১.
একজন খেলোয়াড় মাত্রই বিশ্বকাপ জিতলেন, ১১ ম্যাচে ১৩.৭৩ গড়ে ২৬টি উইকেট নিয়ে কাপ জয়ে অবদান রাখার সাথে সাথে টুর্নামেন্ট সেরা। অথচ প্রশংসা না শুনে সবার কাছে প্রশ্ন শুনতে হচ্ছে , ‘এখনই কেন?’ স্মিত হেসে তার উত্তরটাও সুন্দর ছিল,
‘এই প্রশ্নটা করবেন বলেই। আমি শুনতে চাই না, আমাকে নিয়ে কেউ বলুক এখনো অবসর নিচ্ছে না কেন?’
বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি উইকেট, এক বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি উইকেট, এক ইনিংসে সবচেয়ে ভালো বোলিং পারফরম্যান্স, তখন পর্যন্ত সবচেয়ে ভালো বোলিং গড় (পরবর্তীতে এই রেকর্ড ভেঙ্গেছেন স্টার্ক), সবচেয়ে বেশি মেইডেন ওভার করার রেকর্ড; এত অর্জন থাকায় ৩৭ বছরে অবসর নেয়ার পরও ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে তাই আক্ষেপ জড়িয়ে থাকে, ‘আহা, আর কিছুদিন যদি খেলতেন।’
ক্যারিয়ারে বিশ্বকাপ খেলেছেন চারটি, তিনটিতে চ্যাম্পিয়ন আর একটাতে রানার্সআপ। ‘৯৬ ফাইনালে যখন প্রতিটা অস্ট্রেলিয়ান বোলারই বেধরক মার খাচ্ছিলেন, এর মাঝেও ম্যাকগ্রা আলাদা ছিলেন (৮.২ ওভারে ২৮ রান)। কেবল এই ম্যাচেই নন, পুরোটা ক্যারিয়ার জুড়েই অনেকের চেয়ে আলাদা ছিলেন। হয়তো আলাদা ছিলেন বলেই সফলতা পেয়েছিলেন।
২.
কিন্তু সফলতা এতটা সহজে আসেনি।
যে বিশ্বকাপের পর অস্ট্রেলিয়ার রাজত্ব শুরু, সেই ১৯৯৯ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া এককভাবে ফেভারিট ছিল না। ফেভারিট হিসেবে তাদের সাথে পাকিস্তান আর দক্ষিণ আফ্রিকাকেও একই কাতারে রাখা হচ্ছিলো। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে স্টিভ ওয়াহ পরিকল্পনায় একটু পরিবর্তন আনলেন, দলের মূল বোলিং অস্ত্র ম্যাকগ্রাকে দিয়ে ওপেন না করিয়ে ফার্স্ট চেঞ্জে নিয়ে আসতেন। কিন্তু এই অবস্থায় ম্যকগ্রাকে ঠিক চেনা রূপে দেখা যাচ্ছিলো না। নিউজিল্যান্ড আর পাকিস্তানের সাথে তো ম্যাচ হেরে টুর্নামেন্টে থেকে বাদ পড়ারই উপক্রম হয়। পরিস্থিতি তখন এমন ছিল যে, অস্ট্রেলিয়াকে বিশ্বকাপ জিততে হলে আর একটাও ম্যাচ হারা যাবে না। এই অবস্থায় স্টিভ ওয়াহ পরের ম্যাচগুলোতে ম্যাকগ্রাকে আবার বোলিং ওপেনে নিয়ে এলেন, ম্যাকগ্রাও নিজের রূপে ফিরে এলেন আর একবার। তার সামনে একেবারেই চেনা যাচ্ছিলো না সেই সময়ের বিশ্ব ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় দুই তারকা লারা আর শচীনকে।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে নিলেন ১৪ রানে ৫ উইকেট, লারার অফ স্ট্যাম্প উড়ে গেল। যতটুকু স্পর্শ লাগলে বেইল পড়তে পারে, ঠিক ততটুকুই লাগলো। সর্বোচ্চ ডিফেন্ড করতে চেষ্টা করেও সেই ম্যাজিক বল থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারলেন না লারা। ম্যাকগ্রা হলেন ম্যান অব দ্য ম্যাচ।
সুপার সিক্সের প্রথম ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে শচীনকে আউট করলেন প্রথম ওভারেই শূন্য রানে। ম্যাজিক্যাল প্রথম স্পেলেই শচীন, দ্রাবিড়, আজহারউদ্দিনকে আউট করে ম্যাচটাকে বানিয়ে ফেললেন একতরফা। পরবর্তীতে শেন ওয়ার্নের ম্যাজিক্যাল সেমিফাইনাল আর ফাইনালের পারফরম্যান্সে ম্যাকগ্রার বিষয়টা ঢাকা পড়ে গিয়েছে।
তবে পারফরম্যান্স ঢাকার পেছনে আরেকটা কারণ হচ্ছে, পুরো ক্যারিয়ার জুড়েই প্রচারবিমুখ ছিলেন ম্যাকগ্রা। লাইমলাইটে খুব বেশি আসতে চাইতেন না। তার মূল কাজ বোলিং নিয়েই থাকতেন। উচ্চতা থাকায় বাড়তি কিছু সুবিধাও পেয়েছিলেন। অথচ বোলিং করতেন খুবই সাধারণ ভঙ্গীতে। এই প্রসঙ্গে তাকে জিজ্ঞেস করা হলে উত্তরটাও খুব সুন্দর দিয়েছিলেন,
‘আমি জানি, আমার সীমাবদ্ধতা কোথায়। আমার কাছে শোয়েব কিংবা ব্রেট লি’র মতো গতি নেই, ওয়াসিমের মতো সুইং নেই। আমি শুধু একটা কাজের চেষ্টাই করি, ঠিক জায়গায় বল ফেলা। আমি জানি, যদি ১০০ বারের মাঝে ৯০ বার ঠিক জায়গায় বল ফেলতে পারি, তাহলে ব্যাটসম্যান ভুল করবেই।’
পুরো ক্যারিয়ারজুড়েই এই সাধারণ কাজ করার চেষ্টা করে গিয়েছেন, এবং ব্যাটসম্যানরাও নাকাল হয়েছেন অবিরত। উইকেটে সেট হবার আগেই ব্যাটসম্যানকে আউট করার ক্ষেত্রে ম্যাকগ্রা ছিলেন প্রথম পছন্দ। টেস্ট ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি ব্যাটসম্যানকে শূন্য রানে আউট করার রেকর্ড ম্যাকগ্রারই।
এছাড়া আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশিবার শূন্য রানে ব্যাটসম্যানকে আউট করা বোলার হিসেবে তার অবস্থান দ্বিতীয় (১৭৬ বার), প্রথম ওয়াসিম আকরাম (১৮৯ বার)।
৩.
অষ্ট্রেলিয়াকে সর্বজয়ী দলে পরিণত করতে যে কয়েকজন খেলোয়াড়ের ভূমিকা আছে, তার মাঝে ম্যাকগ্রা অন্যতম।
ক্যারিয়ারে ওয়ানডে টুর্নামেন্টের ফাইনাল ম্যাচ খেলেছেন ২৭টি, তাতে ১৬.৪৩ গড়ে উইকেট ৫৫। বিশ্বকাপে ৩৯ ম্যাচে ১৮.১৯ গড়ে ৭১টি উইকেট। বড় ম্যাচে যে বেশি ভালো খেলেন, এই পরিসংখ্যানই তারই প্রমাণ।
ওয়ানডেতে তার ইকোনমি রেট মাত্র ৩.৮৮। তার পর ক্যারিয়ার শুরু করেছেন এমন খেলোয়াড়দের মাঝে মাত্র পোলকের ইকোনমিই তার চেয়ে ভালো (৩.৬৭)। তিনি যখন ক্যারিয়ার শুরু করেন, এরপর পাওয়ার প্লে’র যুগ শুরু হলো, ব্যাটসম্যানরাও সুবিধা পেতে শুরু করলো। কিন্তু তার সময়ের সেরা ব্যাটসম্যানরাও ম্যাকগ্রার বিপক্ষে স্বচ্ছন্দ্য ছিলেন না।
তার বলে শোয়েব আখতারের মতো বন্যতা ছিল না, ওয়াসিমের মতো রহস্য ছিল না, সাদাসিধে একটা স্টাইল। কিন্তু এই স্টাইল নিয়েই পুরো ক্যারিয়ারে ব্যাটসম্যানদের চাপে রেখেছেন। অধিনায়কও তাকে বাঁচিয়ে রাখতেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তের জন্য। পুরো ক্যারিয়ারে খুব বেশি সময় অধিনায়ককে হতাশও করেন নি। অধিনায়কও জানতেন, ক্রুশিয়াল মুহূর্তে উইকেট ম্যাকগ্রা পাবেনই, আর যদি কোনো কারণে না-ও পান, তবুও চাপটা ঠিকই ধরে রাখবেন। অধিনায়কের আস্থার প্রতিদান বারবার দিয়েছেন।
যেকোনো সিরিজ শুরু হওয়ার আগে ঘোষণা দিয়ে দিতেন, বিপক্ষ দলের সেরা ব্যাটসম্যানের উইকেটটা তার চাই। চাওয়াটা পূরণ হয়েছে অনেকবারই। ইংল্যান্ড ওপেনার মাইকেল আথারটনকে টেস্টে আউট করছেন ১৯ বার। টেস্টে লারাকে আউট করেছেন ১৩ বার, ওয়ানডেতে ২ বার।
শচীনের বিপক্ষে খেলাটা কম হয়েছে। তবে এই কম দেখাতেই ওয়ানডেতে ৬ বার আর টেস্টে ৬ বার আউট করেছেন। ম্যাকগ্রা থাকা অবস্থায় শচীন কখনোই তেমন ধারাবাহিকভাবে স্বচ্ছন্দ্য ছিলেন না। একটা তথ্য দিলে হয়তো কিছুটা বুঝা যাবে।
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৬৮টি ওয়ানডে খেলে শচীন করেছেন ৪৬.৩৩ গড়ে ৩,০৫৮ রান। অথচ ম্যাকগ্রা খেলেছেন এমন ২৩ ম্যাচে রান ৩৬.১৩ গড়ে ৮৩১। আর ম্যাকগ্রা খেলেননি, এমন ৪৫টি ম্যাচে শচীনের রান ৫১.৭৯ গড়ে ২,২২৭।
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৩১টি টেষ্ট খেলে শচীন রান করেছেন ৬০.৫৯ গড়ে ৩,১৫১ রান। ম্যাকগ্রা খেলেছেন এমন ৯ ম্যাচে রান ৩৬.৭৭ গড়ে ৬৬২। আর ম্যাকগ্রা খেলেননি এমন ২২টি ম্যাচে শচীনের রান ৭৩.২০ গড়ে ২,৪৮৯। পার্থক্যটুকু লক্ষ্য করেছেন নিশ্চয়ই!
৪.
টেস্টে ফাস্ট বোলারদের জন্য সবচেয়ে বাজে জায়গা কোনটা? সবাই জানে, উত্তরটা ‘ভারতবর্ষ’। ভারত নিজের মাঠে সবসময় এমন উইকেট বানাতো, যেন স্পিনাররা সহায়তা পায়। অনেক ম্যাচেই ভারত মাত্র একটা মূল ফাস্ট বোলার স্কোয়াডে রাখতো। ফাস্ট বোলারদের জন্য বধ্যভূমিতেই ম্যাকগ্রা ২১.৩০ গড়ে ৩৩ উইকেট পেয়েছেন।
ক্যারিয়ারে অল্প কিছুদিন কাউন্টি খেলেছেন। উস্টারশায়ারের হয়ে প্রথম ১৪টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচেই নেন ১৩.২১ গড়ে ৮০টি উইকেট। পরবর্তীতে ২০০৪ সালে মিডলসেক্সের হয়েও অল্প কিছু ম্যাচ খেলেছেন।
তবে মূল সফলতা টেস্ট ক্রিকেটেই। ফাস্ট বোলারদের মাঝে সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক উইকেট (৯৪৯) ম্যাকগ্রার। যখন অবসর নিয়েছেন, তখন টেস্টে ফাস্ট বোলারদের মাঝে সবচেয়ে বেশি উইকেটও তারই ছিল। পরবর্তীতে সেই রেকর্ড ভাঙেন জেমস অ্যান্ডারসন। অবশ্য ম্যাকগ্রার ১২৪ টেস্টে ৫৬৩ উইকেটের রেকর্ড ভাঙতে অ্যান্ডারসনের ম্যাচ ১৮টি বেশি খেলতে হয়েছিলো (১৪২ টি)।
টেস্টে বোলারদের আরাধ্য একটা হ্যাটট্রিকও পেয়েছেন।
ম্যাকগ্রা একটা ব্যতিক্রমী রেকর্ডের অধিকারি। তিনি টেস্ট ক্যারিয়ারের শেষ বলে উইকেট পেয়েছেন, ওয়ানডে ক্যারিয়ারের শেষ বলেও উইকেট পেয়েছেন, আবার অস্ট্রেলিয়াতে শেষ ওয়ানডেতে খেলা শেষ বলেও উইকেট পেয়েছেন।
ব্যাটসম্যান হিসেবেও কিছু রেকর্ড ছিল ম্যাকগ্রার। টেস্টে ১১ নং ব্যাটসম্যান হিসেবে সবচেয়ে বেশি রান ম্যাকগ্রার (৬০৩ রান)।
৫.
অস্ট্রেলিয়ান খেলোয়াড়দের একটা চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা মাঠের ভেতর প্রতিপক্ষকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেন না। প্রয়োজনে স্লেজিংয়ের আশ্রয় নেন। ম্যাকগ্রাও এদিক থেকে একটুও পিছিয়ে নেই। অনেকবারই স্লেজিং করে প্রতিপক্ষের সাথে তর্কে জড়িয়েছেন। কিন্তু মাঠের বাইরে ম্যাকগ্রা অমায়িক একজন মানুষ। স্ত্রী আর দুই সন্তান নিয়ে ছিল পরিপাটি এক সংসার। কিন্তু ১৯৯৭ সালে যখন তার স্ত্রী’র স্তন ক্যানসার ধরা পড়ে, তখন ব্যক্তিগত জীবনে বিপর্যয় নেমে আসে। আস্তে আস্তে নিয়তিকে মেনে নেন, ২০০২ সালে স্ত্রী জেনকে নিয়ে গঠন করেন ‘ম্যাকগ্রা ফাউন্ডেশন’। এটা স্তন ক্যানসার সম্পর্কে নারীদের সচেতন করার একটা দাতব্য প্রতিষ্ঠান। ২০০৮ সালে জেন মারা যাবার পর এই ফাউন্ডেশন তার কাজের পরিধি বাড়ায়। ২০১৬ সালে এই ফাউন্ডেশন ১১০টি নার্স ছড়িয়ে দেয় অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন স্থানে, এবং এর মাধ্যমে প্রায় ৩৩,০০০ অস্ট্রেলিয়ান পরিবারকে সাহায্য করতে সমর্থ হয়।
চিরকাল সাদাসিধে স্টাইলে বোলিং করা ম্যাকগ্রার বোলিং দর্শনকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা কথার সাথে উপমা হিসেবে তুলনা করা যেতে পারে, ‘সহজ কথা যায় না বলা সহজে’। ঠিক একইভাবে, ‘সহজ কাজটা সহজে করার মতো কঠিন কাজটা’ পুরো ক্যারিয়ারে ম্যাকগ্রা করে যেতে পেরেছিলেন বলেই হয়তো সেরা ব্যাটসম্যানদের যুগেও রাজত্ব করতে পেরেছেন অনায়াসে।