Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

শেরে বাংলায় শততম ওয়ানডে ও বিসিবির ক্রিকেট মূল্যবোধ

প্রতিদিনের মতোই বুধবারের সকাল শুরু করেছিলেন মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের হেড গ্রাউন্ডসম্যান আব্দুল মতিন। দুপুর ১২টায় জিম্বাবুয়ে-শ্রীলঙ্কার ম্যাচ, তাই সকাল থেকেই শুরু হয়েছিলো তোড়জোড়। মাঠে যখন গেলেন, সবাই স্বাভাবিকভাবেই কাজ করছিলো। হয়তো ভাবছিলেন, সবাই কি ভুলে গেলো! তা কী করে হয়! একটু পর যখন নীল রঙের নতুন প্যাকেটে স্মারক জ্যাকেট পেলেন, তখনই ভুল ভাঙল তার। নাহ! আজ যে স্টেডিয়ামে ১০০তম ওয়ানডে ম্যাচ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সেটা তাহলে ভোলেনি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)।

কিছুই হয়নি, তার মধ্যেও অনেক কিছু হয়েছে। মতিন আপ্লুত হয়েছেন। যার কাজ শুধু মাঠেই, তাকে মাথায় তুলে নিয়েছে বিসিবি, দিয়েছে সংবর্ধনা। নিজের চোখকে হয়তো বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না ১৯৭৮ সাল থেকে স্টেডিয়ামের মাঠকর্মী হিসেবে কাজ করা মতিন। আহা, এই মাঠ! দেখতে দেখতে ১০০ ওয়ানডে খেলে ফেলছে, যার সাক্ষী তিনি; সেই শুরু থেকেই।

১০০তম ওয়ানডে মিরপুর ক্রিকেট স্টেডিয়ামে। ম্যাচ জিম্বাবুয়ে-শ্রীলঙ্কার। সেখানে এই আব্দুল মতিনটা আবার কে? প্রশ্ন আসতেই পারে। আমরা সাফল্যকে মনে রাখি। এতই দুর্ভাগা যে, কান্ডারিদের না। এই মতিন হলেন স্টেডিয়ামের এই মুহূর্তে একমাত্র মাঠকর্মী যিনি কিনা স্টেডিয়ামের প্রথম ম্যাচেও মাঠকর্মী ছিলেন। এই মুহূর্তে কাজ করছেন চট্টগ্রাম জহুর আহমেদ চৌধুরী ক্রিকেট স্টেডিয়ামের হেড গ্রাউন্ডসম্যান হিসেবে। শেরে বাংলার শততম ওয়ানডের কারণেই তাকে ঢাকায় নিয়ে আসে বিসিবি। সে কারণেই কিনা বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজাও পড়লেন তাকে নিয়ে। বলেছেন, “তামিম-সাকিব আরও অনেকের ১০০ পেরিয়ে আজ মতি মামার ১০০ নট আউট যেন বেশি আনন্দের। অভিনন্দন মতি ভাই, ২০০-এর অপেক্ষায় আছে শেরে বাংলা…।”

শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচের একটি দৃশ্য; Source: ESPN

বাংলাদেশ ক্রিকেট দল কিন্তু একদিক থেকে বেশ দুর্ভাগা। শততম টেস্ট খেলল সেটাও সেই বিদেশ বিভূঁইয়ে শ্রীলঙ্কায়। আর মিরপুরে যখন ভেন্যুর ওয়ানডে সেঞ্চুরি, তখন মাঠের বাইরে দর্শক হয়ে মাশরাফি-সাকিবরা। এই আক্ষেপ হয়তো আজীবন পোড়াবে তাদের। তাই উদযাপন না করার ‘অজুহাত’ দিতেই পারে বিসিবি! অনেকটা সেই ইঙ্গিতও দিলেন বোর্ড সভাপতি। তার মধ্যেও আক্ষেপ ঝরে পড়ল তার কণ্ঠে। বললেন, “একদিক দিয়ে ঠিক যে আজকে ভেন্যুর শততম ওডিআইতে বাংলাদেশের খেলাও রাখতে পারতাম। এটা ঠিক আছে। আমরা শততম টেস্ট ম্যাচটাও বাইরে খেলেছি। আজকেরটা ভেন্যুর ওপর দিয়ে গেছে। এটা বিশাল একটা ব্যাপার আমার কাছে। এই মাঠে প্রথম খেলাটা হয়েছিলো যখন তখন প্রতিপক্ষ ছিল জিম্বাবুয়ে। এবারও তাই। সেই ম্যাচের মাসাকাদজা এবারও খেলছেন। তবে হ্যাঁ, বাংলাদেশ হলে আরও ভালো হত।”

চাইলেই সূচিতে বাংলাদেশের খেলা রাখা যেত। সেটা স্বীকারও করছেন পাপন। সঙ্গে আবার দায়ও দিচ্ছেন জিম্বাবুয়েকে, “আসার ব্যাপারে টিমগুলো, বিশেষ করে জিম্বাবুয়ে লেট করেছে। একটু তাড়াহুড়ো ছিল। কিছু অনিশ্চয়তা ছিল বলেই আগে থেকে ঠিক করতে পারিনি। এটা যে করা যেত না তা-ও না। করা যেত। করতে পারলেই ভাল হতো।”

অনুশীলন করতে গিয়ে সকাল বেলাতেই মাঠে যেতে হয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে। সেখানে গিয়ে সবার আগে মতিনের সঙ্গে দেখা করেছেন বাংলাদেশের অধিনায়ক মাশরাফি। এমন দিনে মাশরাফির অভিনন্দন ছুঁয়ে গেছে মতিনের হৃদয়কেও।

সে কথা বলতে গিয়েই আপ্লুত মতিন। বললেন, “মাশরাফি ভাই আমাকে মামা বললে মন ভরে যায়। আজকেও দেখা হল, কথা হল। ১০০তম ওয়ানডে ম্যাচের আগে এসে অভিনন্দন জানালেন আমাকে।”

আবদুল মতিনের সঙ্গে মাশরাফি বিন মুর্তজা; Source: The Daily Star

এই স্টেডিয়াম বাংলাদেশ ক্রিকেটের আধুনিক ইতিহাসের জাদুঘর হয়ে থাকবে আজীবন। এখানেই ২০১০ সালে নিউজিল্যান্ডকে ৪-০ তে সিরিজ হারিয়েছিল বাংলাদেশ। এখানেই ২০১২ এশিয়া কাপের ফাইনালে জায়গা করে লাল-সবুজ জার্সিধারীরা। শুধু তা-ই নয়, ২০১৫ বিশ্বকাপের পর ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা আর পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ জয় এসেছিল এই ভেন্যুতেই। কত আয়োজন, কত রোমাঞ্চের গল্প স্টেডিয়ামের প্রতিটি ঘাসে, গ্যালারির চেয়ারে, দেয়ালে, এমনকি ধুলোয় জড়িয়ে আছে তা বলে শেষ করা যাবে না। কিন্তু সাফল্যের উল্টো পিঠে ব্যর্থতার দুঃস্মৃতিও কম নয়। ৫৮ রানে অল আউট হওয়ার দুর্ঘটনা এখানেই ঘটেছিল। সাম্প্রতিক সময়ে মাঠ সংস্কারের পর আউটফিল্ড ‘পুওর’ বলে তকমা পেয়েছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সংস্থা আইসিসির কাছে।

মিরপুর স্টেডিয়ামের গল্প শুনতে হলে বেশ পুরনো নথি ঘাঁটতে হবে। যেতে হবে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের কাছে। সে-ই সবচেয়ে বড় সাক্ষী। মূলত, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামেই অনুষ্ঠিত হতো ক্রিকেট ম্যাচগুলো। কিন্তু ঝামেলা হয়ে যেত ফুটবলের কারণে। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সঙ্গে এ নিয়ে কম বাকবিতণ্ডা হয়নি বংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সেই সময়ে। সাধারণত গরমের দিনে ফুটবলের জন্য রাখা হতো স্টেডিয়ামটিকে। আর শীতে ক্রিকেটের। কিন্তু সূচি মেলাতে গিয়ে পড়তে হতো বিপদে। শেষপর্যন্ত ফুটবল-ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থা দুটিকে সামলাতে সরকার হস্তক্ষেপ করলেন। বিসিবিকে বলা হল মিরপুর ক্রিকেট স্টেডিয়ামকে নিতে। ওই সময়ে স্টেডিয়ামটিতে শুধুমাত্র ফুটবলের কিছু লিগ ম্যাচ অনুষ্ঠিত হতো।  সরকারি আদেশে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের ফটক মাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে আসতে হল মিরপুরে। এখানেই তারপর তৈরি হলো বাংলাদেশের ‘হোম অব ক্রিকেট’, বিসিবির কর্পোরেট অফিস। বাকি গল্পটা সবার জানা। জাতীয় দলের পাশাপাশি ‘এ’ দল, হাই পাফরম্যান্স ইউনিট (এইচপি), নারী ক্রিকেট, বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল), জাতীয় ক্রিকেট (এনসিএল), বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগ সহ (বিসিএল) সবকিছুই এখানে। অবকাঠামোর বাস্তবায়ন, নতুন নতুন পরিকল্পনা, আধুনিক সুযোগ-সুবিধা; কী নেই এখানে!

ঘরের মাঠে পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম জয়ের স্বাদ দিয়েছিল এই শেরে বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়াম; Source: Cricinfo

বাংলাদেশের এই স্টেডিয়াম তার ক্যারিয়ারের ১০০তম ওয়ানডে পূর্ণ করলেও, ক্রিকেটের তিন ফরম্যাট মিলে মোট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হলো ১৫২টি। ক্রিকেট বিশ্বে এদিক  থেকে সবার চেয়ে এগিয়ে শেরে বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়াম। ২০০৬ সালে অভিষেকের পর, সবচেয়ে কম সময়ে ওয়ানডে সেঞ্চুরি করে বসল সে। অতীতে মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড (এমসিজি), সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজাহ, হারারে স্পোর্টিং ক্লাব জিম্বাবুয়ে ও শ্রীলঙ্কার আর. প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে ১০০টি ওয়ানডে ক্রিকেট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হওয়ার রেকর্ড রয়েছে।

দিনশেষে দুর্ভাবনার কথা থেকেই  যায়। মিরপুর দ্রুততম সময়ে ১০০তম ওয়ানডে অনুষ্ঠিত করল। এটা কি আসলেও সুখের খবর? খোলা চোখে দেখলে মাইলফল মনে হবে। কিন্তু ১৩ বছরে ১০০ ওয়ানডে আর ১৫২ ম্যাচ অনুষ্ঠিত করার মধ্যে দিয়ে  লজ্জার রেকর্ডই গড়ল বিসিবি। বারবার বলা হচ্ছে স্টেডিয়ামকে বিশ্রাম না দেওয়ার কারণেই উইকেটের অবস্থাও যেন দিন দিন ক্লিশে হয়ে যাচ্ছে। বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনও ঘুরেফিরে ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতে পারলেন না। বললেন, “এত ম্যাচ খেলা হচ্ছে এটা আসলেই চিন্তার বিষয়। আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামগুলোর বিশ্রাম দরকার হয়। মিরপুরকে বিশ্রাম দেওয়া হচ্ছে না, বিশ্রাম লাগবে একটা।”

বাদামী আউটফিল্ডে সবুজ গালিচা এখন কেবলই স্মৃতি; Source: Cricinfo

কেন দেশের অন্যান্য স্টেডিয়ামগুলোতে আন্তর্জাতিক ম্যাচ সেভাবে দেওয়া হচ্ছে না? আর কতদিন এভাবে ঢাকার বাইরের আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামগুলো সুযোগ-সুবিধার অভাবে অবহেলায় নষ্ট হবে কোটি কোটি টাকার সম্পদ? ঢাকাকেন্দ্রিক হয়ে থেকে কি ক্রিকেটের বিশ্বায়ন সম্ভব হচ্ছে? প্রশ্ন থেকে যায়। কিন্তু এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, মিরপুর স্টেডিয়ামকে বাঁচাতে হলে অন্যান্য স্টেডিয়ামেও ম্যাচ দিতে  হবে। তাতে যেমন দর্শক টানা সম্ভব হবে, সঙ্গে পরিচিতি বাড়বে সেসব স্টেডিয়ামেরও।

ফিচার ইমেজ- ESPN Cricinfo 

Related Articles