১
ইউরোপিয়ান কাপ (বর্তমানে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ) ১৯৯২, লন্ডনের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে খেলা চলছে। ফাইনাল ম্যাচ, মুখোমুখি স্পেনের বার্সেলোনা আর ইতালির সাম্পডোরিয়া। ২০১৭ সালে বসে খুব সহজেই বলে ফেলা যায় যে, ফেভারিট তো অবশ্যই বার্সেলোনা। কিন্তু ফুটবল ইতিহাসের মনোযোগী পাঠকদের প্রত্যেকেই জানেন, ১৯৯২ সালের বার্সেলোনা বর্তমানের মতো ছিল না।
দুই দলের জন্যই ম্যাচটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বার্সেলোনা লিগ জিতলেও এর আগ পর্যন্ত কখনো ইউরোপ সেরা হতে পারেনি। এর আগে ফাইনালেই উঠেছিল মাত্র ২ বার, সেটাও সর্বশেষ ১৯৮৬ সালে। অন্যদিকে সাম্পডোরিয়া আগের মৌসুমেই ইতালির সিরি এ চ্যাম্পিয়ন। ক্লাবের ইতিহাসে প্রথমবার ইউরোপ সেরা হবার সুযোগটিকে তারা হারাতে চাচ্ছিল না। নির্ধারিত সময় গোলশূন্য শেষ হলো।
সেই মূহুর্তে ডাগ আউটে একজন মানুষকে দেখা গেল ললিপপ মুখে নিয়ে অস্থিরভাবে পায়চারি করতে। টেনশনে সিগারেট খাওয়ার দৃশ্যটা অস্বাভাবিক নয়, কেউ কেউ হয়তো ডাগ আউটে চুইংগাম চাবানোটা একটা স্বভাবে পরিণত করে। কিন্তু বাচ্চাদের মতো ললিপপ খাওয়ার চিত্রটি একটু অদ্ভুত। টেনশনটা বেশিক্ষণ রইলো না। ১১২তম মিনিটে বার্সেলোনার পক্ষে গোল করে ইতালিয়ান দুর্গ ভাঙার কাজটি করলেন রোনাল্ড কোম্যান। বাকি ৮ মিনিট ভালোভাবেই পার করলো বার্সেলোনার সদস্যরা।
শেষ বাঁশি বাজার সাথে সাথে ললিপপটা শূন্যে উড়িয়ে বাচ্চাদের মতোই দলের অন্যান্যদের সাথে মাঠে নেমে গেলেন তিনি উল্লাস করতে। উল্লাস করাটা মোটেও দোষের কিছু ছিল না, ইউরোপের নতুন চ্যাম্পিয়ন তারা।
ললিপপ মুখে রাখা এই লোকটির নাম ক্রুয়েফ। এক সময় চেইন স্মোকার ছিলেন, তার কুফলটা পেলেন অনেক দিন পর। ১৯৯১ সালে এক ডাক্তারি পরীক্ষায় জানা গেল, ফুসফুসে বাসা বেঁধেছে ক্যান্সার, তাই নিকোটিন ছাড়তে হলো। সিগারেটের পরিবর্তে তাই ডাগ আউটে ললিপপ মুখে নিয়ে ঘুরতেন এই ভদ্রলোক।
২
শুধু ইউরোপ জয়ই নয়, কোচ হিসেবে বার্সেলোনার ইতিহাসটাকেই পালটে ফেলেছিলেন ক্রুয়েফ। তবে শুরুটা এতটা মসৃণ ছিল না। সবচেয়ে বড় কথা, যে বার্সেলোনাকে নিয়ে তিনি পথচলা শুরু করেছিলেন, সেটিও অসাধারণ মানের কিছু ছিল না। যখন কোচিংয়ের দায়িত্ব পেলেন, তখন তাদের লিগ শিরোপা ছিল মাত্র ১০টি, রিয়াল মাদ্রিদের ২৪টি। এমনকি অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদ আর অ্যাথলেটিকো বিলবাও ৮টি করে লিগ শিরোপা নিয়ে বার্সেলোনার সাথে প্রতিযোগিতায় ছিল।
দলের দায়িত্ব নিয়ে ক্রুয়েফ তাড়াহুড়ো করলেন না, একটু দূরের দিকে তাকালেন। আগের মৌসুমে লিগে পজিশন ছিল ৬ নম্বরে, দায়িত্ব পেয়ে প্রথম মৌসুমে দলকে নিয়ে আসল দ্বিতীয় অবস্থানে। ৭ বছর পর তারা জিতলো উয়েফা কাপ উইনার্স কাপ।
পরের মৌসুমে লিগে অবস্থান একটু খারাপ হলো, রিয়াল মাদ্রিদের চেয়ে ১১ পয়েন্ট পেছনে থেকে লিগে ২য় হলো বার্সা। তবে রিয়াল মাদ্রিদকেই ২-০ গোলে হারিয়ে জিতলো কোপা দেল রে। এরপরের মৌসুমগুলো হলো শুধুমাত্র ক্রুয়েফ শো।
যে দল লিগ জিতেছে সর্বশেষ ১৯৮৫ মৌসুমে, সেই দল ১৯৯০-৯১ থেকে ১৯৯৩-৯৪ পর্যন্ত টানা ৪ মৌসুম লিগ শিরোপা জিতে নিল। বার্সেলোনার সেই দলের নাম হলো ‘Dream Team’, মানে ‘স্বপ্নের দল’। সত্যিকার অর্থে কল্পকথার মতো অবিশ্বাস্যই খেলছিল তারা। ১৯৮৯-৯৪ পর্যন্ত টানা ৫টি মৌসুম স্বপ্নের মতোই কাটিয়েছিল ক্রুয়েফের দল। এই সময়ের মাঝে তারা ৪টি লিগ ছাড়াও ১টি ইউরোপিয়ান কাপ, ১টি কোপা ডেল রে, ৩টি স্প্যানিশ সুপার কাপ, ১টি উয়েফা সুপার কাপ আর ১টি উয়েফা কাপ উইনার্স কাপ জিতে নেয়। এছাড়া হট ফেভারিট হয়েও মিলানের কাছে ফাইনালে ১টি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ হেরে যায়।
বার্সার হয়ে ১১টি ট্রফি জয় ক্রুয়েফকে বার্সার ইতিহাসের সবচেয়ে সফল কোচে রূপান্তরিত করেছিল, যে রেকর্ড পরবর্তীতে ভেঙেছিল তারই শিষ্য পেপ গার্দিওয়ালা ১৫টি ট্রফি জয়ের মাধ্যমে। তবে শুধু ট্রফি দিয়ে বিবেচনা করলে ক্রুয়েফের প্রতি কিছুটা অবমাননাই করা হবে। বার্সেলোনার ভেতর জয়ের ক্ষুধাটা জাগিয়ে তোলার কাজটি করেছিলেন ক্রুয়েফ। বর্তমানে বার্সেলোনা যে লা মাসিয়া একাডেমির সুফলটা পাচ্ছে, সেটিও তার মাথা থেকেই প্রসূত। এছাড়া পেপ গার্দিওয়ালার টিকিটাকাও তার কৌশলেরই আধুনিক সংস্করণ। তবে দুর্ভাগ্যের বিষয় এই, বার্সেলোনার হয়ে শেষ দুই মৌসুম ট্রফিশূন্য থাকায় তাকে ক্লাব থেকে বহিস্কার করা হয়।
পরবর্তীতে ক্রুয়েফ কাতালেনিয়া জাতীয় দলের কোচ হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন। প্রথম ম্যাচেই তার দল আর্জেন্টিনাকে একটি প্রীতি ম্যাচে ৪-২ গোলে হারিয়ে দেয়। হন্ডুরাসকে তারা প্রীতি ম্যাচে হারায় ৪-০ গোলে, তবে তিউনিশিয়ার সাথে গোলশূন্য আর নাইজেরিয়ার সাথে ১-১ গোলে ড্র করে। এছাড়া নেদারল্যান্ড জাতীয় দলের কোচ হবার কথাও কিছুদূর এগিয়ে থেমে যায় ক্রুয়েফের। এগুলো ছাড়াও ক্যারিয়ারের শুরুতে কিছুদিন আয়াক্সের হয়ে কোচিং করেন তিনি। দায়িত্ব নিয়ে আয়াক্সের প্রায় তরুণ একটি দলকে নিয়ে ১৯৮৭ সালের কাপ উইনার্স কাপ জেতেন।
এছাড়া দুটো ডাচ কাপ জেতেন আয়াক্সকে নিয়ে। কিন্তু লিগ জিততে পারেননি। ১৯৮৫-৮৬ মৌসুমে তার দল দ্বিতীয় হয়, যদিও তার দলের গোল ব্যবধান ছিল ৮৫টি। তবে তার গড়ে তোলা পদ্ধতি অনুসরণ করেই আয়াক্স ১৯৯৫ সালে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয় করে, যার কৃতজ্ঞতা স্বরুপ পরবর্তীতে আয়াক্স থেকে অফিশিয়ালি ট্রফিটি তাকে উৎসর্গ করা হয়।
৩
২০১৬ সালে Gabriele Marcotti নামে একজন ইংরেজ বংশোদ্ভুত ইটালিয়ান ক্রীড়া সাংবাদিক, ক্রীড়া লেখক এবং টেলিভিশন ও রেডিওর ক্রীড়া বিশ্লেষক বলেছিলেন,
“আপনি বার্সেলোনার ইতিহাসকে BCE (Before Cruyff Era) এবং CE (Cruyff Era) হিসেবে ভাগ করতে পারেন। ২০ বছর হয়ে গিয়েছে ক্রুয়েফ বার্সেলোনার কোচ থেকে অবসর নিয়েছেন, কিন্তু এখনো ক্রুয়েফের প্রভাব বার্সেলোনার উপর রয়ে গিয়েছে।”
২০১১ সালে যখন পেপ গার্দিওয়ালার বার্সেলোনা সর্বোচ্চ সাফল্য উপভোগ করছিল, তখন জার্মান কিংবদন্তী ক্লিন্সম্যানের ভাষ্য ছিল,
“এই বার্সেলোনার জন্ম গত দুই বছরে হয়নি। ৯০ দশকের শুরুর দিকে ক্রুয়েফের হাত ধরে এই বার্সেলোনার জন্ম হয়েছিল। ২০ বছরের ফল আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি এবং আমাদের সকলের একে সম্মান জানানো উচিত।”
আনুষ্ঠানিকভাবে বার্সেলোনার কোনো পদে না থেকেও ক্রুয়েফের অসম্ভব প্রভাব ছিল বার্সেলোনার উপর। সেটা বোঝা যায় বার্সেলোনার সাবেক প্রেসিডেন্ট হুয়ান লাপোর্তার কথাতেও। ২০১৭ সালের একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন,
“আমি রাইকার্ড এবং গার্দিওয়ালাকে বার্সেলোনার জন্য পছন্দ করেছিলাম কারণ, ক্রুয়েফ তাদের কথা বলেছিলেন।”
“বার্সেলোনাতে কোচ হিসেবে যেই আসুক তাকে ক্রুয়েফের পথে হাঁটতে হবে।”
লাপোর্তার আরেক সাক্ষাতকারে ক্রুয়েফের প্রভাবটা আরো স্পষ্টভাবে ফুটে উঠে।
৪
উপরের ঘটনাগুলো পড়ার পর আপনার যদি মনে হয় যে ক্রুয়েফ একজন অসাধারণ কোচ ছিলেন তাহলে আপনি ঠিকই ভাবছেন। কিন্তু আপনি যদি ভাবেন, তিনি কেবলই একজন কোচ ছিলেন, তাহলে নিঃসন্দেহে ভুল ভাবছেন। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ইতিহাসে মাত্র সাতজন মানুষ আছেন যিনি কিনা কোচ এবং খেলোয়াড় দুই হিসেবেই চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা জিতেছেন। ক্রুয়েফ হচ্ছেন এই সাতজনের মাঝে একজন। প্রশ্ন আসতে পারে, খেলোয়াড় হিসেবে ক্রুয়েফ কেমন মানের ছিলেন?
IFFHS (International Federation of Football History & Statistics) এর তত্ত্বাবধানে ক্রীড়া সাংবাদিক এবং সাবেক খেলোয়াড়দের ভোটে গত শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড় নির্বাচন করা হয়েছিল। সেখানে পেলের পরেই দ্বিতীয় সেরা খেলোয়াড় হিসেবে নির্বাচিত হন ক্রুয়েফ।
বার্সেলোনার বদলে যাওয়ার পেছনে কোচ হিসেবে তো ক্রুয়েফের ভূমিকার কথা বলাই হলো, এখন খেলোয়াড় হিসেবে বার্সেলোনাতে তিনি কী ভূমিকা রেখেছিলেন সেটিও এক নজরে দেখা যাক।
ক্রুয়েফ বার্সেলোনাতে আসেন ১৯৭৩ সালে ট্রান্সফার ফি’র রেকর্ড ভেঙে। বার্সেলোনা তখন লা লিগায় খেই হারিয়ে নিজেদেরকে খুঁজে ফিরছে। সর্বশেষ লিগ শিরোপা জিতেছে তারা ১৯৬০ সালে। এরপর ১৪ বছর পার হয়ে গিয়েছে। এর মাঝে রিয়াল মাদ্রিদ লিগ জিতেছে ৯ বার। ধুঁকতে থাকা বার্সেলোনাকে প্রথম মৌসুমেই লা লিগার শিরোপা জেতালেন ক্রুয়েফ। তবে এরচেয়েও বিস্ময়ের কাজ করলেন এল ক্ল্যাসিকোতে রিয়াল মাদ্রিদকে ৫-০ গোলে হারিয়ে, সেটাও রিয়াল মাদ্রিদের মাঠ বার্নাব্যুতে।
এই ম্যাচের পর নিউ ইয়র্ক টাইমসে ক্রুয়েফকে নিয়ে প্রতিবেদন করা হলো, “ক্রুয়েফ ৯০ মিনিটে কাতালনদের আত্মবিশ্বাস যতটা বাড়িয়ে দিয়েছেন, সেটা বহু বছর ধরে তাদের রাজনীতিবিদরাও শত চেষ্টা করে করতে পারেন নি।”
খেলোয়াড় ক্রুয়েফ নিয়ে আলোচনা করা শুরু করলে লেখাটি অনেক বড় হবে। সেই গল্প না হয় আরেকদিন করা যাবে। ফুটবল সাংবাদিক গ্রাহাম হান্টার ২০১১ সালে একটা বই লিখে ছিলেন, ‘Barca: The Making of the Greatest Team in the World’ শিরোনামে। সেই বইয়ের এক উক্তি দিয়ে আজকের লেখা শেষ করা যাক,
“যদি বার্সেলোনার ১,৭৫,০০০ সদস্য রাতের পর রাত এক সারিতে দাঁড়িয়ে তাকে সম্মান জানায়, তার ক্লান্ত পা-কে ম্যাসাজ করে দেয়, তার জন্য রাতের খাবার প্রস্তুত করে দিয়ে তাকে বিছানা পর্যন্ত পৌঁছে দেয়, এমনকি নিজেদের পারিশ্রমিকের অর্ধেকও ক্রুয়েফকে দিয়ে দেয়, তাহলেও ক্রুয়েফের ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হবে না। তিনি যদি বার্সেলোনাতে একটি দর্শন আরম্ভ করতে না পারতেন, তাহলে মাত্র ১৩ বছর বয়সেই লিওনেল মেসির মতো একজন খেলোয়াড়কে ব্যর্থ মনোরথে বাড়ি ফিরে যেতে হতো এবং ইনিয়েস্তার মতো খেলোয়াড়ও সুযোগ পেতেন না। ক্রুয়েফ হচ্ছেন ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ।”