
তিনি যেন এক খ্যাপা চরিত্র।
কখনো নিজেকে বিশ্বসেরা বলছেন, কখনো অন্যদের খোঁচা দিয়ে কথা বলছেন, কখনো আবার সম্মান দাবি করছেন সাংবাদিকদের কাছে। হোসে মরিনহোকে দূর থেকে দেখলে একজন খ্যাপা কোচ বলেই মনে হয়। কিন্তু মরিনহোর দল, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বড় তারকা রোমেলু লুকাকু বললেন, মরিনহো নিজের আবেগ লুকাতে পছন্দ করেন না বলেই এমন মনে হয়।
মরিনহোর মনে যা আছে, সেটা তিনি বলে দেন। আর এতেই মনে হয় লোকটা একটু কেমন যেন।
বিবিসি ওয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে এসব কথা বলছিলেন লুকাকু। শুধু মরিনহোকে নিয়ে নয়, লুকাকু কথা বলেছেন তার ওপর দ্রগবা, অঁরি, কোয়েম্যানের প্রভাব নিয়েও।

প্রসঙ্গ: মরিনহো
লুকাকু বলছিলেন, মরিনহো খুবই পারিবারিক ধরনের একজন মানুষ। খেলোয়াড়দের তিনি হাসাতে পারেন, ভয় দিতে পারেন এবং সবার কাছ থেকে তার সত্যিই সম্মান প্রাপ্য।
মরিনহোকে কেন ভুল বোঝা হয়, এটা ঠিক বুঝতে পারেন না লুকাকু,
“লোকে তার একটা দিকই চেনে; যেখানে সে একজন বিজয়ী। কিন্তু আমি পছন্দ করি যে, এই মানুষটা কখনো কোনো আবেগ বানিয়ে প্রকাশ করে না। যখন সে পাগলাটে, তখন আপনি তাকে দেখেই বুঝবেন সে পাগলাটে। যখন সে খুশি, তখন আপনি তাকে খুশিই দেখতে পাবেন।”
“আমি বুঝতে পারি না যে, লোকে কেন তার এই বাস্তব রূপটা পছন্দ করে না। সে যখন পাগলাটে থাকে, আমি জানি সে আমার প্রতি খেপে আছে। আমি চেষ্টা করি যে, সে যাতে আবার খুশি হয়ে ওঠে, এমন কিছু করতে।”
গত মৌসুমে মরিনহোর ইউনাইটেড দ্বিতীয় হয়েছিলো প্রিমিয়ার লিগে। কিন্তু এ বছর শুরুর চার ম্যাচেই হেরেছে তারা দুই ম্যাচে। ফলে মরিনহোকে নিয়ে অনেক সমালোচনা হচ্ছে।
লুকাকু বলছিলেন, মরিনহোর আসলে এই সমালেচনা প্রাপ্য নয়। মানুষ হিসেবে তিনি এতটাই মিশুক ও প্রাণবন্ত যে, তার আরেকটু শ্রদ্ধাই প্রাপ্য,
“আমার সাথে তার সম্পর্ক খুবই ভালো। তিনি আমাকে হাসান, দলের সব খেলোয়াড়কেই হাসান। তিনি আসলেই পারিবারিক একজন মানুষ। তিনি তার খেলোয়াড়দের জন্য লড়াই করতে জানেন। তিনি একজন খাটি মানুষ। আপনি যখন খুশি নন, আপনার তখন বানিয়ে বানিয়ে নিজেকে খুশি দেখানোর তো দরকার নেই।”
“লোকেদের এটাকে প্রশংসা করা উচিত। এখনও অবধি বিশ্বে অন্তত তার মতো কিছু খাটি লোক আছে। কারণ, এই লিগে বেশিরভাগ কোচ যখন খুশি থাকে না, তখনও দেখানোর চেষ্টা করে যে, তারা খুশি।”
“আপনাদের তাকে সম্মান জানানো উচিত এই কারণে যে, তিনি তার নিজস্ব ব্যক্তিত্বটা ধরে রেখেছেন। তিনি কখনো কোনো লড়াইয়ে মুখোমুখি হতে লজ্জা পান না। এখানে (ইউনাইটেডে) তিনি চান আসলেই আমরা উন্নতি করি। তিনি সাধারণ একজন মানুষ, আমরা একসাথে দারুণভাবে চলতে পারছি। তিনি সবার সাথে খুব ভালো মিশতে পারেন।”

প্রসঙ্গ: অঁরি ও দ্রগবা
দ্রগবা কিছুদিন আগে তার এক কলামে লিখেছিলেন, লুকাকু তার কাছে এখনও ছোট ভাইটার মতোই। অন্য দিকে লুকাকু দারুণ ভক্ত এই দিদিয়ের দ্রগবার। সেই সাথে ভক্ত তিনি থিয়েরি অঁরির।
এই সাক্ষাতকারে দ্রগবা ও অঁরিকে নিয়েও কথা বলেছেন লুকাকু।
লুকাকু ইংল্যান্ডে আসার পর থেকে ১০৪টি প্রিমিয়ার লিগ গোল করেছেন। ১৮ বছর বয়সে চেলসিতে যাত্রা শুরু করেছিলেন তিনি। তাকে মনে করিয়ে দেওয়া হলো, দ্রগবার চেয়ে ৩০ ম্যাচ কম খেলে লুকাকু গোলের সেঞ্চুরি করেছেন।
লুকাকু মাথা নেড়ে বললেন, “কিন্তু তার চারটি প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা আছে। আমার একটাও নেই।”
লুকাকু বলছিলেন, তার ক্যারিয়ারে প্রচণ্ড প্রভাব আছে এই দ্রগবার। আর প্রভাব আছে অঁরির। এবার বিশ্বকাপের সময় এই দুজনকেই খুব কাছে পেয়েছিলেন লুকাকু। অঁরি বেলজিয়ামের সহকারী কোচ ছিলেন। আর দ্রগবা পেশাগত কাজে ছিলেন বেলজিয়াম দলের হোটেলেই।
এ নিয়ে বলতে গিয়ে লুকাকু বলছিলেন,
“আমরা প্রতিদিন কথা বলি। সে (দ্রগবা) আমার জীবনের অংশ। আমি প্রিমিয়ার লিগে আসার পর থেকে সে আমার জীবনের অংশ। যদিও আমরা অনেক বছর হলো এক দলে খেলি না। কিন্তু সে এখনও আমার জীবনের অংশ।”
“বিশ্বকাপে বেশিরভাগ সময় সে আমাদের হোটেলে থাকতো। আপনি কল্পনা করতে পারেন, বিশ্বকাপের মতো আসরে রাশিয়ায় আমরা যে হোটেলে ছিলাম, সেখানে সে ছিলো! থিয়েরি অঁরি তো আমাদের সাথে ছিলোই এবং দিদিয়েরও ওখানে আসতো। আমি দুজনের সাথেই বসতাম আর শুনতাম। ওনারা বলতেন, তুমি এটা ভুল করেছ, তুমি ওটা ভুল করেছ; আর এটা ঠিক আছে।”

“তারা জানতেন যে, আমি এগুলো মেনে নেবো। কারণ আমি তাদের মতো হতে চাই আমার এই ক্যারিয়ারে। তারা অনেক কঠিন হতে পারে চাইলে। কিন্তু আমি তাদের কথা শুনি। কারণ, আমি তাদের মতো অর্জন করতে চাই।”
“আমার জন্য তাদের অভিজ্ঞতা শোনাটা বিরাট ব্যাপার; কারণ আমি তাদের থেকে গ্রহণ করি। তারা যদি আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে চায়, তাতেও কোনো সমস্যা নেই। এই দুজন মানুষের কাছে আমি যা চাই, তা আছে। আমি চাই, তারা বলুক যে, তুমি ভয়ানক; কারণ তুমি, আমরা যা ছিলাম, তার চেয়ে শক্তিশালী। আর আমি অঁরির সাথে সবসময় তার গতি নিয়ে তর্ক করি।”
“থিয়েরি ও দিদিয়েরের কাছ থেকে শিক্ষা নেওয়াটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।”

প্রসঙ্গ: কোয়েম্যান
২০১৩-১৪ মৌসুমে প্রথমে ধারে খেলতে গিয়েছিলেন এভারটনে। এরপর ২৮ মিলিয়ন পাউন্ডে ক্লাবটির সাথে চুক্তি করে ফেলেন। এভারটনে লুকাকুর ফর্ম দেখে অনেক ক্লাবই তাকে পেতে চাচ্ছিলো। লুকাকুও ক্লাব ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন।
তখনই দৃশ্যপটে এলেন সাবেক বার্সেলোনা ও নেদারল্যান্ডসের খেলোয়াড় রোনাল্ড কোয়েম্যান। তিনি কোচ হয়ে এলেন এভারটনে। আর এই মানুষটাই বদলে দিলেন লুকাকুর মন।
লুকাকু স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলছিলেন, তাকে আরও শক্ত করে গড়ে তোলার পেছনে কোয়েম্যানের একটা বড় অবদান আছে,
“রোনাল্ড কোয়েম্যান এলেন এবং আমি ও তিনি একটা খোলামেলা আলোচনায় বসলাম। ওই সময় আমি দল ছেড়ে যেতে পারতাম। আমি তাকে বলেছিলাম, “আপনি নিজে তো পেশাদার ছিলেন। এই বয়সেই আপনি বার্সেলোনায় গিয়েছিলেন।” আমি বলতে পেরেছিলাম। কারণ, তাকে নিয়ে আমি গবেষণা করেছিলাম।”
“তিনি আমাকে বললেন, “তুমি যদি এখানে থাকো, আমি সত্যিই তোমাকে আরও ভালো খেলোয়াড়ে পরিণত করবো।” তিনি যখন এটা বললেন, আমি তাকে একটা সুযোগ দিতে চাইলাম। কারণ, আমি জানতাম যে, একজন সেন্টার ব্যাক হয়েও তিনি অনেক গোল করেছেন। অনেক স্ট্রাইকারের চেয়ে ক্যারিয়ারে বেশি গোল করেছেন।”
“আমি তাকে বুঝতে গিয়ে দেখলাম, তার খুব বিস্তৃত একটা দেখার চোখ আছে। অনুশীলনে তিনি আমাকে একটা সেকেন্ডও ছাড় দিতেন না। সবসময় আমার সাথে লেগে থাকতেন। আমি সেটাতে কিছু মনে করিনি। কারণ এটা আমাকে মানসিকভাবে আরও শক্তিশালী করেছে।”
লুকাকু বলেছেন, ফুটবলার হিসেবে তার যে আরও সফল হয়ে ওঠা, আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠা; সেজন্য তার কৃতজ্ঞতা এই মানুষগুলোর প্রতি