Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

২৮ বছরের শিরোপা খরা ঘোচাতে আর্জেন্টিনা কি প্রস্তুত?

দরজায় আরো একটি বিশ্বকাপ কড়া নাড়লেও চার বছর আগের ব্রাজিল বিশ্বকাপের স্মৃতি এখনো সবার কাছে উজ্জ্বল। তবে মারাকানা স্টেডিয়ামের সেই স্মৃতি আর্জেন্টিনার কাছে একদমই সুখকর নয়। দীর্ঘ ২৪ বছর পর আর্জেন্টিনা পৌঁছেছিলো বিশ্বকাপ ফাইনালে। লিওনেল মেসির সামনে সুযোগ এসেছিলো অবিসংবাদিত সেরা হবার। আর্জেন্টিনা মঞ্চও প্রস্তুত করে রেখেছিলো বরণ করে নেবার জন্য।

কিন্তু ভাগ্যবিধাতা তা হতে দেননি। বিশ্বকাপ ট্রফির সামনে মাথা নিচু করে ফিরতে হয়েছিলো মেসিবাহিনীকে। ব্রাজিল বিশ্বকাপ ব্যর্থতার পরে টানা দুটি কোপা আমেরিকার ফাইনাল হেরেছে তারা।  হতাশা, বেদনার ভার সইতে না পেরে মাঝে জাতীয় ফুটবল থেকে বিদায় নিয়েছিলেন মেসি। তবে অনুরোধ ও ভালোবাসায় ফিরতে হয়েছে তাকে। কোচও পরিবর্তন হয়েছে তিন তিনবার। রাশিয়া বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব বিবর্ণ গেলেও শেষপর্যন্ত চূড়ান্ত পর্বের টিকিট কাটতে পেরেছে আর্জেন্টিনা।

জার্মানির শেষ মুহুর্তের গোলে হেরে যাওয়া বিপর্যস্ত আর্জেন্টিনা; Source: Getty Images

মেসি জানিয়েছেন, “ইকুয়েডরের বিপক্ষে ম্যাচ জয়ের পর আর্জেন্টিনা দলের আবহাওয়া একদম পরিবর্তন হয়ে গেছে।” নতুন স্বপ্নে বিভোর হয়ে ছুটে চলা আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ প্রস্তুতি কি আসলে প্রত্যাশা অনুযায়ী? এ লেখায় সে বিষয়গুলোই বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো।

প্রাথমিক দল ও একাদশ

আর্জেন্টিনা ফুটবলে সবসময়ই গোলকিপার ও দুর্বল ডিফেন্সের সমস্যায় ভুগেছে। গতবারের মতো এবারও সমর্থকদের ভরসা রাখতে হবে পুরনো সৈনিক সের্হিও রোমেরোর উপর। রোমেরোর সাথে এবার প্রথমবারের মতো দলে থাকবেন ৩৬ বছর বয়সী উইলিয়াম ক্যাবায়েরো। এদের দুজনের কেউই ক্লাব ফুটবলের প্রথম একাদশে নিয়মিত খেলোয়াড় নন। চেলসি ও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বেঞ্চে বসে থেকে তাদের দুজনেরই ফর্মে মরচে ধরে যাবার কথা। এ দুজনের উপর আস্থা রাখা আর বাঘকে পোষ মানানো একই কথা।

দলের আরেকটি পুরনো সমস্যা মূল ডিফেন্স। অথচ বললে কেউ বিশ্বাস করবে না, ‘১৪ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার সাফল্যের অন্যতম কারণ ছিলো এই আর্জেন্টাইন ডিফেন্স। তৎকালীন কোচ আলেহান্দ্রো গঞ্জালেস সাবেয়া সম্ভবত জাদুমন্ত্র কিছুটা জানতেন। ওটামেন্ডি, ডেমিচেলিস ও গ্যারায়দের ব্যবহার করে রক্ষণের চেহারা যে বদলে ফেলেছিলেন তিনি। তাঁর বিদায়ের পর যেন পুরনো সমস্যা আবারো ভয়াল রূপে সামনে আসলো।

বর্তমান আর্জেন্টিনা কোচ হোর্হে সাম্পাওলি সম্পর্কে জানাশোনা থাকলে জানার কথা, তিনি মার্সেলো বিয়েলসার অনুসারী। তার পদ্ধতি অনুসরণ করে সাম্পাওলি নিজেও উইং এবং ফুলব্যাক পজিশনে বেশি গুরুত্ব দেন। পাবলো জাবালেতার পুরনো ফর্ম না থাকায় আর মার্কোস রোহোর ধারাবাহিক ব্যর্থতায় তিনি আনকোরা দুই ফুলব্যাক নিকোলাস ট্যাগলিয়াফিকো ও ফ্যাব্রিসিও বুসতোসকে এবার একাদশে ডাকেন। সাম্পাওলির ফুটবল দর্শন ও সম্প্রতি শেষ হওয়া প্রীতি ম্যাচগুলো দেখে এটা পরিষ্কার যে, বিশ্বকাপের মূলমঞ্চে এরাই তার স্কোয়াডে থাকবেন। দলের রাইটব্যাক বুসতোসের ম্যানমার্কিংয়ে সমস্যা আছে। প্রায় সময়ই নিজের পজিশন হারিয়ে জায়গা বাড়িয়ে দেবার মতো ভুল করে বসেন। ট্যাগলিফিকোর বল হারানোর প্রবণতা বেশি। তাই নতুন এ দুই ফুটবলার এবং ওটামেন্ডি ও ফ্যাজিওকে নিয়ে সাম্পাওলি রক্ষণ কতটুকু মজবুত করতে পারবেন, সেখানে প্রশ্ন থেকেই যায়।

আর্জেন্টিনার নতুন সেনা। ট্যাগলিয়াফিকো ও বুসতোস; Source: Facebook

প্রীতি ম্যাচে স্পেনের বিপক্ষে আর্জেন্টিনার বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ স্বয়ং সাম্পাওলি। বুড়োদের নিয়ে মিডফিল্ড সাজিয়ে তিনি যে বাজিমাত করতে চেয়েছিলেন সেটা সম্পূর্ণ ভেস্তে গেছে। মাশ্চেরানো, বানেগা ও বিলিয়ারা নিজেদের দায়িত্ব তো পালন করতে পারেননি, উল্টো বল হারিয়েছেন স্পেনের প্লেয়ারদের কাছে। অথচ তরুণদের প্রতিভা ও বয়স্ক খেলোয়াড়দের অভিজ্ঞতার মিশেলে কতটা পরিপূর্ণ ফুটবল খেলা সম্ভব তার তরতাজা উদাহরণ ইতালির বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচ। মিডফিল্ডের জন্য লো সেলসো, পারেদেস, লানজিনি, ম্যাক্সিমিলিয়ানো মেজার মতো তরুণ প্রতিভাবান প্লেয়ারদের অপশন সাম্পাওলির হাতে আছে। তাই এদিকটা পুরোটাই নির্ভর করছে দলের কোচের ওপর।

স্পেনের কাছে ৬-১ গোলে হতাশার ম্যাচে আর্জেন্টিনা; Source : Twitter

বর্তমান ফুটবলে আর্জেন্টিনার আক্রমণত্রয়ীকে নির্দ্বিধায় সেরা বলা যায়। ডি মারিয়া, ইগুয়াইন, আগুয়েরো, মেসি- এদের সামর্থ্য নিয়ে কারো সংশয় থাকার কথা নয়। অথচ মূলমঞ্চে এ আক্রমণ যেন সবথেকে বেশি আত্মবিশ্বাসহীন, সবথেকে বেশি অলস। আর্জেন্টিনার তিনটি ফাইনাল ম্যাচে গোল মিস করেছেন গঞ্জালো ইগুয়াইন। এ ধারা বজায় রেখে স্পেনের বিপরীতে সহজ গোলগুলোও একের পর এক হাতছাড়া করেছেন তিনি। সামান্য ‘ট্যাপ ইন’ গোল তিনি জালে জড়াতে পারেননি। জুভেন্টাসের হয়ে ক্যারিয়ারের সেরা সময় পার করলেও আর্জেন্টিনার ম্যাচে তিনি অনেক বেশি অলস, গোল ক্ষুধাহীন। ইগুয়াইনের বিকল্প ভাবা উচিত আর্জেন্টিনা কোচের। আগে থেকে ভঙ্গুর দল না নিয়ে, আত্মবিশ্বাসী একটি দলকে বিশ্বকাপের মূলমঞ্চে পাঠানো বেশি যুক্তিসংগত।

ইনজুরি সমস্যা

বিশ্বকাপের আগে আর্জেন্টিনা দলে কোনো গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়ের বড় ধরনের ইনজুরি সমস্যা নেই। লিওনেল মেসি আর্জেন্টিনা ক্যাম্পে অনুশীলনে চোট পেয়েছেন সেটা সত্য। তবে এএফএ জানিয়েছে, মেসির চোট তেমন গুরুতর নয়। প্রীতি ম্যাচ বলেই সাম্পাওলি তাকে দলে নেবার সাহস দেখাননি। ইতালি ম্যাচে পারেদেস, লানজিনি ও ডি মারিয়া চোট পেলেও বিশ্বকাপের অনেক আগেই তারা ফিট হয়ে যাবেন। তবে রাশিয়ার আবহাওয়ায় যে খেলোয়াড়ের অভিজ্ঞতা সবথেকে বেশি কাজে দিতে, লিগামেন্ট ইনজুরিতে জর্জরিত হয়ে এমানুয়েল মাম্মানার বিশ্বকাপ শেষ হয়ে গেছে এ মাসের শুরুর দিকে। এছাড়া বেনফিকার উইংগার এদুয়ার্দো সালভিওর গোড়ালির ইনজুরি কারণে বিশ্বকাপে খেলা নিয়ে সংশয় আছে।

জেনিস সেন্ট পিটার্সবাগের অার্জেন্টাইন ডিফেন্ডার এমানুয়েল মাম্মানা; Source: Getty Images

আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন ও কোচ সাম্পাওলি

শতবার্ষিকী কোপা আমেরিকার পর আর্জেন্টিনা দলে প্রথম ধাক্কা আসে কোচ জেরার্ডো মার্টিনোর আকস্মিক পদত্যাগের পর। তার আর্জেন্টিনার ম্যানেজারের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর অন্যতম কারণ এএফএ এর গোঁয়ার্তুমি ও বেতন পরিশোধ করার অনীহা। এএফএ’র মাঝে এত বেহাল অবস্থা ছিলো যে, দলের স্টাফদের বেতন বাকি দেখে তা পরিশোধ করে দিয়ে যান লিওনেল মেসি! পরবর্তীতে নির্বাচনের মাধ্যমে আর্জেন্টিনার নতুন সভাপতি হন ক্লাদিও তাপিয়া। তিনি এসে প্রথমে এদগার্দো বাউজাকে ছাঁটাই করে হোর্হে সাম্পাওলিকে আর্জেন্টিনার কোচের দায়িত্বে নিয়োগ দেন। বর্তমানে সহায়তা ও আর্থিক দিক থেকে আর্জেন্টিনার কোনো সমস্যা নেই।

২০১৫ সালের কোপা আমেরিকা আর্জেন্টিনা হেরেছিলো চিলির বিপক্ষে। সে সময়ে চিলির কোচ ছিলেন সাম্পাওলি। চিলির ইতিহাসে প্রথম শিরোপা জয়ে অন্যতম ভূমিকা ছিলো আর্জেন্টাইন এ কোচের। তাঁর ছোঁয়ায় চিলি ছুটছিলো দুর্নিবার গতিতে। চিলি ছেড়ে সেভিয়াতে গিয়েও সাম্পাওলি সাফল্য লাভ করেছিলেন, সেভিয়াকে স্বপ্ন দেখাচ্ছিলেন আরেকটি ইউরোপা জয়ের। কিন্তু আর্জেন্টিনার কোচ হবার প্রস্তাব পেয়ে তিনি তা উপেক্ষা করতে পারেননি। ইউরোপা জয়ে আশা ত্যাগ করে আর্জেন্টিনার দায়িত্ব গ্রহণ করতে ছুটে আসেন তিনি। সমর্থকেরা ভেবেছিলেন, এবার হয়তো স্বপ্নিল দিনগুলো ফিরবে। তবে আশা দেখিয়েও সমর্থকদের নিরাশ করেছেন সাম্পাওলি। এদগার্দো বাউজার অগোছালো দলকে তিনি শুধুমাত্র গুছিয়ে এনেছেন। ফিরিয়ে আনতে পারেননি দলের পারফর্মেন্স, খেলোয়াড়দের আত্মবিশ্বাস।

হোর্হে সাম্পাওলি; Source : Dailymail

নাইজেরিয়া ও স্পেনের সাথে প্রীতি ম্যাচে বাজে ভাবে হার স্বীকার করার পর, সকল সমালোচনার তীর যায় সাম্পাওলির বিরুদ্ধে। তার কারণ অবশ্য আছে। তিনি সবসময় তরুণ প্লেয়ারদের সুযোগ দিতে পছন্দ করেন। আর্জেন্টিনাতে এসেও তরুণ প্লেয়ারদের নিয়ে সদা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গেছেন। দায়িত্ব নেবার এত মাস পরও তিনি একটি স্থায়ী একাদশ তৈরি করতে পারেননি। শুধু ফরমেশন নয়, খেলোয়াড়দের পজিশন পরিবর্তন করেও তার এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে গেছেন। অথচ যেখানে পরিবর্তন সবথেকে বেশি জরুরি ছিলো, সেখানে তিনি ছিলেন নিশ্চুপ। ধারাবাহিক ব্যর্থতার পর আবারো তিনি গঞ্জালো ইগুয়াইনকে ডেকেছেন ইকার্দিকে ভালোভাবে সুযোগ না দিয়ে। সবথেকে অদ্ভুত বিষয়, তিনি চেয়েছিলেন সিরি আ’র এ সিজনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা (দিবালা ও ইকার্দিকে) উপেক্ষা করে বিশ্বকাপে যেতে।

স্পেনের সাথে প্রীতি ম্যাচের আগে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, “বিশ্বকাপের জন্য যথাযথ দল এখনও তিনি খুঁজে পাননি।” খুঁজে না পেলে হয়তো একটি একাদশ তিনি ভেবে রেখেছিলেন। এ ম্যাচের পর আগের ভেবে রাখা অনেক কিছুই মুছে ফেলে তাকে ভাবতে হবে নতুন করে, সেটা আর্জেন্টিনা কোচ নিজের মুখে স্বীকার করেছেন। সেক্ষেত্রে স্পেনের সাথে এ লজ্জাজনক হার একপ্রকার সান্ত্বনা। কোচের নতুন চিন্তাভাবনায় বাদ যেতে পারে অনেক খেলোয়াড়, পরিবর্তন হতে পারে দলের অনেক কিছু। তবে বিশ্বকাপের আগে হারানো আত্মবিশ্বাস দলকে ফিরিয়ে এনে দেওয়া, ভারসাম্যহীন রক্ষণ মেরামত করা ও আক্রমণে গতি এনে দেবার মতো তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ অবশ্যই তাকে করতে হবে। সবকিছুর জন্য হোর্হে সাম্পাওলি সময় পাবেন মাত্র সোয়া দুই মাস।

আর্জেন্টিনাকে সোজা করে দাঁড় করানো ছাড়া কোন বিকল্প সমাধান নেই সাম্পাওলির হাতে; Source : Victor R Caivano

অনেক সমালোচনার পরও হোর্হে সাম্পাওলি এখনও আর্জেন্টাইনদের কাছে একটি ভরসার নাম। আর লিওনেল মেসি তো আছেনই। ইকুয়েডরের বিপক্ষে তিনি জ্বলে না উঠলে আর্জেন্টিনাকে এ বিশ্বকাপে থাকতে হতো দর্শক হয়ে। একজন মেসি ছাড়া আর্জেন্টিনা খর্বকায় ও সাধারণ মানের একটি ফুটবল দল। আর্জেন্টিনার অন্যতম আস্থার প্রতীক মেসি নিজেই মানেন এ বিশ্বকাপে তার দল ফেবারিট নয়। দলের অবস্থা এমন নড়বড়ে জেনেও অনেক সমর্থকই আশায় বুক বাঁধেন। স্বপ্ন দেখেন ২৮ বছরের আরাধ্য শিরোপা জয় করার। তবে মেসি কখনোই একা পারবেন না, সামর্থ্য অনুযায়ী লড়তে হবে পুরো দলকে। ইতিবাচক দিক একটাই, বিপদ উপলব্ধি করার পর সেটা এড়ানোর জন্য মূল্যবান ৭০ দিনের কিছু বেশি সময়।

Featured photo: Bao Tailiang

Related Articles