা। ইংরেজরা যেখানে শেষ করেছিল, টেস্টের দ্বিতীয় দিনে অস্ট্রেলিয়া যেন শুরু করেছিল সেখান থেকেই। প্রথম পঞ্চাশ বায়ান্ন বলে, দলীয় শতরান ২৩তম ওভারে এবং দিন শেষ হয়েছিল ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় ইনিংসের শুরুতে। ক্ষমা করবেন পাঠক, ওই টেস্ট তো এগিয়েছিল এমন রোলার কোস্টার গতিতেই!
আচ্ছা পাঠক, আরেকবার রিওয়াইন্ড করা যাক। শুরুতেই হেইডেন ড্রেসিংরুমে ফিরে গেলেও অস্ট্রেলিয়ার প্রতি-আক্রমণের চিন্তায় নড়চড় হয়নি চুলপরিমাণও। শুরুটা করেছিলেন পন্টিং, তারপর ডেমিয়েন মার্টিনও যোগ দিয়েছিলেন তার সাথে। তবে নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারিয়ে অস্ট্রেলিয়া বাধ্য হয়েছিল খোলসে ঢুকে পড়তে! চারজন ব্যাটসম্যান চল্লিশের কোটা পেরোলেও অস্ট্রেলিয়াকে থামতে হয়েছিলো ৩০৮ রানে, বাকি সাত ব্যাটসম্যানের ছ’জনই তো পৌঁছাতে পারেননি দুই অঙ্কের ঘরে!
শেষ বিকেলে ইংল্যান্ড আবার নেমেছিল ব্যাটিংয়ে, মোটে সাত ওভারের জন্যেই। ২৫ রান তুলতেই হারিয়েছিল স্ট্রাউসের উইকেট, ওয়ার্নের তুলে নেয়া যে উইকেট নিয়ে চাইলেই লিখে ফেলা যায় কয়েকশ’ শব্দের কাব্য। অফ-স্ট্যাম্পের আড়াই ফিট মতো বাইরে বল পিচ করিয়ে কী করে স্ট্রাউসের লেগ স্ট্যাম্প উপড়ে ফেলেছিলেন, তা তো গবেষণার দাবি রাখেই। যেমনটা দাবি করেছিল‘বল অব দ্য সেঞ্চুরি’!
স্ট্রাউসের উইকেট তো ছিল ট্রেলার, মূল সিনেমা তো ওয়ার্ন জমিয়ে রেখেছিলেন তৃতীয় দিনের জন্যে। প্রথম দিনের উইকেটে তো কোনো ক্ষত ছিল না, ওয়ার্নিও পারেননি রাউন্ড দ্য উইকেটে গিয়ে বিশাল টার্নওয়ালা লেগ-ব্রেক ডেলিভারিগুলো ছাড়তে, পুরো ইনিংসে মাত্র ১১টি বলই করেছিলেন রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে। উইকেট ভাঙতে শুরু করেছিল দ্বিতীয় দিন থেকেই, দ্বিতীয় ইনিংসে ওয়ার্নিও তাই ফেরত গিয়েছিলেন নিজের চিরাচরিত পরিকল্পনাতে, দ্বিতীয় ইনিংসে করা ১৩৯ বলের অর্ধেকের বেশিই করেছিলেন রাউন্ড দ্য উইকেটে গিয়ে, ৮৫টি বল ফেলেছিলেন লেগ স্ট্যাম্পের বাইরের ভেঙে যাওয়া অংশে। প্রথম ইনিংসের নিষ্প্রভ ওয়ার্নও দ্বিতীয় ইনিংসে তাই ফিরে পেয়েছিলেন নিজেকে। প্রথম ইনিংসে ৯৯ রানে পিছিয়ে থাকবার পরও যে অস্ট্রেলিয়াকে ম্যাচ থেকে বাতিল করে দেয়া যায়নি, সে তো ওয়ার্নের ছয় উইকেটের কারণেই। তবে এ ম্যাচে তো আরও একজন ফেরত এসেছিলেন, অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ হয়ে ‘হেডিংলির ইয়ান বোথাম’!
প্রথম ইনিংসে ঝড়োগতির অর্ধশতকের পরে বোলিংয়েও তুলেছিলেন তিন উইকেট। তবে সবটুকু আলো কেড়ে নেবার মঞ্চটা সাজিয়েছিলেন দ্বিতীয় ইনিংসে। ওয়ার্নের টার্নে পরাস্ত হয়ে ৭২ রানেই সাজঘরে ফিরেছিলেন প্রথম পাঁচ ব্যাটসম্যান। ফ্লিনটফ নেমেছিলেন তখনই, নেমেই প্যাভিলিয়নের পথ ধরতে দেখেছিলেন ইয়ান বেলকে। শেষ চার উইকেটে ইংল্যান্ড যোগ করেছিল আরও ১০২ রান, যার ৭১ রানই এসেছিল ফ্লিনটফের ব্যাটে। ম্যাচশেষে জয়-পরাজয়ের ব্যবধান দেখে ইংল্যান্ড সমর্থকেরা ভাবতেই পারেন, ‘ভাগ্যিস, ফ্রেডি ছিলেন!’ ফ্লিনটফের রানগুলোর মাহাত্ম্য আরও বাড়বে, যখন জানবেন এই ইনিংসের বেশিরভাগ জুড়েই বয়ে বেড়িয়েছিলেন কাঁধের চোট। ফ্লিনটফের ব্যাটে চড়ে ১৮২ রানে অলআউট হয়ে অস্ট্রেলিয়ার সামনে ইংরেজরা লক্ষ্য ছুঁড়েছিল ২৮২ রানের। ম্যাচের তিন সম্ভাব্য ফল থেকে ‘ড্র’ বাদ পড়ে গিয়েছিল তখনই, ম্যাচ যে চতুর্থ দিনে গড়ানো নিয়েই সংশয় তখন!
গ্রন্থিমোচন
হাতে আড়াইদিনেরও বেশি সময়, আবহাওয়ার পূর্বাভাসেও নেই বৃষ্টির আভাস। সব দেখেশুনে জাস্টিন ল্যাঙ্গার আর ম্যাথু হেইডেন শুরুটা করেছিলেন সাবধানী। হার্মিসন আর হগার্ডের উদ্বোধনী স্পেল পার করে দিয়েছিলেন খুব সহসাই। তবে এই ম্যাচ তো ফ্লিনটফের নামে লিখেই রেখেছিলেন বিধাতা!
১৩তম ওভারে বোলিংয়ে এসে দ্বিতীয় বলেই স্ট্যাম্প উপড়ে ফিরিয়েছিলেন ল্যাঙ্গারকে, পরের চার বলে পন্টিংকে নাকানিচুবানি খাইয়ে পঞ্চম বলে বাধ্য করেছিলেন প্যাভিলিয়নের ফিরতি পথ ধরতে। ঠিক যেই মুহূর্তে অস্ট্রেলিয়া ভাবতে শুরু করেছিল, ম্যাচ এখনো হাতছাড়া হয়নি, প্রতিবারেই একজন ফ্লিনটফের কাছে তাদের মুখ থুবড়ে ফিরতে হয়েছে।
ফ্লিনটফ যেন খুলে দিয়েছিলেন আলীবাবার সেই গোপন দরজা। পন্টিং ফেরার পরে দিনে যে বাদবাকি আরও ৩০.৪ ওভার খেলা হয়েছিল, অস্ট্রেলিয়া তাতেই খুঁইয়েছিল ছয় উইকেট। দিনের খেলা শেষ হবার দুই বল আগে হার্মিসনের স্লোয়ারে মাইকেল ক্লার্ক বিভ্রান্ত হয়ে বোল্ড হতেই নিশ্চিত হয়েছিল, এই টেস্ট ইংল্যান্ড হারবে, এমন চিন্তা এখন বাড়াবাড়ি! কোনো স্বীকৃত ব্যাটসম্যান অবশিষ্ট নেই; শেন ওয়ার্ন, ব্রেট লি আর মাইকেল ক্যাসপ্রোভিচকে পাড়ি দিতে হবে ১০৭ রানের পাহাড়। এই টেস্টের ফল নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভোগার আর কোনো কারণ নেই।
শেষের রোমাঞ্চে
শেন ওয়ার্ন যে ব্যাটিং একদমই জানতেন না, তা নয়। টেস্টে তো ৯৯ রানের এক ইনিংসও খেলেছিলেন সেই ২০০১ সালে। ওয়ার্ন তাই রানের খাতায় ৪২টি দাগ ফেললেও তা বোধহয় ইংলিশদের মনে তেমন দাগ ফেলতে পারেনি। জয় তো অস্ট্রেলিয়ার জন্যে তখনও বহু দূরের বাতিঘর।
ফ্লিনটফের আগুনে বোলিংয়ে পিছনে সরতে সরতে ওয়ার্ন যখন স্ট্যাম্পই উপড়ে ফেললেন, অস্ট্রেলিয়া জয় থেকে দাঁড়িয়ে ৬২ রান দূরত্বে। ব্রেট লি তখন অপরাজিত ১৮ রানে, যা ছিল তার টেস্ট ক্যারিয়ারের ১৪তম সর্বোচ্চ। ওয়ার্ন ফিরে যাওয়ায় ক্রিজে নেমেছিলেন মাইকেল ক্যাসপ্রোভিচ।
দু’জনে মিলে শুরুটা করেছিলেন এক রান নিয়ে, কাঁধের চোট নিয়েও ফ্লিনটফ বল ছুঁড়ছিলেন প্রায় নব্বই মাইল গতিতে, গতির নেশায় ওভারস্টেপিং করছিলেন মাঝেমাঝেই, বলের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অতিরিক্ত রানও বিলোচ্ছিলেন দেদারসে। অপর প্রান্তে স্লো বোলার অ্যাশলি জাইলসকে পেয়ে লি-ক্যাসপ্রোভিচ জুটি রানও তুলছিলেন সমানে। ইংরেজ কাপ্তান মাইকেল ভন যতক্ষণে টের পেলেন জুটিটা জমে যাচ্ছে, জয় আর অস্ট্রেলিয়ার মাঝে ব্যবধান মাত্র ২৭ রানের!
বুঝতে পেরে মাইকেল ভন আক্রমণ থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন জাইলসকে, বল তুলে দিয়েছিলেন তার আরেক গতিতারকা স্টিভ হার্মিসনকে। ফ্রেডি-হার্মি জুটি মিলে লি-ক্যাসপ্রোভিজ জুটির ব্যাটসম্যানশিপের চূড়ান্ত পরীক্ষাই নিয়েছিলেন। বারকয়েক শরীর বরাবর শর্ট বল ছুড়ে, একবার ফিজিওকে ডাকিয়ে, টো ক্রাশার ইয়র্কারে, প্যাভিলিয়নে তাদের ফেরত পাঠাতে সবরকমের চেষ্টাই করেছিলেন ফ্রেডি আর হার্মি।
লাভ হয়নি কিচ্ছুতেই। উল্টো প্রাণান্ত চেষ্টার ক্ষতিপূরণ হিসেবে বাই আর নো বলে রানও দিচ্ছিলেন বেশ৷ ম্যাচে শেষবারের মতো ওভারস্টেপিংয়ের কারণে অতিরিক্ত রানের খাতায় ফ্লিনটফ যখন আরও পাঁঁচবার দাগ কাটালেন, অস্ট্রেলিয়ার লক্ষ্যমাত্রা একক সংখ্যায় নেমে এসেছে।
অথচ খেলার মীমাংসা কিন্তু হয়ে যেতে পারতো এর আগের বলেই। ফ্রেডির ৯০.৩ মাইলের গোলাকে আপার-কাট মতোন কিছু করতে গিয়ে ক্যাসপ্রোভিচ বল তুলে দিয়েছিলেন থার্ডম্যানের ফিল্ডারের কাছে। একে তো ম্যাচের অন্তহীন চাপ, তার ওপর গ্যালারিভর্তি রংধনু রঙে রাঙা দর্শক; সাইমন জোনস বলটাই দেখতে পারেননি।
সুযোগ পেয়ে ক্যাসপ্রোভিচ যোগ করেছিলেন আরও দুই রান। ম্যাচের প্রেক্ষিতে সেই দুই রান অমূল্য হলেও শেষ অব্দি ক্যাসপ্রোভিচের আক্ষেপ সেই দুই রানেরই।
হার্মিসনের করা ইনিংসের ৬৫ নম্বর ওভারের তিন নম্বর বলটা ক্যাসপ্রোভিচ ছেড়ে দিলেও পারতেন। হয়তো বা একেবারে শেষক্ষণে ছেড়ে দিতেই চেয়েছিলেন। কিন্তু ৯০ মাইল ছোঁয়া বাউন্সারটা ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় যে বহু আগেই পেরিয়ে গিয়েছিল।
বল ক্যাসপ্রোভিচের গ্লাভস ছুঁয়েছিল, সেকেন্ড দুই বাতাসে ভেসেছিল, ডাইভিং জেরাইন্ট জোন্সের গ্লাভসে বলখানা আশ্রয় নিয়েছিল। বিলি বাউডেন আঙুল তুললেন। ম্যাচ শেষ হলো। জিততে অস্ট্রেলিয়ার তখনও তিন রান লাগতো।
তারপর যা হয়েছিল
কেউ গিয়ে আলিঙ্গনে বাঁধলেন বোলার স্টিভ হার্মিসনকে, কেউ বা জেরাইন্ট জোনসকে। তবে ম্যাচের মতো ম্যাচের পরের সবটুকু আলোও কেড়ে নিয়েছিলেন একজনই, অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ।
নন-স্ট্রাইক এন্ডে ব্রেট লি সব হারানোর বেদনায় বসে পড়েছেন, ফ্লিনটফ ম্যাচজয়ের আনন্দে না ভেসে এসেছিলেন লি’র কাছে, কাঁধে হাত রেখে কি যেন বললেনও। সেদিন ব্রেট লি’কে ফ্রেডি কী বলেছিলেন, তা জানা যায়নি আজও। তবে চাইলে তো নিজের মনের মতো অনুমান করেই নেয়া যায়,
‘এমন ম্যাচে অস্ট্রেলিয়া জয়ী হয় না, ইংল্যান্ড জয়ী হয় না, জয়টা হয় ক্রিকেটেরই!’
সিরিজে যা হয়েছিল
ওল্ড ট্রাফোর্ডের পরের টেস্টটা ড্র হয়েছিল, ড্র হয়েছিল ওভালের পঞ্চম টেস্টও। মাঝে নটিংহ্যামে চতুর্থ টেস্টে ইংল্যান্ড জয় পেয়েছিল তিন উইকেটে। সেই সাথে নিশ্চিত হয়েছিল ক্রিকেটের জন্মভূমে অ্যাশেজ ফিরতে চলেছে, ১৯ বছর পর।
এর পূর্বেই অবশ্য নিশ্চিত হয়েছিল, এজবাস্টন নিয়ে চর্চা হবে, আজ হতে ঊনিশ শতাব্দী পরও।