এক প্রান্তে ব্যাটসম্যানদের আসা যাওয়ার হিড়িক চলেছে। আরেকপ্রান্তে হেলমেটে বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে একজন একাই দলকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। প্রান্ত বদলের মধ্যে মাঝে মাঝে হেলমেটটা মাথার উপর চেপে ধরে ঘামের পানি বের করে নিচ্ছেন, আবার এগোচ্ছেন উইকেটের রণক্ষেত্রে। তাল হারানোর কোন সুযোগই নেই, আপাতত মাটি কামড়েই পড়ে থাকতে হবে তাকে। সে কারণেই হয়তো প্রথম ৫০ রান তুলতে খেললেন ৬৪ বল, একটু সময় নিয়ে। পরের ৫০ রান এলো ৫৪ বলে।
শততম রানটা নিতে গিয়ে যখন প্রান্ত বদল করলেন, সোজা ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে ব্যাটটা আড়াআড়ি দু’হাতে তুলে নিলেন। ক্রন্দনরত বাচ্চাকে কোলে নিয়ে যেভাবে ঘুম পাড়াতে হয়, তেমন অঙ্গভঙ্গি করে বুঝিয়ে দিলেন, এই সেঞ্চুরিটি তার কদিন আগে ভূমিষ্ঠ হওয়া সন্তানের জন্য।
১.
ইমরুল কায়েস। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের ওপেনিং ব্যাটসম্যান। চলমান জিম্বাবুয়ে সিরিজে ওপেনার তামিম ইকবালের অনুপস্থিতিতে প্রথম ওয়ানডে ম্যাচে পুরো দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন তিনি। ২৭১ রানের দীর্ঘ লক্ষ্য তার মাঝারি গড়নের সেই কাঁধে চড়েই পেয়েছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা-মুশফিকুর রহিমরা।
কেবল তাই নয়, নিজের পারফরম্যান্সের পাশাপাশি তরুণ পেস বোলিং অলরাউন্ডার মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনকে সঙ্গে নিয়ে গড়লেন ১২৭ রানের জুটি, যেটা শুরু হয়েছিল ১৩৯ রানে বাংলাদেশের ৬ উইকেট হারানোর পর। বুঝিয়ে দিলেন, বাংলাদেশ দলে যোদ্ধার অভাব নেই। প্রয়োজন কেবল পরিস্থিতি আর অন্তরের আগ্রহের।
ইমরুল কায়েস শেষ পর্যন্ত ১৪৪ রানের ইনিংস খেলেছিলেন, যা তার ওয়ানডে ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ রানের ইনিংস। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের হাজার হাজার দর্শকের সামনে নজর কেড়েছে ইমরুল কায়েসের উদযাপনের দৃশ্য। যার মধ্যে লুকিয়ে ছিল অভিমান, গর্ব, হাসি, কান্না আর একজন নতুন বাবার গল্প।
২.
রাজধানী ঢাকা থেকে ২৮৩ কিলোমিটার দূরের মেহেরপুর জেলার ছোট্ট শহর। মেহেরপুর জেলার মোট তিনটি থানা – মেহেরপুর সদর, মুজিবনগর আর গাংনী। গাংনীর বাঁশবাড়ি থেকে মেহেরপুর পর্যন্ত বাসে করে যেতে লাগে চার টাকার বাসভাড়া।
প্রতিদিন একটা ছেলে সেই চার টাকা বাসভাড়া দিয়ে আসে মেহেরপুরের ছোটখাটো জেলা স্টেডিয়ামে। সকাল থেকে চলে কঠোর ব্যাটিং অনুশীলন। সারা দেশের মতো ক্রিকেটের মৌসুম না হলে আবার বোলার খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু ছেলেটার ব্যাটিং অনুশীলন তো থেমে থাকে না। কি শীত, কি গরম, কি বর্ষার বাদলা বৃষ্টি – ছেলেটি স্টেডিয়ামে আসে। সুতো ওঠা কিছু বল নিয়ে চলে ব্যাট-বলের ঠুকঠাক। বোলার না পেলে স্টেডিয়ামের ছোট ছোট বাচ্চা, এমনকি পাশের ছাগল চরানো রাখালের হাতে পর্যন্ত পাঁচ টাকা দিয়ে ৪০-৫০টা বল থ্রো করানো। সেই বলে ব্যাট চালায় ছেলেটি। ততদিনে বয়সভিত্তিক জেলা দলে নিজের ভিত গড়ে ফেলেছে সে। সেখান থেকে বিভাগীয় দল, প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগ হয়ে ২০০৮ সালে জাতীয় ক্রিকেট দল ।
মেহেরপুরের সেই ছেলেটিই আজকের ইমরুল কায়েস। ১০ বছরে যিনি কিনা দেশের জার্সিতে খেলেছেন ৩৪ টেস্ট, ৭৪ ওয়ানডে আর ১৪টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ। সংগ্রহ করেছেন যথাক্রমে ১৬৭৯, ২২২৫ ও ১১৯ রান। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সেঞ্চুরির পর ইমরুলের ঝুলিতে এখন তিনটি ওয়ানডে সেঞ্চুরি। টেস্টেও একই সংখ্যক সেঞ্চুরি।
একবার তামিম ইকবাল বলেছিলেন, ইমরুল উইকেটে মনের কথা বোঝেন। তার সঙ্গে ব্যাট করতে গেলে দুজনের মধ্যে বোঝাপড়াটা খুব ভালো হয়। ইমরুল নাকি দারুণভাবে দায়িত্ব নিয়ে তামিমের উপরে চাপটা কমিয়ে দেন। সত্যিকার অর্থেই ইমরুল এটা করেন। সেটা যেমন জাতীয় দলের জার্সিতে, তেমনই ঘরোয়া ক্রিকেটেও। কিন্তু তারপরও কেন যেন জাতীয় দলে অনিয়মিত হয়ে যান মেহেরপুরের এই ছেলেটি। তার জায়গায় ওপেনিংয়ে বারবার সুযোগ দেওয়া হয় দলে নতুন আগত কোন তরুণ ক্রিকেটারকে। ইমরুল কখনও তার জায়গাটা ধরে রাখার সুযোগ পান না। মোদ্দা কথা, গেল ১০ বছরেও তার পায়ের তলার মাটি শক্ত হয়নি। বারবার কোনো না কোনো এক কারণে নির্বাচকরা খুঁজে ফিরে ইমরুলের উপরই ছাঁটাইয়ের তরবারিটা চালিয়ে দেন। অথচ বাংলাদেশে আয়োজিত ২০১১ বিশ্বকাপে নিজেদের দুটি ম্যাচে ইমরুল কায়েস জিতেছেন ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার। একটা ছিল নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে, আরেকটি ইংল্যান্ডের বিপক্ষে।
একাধিক ম্যাচে দলের হয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ইনিংস খেলেছেন ইমরুল, আবার ব্যর্থও হয়েছেন। কিন্তু সমর্থক থেকে শুরু করে নির্বাচক, এমনকি কোচ পর্যন্ত কেন যেন ইমরুলের ব্যর্থতাকেই মনে রেখেছেন। ২০১১ সালের বিশ্বকাপের পর ইমরুল দল থেকে বাদ পড়লেন। তার জায়গায় একাধিক ওপেনারকে পরীক্ষা করেছে টিম ম্যানেজমেন্ট।
টানা ৩ বছর রঙিন পোশাকে দলের বাইরে ছিলেন ইমরুল। ২০১৪ সালে ফিরলেন, প্রথম ম্যাচেই পেলেন হাফ সেঞ্চুরি। সেই উদযাপনটাও দেখার মতো ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য যেন নিয়ত তার কপালে লেখাই থাকে, যে কারণে পরের টানা ৭ ম্যাচে ১০ রানের নিচে সাজঘরে ফেরা। এবার আর কাউকে দোষ দেওয়ার নেই। আবারও সীমিত ওভারের ক্রিকেট থেকে আপদকালীন বিদায়।
৩.
২০১৪ সালের শেষদিক থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ওয়ানডেতে বাংলাদেশ যখন দারুণ সময় কাটিয়েছে, সেটার স্বাদ নেওয়ার সুযোগ হয়নি ইমরুল কায়েসের। তারপরও তার বেশ কিছু ইনিংস এখনও তাকে শান্তি দেয়, সমর্থকরা ভুলে গেলেও দেশের ক্রিকেটের ইতিহাস গায় সুরের দোটানা।
তার একটি ইনিংস আজীবন মনে রাখবে বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা। সেটা হলো ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সাকিব আল হাসানের সঙ্গে ১১৮ রানের জুটি। সেবার ইংলিশদের দেওয়া ৩০৯ রান তাড়া করতে নেমে চাপের মধ্যে লড়াকু সেঞ্চুরি করেছিলেন কায়েস। যদিও সেটা শেষপর্যন্ত জেতা হয়নি বাংলাদেশের।
অনেক পুরনো কথা থাক। মাত্র শেষ হওয়া এশিয়া কাপের শুরুতেও ছিলেন না ৩১ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার। তামিমের ইনজুরি হলে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) হাই পারফরম্যান্স ইউনিট (এইচপি) এর খেলার মাঝখান থেকে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ইমরুলকে। লম্বা ভ্রমণের ধকল সয়ে টুর্নামেন্টে দলের বাঁচা-মরার ম্যাচে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৮৯ বলে খেলে ফেলেন ৭২ রানের ইনিংস, যা দলকে নিয়ে যায় ফাইনালের দিকে।
ইমরুল আসলে দল নিয়ে কতটা ভাবেন? জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডে শেষেই সেটা নিজের কথায় জানিয়ে দিয়েছেন। প্রশ্ন উঠেছিলো, এই ইনিংসটিই ওয়ানডেতে তার সেরা ইনিংস কিনা। উত্তরে বলেছেন,
‘এটা আমার ক্যারিয়ারের ভালো একটা ইনিংস হিসেবে রাখবো। তবে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ইনিংসটা অনেক দরকার ছিল। আল্টিমেটলি নিজে ভালো খেললে দলের কাজ হয়ে যায়। আজকের ইনিংসটির জন্য বাংলাদেশ দল সেভ হয়ে গেছে। এটার জন্য আলহামদুলিল্লাহ।’
ইমরুল ওপেনার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও কোচ চান্দিকা হাতুরুসিংহের কারণে তাকে অনেকগুলো ম্যাচ ওয়ানডেতে খেলতে হয়েছে তিন নম্বরে। কারণ ততদিনে সৌম্য সরকারে মুগ্ধ শ্রীলঙ্কান কোচ যেন ভুলেই গিয়েছিলেন ইমরুলের কথা।
মুগ্ধতা আসবে যাবে, জয়জয়কার হবে নতুন কারও। কিন্তু ১০ বছর ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলেও যেখানে অবহেলিত ইমরুল কায়েস, তিনি এসব নিয়ে ভাবতে চান না একটুও। বরং দায়িত্বটা কাঁধে নিয়ে এগোতে চান যখন তখন, খেলতে চান আরও অনেকদিন।
ইমরুলের ভাষায়,
‘আমার সঙ্গে অনেক ক্রিকেটারের একসঙ্গে অভিষেক হয়েছে, খেলেছে। তারা এখন দৃশ্যপটেও নেই। আমার কাছে মনে হয় দৃঢ়প্রতিজ্ঞার ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি বিশ্বাস করি আমার ক্যারিয়ারে এত দ্রুত শেষ হতে পারে না। আমি সবসময় নিজেকে প্রস্তুত রাখি। যতদিন খেলবো, জাতীয় দলে খেলার জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখি। যেদিন হয়তো জাতীয় দলে খেলার চান্স থাকবে না, নিজেই বলব থ্যাংক ইউ।’
বাংলাদেশ দলে পর্দার আড়ালের নায়করা কেন যেন এমনই হন। ফিরে আসেন বারবার, জানান দেন শক্তি ও সম্ভাবনার। যেন বুঝিয়ে দেন, ‘চির উন্নত মম শির’।