![](https://assets.roar.media/assets/Hkv5zchxX1yAaW9h_article-2176952-142B616B000005DC-779_1024x615_large.jpg?w=1200)
টমাস জেমস ম্যাথুজ। সংক্ষেপে টি. জে ম্যাথুজ। তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার খুব সাদামাটা। এতই চাকচক্যহীন যে সবজান্তা গুগলে টি. জে ম্যাথুজ লিখে সার্চ করলে শুরুতে তার নাম আসে না। নামের পাশে ক্রিকেটার লিখে দিলেই তবে তার নাম সার্চ লিস্টের উপরের দিকে আসে।
তার ক্যারিয়ারটাও এমন। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে মাত্র আটটি টেস্ট খেলে মাত্র একটি অর্ধশতকের সাহায্যে ১৭.০০ ব্যাটিং গড়ে ১৫৩ রান তুলেছেন। বল হাতে কখনও ইনিংসে ৫ উইকেট পাননি, ২৬.১৮ গড়ে শিকার করেছেন ১৬ উইকেট। ফিল্ডার হিসেবে সাতটি ক্যাচ তালুবন্দী করেছেন। এই পরিসংখ্যান দেখে যে কেউ তাকে একজন সাধারণ ক্রিকেটার হিসেবেই গণ্য করবে। কিন্তু এই পরিসংখ্যানের সাথে ‘হ্যাটট্রিক’ শব্দটা জুড়ে দিলেই ম্যাথুজ অমর হয়ে থাকবেন। ঠিক যেমনটা তার নামের পাশে ক্রিকেটার বসিয়ে তাকে গুগল সার্চ লিস্টের প্রথম পাতায় আনা যায়।
![](https://assets.roar.media/assets/FA3Dm2meqJPvszm8_4893485044_a429cb5dc0_b.jpg)
১.
টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বপ্রথম হ্যাটট্রিক করেছেন ফ্রেড স্পফোর্থ। সর্বশেষ হ্যাটট্রিকটি ইংল্যান্ডের স্পিনার মঈন আলীর দখলে। টেস্টে এখন পর্যন্ত বোলারদের হ্যাটট্রিক করার ঘটনা ঘটেছে ৪৩ বার। এর মধ্যে নাম রয়েছে জিমি ম্যাথুজেরও। একবার নন, দুবার হ্যাটট্রিক করেছেন তিনি। অবশ্য দুবার হ্যাটট্রিক করা একমাত্র বোলার নন তিনি। টেস্ট ক্রিকেটে দুবার করে হ্যাটট্রিক করেছেন তার স্বদেশী হিউ ট্রাম্বল এবং পাকিস্তানি পেসার ওয়াসিম আকরামও। তবে তাদের থেকে ম্যাথুজের কীর্তিটা অনন্য। তিনি টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসের একমাত্র বোলার হিসেবে একই ম্যাচের দুই ইনিংসে হ্যাটট্রিক করেন। ওয়াসিম আকরামও খুব একটা পিছিয়ে নেই। তিনি পরপর দুই টেস্টে হ্যাটট্রিক করেছিলেন। তবে ম্যাথুজের মতো এক ম্যাচ দুবার হ্যাটট্রিক করতে পারেননি আর কোনো বোলার। তিনি শুধু এক ম্যাচে না, একইদিনে দুটি হ্যাটট্রিক করেছিলেন।
![](https://assets.roar.media/assets/90e58oozCRiOezVh_221791.jpg)
হিউ ট্রাম্বল এবং ওয়াসিম আকরাম, দুজনই বোলার হিসেবে ম্যাথুজের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার অফব্রেক বোলার ট্রাম্বল ৩২ টেস্ট খেলে ১৪১ উইকেট শিকার করেছিলেন। আর ওয়াসিম আকরামের কীর্তি তো পরিসংখ্যান দিয়ে না বললেও চলবে।
২.
অস্ট্রেলিয়ার লেগব্রেক বোলার জিমি ম্যাথুজ এক ম্যাচের দুই ইনিংসে হ্যাটট্রিক করেছিলেন ১৯১২ সালের ২৮ মে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারের ওল্ড ট্রাফোর্ড। তবে প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড না। তার হ্যাটট্রিকের শিকার হয়েছিলো দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটসম্যানরা। দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে ১৯১২ সালে একটি ট্রায়াঙ্গুলার টেস্ট সিরিজ অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সিরিজের প্রথম ম্যাচে ডাবল হ্যাটট্রিকের কীর্তি গড়েন ম্যাথুজ।
ম্যাচে টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। ওয়ারেন বার্ডসলির ১২১ রান, চার্লস কেলওয়ের ১১৪ রান এবং জিমি ম্যাথুজের অপরাজিত ৪৯ রানের উপর ভর ৪৪৮ রান সংগ্রহ করেছিল অস্ট্রেলিয়া। জবাবে দ্বিতীয় দিনে নিজেদের প্রথম ইনিংসে দক্ষিণ আফ্রিকার সংগ্রহ ছিলো ৭ উইকেটে ২৬৫ রান। একপ্রান্তে ১২২ রানে অপরাজিত ছিলেন জর্জ ফকনার। তিনি এরপর আর ব্যাটিং প্রান্তে যেতে পারেননি। কারণ ম্যাথুজ তার প্রথম হ্যাটট্রিক করেন ঠিক সেইসময়।
প্রথমে রোল্যান্ড বিউমন্ডকে বোল্ড করেন তিনি। এরপর প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়ার ছয় ব্যাটসম্যানকে আউট করা সিড পেগলারের উইকেট তুলে নেন। পরের বলে শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে মাঠে নামা উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান টম ওয়ার্ডের উইকেট তুলে নিয়ে হ্যাটট্রিক করেন। এই হ্যাটট্রিক করতে তিনি কোনো ফিল্ডারের সাহায্য নেননি। বিউমন্ডকে বোল্ড করার পর পেগলার এবং ওয়ার্ডকে লেগ বিফোরের ফাঁদে ফেলেছিলেন।
![](https://assets.roar.media/assets/MZU3M7RcKNR5EZ9T_145534.jpg)
ফলো-অনে পড়ে ব্যাট করতে নেমে দ্বিতীয় ইনিংসে দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটিংয়ের অবস্থা হয় আরও শোচনীয়। মাত্র ৯৫ রানের মধ্যে সবক’টি উইকেট হারায় তারা। কয়েক ঘন্টা আগে হ্যাটট্রিক করা ম্যাথুজ আবারও হ্যাটট্রিক করেন। দক্ষিণ আফ্রিকার যখন ৭০ রানে ৫ উইকেট নেই, তখন ম্যাথুজের হ্যাটট্রিক কার্যক্রম শুরু হয়। প্রথমে ফেরান দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান হার্বি টেইলরকে। এবারও বোল্ড করে প্রথম উইকেট শিকার করেন। দ্বিতীয় উইকেট শিকার করেন রেগি শোয়ার্জের। তাকে কট এন্ড বোল্ড করে ফিরিয়ে দেন। প্রথম ইনিংসে ১১ নাম্বারে নামা ওয়ার্ডের উইকেট দিয়ে হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেছিলেন তিনি। কী ভেবে আবারও হ্যাটট্রিকের শেষ শিকারে পরিণত হতে নয় নাম্বারে নামেন ওয়ার্ড। ঘটলো-ও তাই। ওয়ার্ডকেও কট এন্ড বোল্ড করে একদিনে নিজের দ্বিতীয় হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেন জিমি ম্যাথুজ।
৩.
টেস্ট ক্রিকেটে মাত্র ১৬ উইকেট শিকার করা জিমি ম্যাথুজ ঐ ম্যাচে দুবার হ্যাটট্রিক করলেও মোটে ঐ ৬ উইকেটই পেয়েছিলেন। প্রথম ইনিংসে ১২ ওভারে ১৬ রান দিয়ে ৩ উইকেট এবং দ্বিতীয় ইনিংসে ৮ ওভারে ৩৮ রান দিয়ে ৩ উইকেট শিকার করেছিলেন। ম্যাচে অস্ট্রেলিয়া ইনিংস ও ৮৮ রানের ব্যবধানে জিতেছিল। এই জয়ে ম্যাথুজের অবদান অনস্বীকার্য। তবে সবচেয়ে বেশি অবদান ছিলো চার্লস কেলওয়ের। তিনি ব্যাট হাতে ১১৪ রানের ইনিংস খেলার পর বল হাতে দ্বিতীয় ইনিংসে ৫ উইকেট শিকার করেছিলেন।
১৯১২ সালের ২৮ মে বাদ দিলে জিমি ম্যাথুজ খুবই সাধারণ একজন ক্রিকেটার, যার ক্যারিয়ারে নেই কোনো শতক কিংবা ইনিংসে ৫ উইকেট। ম্যাচ সংখ্যাও এক অংকের। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটও খেলেছেন মাত্র এক পঞ্জিকাবর্ষ। ১৯১২ সালের ১২ জানুয়ারি ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে তার। অভিষেক ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসে নয় নাম্বারে ব্যাট করতে নেমে ৫৩ রানের ইনিংস খেলেছিলেন, যা তার ক্যারিয়ারের একমাত্র অর্ধশতক।
![](https://assets.roar.media/assets/kiPTAZqTtEBmhfsM_C3SOH4AWYAAuM06.jpg)
নিজের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছিলেন ১৯১২ সালের ১৯ আগস্ট। তার খেলা আটটি টেস্টের মধ্যে ছয়টি খেলেছেন ঐ ট্রায়াঙ্গুলার সিরিজেই। এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে ক্রিকেট খেলা বন্ধ ছিলো। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে পুনরায় ক্রিকেট খেলা শুরু হলেও বয়স থাকা সত্ত্বেও আর মাঠে নামেননি জিমি ম্যাথুজ। আর এতে করেই তার সাদামাটা ক্যারিয়ারের শুরু এবং সমাপ্তি ঘটে ১৯১২ সালে। ১৯১২ সালের ইংল্যান্ড সফরটি তার আট-নয় বছরের ফার্স্টক্লাস ক্যারিয়ারের সেরা সময় ছিলো। ফার্স্টক্লাস ক্রিকেটে মোট ১৭৭ উইকেট শিকার করা ম্যাথুজ ঐ বছরেই ১৯.৩৭ বোলিং গড়ে ৮৫ উইকেট শিকার করেছিলেন। সাধারণ এই ক্রিকেটার রেকর্ডের পাতায় অমর হয়ে থাকবেন ১৯১২ সালের ২৮ মে দিনটির কারণে। যখনি টেস্ট ক্রিকেটে আলোচনা উঠবে, তখনি ম্যাথুজের নামটি সবার আগে থাকবে।
৪.
![](https://assets.roar.media/assets/enwu4TNEES381igs_213529.jpg)
টেস্ট ক্রিকেটে হ্যাটট্রিক নিয়ে কিছু কথা
- টেস্ট ক্রিকেটে একাধিকবার হ্যাটট্রিক করেছেন তিনজন। হিউ ট্রাম্বল, জিমি ম্যাথুজ এবং ওয়াসিম আকরাম দুবার করে হ্যাটট্রিক করেন।
- অভিষেক টেস্ট হ্যাটট্রিক করেছেন তিনজন- মরিস আলম, পিটার পেথেরিক এবং ড্যামিয়েন ফ্লেমিং।
- ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট ম্যাচে হ্যাটট্রিক করেছেন দুজন- হিউ ট্রাম্বল এবং জিওফ গ্রিফিন।
- দুই ইনিংস মিলিয়ে হ্যাটট্রিক করেছেন তিনজন- কোর্টনি ওয়ালশ, মার্ভ হিউজেস এবং জার্মেইন ল’সন।
- অভিষেক টেস্টে হ্যাটট্রিক করা পিটার পেথেরিক ঐ ইনিংসে ১০৩ রানের বিনিময়ে ৩ উইকেট শিকার করেছিলেন, যা হ্যাটট্রিক করা কোনো বোলারের সবচেয়ে বেশি খরুচে বোলিং বিশ্লেষণ।
- অভিষেক টেস্টে হ্যাটট্রিক করা ড্যামিয়েন ফ্লেমিংও এক জায়গায় অনন্য। তিনি ঐ ইনিংসে হ্যাটট্রিক করার পরেও পাকিস্তান ৫৩৭ রান সংগ্রহ করেছিলো। কোনো বোলার হ্যাটট্রিক করার পরেও প্রতিপক্ষের সবচেয়ে বেশি রান সংগ্রহ করার রেকর্ড এটি।
- বাংলাদেশের প্রথম বোলার হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে হ্যাটট্রিক করেছিলেন অলক কাপালি। এই হ্যাটট্রিকসহ তার ক্যারিয়ারে মোট উইকেট সংখ্যা ছয়টি। হ্যাটট্রিক করা কোনো বোলারের সবচেয়ে কম উইকেট শিকারের রেকর্ড কাপালির দখলে।
- ইনিংসে নিজের করা প্রথম তিন বলে হ্যাটট্রিক করা একমাত্র বোলার শ্রীলঙ্কার বাঁহাতি পেসার নুয়ান জয়সা। তিনি জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ১৯৯৯ সালে হারারেতে ইনিংসের দ্বিতীয় ওভার এবং নিজের প্রথম ওভারের তিন বলে হ্যাটট্রিক করেছিলেন।
- টেস্ট ক্রিকেটে একমাত্র বোলার হিসেবে ইনিংসের প্রথম ওভারে হ্যাটট্রিক করার কীর্তি ইরফান পাঠানের দখলে। তিনি ২০০৬ সালে করাচিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে ইনিংসের প্রথম ওভারে হ্যাটট্রিক করার কীর্তি গড়েছিলেন।