ফুটবলের আঁতুড়ঘর হিসেবে জগতজুড়ে খ্যাতি রয়েছে বার্সেলোনার একাডেমি লা মাসিয়ার। বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা ফুটবলার খ্যাত লিওনেল মেসি ছাড়াও জাভি, ইনিয়েস্তা, পুয়োল, বুস্কেটসসহ বেশ ক’জন তারকা ফুটবলারের উত্থান লা মাসিয়ার হাত ধরেই। নিজেদের একাডেমির খেলোয়াড়দের বদৌলতেই ট্রেবল জিততে সক্ষম হয়েছিলো স্প্যানিশ ক্লাবটি। তবে লা মাসিয়া কিছু প্রতিভাবান ফুটবলারদেরও হারিয়েছিলো। আজ আমরা জানবো তেমনি কয়েকজন ফুটবলার সম্পর্কে।
মাউরো ইকার্দি
ক্লাব ক্যারিয়ার – সাম্পদোরিয়া, ইন্টার মিলান
বর্তমান সময়ের অন্যতম ভয়ঙ্কর স্ট্রাইকার হিসেবে ইতিমধ্যেই নিজের উপস্থিতির জানান দিয়েছেন মাউরো ইকার্দি। ডি বক্সের মধ্যে ধূর্ত শেয়ালের মতো থাকা এই আর্জেন্টাইন ‘ফক্স ইন দ্য বক্স’ হিসেবেও খ্যাত।
পেশাদার ক্যারিয়ারে ইতালিয়ান লিগে খেলা শুরু করলেও মাউরো ইকার্দির ফুটবল ক্যারিয়ারের হাতেখড়ি হয় বার্সেলোনার লা মাসিয়া একাডেমিতে। পেপ গার্দিওলা যুগের শুরুর দিকে লা মাসিয়াতে যোগ দেন ইকার্দি। আড়াই বছর ধরে যুব একাডেমিতেই খেলে যান। সেখানে ভালো করলেও কিছু সমস্যার জন্য উপেক্ষিতই থেকে যান। ব্যাড বয় তকমা ছাড়াও পেপের সময় ফলস নাইন পদ্ধতিতে খেলায় তার জায়গা দখল করে নেন রাফিনহা।
আর তাতেই ক্লাব ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। যোগ দেন ইতালিয়ান ক্লাব সাম্পদোরিয়াতে। সেখানে ভালো খেলার সুবাদে তাকে কিনে নেয় ইতালিয়ান জায়ান্ট ইন্টার মিলান। ইন্টার মিলানের হয়ে এখন পর্যন্ত ২০০ ম্যাচ খেলে ১০০ এর উপর গোল করেছেন এই ফরোয়ার্ড। বর্তমানে ক্লাবটির অধিনায়কের দায়িত্বও পালন করছেন তিনি।
পেপে রেইনা
ক্লাব ক্যারিয়ার – বার্সেলোনা, ভিয়ারিয়াল, লিভারপুল, নাপোলি (ধারে), বায়ার্ন মিউনিখ, নাপোলি, মিলান
ভিক্টর ভালদেজের পূর্বে বার্সেলোনার গোলবারের নিচে পেপে রেইনাকেই ধরা হয়েছিলো সম্ভাব্য গোলকিপার হিসেবে। কিন্তু ২০০১ সালে উয়েফা কাপের সেমিফাইনালই যমদূত হয়ে আসে তার জন্য। মাত্র ১৯ বছর বয়সী রেইনাই সেদিন দাঁড়িয়েছিলেন বার্সেলোনার গোলবারের নিচে। কিন্তু কর্নার কিক থেকে উড়ে আসা বল পাঞ্চ করতে গিয়ে গোল খেয়ে বসেন রেইনা। সেই গোলেই বার্সেলোনাকে নক আউট করে লিভারপুল। আর এর জের ধরেই কাতালুনিয়া ছেড়ে ভিয়ারিয়ালে পাড়ি জমান তিনি। পরবর্তীতে বিভিন্ন ক্লাবে খেললেও ক্যারিয়ারে সেভাবে লাইমলাইটে আসতে পারেননি তিনি।
মাইকেল আরটেটা
ক্লাব ক্যারিয়ার – পিএসজি (ধারে), রেঞ্জার্স, রিয়াল সোসিয়েদাদ, এভারটন, আর্সেনাল
এই স্প্যানিশ মিডফিল্ডারের ক্যারিয়ার গোড়াপত্তন শুরু হয় লা মাসিয়াতে। ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে খেলা আরটেটার বার্সেলোনার রাস্তা বন্ধ করে দেন তৎকালীন কোচ গার্দিওলা। বুস্কেটস, জাভি, ইনিয়েস্তাকে সরিয়ে দলে জায়গা পাকাপোক্ত করাটা কঠিন বিবেচনা করে দল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন আরটেটা। প্রথমে ধারে পিএসজিতে যোগ দিলেও নিজেকে মেলে ধরেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে। সেখানে আর্সেনালের মূল দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠেন তিনি।
মজার ব্যাপার হলো, যে গার্দিওলার কারণে বার্সেলোনা ছাড়তে হয়েছিলো আরটেটার, বর্তমানে ম্যানচেস্টার সিটিতে সেই গার্দিওলার অধীনেই সহকারী কোচের দায়িত্ব পালন করছেন এই স্প্যানিশ ফুটবলার।
থিয়াগো মোত্তা
ক্লাব ক্যারিয়ার – বার্সেলোনা, অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ, জেনোয়া, ইন্টার মিলান, পিএসজি
লা মাসিয়ায় বড় হওয়া থিয়াগো মোত্তাকে ধরা হয়েছিলো বার্সেলোনার ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি। যুবদলের হয়ে ১০০ এর উপর ম্যাচ খেলার পরেও শেষপর্যন্ত বার্সেলোনায় টিকতে পারেননি মাঝমাঠের এই খেলোয়াড়।
এর পেছনে মূল কারণ ছিলো ঘন ঘন ইনজুরিতে পড়া। আর সেজন্য বার্সেলোনা বিক্রি করে দেয় মোত্তাকে। তবে সেই প্রতিশোধ ২০১০ এ তুলে নেন তিনি। ইন্টারের হয়ে সেই মৌসুমে খেলার সময় বার্সেলোনাকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনাল থেকে নক আউট করে তার দল। সেই বছর ইন্টারের হয়ে ট্রেবলও জেতেন এই স্বনামধন্য মিডফিল্ডার। ক্যারিয়ার শেষ দিকে আবার পিএসজির হয়ে মাঠ মাতান এই ইতালিয়ান ফুটবলার।
জর্ডি ক্রুইফ
ক্লাব ক্যারিয়ার – বার্সেলোনা, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, সেল্টা ভিগো (ধারে), আলাভেজ, এস্পানিওল, ভালেত্তা
বিখ্যাত ফুটবলার ইয়োহান ক্রুইফের সন্তান হওয়াতে বাড়তি একটা চাপ সবসময় পেছনে লেগে ছিলো জর্ডি ক্রুইফের। লা মাসিয়াতে ফুটবল শুরু করা জর্ডি কখনোই সেভাবে নজর কাড়তে পারেননি। সেই সময় বার্সেলোনার কোচের দায়িত্বে থাকা বাবা ক্রুইফও পারেননি ছেলে থেকে দারুণ কিছু বের করে আনতে।
তাই বার্সেলোনা ছেড়ে জর্ডি পাড়ি জমান ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে। সেখানে চার বছর থাকলেও খুব কম সময়ই মাঠে দেখা গিয়েছিলো তাকে। ইংল্যান্ড থেকে পরবর্তীতে স্পেনে ফিরে এসে অবশ্য আলাভেজের হয়ে কিছু চমক দেখান তিনি। ২০০১ সালের উয়েফা কাপ ফাইনালে আলাভেজকে ফাইনালে তুলতে সাহায্য করেন তিনি। ফাইনালে ৮৮ মিনিটে তার করা গোলে আলাভেজ সমতায় ফিরলেও শেষ হাসি হাসতে পারেনি তারা।
আলাভেজের পরে এস্পানিওলের হয়ে খেললেও ধীরে ধীরে আড়ালে পড়ে যান তিনি। তারপরও কিছুদিন দ্বিতীয় বিভাগের দলেও খেলেছিলেন জর্ডি। তবে বাবার মতো বিখ্যাত হতে পারেননি।
জিওভানি দস সান্তোস
ক্লাব ক্যারিয়ার – বার্সেলোনা, টটেনহাম, ইপসউইচ (ধারে), গ্যালাতেসারে (ধারে), রেসিং (ধারে), মায়োর্কা, ভিয়ারিয়াল, এলএ গ্যালাক্সি
বোজান ও লিওনেল মেসির সমসাময়িক সময়ে নিজেকে লা মাসিয়াতে দারুণভাবে মেলে ধরেন জিওভানি দস সান্তোস। ভবিষ্যৎ ট্রায়ো হওয়ার ক্ষেত্রে এই তিনজন এগিয়ে ছিলেন বাকি সবার চেয়ে। কিন্তু সেই সময় যুবদলে খেলার জন্য বেতন তেমন একটা বেশি পেতেন না তিনি। মূল দলের জন্য আর অপেক্ষা না করে বেশি টাকার জন্য নিজে থেকেই বার্সেলোনা ছাড়েন দস সান্তোস। যোগ দেন টটেনহামে। কিন্তু সেখানে ফ্লপ হিসেবে পরিচিত হন তিনি। মানুষজন জিওভানি দস সান্তোসের পারফরম্যান্সে ভুলেই যেতে বসেছিলো যে, একটা সময় লিওনেল মেসির মতো উদীয়মান নক্ষত্র হিসেবে বিবেচিত ছিলেন তিনি।
টটেনহামের পরে ধারে বিভিন্ন ক্লাবে ঘোরার পর ভিয়ারিয়ালে আবার নিজের পুরনো ফর্ম ফিরে পেতে শুরু করেন। যদিও কিছুদিনের মধ্যেই এলএ গ্যালাক্সিতে পাড়ি জমান তিনি।
কেইটা বাল্ডে
ক্লাব ক্যারিয়ার – লাজিও, মোনাকো, ইন্টার (ধারে)
লা মাসিয়ার প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কেইটা বাল্ডে। কিন্তু মূল দলে খেলার জন্য তর সয়নি তার। এমনকি মূল দলে খেলার বয়স হওয়ার আগেই ক্লাব ত্যাগ করেন বাল্ডে। যোগ দেন লাজিওতে।
সেখানে মূল দলে খেললেও নিজের সামর্থ্যের পুরোপুরি কখনোই দিতে পারেননি। মোনাকোতে নিজেকে কিছুটা খুঁজে পেলেও মোনাকে তাকে ধারে পাঠায় ইন্টার মিলানে। সেখান এসে নিজেকে আবার মেলে ধরতে পারেন কি না বাল্ডে সেটাই দেখার বিষয়।
এডাম ট্রাওরে
ক্লাব ক্যারিয়ার – বার্সেলোনা, এস্টন ভিলা, মিডলসব্রো, উলভস
ফুটবলীয় দক্ষতা ও শারীরিক সক্ষমতা দুটি মিলিয়ে বার্সেলোনার বড় তারকা হওয়ার সব গুণাবলীই ছিলো ট্রাওরের মাঝে। কিন্তু তৎকালীন কোচ লুইস এনরিকে ট্যাকটিক্যাল কারণে ট্রাওরেকে মাঠেও নামাননি। তাই ক্লাব ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
কিন্তু এস্টন ভিলাকে বেছে নিয়েই সবচেয়ে বড় ভুল করেন তিনি। চুক্তির নিয়মানুযায়ী বেতন যাতে না দিতে হয়, তাই ট্রাওরেকে বেশিরভাগ সময়ই বেঞ্চে রাখে এস্টন ভিলা। আর সেই মৌসুমেই প্রিমিয়ার লিগ থেকে অবনমিত হয় এস্টন ভিলা। ক্লাব ছেড়ে ট্রাওরে এবার যোগ দেন মিডলসব্রোতে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ট্রাওরে যোগ দেওয়ার মৌসুমেই মিডলসব্রোও অবনমিত হয় প্রিমিয়ার লিগ থেকে।
বর্তমানে ট্রাওরে আছেন উলভসে। উলভসও অবনমন এলাকা থেকে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। দেখার বিষয়, অসাধারণ ড্রিবলিং করা ট্রাওরে কি এবার উলভসকে অবনমন হওয়া থেকে বাঁচাতে পারেন কি না।